প্রথম পর্ব দ্বিতীয় পর্ব তৃতীয় পর্ব
ট্রেন জার্নি ব্যাপারটা নিলাকে খুব আকর্ষণ করে, যদিও ঢাকার স্থানীয় বাসিন্দা হওয়ার কারণে ট্রেনে করে ঢাকার বাইরে তেমন কোথাও যাওয়ার সুযোগ হয়নি। আজ সেই সুযোগ এসেছে তার সামনে, ট্রেনে করে সে ঢাকার বাইরে যাচ্ছে। তার উপর ট্রেনে তার পাশের সিটেই বসে আছে শুভ্র, এই কারণে সে আরও অনেক বেশী উচ্ছাসিত। দূরের কোন যাত্রায় কাছের কোন মানুষকে পাশে পাওয়াটা সত্যিই খুব আনন্দের। দীর্ঘ যাত্রাপথে প্রিয়জনের সান্নিধ্য, ট্রেনের দুইপাশে প্রকৃতির নয়নাভিরাম দৃশ্য – সব মিলিয়ে আজ সত্যিই নিলার মনের মাঝে একটা স্বর্গীয় অনুভূতি কাজ করছে। ট্রেনের জানালা দিয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন যে নিলা শুভ্রর কাঁধে মাথা রেখে হেলান দিয়েছে বুঝতেই পারেনি, আর ট্রেনে এতগুলো মানুষের সামনে যে দিব্যি শুভ্রর কাঁধে মাথা দিয়ে বসে আছে, তাতে করে নিলার কোন লজ্জাবোধ হচ্ছেনা, ব্যাপারটি বুঝতে পেরে নিলা অবাক হয়ে গেল। এই মুহুর্তে নিলার ইচ্ছে করছে, ট্রেনটি যদি অনন্তকাল ধরে চলত, তাহলে কতই না ভাল হত, তাহলে সে অনন্তকাল ধরেই শুভ্রর সাথে এমন রোমান্টিক পরিবেশে থাকতে পারত। নিলার মনে হচ্ছে তার সেই ইচ্ছেটাই সত্যি হতে যাচ্ছে, ট্রেনটি অনন্তকাল ধরে কু-ঝিক ঝিক, কু-ঝিক ঝিক শব্দ করে ডেকে ছুটে চলছে অনন্তের পথে…………..........
টুং টাং, টুং টাং, টুং টাং………….....
বাসার মূল দরজা থেকে ভেসে আসা কলিং বেল বাজার শব্দে নিলার ঘুমটা হঠাৎ করেই ভেঙ্গে গেল। ঘুম ভাঙ্গার সাথে সাথেই নিলা বুঝতে পারল যে সে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল। ইশ্ , কেন ঘুমটা ভেঙ্গে গেল? নিলার কেন যেন খুব কষ্ট লাগছিল ঘুমটা ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে, স্বপ্নটা খুব সুন্দর ছিল। কিন্তু পরক্ষণেই সে রীতিমত একটা ঝাঁকি খেল মনের ভেতর, এ কাকে দেখল সে স্বপ্নে? শুভ্রকে? কেন? শুভ্র তো শুধুই ওর বন্ধু, তাহলে ওকে নিয়ে এত অন্তরঙ্গ স্বপ্ন দেখার মানে কি? নিলা শুনেছে মানুষের অবচেতন মন যা ভাবে, সেটাই ঘুমের মাঝে স্বপ্ন হয়ে ধরা দেয় তার কাছে। তবে কি নিলা শুভ্রকে বন্ধুর চেয়েও বেশী কোন আসনে স্থান দিয়ে এসেছে তার নিজেরই অজান্তে? কি করবে সে এখন? কার সাথে এই ব্যাপারটি শেয়ার করবে? এরকম নানা অস্থিরতায় ঘরময় বহুক্ষণ পায়চারী করে বেড়াল সে। তার ভাবনার জালে ছেদ পড়লো দরজায় নকের শব্দে, দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন বাবা-
- কিরে মা, কেমন আছিস?
- হ্যাঁ বাবা, ভাল আছি। তুমি কি মাত্র এলে?
- হ্যাঁ রে মা, আজ অনেক চাপ গেল অফিসে, সারাদিন তোর খোঁজ নিতে পারিনি।
- ইটস্ ওকে বাবা, এস ভেতরে এস।
(রুমের ভেতরে ঢুকে নিলার বিছানায় বসলেন বাবা)
-তোর পড়াশুনা কেমন চলছে রে মা?
-ভাল বাবা, একটু প্রেশার এ আছি। অ্যাসাইনমেন্ট রেডি করতে হবে আজ রাতের ভেতরে, নেক্সট উইক-এ ফাইনাল এক্সাম শুরু।
-ভাল করে পড় মা, টেনশন করিস না, ভাল করবি পরীক্ষায় ইনশাল্লাহ্।
-দোয়া করো বাবা।
-অবশ্যই দোয়া করি মা, তোর জন্য দোয়া করব না তো কার জন্য করব? তুই পড়াশুনা কর, আমি যাই।
-ঠিক আছে বাবা।
বাবা রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর পরই নিলা ওয়াশরুমে ঢুকে মুখ হাত ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিল। তারপর কম্পিউটার অন করে বসল অ্যাসাইনমেন্ট তৈরীর কাজে। উফ্, ইন্টারনেট নামের সমুদ্র থেকে নিজের কাঙ্খিত ও প্রয়োজনীয় জিনিসটা খুঁজে পাওয়া যে চাট্টিখানি কথা নয়, সেটা নিলা আজ আরো একবার টের পেল। প্রায় ঘন্টাখানেক গুগল-এ সার্চ করার পর কিছু ডাটা পেল, যেগুলো সে তার অ্যাসাইনমেন্ট তৈরীর কাজে ব্যবহার করতে পারে। অবশেষে সেই ডাটাগুলো নিয়েই কাজ শুরু করলে সে, আরও প্রায় ঘন্টাখানেক পর তার কাজ শেষ হল।
কাজ করতে করতে কখন যে রাত দশটা পেরিয়ে গেছে নিলা খেয়ালই করেনি। এরই মধ্যে মা একবার ডেকে গেছেন ডিনারের জন্য, নিলা “আসছি, আসছি” বলে সময় নিচ্ছিল। আসলে হাতের কাজটা শেষ না করে উঠতে ইচ্ছে হচ্ছিলনা তার। অ্যাসাইনমেন্ট এর কাজ শেষ করে একটা বড় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে উঠল খাওয়ার জন্য। ডাইনিং টেবিল-এ গিয়ে সে দেখল বাবা-মা দুজনেই বসে আছেন তার জন্য। নিলার এই জিনিসটা খুবই ভাল লাগে, বাবা-মা কখনই তাকে কোন কাজে প্রেশার দেন না, আজও যখন সে তার পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত, তখন তাঁরা তাকে খাওয়ার জন্য তাগাদা দেন নি, বরং মেয়ের জন্য অপেক্ষা করছিলেন খাওয়া নিয়ে। বাবা-মায়ের এমন স্নেহসুলভ আচরণ সবসময়ই নিলাকে আবেগাপ্লুত করে।
খাওয়াদাওয়া শেষ করে রুমে ফিরে অভ্যাসবশত মোবাইল ফোনটি হাতে নিয়েই নিলা দেখল শুভ্রর চারটি মিসকল। সে দেরী না করে কলব্যাক করল শুভ্রকে-
-কিরে শুভ্র তুই কল দিয়েছিলি নাকি?
-হ্যাঁ, অনেকক্ষণ ধরে রিং হচ্ছিল। তুই কই ছিলি?
-আরে আমি ডিনার করছিলাম।
-এত রাতে ডিনার!!!
-আর বলিস না, নার্গিস ম্যাডামের অ্যাসাইনমেন্টটা শেষ করতে করতে দেরী হয়ে গেল, আর আমি হাতের কাজ শেষ না করে অন্য কাজ করতে আনইজি ফিল করি, তাই খেতে দেরী হল আজ।
-ওহ্ আচ্ছা তাই বল। আচ্ছা কাল তো ক্লাস নেই। কি করবি কাল?
-দেখি, ভাবছি সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করে পড়তে বসব। নেক্সট উইক থেকে তো এক্সাম, সিলেবাস কিছু বাকি আছে ওগুলো শেষ করতে হবে। কেন বলতো?
-নাহ্ ভাবছিলাম বিকেলের দিকে একটু বের হব। তুই যদি ফ্রি থাকিস তাহলে বেরিয়ে আসা যেত।
-আচ্ছা দেখি, আমি বিকেলের দিকে ফ্রি থাকলে তোকে জানাবো।
-ঠিক আছে, এখন রাখি তাহলে। গুড নাইট।
-গুড নাইট শুভ্র।
নিলার সাথে ফোনে কথা শেষ করে নানারকমের ভাবনা পেয়ে বসল শুভ্রকে। সে ভাবছে, নিলা কি মাইন্ড করলো কাল বিকালে বের হবার কথা বলার কারণে? শুভ্রকে কি সে হ্যাংলা টাইপ ছেলে ভাবছে? ধুর, কি সব আবোলতাবোল ভাবছে সে? নিলা এমন মেয়েই নয় যে শুভ্রকে খারাপ ছেলে ভাববে। এতদিনের বন্ধু তারা সবাই, অন্ততঃপক্ষে বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে তো তাকে বেড়াতে যাওয়ার কথা বলাই যায়, এতে নিলা মাইন্ড করবে কেন?
আসলে নিলাকে নিয়ে শুভ্রর এমন ভাবনারও একটা কারণ আছে। আজ ক্লাস শেষে বাসায় ফিরে লাঞ্চ সেরে একটু ঘুমিয়েছিল শুভ্র। স্বপ্নে সে দেখল প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে আর নিলা আর ও দুজনে পাশাপাশি হাঁটছে একটা পার্কে। তাদের দুজনের হাতেই ছাতা আছে কিন্তু তারা ছাতা বন্ধ করে রেখেছে। তুমুল বৃষ্টিতে তারা ভিজে একেবারে চুপসে গেছে, তারপরও তাদের কোন আক্ষেপ নেই। এত সুন্দর একটা স্বপ্নের মাঝে হঠাৎই সন্ধ্যার দিকে শুভ্রর ঘুম ভেঙ্গে গেল মোবাইল বেজে ওঠার শব্দে, তার এক বন্ধু কল করেছিল। মনে মনে তখন সে ঐ বন্ধুটির পিন্ডি চটকাচ্ছিল, শালা ফোন করার আর সময় পেলিনা, না? এত সুন্দর একটা স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল তোর কারণে। সেই বন্ধুটির সাথে কথা শেষ করেই শুভ্রর মনে দারুন এক ভাবান্তর ঘটে গেল। নিলা,দিপা,ফারজানা,শাওন,শান্ত আর শুভ্র এতদিন ধরে বন্ধু, কিন্তু কখনও শুভ্রর নিলাকে বন্ধুর চেয়ে বেশী কোন কিছু ভাবেনি। কিন্তু শুভ্র তো এতদিন ধরে জেনে এসেছে মানুষ তাই স্বপ্ন দেখে যা তার মনের অগোচরে ভাবে। তাহলে কি শুভ্র নিলাকে মনের অগোচরে ভালোবেসে ফেলেছে? এতসব ভাবতে ভাবতেই তার হঠাৎ খুব ইচ্ছে হল নিলার সাথে দেখা করতে কাল বিকেলে, কাল ক্লাস নেই, তাই তেমন কোন ব্যস্ততাও নেই বিকেলের দিকে। এসব ভেবেই সে নিলাকে ফোন করেছিল এত রাতে। কিন্তু শুভ্রর কেন যেন মনে হল নিলা কাল দেখা করতে ইন্টারেস্টেড না।
নিলা ফোন রাখার পর থেকে তাই খুব টেনশন হচ্ছে শুভ্রর, কাল নিলা আদৌ দেখা করতে চাইবে তো?
(চলবে).......
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জানুয়ারি, ২০১৩ সকাল ১১:২৪