কার্ল মার্ক্স ও এ্যাঙ্গেলস নবী মুহাম্মদের ইসলাম প্রতিষ্ঠার অভিযানকে একটা অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার বিপ্লব হিসেবে দেখতেন। সেটাকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বলা না হলেও তাদের দৃষ্টিতে সেটা ছিল মূলত একটা অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রসূত দ্বন্দ্ব। কিন্তু আজ পাশ্চাত্যের অনেক পণ্ডিত বলতে চান যে, নবী মুহাম্মদ ছিলেন মূলত একজন পূঁজিবাদী। এবং তাদের যুক্তি হচ্ছে নবী ছোটকাল থেকে ব্যবসা কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত ছিলেন এবং ধনাঢ্য খাদিজার বিরাট ব্যবসাকে সফল ও লাভজনক ভাবে পরিচালনা করেছিলেন।
প্রশ্ন হচ্ছেঃ এ দু’টো দাবীর মধ্যে কোনটি সঠিক? নবী মুহাম্মদ সমাজবাদী বা সমাজতান্ত্রিক ছিলেন, না পূঁজিবাদী?
১৯৯৯ সালে বিবিসি’র সমীক্ষায় মার্ক্স দ্বিতীয় শহস্রাব্দের সেরা চিন্তাবিদ নির্বাচিত হয়েছিলেন। কাজেই মুহাম্মদ সম্পর্কে বিচার-বিবেচনায় তিনি আজকের চুনোপুটি পণ্ডিতদের কাছে হেরে যাবেন, সেটা কী করে সম্ভব! যারা মুহাম্মদকে পূঁজিবাদী হিসেবে দেখেন, তারা ভুলে যান যে, নবীর জীবনের দু’টো অধ্যায় রয়েছেঃ প্রথমটা পৌত্তলিক, দ্বিতীয়টা ইসলামী। এবং তিনি পূজিবাদী ছিলেন পৌত্তলিক অধ্যায়ে। ইসলামের নবীত্ব শুরুর পর তিনি ব্যবসা-বাণিজ্য ছেড়ে দেন এবং স্ত্রী খাদিজার পূঞ্জীকৃত ধন-সম্পদের উপর ভর করে তার ইসলামী বিপ্লব সংগঠিত করতে থাকেন। সে পর্বে আমরা দেখি খাদিজা ও আবু বকর প্রমুখ ধনাঢ্য মুসলিমরা তাদের ধন সম্পদ দিয়ে দারিদ্র-পীড়িত মুহাম্মদের শিষ্যদেরকে সাহায্য করে যাচ্ছেন। অর্থাৎ মুহাম্মদের ইসলামী নবীত্ব পর্বে আমরা তার সম্প্রদায়ের মাঝে মার্ক্সবাদী অর্থনীতির ছাপ দেখি ।
এবং মদীনায় স্থানান্তরের পর আমরা নবীকে দেখি বাণিজ্য-কাফেলা আক্রমণ করে লুণ্ঠিত মালামালে তার মুসলিম সম্প্রদায়ের জীবিকা নির্বাহ নিশ্চিত করতে। এটা পূঁজিবাদের পরিপন্থী, কেননা একজন পূঁজিবাদী চাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের বাধা-বিঘ্নহীন পরিচালনা।
এবং এরপর নবী মদীনা থেকে শুরু করে আরবের ধনী সম্প্রদায়গুলোকে হামলা করে তাদের ধন-সম্পদ করায়ত্ব করতে থাকেন, যার উপর ভিত্তি করে তাঁর মুসলিম সম্প্রদায় জীবিকা নির্বাহ করতে থাকে। কোরানের অষ্টম সুরাটির শিরোনাম হচ্ছে “আন-ফাল”, যার অর্থ হচ্ছে “গণিমতের মাল” বা “যুদ্ধে লুণ্ঠিত মালামাল”। এ সুরাটি মুসলিমদেরকে নির্দেশনা দিয়েছে কিভাবে তারা অবিশ্বাসীদের মালামাল লুণ্ঠণ করে তা মুসলিমদের মাঝে বণ্টন করবে। বণ্টনের ব্যাপারে আল্লাহ বলেছেন লুণ্ঠণের এক-পঞ্চমাংশ নবী ও আল্লাহর ভাগে যাবে; বাকী অংশ সব মুসলিমদের মাঝে সমানভাবে ভাগ করে দেওয়া হবে।
সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্ম-প্রণালীও কিন্তু অনেকটা সেরকমই। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রাথমিক পর্বে ধনীদের ধন-সম্পদ কেড়ে নিয়ে সবার মাঝে পুনর্বণ্টন করা মার্ক্সবাদী অর্থনীতির একটা বড় লক্ষ্য। সে প্রসঙ্গে নবীর গ্রহণকৃত অর্থনৈতিক পন্থা মার্ক্সবাদী অর্থনৈতিক নীতির কাছাকাছি ছিল।
মোটকথা পৌত্তলিক জীবনে নবী ছিলেন পূঁজিবাদী এবং ইসলামী মিশন গ্রহণের পর তিনি পূঁজিবাদ বিরোধী হয়ে উঠেন এবং অনেকটা মার্ক্সবাদী পন্থার কাছাকাছি ছিল নবীর ইসলামী অর্থনৈতিক পন্থা।
এবং নবীর জীবনের শেষ পর্যায়ে যখন পুরো আরব ইসলামের পদতলে এসে গেছে এবং বেশীর ভাগ মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছে, যার ফলে লুটপাট করার মতো আর সম্প্রদায় অবশিষ্ট নেই – তখন আগের সেই অর্থনৈতিক পন্থা মেনে চলা সম্ভব হল না। এখন লুটপাটের পেশা ছেড়ে মুসলিমদেরকে হয় চাষাবাদ বা ব্যবসা-বাণিজ্যে তথা পূঁজিবাদী পথে যেতে হবে, নইলে অন্য উপায় বের করতে হবে। এবং আল্লাহ কি করলেন? আল্লাহ সেটা নির্ণয় করেছেন কোরানের ৯:২৮-২৯ আয়াতে।
৯.২৮: “হে বিশ্বাসীরা! পৌত্তলিকরা সত্যি সত্যি নোংরা; সুতরাং এ বছরের পর আর তাদেরকে কাবায় ঢুকতে দিবে না। এবং তোমরা যদি দারিদ্রের আশংকা কর, আল্লাহ শীঘ্রই তোমাদেরকে ধনবাদ করে তুলবেন...”
আল্লাহ কীভাবে মুসলিমদেরকে ধনবাদ করে তুলবেন? তা তিনি উল্লেখ করেছেন পরের আয়াতে (৯:২৯), যাতে আল্লাহ বলেছেনঃ “যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে না এবং আল্লাহর নবী যা নিষেধ করেছেন তা নিষিদ্ধ বিবেচনা করে না – তারা আসমানী কিতাবের মানুষ হলেও তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাও যতদিন-না তারা অবমানিত ও বশীভূত হয়ে স্বেচ্চায় কর প্রদান করবে।”
মুসলিমরা রাষ্ট্রকে দিবে নগণ্য যাকাত মাত্র, তাও স্বেচ্ছামূলকভাবে – যার দ্বারা মুসলিম সম্প্রদায় ও রাষ্ট্রের পরিচালনা সম্ভব নয়। অন্যদিকে, ইসলাম পৌত্তলিকদেরকে বাঁচতে দেবে না। একমাত্র বাকী থাকে ইহুদি ও খৃষ্টানরা – যারা অন্তত আল্লাহরই পাঠানো তবে অনিখুঁত ও ভ্রান্ত ধর্মের অনুসারী। তাদেরকে ইসলাম গ্রহণের ডাক দিয়েছেন আল্লাহ ও তাঁর নবী, এবং তারা সে ডাকে সাড়া না দিলে তাদেরকে ইসলামী রাজ্যে বাঁচতে দেওয়া হোক, তবে বৈষম্যমূলক ও উচ্চ কর প্রদানের বিনিময়ে। এবং তাদের উপর প্রধানত দুই ধরনের কর আরোপ করা হয়ঃ ১) জিজিয়া বা বশ্যতা কর এবং ২) খারাজ বা ভূমি কর।
কোরানে নির্দেশিত ইসলামী অর্থনীতির রূপরেখা মোটামুটি এটাই। এবং যতদিন ইসলামী খিলাফতের কর্তৃত্ব আরবদের হাতে ছিল, ততদিন বিশেষত আরব-মুসলিমরা এভাবেই জীবিকা বির্বাহ করেছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই অক্টোবর, ২০১২ সকাল ১১:৩৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




