স্বাধীনতার প্রথম ঘোষক হিসেবে মেজর জিয়াউর রহমানের নাম রয়েছে এমন যেকোনো প্রকাশনা বাজেয়াপ্ত করতে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ও বিচারপতি মমতাজ উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চের পূর্ণাঙ্গ রায়ে এ তথ্য রয়েছে।
জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণাসংক্রান্ত রায় হাইকোর্ট ঘোষণা করেন গত বছরের ২১ জুন। ৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট বেঞ্চের দুজন বিচারক পূর্ণাঙ্গ রায়ে সই করেন। জুনে হাইকোর্টের রায়ের পরপরই সরকার মুক্তিযুদ্ধের দলিল (তৃতীয় খণ্ড) প্রত্যাহার এবং তা বিক্রি বন্ধের উদ্যোগ নেয়। বিচারপতি খায়রুল হক তাঁর ৩২০ পৃষ্ঠার রায়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিস্তারিত তুলে ধরেন এবং বিশেষ করে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রসংক্রান্ত উল্লেখযোগ্য সব দেশি-বিদেশি দলিলের চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন।
জিয়ার সততা: বিচারপতি খায়রুল হক জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কে মন্তব্য করেন, ‘ক্ষমতার সর্্বোচ্চ অবস্থানে থেকেও কখনো তিনি নিজেকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে দাবি করেননি। এমনকি ১৯৭৭ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি তাঁকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে প্রশংসা করার পরও তিনি এরূপ কোনো দাবি করেননি। এটা তাঁর সততার নিশ্চিত পরিচায়ক।’ রায়ে জিয়াকে ‘সুদক্ষ সেনা কর্মকর্তা’ এবং ‘চাকরিজীবনে অত্যন্ত সাফল্যের অধিকারী’ হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়, ‘২৭ মার্চ সন্ধ্যায় চট্টগ্রামে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে তিনি যে একটি ঘোষণা পাঠ করেছিলেন, তাও ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত।’ উল্লেখ্য, জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার প্রথম ঘোষক এমন বক্তব্যসংবলিত বইপত্র এখনো দেশে রয়েছে।
রিট আবেদনকারীদের আইনজীবী মনজিল মোরশেদ সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, রায় পাওয়ার পর সরকারকে এখন দ্রুততার সঙ্গে এ ধরনের বইপত্র বাজেয়াপ্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে।
রিটের বিরোধিতাকারী উইং কমান্ডার (অব.) হামিদুল্লাহ খানের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন খন্দকার মাহবুব উদ্দিন আহমাদ। তিনি এর আগে রায় স্থগিত করার আবেদন করলে চেম্বার জজ তা অগ্রাহ্য করেন। গতকাল রিটের বিরোধিতাকারীর পক্ষের অন্যতম আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস প্রথম আলোকে বলেন, ‘চেম্বার জজ তাঁদের নিয়মিত আপিল দায়েরের কথা বলেছিলেন। রায়ের অনুলিপি পেলে তাঁরা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।’
জানা গেছে, রায়ের অনুলিপি ৮ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় পাঠানো হয়েছে। এতে রায় তামিলে ‘অবিলম্বে’ কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে। তবে নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়নি।
রায়ে কী আছে: রায়ে বলা হয়েছে, ‘মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন’—২০০৪ সালে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র গ্রন্থাবলী সিরিজের তৃতীয় খণ্ডসহ যেসব পুস্তক-পুস্তিকা, গ্রন্থে এমন বক্তব্য মুদ্রিত বা বিবৃত হয়েছে, অবিলম্বে তা বাজেয়াপ্ত করতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি নির্দেশ দেওয়া হলো।
রায়ের উপসংহারে বলা হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণাসংক্রান্ত বিষয়ে ২০০৪ সালের প্রত্যয়ন কমিটির অভিমত তথ্যভিত্তিক নয়। এটা প্রকৃত সত্যের পরিপন্থী। তা ছাড়া, ওই অভিমত ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। সে কারণে তা সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদের সঙ্গেও সরাসরি সাংঘর্ষিক। তাই তা বাতিলযোগ্য।
রায়ে বলা হয়, ২০০৪ সালে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পুনর্মুদ্রিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র-এর তৃতীয় খণ্ডের প্রথম পৃষ্ঠায় ‘মেজর জিয়ার প্রথম স্বাধীনতা ঘোষণা’ শিরোনামে মুদ্রিত বর্ণনা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের পরিপন্থী তথা সংবিধান পরিপন্থী। তাই এটা অবৈধ ঘোষণা করা হলো। তা ছাড়া ওই তৃতীয় খণ্ডের প্রথম পৃষ্ঠার পাদটীকায় ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ জিয়াউর রহমান অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্যাটালিয়ন অফিসার, জেসিও এবং জওয়ানদের একত্রিত করে ‘স্বাধীনতার ঘোষণা দেন’ ইত্যাদি বক্তব্যও সংবিধান পরিপন্থী বলে তা অবৈধ ঘোষণা করা হলো।
প্রত্যয়ন কমিটি সম্পর্কে অভিমত: রায়ে আরও বলা হয়, প্রতীয়মান হয় যে পুনর্মুদ্রিত স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রের প্রত্যয়ন কমিটির সভাপতি ও সদস্যরা ইতিহাস বিকৃত করেছেন। তাঁরা সংবিধান পরিপন্থী ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন এবং সমগ্র বাঙালি জাতিকে বিভ্রান্ত করেছেন। রায়ে বাংলাদেশ সরকারকে স্বাধীনতার ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সব ধরনের ইতিহাস বিকৃতি দূর করে সঠিক ইতিহাস লিপিবদ্ধ করতে পদক্ষেপ নিতেও নির্দেশ দেওয়া হয়।
উল্লেখ্য, গত ২৪ জুন হাইকোর্টের এই বেঞ্চ আদালত অবমাননার দায়ে অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে রুল জারি করেন। তিনিসহ প্রত্যয়ন কমিটির ছয়জন সদস্য একই দিনে প্রচারিত এক বিবৃতিতে তথ্য বিকৃতির অভিযোগ অস্বীকার করেন। এমাজউদ্দীন দাবি করেন, তিনিসহ কয়েকজন সদস্য মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত সংযোজনের’ প্রতিবাদ করেছিলেন।
ইতিহাস লেখা নয়: উল্লেখ্য, স্বাধীনতার ঘোষকসংক্রান্ত রায়ের অন্যতম সমালোচনা হচ্ছে, এটা ঐতিহাসিকদের কাজ, বিচারকদের নয়। এ সম্পর্কে রায়ে বলা হয়, ‘আমরা বিচারকগণ ঐতিহাসিক নই এবং ইতিহাস লিখনও আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। তবে সংবিধান ও আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করিতে আমরা শপথবদ্ধ। সার্বভৌম জাতীয় সংসদ ব্যতীত সংবিধানের একটি বিন্দুও কেউ পরিবর্তন করতে পারে না। করলে সংবিধান ভঙ্গের দায়ে দায়ী হবে। কেউ সংবিধানের বর্ণনা পরিবর্তন করলে তার প্রতিবিধান করতেও আমরা সাংবিধানিকভাবে দায়বদ্ধ।’
অবৈধ ঘোষণার চার কারণ: জিয়া স্বাধীনতার ঘোষক—এ দাবি চারটি কারণে সাংবিধানিক সমস্যা তৈরি করে বলে মনে করেন আদালত। রায়ে বলা হয়, আমরা ‘স্বাধীনতার ঘোষণা: প্রত্যয়ন কমিটির অভিমত’ এবং একাত্তরের ২৭ মার্চ মেজর জিয়ার প্রথম স্বাধীনতা ঘোষণাটি অত্যন্ত মনোযোগ ও গুরুত্বের সঙ্গে পাঠ করেছি। কমিটির দাবি অনুযায়ী জিয়া স্বাধীনতার ঘোষক হলে এবং সেই ঘোষণা যদি ২৭ মার্চ দেওয়া হয়, তাহলে তাতে সংবিধানের বিভিন্ন বিধানাবলীর মধ্যে সংঘাত তৈরি করে। প্রথমত, বাংলাদেশের সর্বপ্রথম সাংবিধানিক দলিল ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল প্রস্তুত। এতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন বলে উল্লেখ আছে। তাই কমিটির দাবি একটি সাংঘর্ষিক অবস্থা সৃষ্টি করে। দ্বিতীয়ত, একাত্তরের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত Laws Continuance Enforcement Order-এ বলা হয়, একাত্তরের ২৫ মার্চ বাংলাদেশে যেসব আইন বলবত্ ছিল, তা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র সাপেক্ষে বলবত্ থাকবে। এটা ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর হয়। এখন বাংলাদেশ যদি জিয়ার ঘোষণায় ২৭ মার্চ স্বাধীন হয়ে থাকে, তাহলে প্রশ্ন ওঠে যে ওই আদেশ এক দিন আগে থেকে কীভাবে কার্যকর হতে পারে। তৃতীয়ত, ১৯৭২-এর ১১ জানুয়ারি প্রকাশিত প্রথম অস্থায়ী সংবিধান আদেশ একাত্তরের ১০ এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের আওতায় ও ধারাবাহিকতায় ঘোষণা করা হয়েছিল। এ দুটি সাংবিধানিক দলিলের সঙ্গে ২৭ মার্চের ঘোষণা সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ে। চতুর্থত, সংবিধানের প্রস্তাবনার প্রথম বাক্যের সঙ্গেও তা বিরোধ তৈরি করে, কারণ এখানে ২৬ মার্চই স্বাধীনতার ঘোষণার তারিখ নির্দিষ্ট রয়েছে।
রিপোর্ট / - প্রথম আলো
মিজানুর রহমান খান | তারিখ: ১০-০২-২০১০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




