ভাব হচ্ছে অনুভূতির আধিক্য ও হৃদয়ের আবেগ প্রবণতার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। মানব হৃদয়ের সমুদয় আবেগ ভাবের মাধ্যমেই তার স-প্রকাশ ঘটে। সেই ভাবটি যখন ছন্দ ও গীতির মাধ্যমে প্রকাশিত হয়, তখন তাকে ভাবগীতি বলে। ভাবগীতির অসংখ্য প্রকরণ ও শ্রেণী বিভাগ আছে। ভাব ও তত্ত্বগীতির অনুসরণকারী সম্প্রদায় ও উপ-সম্প্রদায় হচ্ছে, আউল-বাউল, ফকির, নাড়া, সাঁই, নাড়ার ফকির, রিন্দা, হযরতি, গোবরাই, পাগলনাথি, শম্ভচাঁন্দী, বলাহাড়ী, কর্তাভজা, খুশিবিশ্বাসী, সাহেবধ্বনি, জিকিরকারী ও রামবল্লভী ইত্যাদি। এছাড়া ঘর ও ঘরানা ভেদে এই সকল সম্প্রদায়ের মধ্য হতে অসংখ্য উপ-সম্প্রদায় তাদের গুরুকে কেন্দ্র করে ভিন্ন ভিন্ন দলে ও উপদলে বিভক্ত হয়ে তাদের নিজেস্ব রীতিতে ভাব সংগীত রচনা করে গেছেন। আনন্দের বিষয় এই যে, সমস্ত ভাবগীতিকারগণের অধিকাংশের জন্মভূমি ও জন্মস্থান এই বৃহত্তর নদীয়া জেলায়, অর্থাৎ (বর্তমান বাংলাদেশ অংশে) বৃহত্তর কুষ্টিয়া, যশোর ও পাবনা জেলার কিছু অংশে। বৃটিশদের নিকট থেকে অখন্ড নদীয়া দুটি ভাগে বিভক্ত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ভাব সংগীতের ক্ষেত্রে কোন বিভাজন চোখে পড়ে না। অর্থাৎ উভয় ভাগের গায়কগণই উভয়ের গান উভয়ে গেয়ে থাকেন। এই উপমহাদেশে সাধক পদকর্তা কবিবর চন্ডিদাসকে (১৩২৫-১৪১৭ খ্রী
চন্ডিদাস লিখিত : সদাবল তত্ত্ব তত্ত্ব কত তত্ত্ব গুণ
চব্বিশ তত্ত্বে হয় দেহের গঠন
চন্ডিদাস বিরচিত ভাব তত্ত্বগীতির দেহতত্ত্ব বিষয়ক গানটির শুরুটা ছিল ঠিক এই রকম। সাধক চন্ডিদাস বাশুলীদেবীর পূজারী হয়েও, দেবীর আদেশে অসংখ্য ভাব তত্ত্বমূলক গীত রচনা করে গেছেন এবং তিনি প্রথম সাধক পদকর্তা, যিনি মানবীয় প্রেমের মাধ্যমে ঈশ্বরের নৈকট্য লাভ করেছিলেন। তাকে এই উপ-মহাদেশের সর্ব প্রথম ভাবসংগীত রচয়িতা বলা যেতে পারে। তিনি ভনিতার ক্ষেত্রে নিজ নামের সঙ্গে রামী, বড়ু, দ্বিজ, দীন, আদি বিশেষণ প্রয়োগে নিজেকে প্রকাশ করেছেন। সাধক চন্ডিদাসের দেহতত্ত্বমূলক ভাবগীতির ধারা অনুসরণ করে সার্থকভাবে আধুনিক ভাবগীতির ধারা প্রবর্তন করেন, মহাত্মা লালন ফকির (১৭৭৪-১৮৯০ খ্রী
এছাড়া অনঙ্গ, কিনু, হাওড়ে গোসাঁই, মুনছুর, আব্দুর রহমান, জহরদ্দি, দীনু, অমূল্য, অহিভুষণ, যাদুবিন্দু, রাধেশ্যাম, বাবু, চন্ডে, মদন, দাস পীতাম্বর, লালমতি, নারান, হেমন্ত, স্বরূপ, জাহ্নবী, রূপুই, শ্রীনাথ প্রমুখ। (এই রূপ ৪ শত ৬০ জন ভাবগীতিকারের অধিকাংশে গুরুর নামসহ বৃহত্তর নদীয়ার ৬ হাজার টি ভাবগীতি আমার সংগ্রহে আছে)।
অত্র অঞ্চলের ভাবসংগীতের আনুপূর্বিক সংগতি রক্ষা করে দাড়া বা ধারা অনুযায়ী গানের রীতিনীতি রক্ষা করে পাল্লা গানের প্রতিযোগিতা বৃহত্তর নদীয়ার একটি ঐতিহাসিক ঐতিহ্য। এছাড়াও জারী, ধুয়ো, কবি, ও তর্জা গানের রেওয়াজ অধ্যাবধি চালু আছে। এ অঞ্চলে গুরু- শিষ্য, জীব-পরম, আদম- শয়তান, কাম-প্রেম, রস-রতি, নূর-নীর, শরিয়ত-মারফত, লীলাকারীসহ ৮২ টি দাড়ার উপর গীতিকারগণ প্রশ্ন ও উত্তররীতি বজায় রেখে ভাবসংগীত রচনা করে গেছেন। এখানে একটি নির্দিষ্ট দাড়ার উপর পাল্লা গাণের শিল্পীগণ দুই রাত দুই দিন পাল্লা গান করতে পারেন। আমি নিজে সরজমিনে অনুষ্ঠানটি দেখেছি ও শুনেছি। যার গায়ক ছিলেন বেহালসাঁই ও গহরসাঁই। আমি বিখ্যাত গায়ক বেহাল সাঁইয়ের নিজ মুখে শুনেছি যে, তিনি ২ হাজারের উপর গান মুখস্ত বলতে পারতেন। খোদবক্স সাঁই “জাহাপুর” ৩৬ বছর যাবৎ বেহাল সাঁহের নিকট তালিম গ্রহণ করেছিলেন, যার প্রমান আমার কাছে আছে। এখনও চুয়াডাঙ্গা জেলায় এমন অনেক গায়ক আছেন, যারা সুনির্দিষ্ট একটি দাড়ার উপর কয়েকদিন পাল্লা গান করতে পারেন। তাহলে বুঝে দেখুন একজন গায়ককে কত শত গান জানতে হয়। ভাবগান রচনার ক্ষেত্রে লক্ষ্য করে দেখা গেছে যে, প্রায় সকল গীতিকারই লালন ফকিরের গানের ধারা অনুসরন করে তার ভাবে ভাব, তার ছন্দে ছন্দ, তার ধারায় ধারা অনুকরণ করে গান রচনা করে গেছেন। ব্যতিক্রম শুধু দুদ্দু সাঁ, কাজেম বিশ্বাস, জহরদ্দিন সাঁ, হওয়াড়ে গোসাঁই, যাদুবিন্দু ও রাধেশ্যামসহ বেশ কয়েকজন। এছাড়া বিচ্ছেদী গীতিকার হিসেবে বিজয় সরকার এই ধারার সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। তাকে নতুন ভাব ধারার গীতিকার বললেও অত্যুক্তি হবে না।
উপরোক্ত গীতিকারগণ তাদের ভাবগীতির ক্ষেত্রে দার্শনিক ভাব-ভাষা, তত্ত্ব-তথ্য, তাত্ত্বিক ভাষা-পরিভাষা, রূপক ভাব-ভাষা ব্যবহার করে গেছেন। এছাড়া তারা নান্দনিক শিল্পতত্ত্ব ও অলংকার ব্যবহারের ক্ষেত্রে যথাযথ রসসিঞ্চন করে গীতিগুলিকে প্রাণবন্ত ও রূপ মাধুরীতে ভরিয়ে তুলেছিলেন
পরিশেষে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, লোক সাহিত্যের গবেষকগণ গ্রাম্য ভাবগীতিকারগণের রচনা, জীবনি লেখালেখি ও গবেষণা করে দেশী-বিদেশী অনেক সম্মানে ভুষিত হয়েছেন ও হচ্ছেন। শুধুমাত্র লালন ফকিরের জীবনি, দর্শন ও গান নিয়ে গবেষণা করে যতজন “ডক্টরেট” ডিগ্রী লাভ করেছেন, তেমনটি এই দেশে আর কারও রচনা নিয়ে হয়েছে কিনা আমার তা জানা নেই। কিন্তু ঐ সকল গ্রাম্য গীতিকার ও সাধকগণ অধ্যাবধি সমাজিক কোন স্বীকৃতি পায়নি এবং তাদেরকে সমাজেও যথার্থ মূল্যায়ন করা হয়নি। ধর্মীয় মৌলবাদের অশনি সংকেতের তান্ডবে তারা কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছেন। যাদের রচনা গ্রাম্য জন সাধারণ ও খেটে খাওয়া মানুষের চিত্তবিনোদনের একমাত্র বাহন ও মন-মানসিকতার ভিত্তিমূলে নাড়া দেয়। সেই সকল নির্মল ও নির্লোভ মানুষগুলি অর্থাৎ সাধুসজ্জনগণ আজ সমাজে অপাংতেয়। এমন কি লালন ফকিরের আখড়ার দখলদারিত্বও আজ সাধক ফকিরেরা হারাতে বসেছে, এখন লালন ফকিরের জন্ম-মৃত্যু বার্ষিকী উৎসব পালন নিয়ে আজ জমজমাট ব্যবসা আরম্ভ হয়েছে। আখড়াই শাধু ফকিরদের শান্ত পরিবেশ বিনষ্ট করে, অশান্ত পরিবেশ ধ্বংশকারী কিছু গঞ্জিকা সেবিদের দৌরাত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। সার্বিক কল্যাণ কামনা করার এখনিই সময়। আমরা জানি: সম্মানিত ব্যক্তিকে সম্মান করলে নিজের মান ও সম্মান বৃদ্ধি পায়। কিন্তু সমাজে কি তা আদৌ সম্ভব???
(নিয়ামত মাষ্টারের লালন বিষয়ক শতাধিক প্রবন্ধ থেকে সংকলিত।)

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




