গভীর রাত। সুনসান নীরবতা চারিদিকে। ঝিঁ ঝিঁ পোকার দল ডেকে চলেছে অবিরত। রাতের পাখিরা মাঝেমধ্যে নিস্তব্ধতা ভেঙে কর্কশ স্বরে ডেকে উঠে জানান দিচ্ছে নিজের অস্তিত্ব। আকাশে রূপালী চাঁদ কালো মেঘের আড়ালে লুকোচুরি খেলছে। চারপাশ কখনো নিকষ কালো আঁধারে ছেয়ে যাচ্ছে আবার কখনো বাঁধ ভাঙা আলোর জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে। খুব দ্রুত হাঁটার চেষ্টা করছে বীথি। ওর ভয় লাগছে খুব। ভীষণ ভয়। শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে গলাটা। হাঁটতে হাঁটতে একটা বিশাল বটগাছের নিচে এসে দাঁড়ালো ও। সাথে সাথে অনেকগুলো বাঁদুর গাছটির ভেতর থেকে ডানা ঝাপটে উড়ে গেলো। হঠাৎ ডানা ঝাপটানোর শব্দে বীথির বুকটা কেঁপে উঠল। একটা আশ্রয়ের খুঁজে তাকালো ও চারিদিকে। কিন্তু আশেপাশে কোথাও কোন জনবসতির চিহ্ন নজরে এলো না। বীথি আবার হাঁটা শুরু করলো। হাঁটছে তো হাঁটছেই। পথ যেনো আর শেষ হতে চায় না। পিপাসায় বুকটা যেন ফেটে যাচ্ছে। এক ফোঁটা পানি কি কোথাও নেই? চারপাশ আবার নিকষ কালো আঁধারে ছেয়ে গেছে। আকাশের দিকে তাকায় বীথি। চাঁদের কোন অস্তিত্বই যেন নেই। অনেকগুলো দানব মেঘ চাঁদকে যেন খেয়ে ফেলেছে। হাঁটতে হাঁটতে হাঁফ ধরে যায় ওর। আর পারছে না বীথি। হঠাৎ পেছনে কারোর পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলো ও। বীথির পা যেন মাটির সাথে আটকে গেলো। ওর মনে হলো কেউ যেন ওর পা দুটিকে মাটির নিচ থেকে হাত বাড়িয়ে মুঠো করে ধরে রেখেছে। কোন রকমে পা দুটিকে টেনে টেনে ও এগোতে থাকলো। একটা মানুষের কালো ছায়া পেছন থেকে বীথিকে পেরিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। ক্রমশ লম্বা হতে লাগলো ছায়াটা। বীথি শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে এবার ছুটতে লাগলো। ছুটছে তো ছুটছেই। ছুটতে ছুটতে একটা কিছুতে হুচট খেয়ে হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেলো ও। হাত পা অনেকখানি ছিলে গেলো। কিন্তু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে কোনরকমে উঠে দাঁড়িয়ে আবার ছুটতে লাগলো বীথি। ছুটতে ছুটতে হঠাৎই সামনে একটা বিশাল বাড়ির প্রবেশ গেট দেখতে পেলো ও। কাছে গিয়ে লোহার গেটটা ধরে খুব জোরে জোরে ধাক্কা দিতে লাগলো বীথি। কিন্তু কেউ এগিয়ে এলো না গেটটা খুলার জন্য। বীথি তাকিয়ে দেখলো একটা মস্ত তালা ঝুলছে গেটে। কিন্তু গেটের ভেতরের সব কিছু দেখা যাচ্ছে বাইরে থেকেই। যেন একটা নিঝুম পুরি বাড়িটা। গেট থেকে অনেকটা দূরে একটা মস্ত বড় প্রাসাদ। একটা প্রশস্ত রাস্তা গেট থেকে এঁকেবেঁকে চলে গেছে প্রাসাদ পর্যন্ত। রাস্তাটার দুপাশে সারি সারি ফুলের গাছ ছেয়ে আছে অজস্র ফুলে। রাস্তাটা ঢেকে গেছে রঙ বেরঙের নানা ফুলে। যেন ফুলের গালিচা বিছানো। গেটের ভেতরটা দেখতে দেখতে মোহগ্রস্থ হয়ে পড়ে বীথি। সব আতঙ্ক উধাও হয়ে যায়। মোহাচ্ছন্নের মত নিজের অজান্তেই গেটের ভেতরে পা বাড়ায় ও। আশ্চর্য লোহার গেট ভেদ করে অবলীলায় ঢুকে পড়ে ও ভেতরে। যেন এক ছায়া মানবী ও। বীথি হাঁটতে থাকে। নাম না জানা কত যে ফুলের মিশেল ঘ্রাণ নাকে এসে লাগে। সেই ঘ্রাণে বিভোর হয়ে হাঁটতেই থাকে ও। কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে ওর পথ যেন আর ফুরায় না। যতই হাঁটে ততই প্রাসাদটা যেন আরো দূরে সরে যায়। হঠাৎ গুঙানীর মত একটা শব্দ শুনতে পায় বীথি। কেউ যেন গুঙিয়ে গুঙিয়ে কাঁদছে। কোন মেয়ের কান্না না। পুরুষের কান্না। কান্নাটা যেদিক থেকে আসছে সেদিকে এগিয়ে যায় বীথি। ধীরে ধীরে কান্নাটার খুব কাছে চলে আসে ও। দেখতে পায় একটা লোক হাঁটু গেড়ে বসে আছে। মাথাটা গুঁজে রেখেছে দুই হাঁটুর ভাজে। লোকটা বীথির দিকে পেছন ফেরা। লোকটার সামনে একটা বিশাল গাছ। সেই গাছের একটি শাখায় ঝুলে আছে একটি নারীদেহ। মেয়েটির মাথাটা একপাশে কাত হয়ে আছে। চোখ ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে কোটর থেকে। আর জিহ্বাটা যেন একহাত লম্বা হয়ে ঝুলে আছে মুখ থেকে। শিউরে ওঠে বীথির সমস্ত শরীর। ভয়ে মুখটা দুইহাতে ঢেকে ফেলে ও। তারপর কোনরকমে নিজেকে সামলে এগিয়ে যায় লোকটার কাছে। পরম মমতায় লোকটার কাঁধে হাত রাখে। লোকটা তখন কান্না থামিয়ে বীথির দিকে ফিরে তাকায়।
ঠিক তখনই বীথির চুলের মুঠি ধরে কেউ সজোরে টান মারে।
---হারামজাদী আর কত ঘুমাবি? সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে চললো। নবাবের বেটি কাজকর্ম করতে হবে না?
সৎ মা-র মার খেয়ে ঘুম ভেঙে ধড়মড় করে উঠে বসে বীথি। চুলের গোড়াটা টনটন করছে খুব। কিন্তু মার খেয়ে বীথি একটুও কাঁদে না। এখন আর মার খেয়ে চোখে জল আসে না ওর। এসবই গা সওয়া হয়ে গেছে সেই কবে থেকে। বরং আফসোস হয় একদিনও স্বপ্নটা পুরো দেখা হয় না বলে। খুব ইচ্ছে হয় বীথির প্রতিদিন স্বপ্নে দেখা ঐ লোকটার চেহারাটা দেখার। কিন্তু চেহারাটা যেই দেখতে যাবে তখনই ঘুমটা ভেঙে যায় ওর। খুব ইচ্ছে হয় ঐ লোকটার সাথে দুটো কথা বলার। বীথি ভেবে পায় না এই স্বপ্নটা ও কেন রোজ দেখে। এত বড় বাড়ি ও জীবনেও দেখেনি। এমন বাড়ির কথা শুধু গল্প উপন্যাসেই পড়েছে। বাস্তবে কখনও দেখা হয়নি। আর এই অজ পাড়াগাঁয়ে এমন বাড়ি কোথা থেকে আসবে? তবে কেন এই বাড়িটাই বারবার ওর স্বপ্নে আসে? স্বপ্নটাও কী ভীষণ অদ্ভুত! কী ভীষণ ভয়ংকর! স্বপ্নের রেষ যেন এখনও রয়ে গেছে। গলাটা এখনও শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। যেন সত্যি সত্যি ঘটনাটা ওর সাথে ঘটেছে।
বিছানা থেকে নেমে বীথি প্রথমে ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি এক নিঃশ্বাসে খেয়ে ফেলে। যেন কতদিনের পিপাসার্থ ও। তারপর হাতমুখ ধোয়ার জন্য বাড়ির পাশের ছোট্ট পুকুর ঘাটে যায়। কিন্তু ঘাটে নামে না ও। ঘাটটার পাশেই বড় একটা শিউলি গাছ। বীথির মায়ের হাতে লাগানো। বীথি প্রতিদিন মুখ ধোয়ার আগে শিউলি গাছটার নিচে যায়। গাছটার গুড়িতে বসে কিছুটা সময় কাটায়। মাকে অনুভব করার চেষ্টা করে। টুকটাক কথা বলে একা একা মায়ের সাথে। যেন এই শিউলি গাছটাই ওর মা। ওর বয়স যখন পাঁচ কি ছয় ঠিক তখনই বীথির মা মারা যান। ভোরবেলার এই সময়টা তাই বীথির ভীষণ প্রিয়। এই সময়টায় ও মাকে অনুভব করতে পারে।
শরৎ চলে এসেছে। হিমেল হাওয়ায় বেশ শীত শীত অনুভূতি হচ্ছে। শরতের স্নিগ্ধতামাখা এই ভোরবেলায় এই শীত শীত অনুভূতিটা বেশ লাগে বীথির। মনে মনে মুনিরা বেগমকে কৃতজ্ঞতা জানায় এই সুন্দর ভোরবেলাটা ওকে উপহার দেয়ার জন্য। হয়তো নিজের অজান্তেই সৎ মা এই কাজটা করেন, তবু তো বীথিকে একটা ভাল লাগার সুযোগ করে দেন। ভোরের আলো ফোটার আগেই বীথিকে জাগিয়ে দেওয়াটা মুনিরা বেগমের একটা জ্বালাতন। তিনি কাজটা করেন বীথিকে কষ্ট দেয়ার জন্য। যাতে বীথি আরাম করে ঘুমাতে না পারে। উনিতো আর জানেন না ভোরের আলোয় পৃথিবীটা এক মোহনীয় স্বর্গীয় রূপ ধারণ করে। আর পৃথিবীর সেই স্বর্গীয় রূপ অবলোকন করার সৌভাগ্য বা সুযোগ সব মানুষের হয় না। সেই সুযোগটাই নিজের অজান্তে তিনি বীথির জন্য করে দেন। বীথি নিশ্চিত, যদি মুনিরা বেগম এটা জানতেন তবে এই কাজটা তিনি ভুলেও করতেন না। বীথি প্রতিদিন ভোরের এই অপূর্ব ক্ষণটায় মুনিরা বেগমকে নিজের অজান্তে করা এই ভুলটার জন্য হাজারবার মনে মনে ধন্যবাদ দেয় আর ওর উপর করা সব অত্যাচারের জন্য ক্ষমা করে দেয়। শিউলিতলা শিউলি ফুলে ছেয়ে সাদা হয়ে আছে। সাদার ফাঁকে ফাঁকে কমলা রঙের বোঁটাগুলো উঁকি দিচ্ছে। শ্বেত শুভ্রতার সাথে রক্তিম কমলার মিলনে এক অদ্ভুত সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয়েছে। পৃথিবীর সব চাইতে সুন্দর ফুল মনে হয় এই শিউলি ফুল। শিউলিকে বলা হয় স্বর্গের শোভা। সূর্যকে দেখামাত্র অভিমানে ঝরে পড়ে শিউলি। সূর্যের সাথে শিউলির বড় অভিমান। পুরানে শিউলিকে বেদনার প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। এক রাজকন্যা ছিল। নাম ছিল তার পারিজাতিকা। রূপে যেন তার আগুন জ্বলতো। অপরূপা এই রাজকন্যার প্রেমে পাগল ছিল সবাই। কিন্তু রাজকন্যার কোন মানুষকে ভাল লাগে না। তিনি ভালবাসতেন সূর্যকে! সূর্যের প্রেমে তিনি ছিলেন পাগলপ্রায়। কিন্তু সূর্যের জন্য রাজকন্যার মন উজার করা এত ভালবাসা পরিণাম পেল না। শত সাধনায়ও সূর্যদেবতার মন গলল না। মনটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো রাজকন্যার। ব্যর্থ প্রেমের দহন সইতে না পেরে অবশেষে নিজের প্রাণটাই বিসর্জন দিয়ে দিলেন তিনি। হিন্দু শাস্ত্র মেনে তাঁকে দাহ করা হয়। কিন্তু সেই দহনে বিলীন হয়ে যান না পারিজাতিকা। বরং একটি গাছ হয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসেন আবার। শুভ্র স্নিগ্ধতায় ভরা এক ফুলে ছেয়ে যায় সেই গাছ। রাজকন্যার নামে ফুলটির নাম রাখা হয় পারিজাতিকা। সেই পারিজাতিকাই অভিমানী ফুল শিউলি। বই পড়ার দারুণ শখ বীথির। কলেজ শেষে অনেকটা সময় ও কলেজের লাইব্রেরিতে কাটায়। সেখানে ও নানা রকমের বই পড়ে। এই কাহিনীও পৌরাণিক একটা বই পড়ে জেনেছে ও।
বীথি প্রথমে একটা ফুল হাতে নিয়ে হাতের তালুতে ডাটাটা ঘষে। কী সুন্দর কমলা রঙে হাতের তালুটা মেহেদির মত রঙিন হয়ে যায়! পাশেই রয়েছে সারি সারি কলা গাছ। সেখান থেকে একটা বড় দেখে কলা পাতা ছিঁড়ে আনে ও। তারপর একটা একটা করে ফুলগুলো কুড়াতে থাকে। দেখতে দেখতে অনেকগুলো ফুল জড়ো হয়ে পড়ে। এরপর একটা একটা ফুল নিয়ে মালা গাঁথে বীথি। সুঁই সুতো সাথে করেই নিয়ে আসে আজকাল মালা গাঁথবে বলে। মালা গাঁথা শেষ হলে মালাটা সাবধানে কলাপাতা দিয়ে মুড়ে রাখে। এই মালাটা ও একজনকে দেবে। বিথির হাতে গাঁথা শিউলি ফুলের মালা তার ভীষণ প্রিয়। বাকি ফুলগুলো কলার মোচায় ভরে নেয়। আঁধার এখনও পুরোপুরি কাটেনি। শিউলি ফুলে ভরা মোচাটা হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে ঘাটে আসে বীথি। সাবধানে ঘাটলায় পা রাখে। শ্যাওলা জমে পিচ্ছিল হয়ে আছে ঘাটটা। নারিকেল গাছ দিয়ে ঘাটটা তৈরি করা হয়েছে। কলার মোচাটা আস্তে করে পানিতে ভাসিয়ে দেয় বীথি। ভোরের মৃদু বাতাসের ধাক্কায় ধীরে ধীরে চলতে থাকে মোচাটা। বীথি সেদিকে চেয়ে থাকে অনেকক্ষণ। ওর ভীষণ ভাল লাগে। কলার মোচাটা ভাসতে ভাসতে কোন এক কিনারে গিয়ে আটকে যায়। তখন বীথি হাতমুখ ধোয়ে ঘরে ফিরে আসে। মা আর খোকন এখনও ঘুমে। মুনিরা বেগম বীথিকে জাগিয়ে দিয়ে আবার ঘুমের কোলে ঢলে পড়েন। তাই ভোর বেলার এই সময়টা বড় নিশ্চিন্তে, বড় স্বাধীনভাবে নিজের ইচ্ছেমত কাটায় বীথি। ছোট ভাই খোকন বীথির সাথেই এক খাটে ঘুমায়। খোকনের বয়স দশ কি এগারো বছর হবে। বীথির খুব ন্যাওটা ভাইটা। বীথি ঘরে এসে খোকনের কাছে যায়। খোকন গভীর ঘুমে মগ্ন। বীথি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে চুলগুলো এলোমেলো করে দেয়। তারপর শিউলি ফুলের মালাটা ওর মাথার কাছে রেখে দেয়। ঘুম থেকে জেগেই মালাটা পেয়ে খুশিতে ঝলমল করে উঠবে ভাইটা। ওর সেই ঝলমলে চেহারাটা দেখতে ভীষণ ভাল লাগে বীথির। সৎ ভাই হলে কী হবে নিজের মায়ের পেটের ভাইয়ের মতই আদর করে বীথি খোকনকে। খোকনও বীথিকে মন প্রাণ দিয়ে ভালবাসে।
চলবে
রচনাকাল
২৯-১০-২০১৮
©নিভৃতা
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ৮:৪৭