somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্প: সূক্ষ্ম বিচার

০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সকাল ১০:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ছবি: ইন্টারনেট
২য় ও শেষ খণ্ড Click This Link

আমার নাম নাজমা। স্বামী, শাশুড়ি আর চার মেয়ে নিয়ে বলা যায় সুখের সংসারই আমার। আমার চার কন্যাই খুব লক্ষ্মী। ওদের বাবা মানুষটা বলতে গেলে একেবারে ফেরেশতা। খুবই ভাল মানুষ। এমন ভাল মানুষ আজকাল খুব কম হয়। আমার শাশুড়িও মানুষ ভাল। মনটাও অনেক বড়। কিন্তু বেচারি আমার উপর কিছুটা মনঃক্ষুণ্ণ। বয়স্ক মানুষ। মন তো কিছুটা ক্ষুণ্ণ হবেই। কত আর ধৈর্য্য ধরে থাকবেন।

বড় আশা ছিল একটা নাতির মুখ দেখবেন। নাতি হলো বংশের বাতি। কিন্তু চার চারবারই তার সেই আশায় গুড়েবালি। চারবারই আমি কন্যাসন্তান প্রসব করলাম। কিন্তু কী করে উনাকে বুঝাই যে এতে আমার কোন হাত নেই। আমার স্বামীর অবশ্য আমার উপর কোন রাগ বা অভিযোগ নেই। শিক্ষিত মানুষ। সবই বোঝেন। মনটাও বড়।

তবে মনে মনে একটা ছেলের শখ তারও আছে। কার না থাকে? না থাকাটাই অস্বাভাবিক। আমার প্রথম সন্তান যখন মেয়ে হয় তখন আমার ঘরে খুশির বান বয়ে গিয়েছিল। স্বামী তো মেয়েকে কোল ছাড়াই করছিলেন না। এমন কি আমার শাশুড়িও খুব খুশি। প্রথম সন্তান মেয়ে হওয়া নাকি আল্লাহর রহমত। সৌভাগ্যের নিদর্শন।

এরপর যখন আমার দ্বিতীয় সন্তানও মেয়ে হলো তখনও আমার স্বামী খুব খুশি হলেন। কিন্তু আমার শাশুড়ি কিছুটা ক্ষুণ্ণ হলেন। ক্ষুণ্ণ হলেও আমার সেবা যত্নে কোন কমতি রাখলেন না। তৃতীয়জন নাতি হবে এই আশা বুকে ধারণ করে দ্বিতীয় নাতনিকেও বুকে তুলে নিলেন। কিন্তু আমি মনে মনে কিছুটা ক্ষুণ্ণ হলাম। কারণ দুইটার বেশি বাচ্চা আমি নিতে চাইনি। এখন শাশুড়িকে খুশি করার জন্য হলেও আমাকে তৃতীয়বার সন্তানধারণ করতে হবে।

অতএব, আমাকে তৃতীয়বারের মত গর্ভধারণ করতে হলো এবং যথারীতি মেয়েই হলো। এইবার আমার শাশুড়ি আমাকে অলক্ষ্মী অপয়া ইত্যাদি যা যা গালি বর্ষণ করা যায় সবই করলেন। সেই সাথে অবশ্য সেবা যত্নেরও কোন ত্রুটি ঘটলো না। আমার স্বামী তার তৃতীয় মেয়েকেও আনন্দের সাথে গ্রহণ করলেন। বললেন, তিন মেয়ে হলো ত্রিরত্ন।

কিন্তু তিনি এই কথা বলে যেন নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন এমনটা আমার মনে হলো। তার সেই আনন্দের আড়ালে আমি কোথায় যেন একটা দুঃখের ছায়াও দেখতে পেলাম। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আমার বুকের গভীর থেকে। এমন ভাল মানুষ স্বামীর চোখে দুখের ছায়া আমি সইতে রাজী নই।

স্বামীর চোখের সেই দুখের ছায়া আমাকে কুরে কুরে খায়। মনে হয় যেন এসবের জন্য আমিই দায়ী। আমিই আসলে অপয়া। নয়তো এতদিনে একটা ছেলে হয়েই যেত আমার। আমি শেষ চেষ্টা হিসেবে চতুর্থবারের জন্য বাচ্চা নিলাম। কিন্তু হায় আমার সেই চেষ্টাও বিফলে গেলো। আমার চতুর্থ সন্তানও মেয়েই হলো।

আমার স্বামী এবার তার কষ্ট লুকোতে পারলেন না। আমার শাশুড়ি এবার আমার মেয়ের মুখ দেখতেও নারাজ। কিছুদিন যাওয়ার পর সবকিছুই স্বাভাবিক হয়ে এলো শাশুড়িও মান ভুলে চার নাতনিকেই আদর করেন। আর চার কন্যার মাঝে আমার স্বামীর যেন প্রাণটা লুকিয়ে রয়েছে।

ধীরে ধীরে আমার সংসারে ঝর্ণার কলকল ধারা বইতে লাগলো আমার চার কন্যার কলকাকলিতে। আমার শাশুড়ি অবশ্য উঠতে বসতে আমাকে কথা শুনাতে ছাড়েন না। মাঝে মাঝে আর একটা শেষ চেষ্টা করতেও বলেন। আমি উনার কথা তেমন একটা কানে তুলতাম না। এক সময় মনে হলো আমার স্বামীও মনে মনে সেই ইচ্ছাই পোষণ করছেন। আমিও নিজেকে রাজী করালাম। পঞ্চমবারের মত গর্ভধারণের চেষ্টায় ব্রতী হলাম।

এখন আমি চার মাসের সন্তানসম্ভবা। শাশুড়ি উনার মনঃক্ষুণ্ণভাব এখন আপাতত শিকেয় তুলে রেখেছেন। স্বামীর দুচোখে খুশির ঝিলিক। কারণ তাদের মন বলছে এবার ছেলেই হবে। আমিও মনে প্রাণে চাই ছেলেই হোক। ওদের আশা পূর্ণ হোক। বংশের বাতি জ্বেলে আমি এবার একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে চাই। একটু জিরোতে চাই। শাশুড়ি দিনরাত আমার সেবায় ব্যস্ত। স্বামী আমার যত্নে দিশেহারা।

কিন্তু বিধিবাম। এত আদর যত্ন সেবায় কোন লাভ হলো না। গর্ভে যে আছে সে তার অগ্রজাদেরই অনুসরণ করলো। অর্থাৎ চার মাস পূর্ণ হওয়ার পর জানতে পারলাম এবার যিনি আসছেন তিনিও মেয়ে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এটা শুনে এবার আমার শাশুড়ি কোন বিরূপ আচরণ করলেন না। স্বামীকেও কোন আশাভঙ্গের বেদনায় বেদনাহত হতে দেখলাম না। বরং তারা আগেরই মত আমাকে যত্নআত্তি করতে লাগলেন। অর্থাৎ তারা বিধিকে মেনে নিয়েছেন। আমিও হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।

পাঁচ মাস দশদিনে যেদিন পা রাখলাম ঠিক সেদিন ঘটলো এক ভয়াবহ ঘটনা। হঠাৎ করেই ব্লিডিং শুরু হলো আমার। রক্তের যেন বন্যা বয়ে যেতে লাগলো। তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো আমাকে। ডাক্তাররা জানালো আমার বাচ্চাটা গর্ভেই মৃত্যুবরণ করেছে। তাকে আমার গর্ভ থেকে অপসারণ করা হলো। কষ্টে আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছিল।

আমার শাশুড়ি আর স্বামী আমাকে সান্ত্বনা দিতে থাকলেন। কিন্তু আমার কষ্ট কোন বাঁধ মানছিল না। এক সময় জানলাম বাচ্চাটা আসলে ছেলে ছিল। মেয়ে না। আমি মা। আমার জন্য সন্তান সন্তানই। ছেলে মেয়ে যাই হোক না কেন তার মৃত্যুতে একজন মায়ের সমান কষ্ট হয়। কিন্তু আমার বাচ্চাটা একটা ছেলে ছিল সেটা শুনে আমার শাশুড়ি আর স্বামীর সে কি আহাজারি! যেন মাথা কুটে মরবে তারা এই দশা।

আমার স্বামী একটা বাচ্চা শিশুর মত চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। সেই কান্না আমার কষ্টের বোঝা আরো বাড়িয়ে দিলো। মনে মনে আল্লাহকে দোষারোপ করতে লাগলাম। আল্লাহ যদি দিয়েইছিলেন শেষ অবধি, তবে কেনই বা আবার কেড়ে নিলেন? আল্লাহর এ কেমন বিচার!

এক সময় হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরলাম। শোক কাটিয়ে উঠলাম। শরীরও একটু একটু করে ঠিক হতে লাগলো। নতুন মাসের শুরু হয়েছে। বিল পরিশোধ চলছে। সামনের ফার্মেসি থেকে বাকিতে ঔষধ আনা হয়। মাস শেষে বিল পরিশোধ করি। সেই ফার্মেসিরও বিল এসেছে। সেটাতে চোখ বুলাচ্ছিলাম। হঠাৎ মনে খটকা লাগলো। গেলাম ঐ ফার্মেসিতে।

-----ভাই, কিছু ঔষধের নাম আপনারা বোধহয় ভুলে আমাদের বিলে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। এগুলো তো আমরা কিনি নি।

-----না, ম্যাডাম। বিল ঠিকই আছে। এই ঔষধগুলো গত মাসের প্রথম দিকে স্যার কিনেছিলেন।

-----ওহ। আচ্ছা এগুলো কীসের ঔষধ ভাই?
----- অ্যাবরশন পিল।
বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। হাসবো না কাঁদবো বুঝে উঠতে পারছি না। এখন বুঝতে পারছি মেয়ে জানার পরও কেন এত আদর যত্ন হচ্ছিল আমার। কেন স্যুপটা প্রতিদিন নিজ হাতে মুখে তুলে খাইয়ে দিতেন আমার ফেরেশতার মত স্বামী। কেন স্যুপটা এত তেতো আর বিস্বাদ লাগতো আমার কাছে!

সমস্ত পৃথিবীটাই এখন বড় বিস্বাদ ঠেকছে। পায়ের নিচের সব মাটি যেন সরে গেলো। কোন রকমে ফার্মেসি থেকে বাইরে বেরিয়ে এলাম। বুকের ভেতরটা বড় ভারী ঠেকছিল। বুক ভরে একটা নিঃশ্বাস নিলাম। তারপর আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকালাম। তাকাতেই বুকটা অনেক হালকা হয়ে এলো। কষ্ট ছাপিয়ে অদ্ভুত এক সুখ জায়গা করে নিলো বুকের ভেতরে।
----
রচনাকাল- ০৩-০৪-২০১৯
 ©নিভৃতা
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৪:২৮
২৭টি মন্তব্য ২৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৩৯

১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷

চলুন গল্পটা শুনে আসি৷

বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে এসো রাফসান দি ছোট ভাই

লিখেছেন আবদুর রব শরীফ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৮

রাফসানের বাবার ঋণ খেলাপির পোস্ট আমিও শেয়ার করেছি । কথা হলো এমন শত ঋণ খেলাপির কথা আমরা জানি না । ভাইরাল হয় না । হয়েছে মূলতো রাফসানের কারণে । কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুমীরের কাছে শিয়ালের আলু ও ধান চাষের গল্প।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৪০



ইহা নিউইয়র্কের ১জন মোটামুটি বড় বাংগালী ব্যবসায়ীর নিজমুখে বলা কাহিনী। আমি উনাকে ঘনিষ্টভাবে জানতাম; উনি ইমোশানেল হয়ে মাঝেমাঝে নিজকে নিয়ে ও নিজের পরিবারকে নিয়ে রূপকথা বলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×