১ম খণ্ড Click This Link
©নিভৃতা
রচনাকাল: ১৮-০৪-২০১৯
আমি ঘরে ফিরলাম। কোনদিকে না তাকিয়ে দুইটা স্যুটকেস ভর্তি করলাম নিজের ও মেয়েদের কাপড়ে। শাশুড়ি বার বার জিজ্ঞেস করতে লাগলেন ব্যাপারটা কী? আমি কোন উত্তর দিলাম না। স্বামী বাসায় ছিলেন না। আমার কর্মকাণ্ড দেখে শাশুড়ি খবর দিয়ে তাকে বাসায় আনালেন। সে কী হয়েছে জিজ্ঞেস করতে লাগলো। তার সাথে কথা বলতেও আমার ঘৃণা হচ্ছিল।
আমি তার হাতে ঔষধের বিলটা দিলাম। সে যা বোঝার বুঝে গেল। আমার হাত পা ধরে শত অনুনয় বিনয় করতে লাগলো। বার বার ক্ষমা চাইতে লাগলো। কিন্তু তার মত একটা অমানুষকে ক্ষমা করার কোন প্রশ্নই ওঠে না। দরকার হলে মেয়েদের নিয়ে না খেয়ে মরব তবু তার মত অসুরের ছায়া আমি আমার মেয়েদের উপর পড়তে দেবো না।
আমি আমার বাবার বাড়িতে ফিরে এলাম। আমার বাবা মা আমাকে সাদরে গ্রহণ করলেন। আমার বাবার দুই নম্বর সন্তান আমি। আমার বাবার প্রথম সন্তানও মেয়ে। তাই বলে বাবাকে কোনদিন আক্ষেপ করতে দেখিনি। ইচ্ছে করলে বাবা ছেলের লোভে আরো সন্তান নিতে পারতেন। আমার মায়ের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারতেন। কিন্তু কখনোই তা করেন নি। বরং একটা ছেলের চেয়ে কোন অংশে আমাদের কম করে দেখেননি। মেয়ে বলে কখনও হেয় করেননি।
কোথায় আমার বাবা আর কোথায় আমার স্বামী! অথচ দুজনেই কিন্তু পুরুষ মানুষ। ছি, ছি! সন্তান ছেলে নয় বলে বিষ দিয়ে নিজের সন্তানকে মেরে ফেলে, এমন একটা ইবলিশকে আমি ভালবেসেছিলাম, এমন একটা ইবলিশের সাথে দিনের পর দিন কাটিয়েছি ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে। কষ্টে বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে আমার।
যাই হোক, এক সময় আমার কষ্টটা কমতে থাকলো। ঘৃণার পরিধিটাও যেন ধীরে ধীরে কমে আসতে লাগলো। ঐ ইবলিশটাকে তো আমি সত্যি সত্যিই ভালবেসেছিলাম। আমার ভালবাসায় তো কোন খাদ ছিল না। সেই ভালোবাসা আবার তার অস্তিত্ব জানান দিতে লাগলো। ঐ যে বাঙালি মেয়েদের যা স্বভাব, সেই গণ্ডি থেকে আমার মত এক সাধারণ মেয়ে বের হবে কী করে? আমার মনটা আবার দূর্বল হয়ে পড়লো।
দুই তিন দিন ধরে অনবরত ফোন করেছে সে। রাগের কারণে আমি ফোন ধরিনি। এখন মনে হচ্ছে কিছু তড়পাক লোকটা, এসে কান্নাকাটি করুক। কিছু শাস্তি হোক। এরপরে না হয় আবার ফিরে যাবো। এতদিনের সংসার, এতদিনের মায়ার ডোর, এত সহজেই কি ছিঁড়ে ফেলা যায়? আমি তার অপেক্ষা করতে লাগলাম সব ভুলে। কিন্তু সে আমাদের নিতে আসা তো দূরে থাক, কোন একটা ফোনও করছিল না আর।
আরো দুদিন পর খবর পেলাম সে আরেকটা বিয়ে করেছে। আমার আর সইবার ক্ষমতা ছিল না। আমি একেবারেই ভেঙে পড়লাম। আমার বাবা মা অনবরত আমাকে সাহস জুগাতে লাগলেন। যত বড় কষ্টই হোক সব কষ্টই এক সময় সয়ে যায়। আল্লাহ সেভাবেই মানুষকে তৈরি করেছেন। আমারও সয়ে গেলো। আমি ঐ ইবলিশের কথা ভেবে ভেবে আর সময়ের অপচয় করতে চাইলাম না।
আমার চার মেয়েই আমার সব। ওদেরকে মানুষের মত মানুষ করে তুলবো আমি। বুকে পাথর বেঁধে আমি আবার নিজেকে খাড়া করলাম। প্রতিশোধের আগুন যে ভিতরে ভিতরে জ্বলছিল না, তা না। কিন্তু সেই আগুনটাকে মাটি চাপা দিয়েই রাখলাম। প্রতিশোধ নিতে গিয়ে মেয়েদের ভবিষ্যত আমি নষ্ট করতে পারি না।
আমি ঐ ইবলিশের দিক থেকে মন সরিয়ে আমার মেয়েদের দিকে দৃষ্টি দিলাম। আগেই বলেছি মেয়েগুলো আমার খুব লক্ষ্মী। সবগুলো মেয়েই পড়াশোনায় ভাল করতে লাগলো। মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে আমি আমার সব দুঃখ ভুলে থাকি। এক সময় মেয়েগুলো বড় হলো। একে একে পড়াশোনা শেষ করলো। প্রত্যেকেই ভাল চাকরিতে ঢুকলো। ভাল ঘরে ওদের বিয়ে হলো।
ওদিকের টুকটাক খবর মাঝেমাঝে আমার কানে আসতো। ঐ ঘরে ইবলিশের নাকি একটা ছেলে হয়েছে। ইবলিশের মনোবাসনা তবে আল্লাহ পূরণ করেছেন। মাঝেমাঝে আল্লাহর উপর খুব অভিমান হয়। ভাবি পৃথিবীর ইবলিশগুলোকে আল্লাহ কোন শাস্তি কেন দেন না। বরং ইবলিশগুলোর মনোবাসনা আরো পূর্ণ করে দেন। কেন? কিন্তু কোন উত্তর আমি খুঁজে পাই না।
আমার মেয়েদের ঘরে নাতি নাতনি হলো। সবাই ছুটিতে আমাদের, মানে আমাকে আর আমার বাবা মাকে দেখতে আসে। বাচ্চাকাচ্চার কলকাকলিতে ঘর ভরে ওঠে। খুশিতে আমার চোখের কোণে জল চক চক করে। আমিও মেয়েদের কাছে বেড়াতে যাই। মেয়েগুলো আমাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু করে। কার বাড়ি রেখে কার বাড়ি যাই। এ যেন এক মধুর উপদ্রব।
ওদিকে শুনতে পেলাম ইবলিশের ছেলে নাকি বিয়ে করেছে। ইবলিশ নাকি নিজের সব সম্পদ ঘরবাড়ি ছেলেকে লিখে দিয়েছে। ছেলে আর ছেলে বউ নাকি ইবলিস আর ইবলিসের সেই শকুনী মাকে খুব আদর যত্ন করে। এসব শুনে আমার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। ইবলিশের এত সুখ আমার সহ্য হয় না। আমার বুক ফেটে কান্না আসে। ভাবি আমার এই কষ্টের অবসান কি কোনদিন হবে না?
তারপর এলো সেই দিন, যেদিন আমি আমার দীর্ঘ দিনের লুকোনো সেই দগদগে ক্ষতে কিছুটা যেন ঠাণ্ডা মলমের প্রলেপ পেলাম। আমার খুব আরাম লাগলো। অনেক দিন পর বড় শান্তি লাগছিল। সেই ইবলিশ আর তার মাকে নাকি তার ছেলে, ছেলে বউ এবং তার দ্বিতীয় স্ত্রী মিলে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিয়েছে। যেন এই দিনটির প্রতিক্ষায়ই আমার প্রতিটি ক্ষণ কাটতো।
কিছুদিন পর আমি আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল সচক্ষে ঐ শয়তানগুলোর দুরবস্থা দেখার। অবশেষে আমি সেই বৃদ্ধাশ্রমে গেলাম। সেখানে ইবলিশকে পেলাম না পেলাম ওর মাকে। খুবই শোচনীয় অবস্থায় পেলাম উনাকে। বয়স আর অবহেলার ছাপ স্পষ্ট। ঠিক মত দাঁড়াতেও পারেন না। সমস্ত শরীর জ্বরে কাঁপছিল। আমি আর পাথর হয়ে থাকতে পারলাম না।
উনি আমার সাথে যত খারাপ ব্যবহারই করুন না কেন, ওর ঐ অবস্থা আমাকে মোটেই স্বস্তি দিচ্ছিল না। আমি আর পারলাম না। আমি উনাকে একটা ভাল হাসপাতালে ভর্তি করলাম। ডাক্তার পরীক্ষা নিরীক্ষার পর জানালেন উনি ক্যান্সারে আক্রান্ত। শুধু তাই না, তিনি এখন একেবারে জীবনের শেষ প্রান্তে উপনীত হয়েছেন। তবু কিছু চিকিৎসা আর সেবা যত্নে উনি কিছুটা সুস্থ হলেন। আমি উনাকে ইবলিশের কথা জিজ্ঞেস করলাম।
উনি কাঁদতে কাঁদতে আমাকে যা বললেন, তার সারমর্ম হলো, উনারা বৃদ্ধাশ্রমে যাওয়ার পর একদিন ইবলিশের বউ তাদের দেখতে বৃদ্ধাশ্রমে আসে। সেখানে ইবলিশ আর তার বউয়ের মধ্যে খুব কথা কাটাকাটি হয়। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে ইবলিশের বউ যা বলে তা শুনে মা ছেলে দুজনই বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে পড়ে। ইবলিশের বউ জানায়, যে ছেলেকে এতদিন ইবলিশ নিজের ছেলে ভেবে এসেছে সে আসলে তার ছেলেই নয়। সেই ছেলে নাকি ইবলিশের বউয়ের প্রাক্তন প্রেমিকের। এই কথা শুনার পর ইবলিশ আত্মহত্যা করতে উদ্যত হয়। একসময় সে অপ্রকৃতস্থ হয়ে পড়ে। জিনিসপত্র ভাঙা শুরু করে। যাকে দেখে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বৃদ্ধাশ্রম কর্তৃপক্ষ তাকে সামলাতে না পেরে পাগলখানায় পাঠিয়ে দিয়েছে।
সব শুনে অনেক দিন পর আমার বুকের গভীর থেকে একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো। সেই নিশ্বাসে এক স্বর্গীয় তৃপ্তি জড়িয়ে ছিল। যে কষ্টটা জগদ্দল পাথরের মত বুকের ভেতরে এঁটে বসেছিল এতদিন, হঠাৎই তা যেন গড়িয়ে নিচে নেমে গেলো। অনেক দিন পর বুকের ভেতরটা বড় হালকা লাগতে লাগলো। আল্লাহর প্রতি যে অভিমান মনের ভেতর দানা বেঁধেছিল তাও অবশেষে গলে গলে পড়তে লাগলো।
-------