somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: আক্রোশ - ০৪

০৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ৮:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



৩য় পর্ব - Click This Link

লোকটা নিবিষ্ট মনে ঘাস কেটে চলেছে। রাস্তার পাশে গজিয়ে ওঠা ঘাসগুলো রোজ সে একমনে কেটে যায়। কেটে কেটে একটা চটের বস্তায় ভরে। দূর থেক দেখলে মনে হবে একজন স্বাভাবিক বয়স্ক মানুষ ঘাস কেটে চলেছেন অবিরত। দূর থেকে এই বয়স্ক লোকটাকে ঘাস কাটতে দেখে হয়তো কিছু নরম মনের মানুষের মনে দয়ার উদ্রেক হবে। তারা লোকটার সাথে দুটো কথা বলার জন্য তার কাছে এগিয়ে যাবে।

কাছে যেতেই তাদের মনের সহানুভূতিটা বিস্ময়ে রূপান্তরিত হবে। লোকটা যে শুধু বয়স্ক তা না। লোকটার পুরো একটা পা-ই যে গোড়া থেকে কাটা। কিন্তু তা নিয়ে লোকটা মোটেই দুঃখিত নয়। বরং তার ঠোঁটের কোণে লেগে আছে এক টুকরো তৃপ্তির হাসি। এই পঙ্গু জীবনটাকে নিয়ে তার কোন অভিযোগ নেই। সে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষদের একজন।

তপু খুব কাছ থেকে লোকটাকে লক্ষ্য করছিল। লোকটা একটা জায়গায় ঘাসকাটা শেষ করে ঘাসগুলো বস্তায় ভরলো। তারপর উঠে দাঁড়ালো। একহাতে তার ক্র্যাচটা আর অন্যহাতে ঘাসের বস্তা মাঝখানে তার একটা পা। পা-টা পুরোটাই দেখা যাচ্ছে। কারণ লুঙ্গিটা তার মালকুচা দিয়ে বাঁধা। সে আরো খানিকটা এগিয়ে এলো। আবার ঘাস কাটতে বসে পড়লো। নিপুণহাতে সে কেটে চলেছে ঘাস। তপু লোকটার কাছে এগিয়ে গেলো।
----ভাই কেমন আছেন?
----আল্লায় ভালাই রাখসে সাব।
----এক পা দিয়ে কাজ করেন, কষ্ট হয় না আপনার?
----না। দুই  পা কুনদিন আসিলো হেইডাই ভুইলা গেসি।
----এই বয়সে কাজ করেন কেন? ছেলে মেয়েরা দেখে না?
----মাইয়ার বিয়া হইয়া গেসে। আর তিন পুলা নিজের সংসার সামলাইবো না আমাগোরে সামলাইবো, কন?
----আপনার মনের শক্তি দেখে অবাক হচ্ছি। আপনার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে তো এই একটা পা নিয়ে ভিক্ষার ব্যবসা শুরু করে দিতো।
----আমিও ভিক্ষাই করতাম সাব। ল্যাংড়া মানুষরে কেউ কাম দিতে চায় না। হের লাইগা ভিক্ষা ছাড়া কোন উপায় ছিল না আমার।
---তাহলে এই কাজটা কী করে পেলেন?
----সব মেয়র সায়েবের দয়া। উনার মনটা যেন একেবারে সোনা দিয়া বান্দানো। এমন মাটির মানুষ আইজকাল দেখা যায় না। এমন ক্ষমতা পাইলে যেহানে মানুষ জনগনের সম্পদ দিয়া নিজের আখের গুছাইতেই ব্যস্ত হইয়া পড়ে, সেইহানে এই লোক মানুষেরটা খাইবো কি নিজের যা আছে তাও মানুষরে বিলাইয়া দেয়। এই শহরে এহন আর তেমন ফকির নাই। সবাইরে মেয়র সাব একটা না একটা কাম দিয়া দিসে। কতজনরে যে থাকনের ব্যবস্থাও কইরা দিসে।

তপু ভেবে দেখলো আসলেই মোহনপুরে এক দুইজনের বেশি ভিক্ষুক সে দেখেনি। এমন কি স্টেশনেও ভিক্ষুক তুলনামূলকভাবে একেবারেই কম। অথচ বাংলাদেশের  স্টেশনগুলো হলো ভিক্ষুকদের আসল আখড়া। নাহ, পল্লবের প্রশংসা করতেই হয়। মোহনপুরকে যেন একটি স্বর্গনগরীতে রূপান্তরিত করেছে ও। এমন শহর বাংলাদেশে সত্যি বিরল। ক্ষমতা থাকলে মানুষ কী না করতে পারে। কেবল ইচ্ছে থাকলেই হয়। কিন্তু বাস্তবে একজন ক্ষমতাবান লোকের সব করার ক্ষমতা থাকে, শুধু মানুষের ভাল করার ইচ্ছেটুকু ছাড়া। এই পল্লবই শুধু ব্যতিক্রম।

   একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তপু।  পল্লবের মত কয়েকজন কাণ্ডারীই দেশটাকে এই অমানিশার অন্ধকার থেকে টেনে আলোতে নিয়ে আসতে পারবে। আজ আঁধারে ছেয়ে যাওয়া  এই দেশটার জন্য এক গুচ্ছ পল্লব বড় বেশি প্রয়োজন। এমন সজিব স্নিগ্ধ  ঘন পল্লবে আচ্ছাদিত হতে পারলেই দেশটা একটা নিষ্পাপ নিষ্কলঙ্ক ফুল হয়ে ফুটে উঠতে পারবে একদিন। যে ফুলকে বাঁচাতে গিয়ে এই দেশে একদিন  মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, এক সাগর রক্ত ঝরেছিল  সেই ফুলতো আজ অবধি ফুটতেই পারেনি, মেলতে পারেনি তার পাপড়ি  মানুষ নামক কিছু কীটের বিষাক্ত দংশনে।

----চাচা আপনার পা-টা কীভাবে কাটা পড়লো?
মুহূর্তেই লোকটার মুখ থেকে সেই হাসিটা মিলিয়ে গেলো। লোকটা কোন কথা না বলে আরো বেশি করে ঘাস কাটতে লাগলো।

এই পথেই অফিসে যাতায়াত করে সজল। লোকটার সাথে সেও প্রায়ই কথা বলে। তপুকে লোকটার সাথে কথা বলতে দেখে সে এগিয়ে এসে কথাগুলো শুনছিল। তপু লোকটাকে আর জোর করলো না। হয়তো লোকটা সেই কষ্টের স্মৃতি মনে করতে চায় না। তাই লোকটার কষ্ট আর না বাড়িয়ে পেছন ফিরলো চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। তখনই চোখ পড়লো সজলের উপর। সজল তপুর দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো। সেই হাসির প্রতি উত্তরে তপুও হাসলো। সজলের মনে হলো কিছু একটা বলা দরকার। তাই তপুর সাথে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
----ভাই কি এখানে নতুন?
----জ্বী আজই আসলাম। স্টেশন থেকে নেমে ঐদিকে যাচ্ছিলাম। গন্তব্য কাছেই তাই রিকশা নেইনি। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ লোকটার দিকে নজর গেলো। ভীষণ অবাক হলাম লোকটাকে দেখে। একটা পা নেই । তবু কী সুন্দর তৃপ্তি নিয়ে আপন মনে কাজ করে যাচ্ছে।
----আমিও লোকটার সাথে প্রায়ই কথা বলি। লোকটাকে দেখি আর অন্তর্জ্বালায় দগ্ধ হই। এই খোঁড়া লোকটার মুখে একটা তৃপ্তির হাসি লক্ষ্য করেছেন?
----হ্যাঁ লক্ষ্য করেছি। খুব সুখী একটা মানুষ মনে হয়।
----সেই সুখটা সেই তৃপ্তিটা হলো ভেজালমুক্ত পরিশ্রমের। সে পরিশ্রম করে খুব অল্প কয়েকটা টাকা হয়তো পায়। তবু সেই টাকা পরিশ্রমের টাকা। সেই টাকায় কোন ভেজাল নেই। পাপ নেই। আর এটাই তার তৃপ্তি।
----বাহ দারুণ বললেন তো। কিন্তু অন্তর্দাহ কেন হয় সেটা তো বললেন না।
সজল একটু চুপ করে থেকে বলে,
----আমি যে ঐ লোকটার মত তৃপ্তির হাসি হাসতে পারি না। চাকরি করি। পরিশ্রমও করি। পারিশ্রমিকও পাই। মোটামুটি ভাল অঙ্কের পারিশ্রমিক। কিন্তু সেই টাকা আমার মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটাতে পারে না। বরং এক অপরাধবোধ এক পাপবোধ ছেয়ে ধরে।
----ওহ। আপনি কোথায় চাকরি করেন ভাই?
----তাওফা ফুড প্রোডাক্ট এ।
----কিন্তু তওফা ফুড তো অনেক নামী একটা কোম্পানী। এই প্রোডাক্ট এখন প্রায় সারা দেশেই পাওয়া যায়। জনপ্রিয়তাও দিন দিন বাড়ছে। তাহলে আপনার মনঃকষ্টের কারণ কী?

সজলের হঠাৎ মনে হলো সে আবেগপ্রবণ হয়ে একটা অপরিচিত লোককে অনেক গোপন কথা বলে ফেলেছে। তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিলো ও।
----ভাই আমাকে বাস ধরতে হবে। যাই এবার। আপনার সাথে কথা বলে অনেক ভাল লাগল।
বলেই দ্রুত হাঁটা শুরু করলো সজল। তপুর একটু সময় ভাবলো। এই লোকটা তার কাজে লাগতে পারে। তাই দৌড়ে সে আবার সজলের কাছে চলে এসে বলল,
----আপনার ফোন নাম্বারটা দেয়া যাবে? আর এতক্ষণ কথা বললাম আমরা, অথচ কেউ কারোর নামই জানলাম না।
-----
চলবে

রচনাকাল- ১৮-০৪-২০১৮
©নিভৃতা

সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ৮:০৮
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৩৯

১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷

চলুন গল্পটা শুনে আসি৷

বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে এসো রাফসান দি ছোট ভাই

লিখেছেন আবদুর রব শরীফ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৮

রাফসানের বাবার ঋণ খেলাপির পোস্ট আমিও শেয়ার করেছি । কথা হলো এমন শত ঋণ খেলাপির কথা আমরা জানি না । ভাইরাল হয় না । হয়েছে মূলতো রাফসানের কারণে । কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুমীরের কাছে শিয়ালের আলু ও ধান চাষের গল্প।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৪০



ইহা নিউইয়র্কের ১জন মোটামুটি বড় বাংগালী ব্যবসায়ীর নিজমুখে বলা কাহিনী। আমি উনাকে ঘনিষ্টভাবে জানতাম; উনি ইমোশানেল হয়ে মাঝেমাঝে নিজকে নিয়ে ও নিজের পরিবারকে নিয়ে রূপকথা বলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×