কিছুদিন আগে নস্টালজিতে আক্রান্ত হই আমার বাসার বুয়ার জীবনের একটি গল্প শুনে। স্মৃতিকাতর হয়ে সেই বিটিভি যুগে ফিরে গিয়েছিলাম।
এই বুয়া অনেকদিন ধরেই আমার বাসায় কাজ করছিল। আমি এতদিন জানতাম বুয়ার পাঁচ ছেলেমেয়ে। কিন্তু সেদিন নতুন কথা জানলাম, বুয়ার আসলে ছয় ছেলেমেয়ে। বুয়া তার ছোট মেয়েকে পালক দিয়ে দিয়েছে। কারন জানতে চাইলে বুয়া জানালো ছোট মেয়ের জন্মের সময় সে খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে। এমন কি চলাফেরার সামর্থ্যও ছিল না। এত গুলো ছেলেমেয়ের খরচ, নিজের চিকিৎসার খরচ, তার উপর এই ছোট বাচ্চা সব মিলিয়ে খুবই খারাপ অবস্থা ছিল। তখন এক নিঃসন্তান দম্পতি মেয়েটিকে দত্তক নিতে আগ্রহ প্রকাশ করলে বুয়া মেয়েটিকে দিয়ে দেয়।
ঐ মেয়েটি এখন ক্লাস ফোর এ পড়ে। বুয়ার সামনে দিয়েই আসে যায়। বুয়া মেয়েটিকে দেখতে ঐ বাসায়ও যায় মাঝেমাঝে। কিন্তু মেয়েটিকে বলতে পারে না যে মেয়েটির জন্মদাত্রি মা আসলে সে। মেয়েটির সুন্দর ভবিষ্যতের কথা ভেবেই চুপ করে থাকে।
মাকে না চিনুক। তবু মানুষ হোক মেয়েটি। সে তো কেবল জন্মই দিয়েছে আর তো কিছু নয়। এমনটিই ভাবে বুয়া। কষ্ট হয় খুব। মেয়ের কথা বলতে বলতে চোখে জল চলে আসে তার। আমারো মনটা ভারী হয়ে ওঠে। মনে পড়ে যায় অনেকদিন আগে দেখা বিটিভির একটি খন্ড নাটকের কথা। তখন সপ্তাহে একদিন একটি ধারাবাহিক নাটক প্রচার হত আর একদিন এক পর্বের সাপ্তাহিক নাটক প্রচার হত। মাঝে মাঝে এক পর্বের জায়গায় দুই পর্বের খন্ড নাটক দেখানো হত। অধির আগ্রহে আমরা দিন গুনতাম। যেদিন রাতে নাটক দেখাতো সেদিনটা যেন কিছুতেই কাটতে চাইতো না।
বুয়ার জীবনের গল্প শুনে যে নাটকটির কথা মনে পড়েছিল সেই নাটকটির নাম ছিল কুসুম। বড়লোক বাবার (আবুল হায়াত) একমাত্র আদরের মেয়ে কুসুম (সুবর্ণা মুস্তফা)। হঠাৎই একদিন ঐ বাড়িতে আসে কুসুমের বাবার পরিচিত এক বাউল (শংকর শাওজাল)। বাউলের গান কুসুমের খুব ভাল লাগে। বাউলকেও তার খুব ভাল লেগে যায়। বাউল কুসুমকে তার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যেতে চায়। কুসুমও বাউলের গ্রাম দেখতে চায়। কুসুমের বাবা অনিচ্ছায় মেয়েকে যেতে দেন। কুসুম বাউলের গ্রামে যায়।
বাউলের বউ (ডলি জহুর) ছিল মানসিক ভারসাম্যহীন। বাউলের দুই মেয়ে তাকে দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ে। সবার ভালোবাসার জোয়ারে ভেসে যায় কুসুম। ও ভেবে পায় না ওর জন্য এদের এত ভালবাসার পেছনে কারন কী। তারপর ও জানতে পারলো ওরই মত ওদের এক বোন ছিল যে ছোটবেলায় হারিয়ে গেছে। ঐ বোনটির জন্যই আজ ওদের মা পাগল। কুসুমের খুব মায়া হয় সবার জন্য। আলাদা এক টান অনুভব করে ওদের জন্য। এক সময় কুসুম জানতে পারে বাউলের সেই হারিয়ে যাওয়া মেয়ে আর কেউ নয়, ও নিজেই। দারিদ্রের জ্বালায় বাউল বিক্রি করে দিয়েছিলো ওকে।
নাটকটির শেষে বাবা আবুল হায়াত মেয়েকে নিতে গ্রামে আসেন। বাবাকে দেখে, ছুটে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল কুসুম।
আমার খুব প্রিয় একটি নাটক ছিল এটি। প্রায়ই বিটিভিতে পুনঃপ্রচার করা হত এই নাটক। যতবারই দেখতাম ততবারই চোখে জল চলে আসতো। এই নাটকটির একটি গান ছিল "আমার মনে বড় দুশকো... ও বড় দুশকো আমার মনেরে"।
কিন্তু এই রকম ঘটনা যে বাস্তবেও ঘটতে পারে তা আমার ধারণায় ছিল না। ভাবতাম এসব কেবল গল্প উপন্যাসেই ঘটে। কিন্তু না। বাস্তবেও এমন অদ্ভুত সব ঘটনা আমাদেরই আশেপাশে ঘটে যায়। কি অদ্ভুত অদ্ভুত কষ্ট বুকের মধ্যে চেপে রেখে বেঁচে থাকে একেকটা মানুষ। সেই অদ্ভুত ঘটনার কিছুটা আমরা জানি আর অনেকটাই থেকে যায় অজানা, অদেখা।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ১১:০৭