গতকাল রাহিয়া আফসানকে বলছিল যে কাল রাহিয়ার এঙগেজমেন্ট । রাহিয়ার বাবা নাকি হঠাৎ করে ঠিক করে ফেলেছেন । আফসান কথাটাকে সিরিয়াসলি নেয় নি । ও ভেবেছে সব সময়ের মতই রাহিয়া মজা করছে । তখন আফসান বলেছিল " আচ্ছা , নভোথিয়েটারের সামনে সকাল ১১টায় থেকো , আমি অপেক্ষা করব " । রাহিয়া বলেছিল " পারবনা " । আফসান হাসতে হাসতে জবাব দিয়েছিল " আচ্ছা দেখা যাক " ।
এখন আফসানের ভয় হচ্ছে , সত্যি সত্যিই যদি রাহিয়ার আজ এঙগেজমেন্ট হয়ে যায় ? না হতে পারে না
। এই বিষয়টা ভাবতেও পারে না আফসান । ভাবলেই চারিদিক অন্ধকার হয়ে আসে ।আফসান এখন কি করবে ? রাহিয়াকে কল করা যায় । আফসান ৫ মিনিট চেষ্টা করল । রাহিয়া মোবাইল ধরল না ।এটা দেখে আরো চিন্তিত হয়ে গেলো আফসান । এখন কি আফসানের রাহিয়ার বাসায় যাওয়া উচিত ?
২.
রাহিয়ার বাসায় গিয়ে উপস্থিত হয় আফসান । মিস্টার খান দরজা খুললেন । আফসান কিছু না বলেই ঘরে ঢুকে যায় । খেয়ালই করে নি যে মিস্টার খান দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল । ওর মাথায় তখন শুধু রাহিয়াই ছিল । মিস্টার খান বললেন " কি ব্যাপার ? আপনি কাকে চান ? "
মিস্টার খান রাহিয়ার বাবা । সাবেক ইঞ্জিনিয়ার । অত্যন্ত ঠাণ্ডা মেজাজের মানুষ । সব কিছুকে অতি সাধারণভাবে নিতে পারেন ।
আফসান শুধু বলল , " রাহিয়া কোথায় ? " । রাহিয়ার বাবা অবাক হলেন । তারপর অবাক হওয়া লুকিয়ে সাধারণভাবে বলার চেষ্টা করলে " কেন ? " । আফসান কোন জবাব না দিয়ে "রাহিয়া রাহিয়া" বলে পাগলের মত ঘর নাড়িয়ে চিৎকার করতে লাগল । রাহিয়া রুম থেকে বের হয়ে দৌড়ে আসল । অবাক হয়ে বলল " আফসান তুমি ? " আফসান শুধু রাহিয়ার কাছে গেলো । হাঁটু ভেঙ্গে বসে পড়ল । রাহিয়ার হাত দুটি ধরে বলল , " রাহিয়া আমাকে ছেড়ে যেয়ো না । আমি তোমাকে ছাড়া বাচবনা । হয়তো কখনও তোমাকে দেখাইনি কিন্তু সত্যি বলছি আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি । অনেক ভালবাসি যা তুমি জানো না । আমাদের এতদিনের সম্পর্ক তুমি এভাবে এক নিমিষে ভেঙ্গে দিয়ো না । এভাবে আমাদের স্বপ্নগুলো ভেঙ্গে দিয়ো না। প্লিজ । " বলে শেষ করল আর আফসানের চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল । রাহিয়া আফসানের কথা শুনে কেঁদে ফেলল । তারপর আফসানকে বলল " আমি তো মজা করেছিলাম পাগল । আর তুমি এত্ত সিরিয়াস হয়ে গেছ ? তোমাকে ছাড়া আর কাউকে ভাবা ও যে আমার পক্ষে সম্ভব না তুমি জানো না ? "
দুজন ভুলে গিয়েছিল ওদের ছাড়াও ওই রুমে আরেকজন লোক ছিল । রাহিয়ার বাবা এতক্ষণ নীরব থাকার পর একটু গলা ঝাঁকিয়ে বললেন " রাহিয়া এসব কি হচ্ছে ? " রাহিয়া আর আফসান স্বপ্নের রাজ্য থেকে পৃথিবীতে নেমে আসে । দুজন পাথরের মত নীরব হয়ে যায় । নিঃশব্দ হয়ে যায় পুরো রুম । চারিদিকে শুধু রাহিয়া আর আফসানের ভালবাসা আর রাহিয়ার বাবার প্রশ্ন , " কি হচ্ছে এইসব " ।
৩.
রাহিয়ার মা রাহিয়া যখন ৫ বছর তখন ব্লাড ক্যান্সারে মারা যান । খান সাহেব রাহিয়াকে মায়ের আদর কি বুঝতে দেননি । মায়ের অভাবের সাথে পরিচিত হতে দেন নি । রাহিয়া যা চেয়েছে তাই পেয়েছে । কখনও কোন আবদার অপূর্ণ থাকে নি । রাহিয়ার বাবা রাহিয়াকে পাগলের মত ভালবাসেন আর রাহিয়াও রাহিয়ার বাবাকে অনেক ভালবাসে । কোনোদিন কিছু করে নি যাতে ওর বাবা কষ্ট পাবে । রাহিয়ার কথা চিন্তা করে তিনি আর কোন বিয়ে করেননি। ভেবেছেন রাহিয়ার প্রতি তার অবহেলা হবে ।
রাহিয়া শান্তভাবে আফসান আর রাহিয়ার সম্পর্কের কথা বলে । আরো বলে যে আফসানকে ছাড়া রাহিয়ার বাচা সম্ভব না । সব শুনে কিছুক্ষণ পর মিস্টার খান বলেন " এটাতে আমার কোন আপত্তি নেই । আমি সবসময় চেয়েছি এমন একটি ছেলে যে আমার রাহিয়াকে আমার মত ভালবাসবে এবং দেখাশুনা করে রাখবে । আজ আমি সেই ছেলেকে পেয়েছি । যার চোখে আমি রাহিয়ার জন্য সেই ভালোবাসাটা দেখেছি । আজ আমি নিশ্চিন্ত । বাবা আফসান , এই মেয়েটিকে আমি কখনও কষ্ট দেই নি । আজ তোমার কাছে ওকে দিয়ে দিচ্ছি । শুধু একটা কথাই বলি । রাহিয়াকে সুখে রাখতে না পারলেও কখনও কষ্ট দিয়ো না । " বলে মিস্টার খান আফসানকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন ।
আফসান বলল , " কোন চিন্তা করবেন না আঙ্কেল । নিজে কষ্ট পাব তবু কখনও রাহিয়াকে কষ্ট দিব না , প্রমিস । "
রাহিয়ার বাবা " আঙ্কেল না , বল বাবা । আর তোমার বাবার ফোন নাম্বার দিয়ে যাও । আমি কথা বলব । শুভ কাজে দেরি করতে নেই । "
রাহিয়া লজ্জা পেয়ে রুম ছেড়ে চলে গেলো । আফসান ওর বাসায় গিয়ে সব খুলে বলল । আফসানের বাবা মা ওর সাথে অনেক ফ্রি । বেস্ট ফ্রেন্ডও বলা যায় । সবকিছু শুনে উনারা সব মেনে নিলেন ।কিন্তু সমস্যা হল আগে ভাল করে পড়ালেখা শেষ করতে হবে ।
রাহিয়া আর আফসান এখন নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করে । নিশ্চয়তা পেয়ে যাওয়ার পর প্রেমের গভীরতা বেড়ে যায় অনেক গুনে । প্রেম করতে করতে কেতে গেলো আরো ২টা বছর । দুই বছরে আফসানের পড়ালেখা শেষ হয়ে এলো । আফসানের ফাইনাল রেজাল্ট বের হল । ডিপার্টমেন্টে টপ না করলেও সম্মানজনক রেজাল্ট করল আফসান ।
তো রেজাল্ট পেয়ে বাসায় আসার পর সবাই স্বাভাবিকভাবেই খুব খুশি হল । কিছুক্ষণ পর আফসানের বাবা আফসানকে বারান্দায় একা একা ডেকে নিয়ে বললেন , " দেখ বাবা , তুই ভাল রেজাল্ট করেছিস । পড়ালেখা শেষ । এখন আমার অফিসের কাজটা তুই বুঝে নে । এই বুড়ো বয়সে সকালে উঠে অফিসে যেতে আর ভাল লাগে না । আর আমি ওদিকে রাহিয়ার বাবার সাথে কথা বলি । মেঘে মেঘে বেলা তো অনেক হল । এখন আর দেরি করে লাভ নেই " , বলে আফসানের বাবা অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন । আফসান কি করবে বুঝতে না পেয়ে বলল , " আচ্ছা তাহলে কালকে থেকে আমি অফিসে যাব । আর রাহিয়ার বাবার সাথে কথা বলে নিয়ো । আমার কোন আপত্তি নেই " ।
ওদের পরিবার বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে ফেলে । আর মাত্র ২ সপ্তাহ পরে রাহিয়া আর আফসানের বিয়ে । বাসায় বিয়ে বাড়ির আমেজ । সবাই খুব ব্যস্ত কে কি করবে তা নিয়ে । বাসার সবচেয়ে ছোট মেয়েটা ব্যস্ত নতুন বউকে কি বলে ডাকবে আর সবচেয়ে বড় মহিলা ব্যস্ত নতুন বউ উনাকে কি বলে ডাকবেন তা নিয়ে ।
আফসান রাহিয়াকে ফোন করল । ভাল মন্দ জিজ্ঞাসার পর আফসান বলল , " জানো আমার আর সময় যাচ্ছে না । " । রাহিয়া বলল , " আফসান আমার বিশ্বাস হচ্ছে না আমাদের স্বপ্ন সত্যি হয়ে যাচ্ছে । " আফসান বলল , " রাহিয়া জানো , তোমাকে যেদিন প্রথম ভার্সিটিতে দেখেছিলাম সেদিনই প্রেমে পড়েছিলাম । আমার বন্ধুদের বলেছিলাম , এই মেয়েটাকে যদি আমি জীবনসঙ্গী হিসেবে পেতাম । দেখো আমার স্বপ্ন আর মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই সত্যি হয়ে যাবে । "
রাহিয়া বলল , " আফসান আমি খুব ভাগ্যবতী যে তোমার মত একটা মানুষ পেয়েছি যে আমাকে এত ভালবাসে । আমি তোমাকে কখনও হারাতে চাই না । একটা মুহূর্ত কাটাতে চাই না যেখানে তুমি নেই " , বলে রাহিয়া কেঁদে ফেলল । আফসান বলল , " আরে কথায় কথায় কাঁদ কেন ? আমি কি তোমায় ছেড়ে কোথায় চলে যাচ্ছি নাকি ? আমি তো তোমারই আছি । আর কয়েকদিন পরে তো আর কোথায় যেতেও পারবনা । তুমি তোমার শাড়ির আচল দিয়ে বেঁধে রেখে দিবে " , বলে দুইজনে হেসে উঠল ।
৪.
বিয়ের দিন চলে এলো । আফসান জলদি ঘুম থেকে উঠল । হঠাৎ করে একটা চিঠি এলো আফসানের নামে । আফসান ভাবল এটা কোন টেস্টের রেজাল্ট হবে । কিন্তু খামের উপরে হাসপাতালের নাম লেখা । তখন আফসানের মনে হয় যে কিসের চিঠি । কয়েকদিন আগে থেকে আফসানের খুব মাথা ব্যথা করত । মাথার পিছনের দিকে অনেক ব্যথা করত । রাত এলে ব্যথা বেড়ে যেত অনেক-গুনে । আফসান কাউকে কিছু না বলে নিজে নিজেই ডাক্তারের কাছে চলে গিয়েছিল । ডাক্তার কিছু টেস্ট করিয়ে অন্যান্য ডাক্তারদের মতই সেই চিরন্তন বানী দিয়েছিল , " চিন্তার কিছু নেই " ।
আফসান খাম খুলে চিঠি পড়ল । চিঠি পড়ে কি করবে বুঝতে পারল না । এক মিনিট আগেও ওর পৃথিবী কত সুন্দর ছিল । কত স্বপ্ন ছিল । এই এক মিনিটেই সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেলো । পৃথিবী অন্ধকার হয়ে গেলো । সবকিছু আফসানের কাছে মিথ্যা লাগছে । কিছুই বিশ্বাস হচ্ছে না । চোখের সামনে যা দেখতে পারছে তা হল রাহিয়ার হাসি মুখটা । ওদের ভালবাসার সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে । বাড়িতে এত হইহুল্লোর কিন্তু আফসানের চারপাশ শান্ত । আফসান কি করবে বুঝতে পারছেনা । কিভাবে রাহিয়াকে এত বড় কষ্ট দিবে । যার সাথে কথা না বলে একটা দিন যায় না কিভাবে তাকে ছেড়ে এভাবে চলে যাবে । তবুও রাহিয়ার জীবন থেকে আফসানকে সরে যেতে হবে । নাহলে রাহিয়ার জীবনটাই নষ্ট হয়ে যাবে ।
আফসানের ব্রেইন টিউমার হয়েছে । আফসানের বিশ্বাসই হচ্ছে না । যার বছরে একবার সর্দি,কাশি হয় না তার কিভাবে এত বড় একটা রোগ হয়ে গেলো ? এটাই ভেবে পাচ্ছে না আফসান । কিভাবে এত স্বপ্নগুলো থমকে গেলো । আফসান নিজের রুমে ঢুকে জলদি করে একটা ব্যাগে কিছু কাপড় ঢুকিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়ল । নিজেও জানে না কোথায় যাবে । তবে একটা জিনিস জানে এই দুনিয়া থেকে আর কিছুদিন পর চলে যেতে হবে । রাহিয়াকে আর কোনোদিন দেখতে পারবেনা ভেবে আফসানের চোখে পানি এসে গেলো । সকালের ঠাণ্ডা বাতাসের মাঝে আফসান কাঁধে একটা ব্যাগ নিয়ে রাস্তায় আস্তে আস্তে হেঁটে যাচ্ছে । চোখ দিয়ে অবিরত পানি পরছে ।
৫.
রাহিয়া বসে আছে কনের সাজে । আজ রাহিয়াকে অনেক সুন্দর লাগছে । রাহিয়া ভাবছে আফসানের কথা । ওদের স্বপ্নের কথা । আর কিছুক্ষণ পরই আফসান বরের বেশে আসবে আর রাহিয়াকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে । পূরণ হবে এতদিনের স্বপ্ন । স্বপ্ন পূরণ শেষের দিকে চলে এসেছে । রাহিয়া বসে আছে আফসানের অপেক্ষায় । আফসান বউ বানিয়ে ওকে এসে নিয়ে যাবে । পূরণ হবে ওদের স্বপ্ন ।
____________________________________________________________________________________
লেখকঃ আতিশা রাহবার ।
© atisha rahbar
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা আগস্ট, ২০১১ সকাল ১১:৩৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



