somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কামেহামেহা, মানোয়া পাহাড় এবং আলোহা। পর্ব-৩(গ)।

৩১ শে জুলাই, ২০০৮ রাত ১১:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মোদোমাতাল ও নারীলিপ্সু


(আগের অংশটুকুর জন্য এখান থেকে পড়ে আসতে হবে)


গাড়ী চালানোর সময়ে নাঈম বেশ গম্ভীরই হয়ে থাকলো পুরোটা সময়। আমার বেশ মজাই লাগছিল তাকে দেখে।

নাইটক্লাবটি আসলেই বেশ অভিজাত কিসিমের। ভিতরে ঢোকার সময়েই দেখলাম বেশ অনেককেই দরজা থেকেই ফেরত আসতে হয়েছে কেননা তাদের পোশাক আপ টু দ্য স্ট্যান্ডার্ড ছিলনা। ভাগ্যিস সুজাতের কথামত ভদ্রগোছের পোশাক পরে এসেছিলাম।

ভিতরে ঢূকবার সময়ে বুক ধুকপুক করছিল। কেউ আবার দেখে ফেলবে নাতো? হাজার হোক গায়ে একটা 'ভাল ছেলে'র তকমা ততদিনে উঠেছে। সেটা কি আজ রাতেই উবে যাবে চিরকালের মতো? এই খবর যদি আমার পিতাজীর কাছে যায়, তাহলেই হয়েছে। তিনি যে কি চীজ, সেটা তো আগের সিরিজেই বিস্তারিত লিখেছি। উৎসাহী পাঠকেরা ইতিমধ্যে সেটা জানেন হয়তোবা।

কোন এক অজানা ভয়ে দুলে ওঠে বুক। কি এমন দরকার আমার এই নাইটক্লাবে যাওয়া? ভিতরে যেয়ে কি দেখবো সেই আতংকেই ঠান্ডা মেরে যাই কেমন যেন। পিছন থেকে সুজাত হাল্কা ধাক্কা দেয়।

"চলো। আমাদের পিছনে তো লোক জমে যাচ্ছে।"

ভিতরে ঢোকার সাথে সাথে প্রথমেই দুটো জিনিস নজরে এলো। এক নানান ধরণের আলোর ঝলকানি, আর সেই সাথে প্রচন্ড জোরে মিউজিক বাজছে। এর সাথে লোকজনদের চেঁচামেচি, সাথে সিগারেটের ধোঁয়া, আর কাঁচের গ্লাসের ঠুনঠুন শব্দ।

আস্তে আস্তে চোখ সয়ে এলো। বেশ বড় একটি হলঘর। মাঝখানে ড্যান্স ফ্লোর, সেখানে গানের তালে তালে ছেলে-মেয়েরা জোড়ায় জোড়ায় নাচছে। আর একটু ভাল করে দেখে বুঝলাম যে সেখানে মেয়ে-মেয়েও নাচছে, তবে তাদের সংখ্যা খুবই কম।

সুজাত বললো, " চলো, একপাশে গিয়ে বসি।"
সেইই যেহেতু লীডার, অতএব তাকেই অনুসরন করা ছাড়া আর গতি কি?

নাচের জায়গাটির চারপাশে ছোট ছোট টেবিল-চেয়ার পাতা। একটি টেবিল দখল করে বসলাম আমরা। বাজনার প্রচন্ড আওয়াজে কারো কথাই ভাল শোনা যাচ্ছেনা। বুঝলাম এখানে বেশীক্ষণ থাকলে আমার কানের বারোটা বাজবে।

নাঈম ইতিমধ্যে কিছুটা সহজ হয়ে এসেছে। দু চারটে কথাবার্তাও হচ্ছে আমাদের মধ্যে। বুঝলাম সে মাঝেমধ্যে এখানে আসে।
সুজাত চেঁচিয়ে ওয়েটারকে ডাকলো। ওয়েটার না বলে ওয়েট্রেস বলাই ভাল। কেননা একমাত্র বারের বারম্যান ছাড়া আর তাবত কর্মচারীই মহিলা।
"আমি চাই জ্যাক ড্যানিয়েলস।" সুজাত উঁচু গলায় বলে।
"উনি আবার কে?" আমি জিজ্ঞেস করি।
সুজাত আমার অজ্ঞতায় হাসে। "জ্যাক ড্যানিয়েলস হচ্ছে এক ধরণের হুইস্কি। আমার প্রিয় ব্র্যান্ড। একটু চেখে দেখবে নাকি?"
"নারে ভাই- আমার জন্যে কোকই ভাল।"
"নাঈম-তুমি কি খাবে? কোক না অন্যকিছু?"
"ডায়েট পেপসী।"

মিনিট খানেকের মধ্যেই আমাদের পানীয় এসে গেল। মাঝারী সাইজের গ্লাসের অর্ধেকের বেশীই ছিল বরফ। ওখানে আবার পানীয়ের দাম সাথে সাথেই টিপস সহ চুকিয়ে দেওয়াটাই রীতি। সুজাত দিল সাড়ে চার ডলার, আমার কোকের দাম পড়লো সোয়া তিন ডলার। আমার তো দাম শুনে মাথায় হাত। অর্ধেক গ্লাস কোকের দাম এতো? বাইরের দোকান থেকে কিনলে ওই পয়সায় গ্যালন গ্যালন কোক কেনা যায়। কিন্তু কি আর করা? এসেই যখন পড়েছি, তখন আর নালিশ করেই বা লাভ কি?

সুজাত বললো,"আস্তে আস্তে খাও। গ্লাস শেষ হয়ে গেলেই ওরা এসে আবার ড্রিংক কেনার জন্য ঝুলোঝুলি করবে।"

গ্লাসে আলতো চুমুক দিয়ে এবারে আশেপাশে তাকাই। নাচের ফ্লোরে বাজনা থামলো। নাচিয়েদের কিছু কিছু ফিরে আসছে, আবার নতুন কিছু নাচিয়েরাও এগিয়ে এলো নাচবার জন্যে।

"তুমি নাচো না সুজাত?" আমি জিজ্ঞেস করি।
"নাহ-আমার মেয়েদের কাছে গিয়ে নাচার জন্যে রিকোয়েস্ট করাটা একদম ভাল লাগেনা। তারপর তারা যদি আমাকে ফিরিয়ে দেয়, সেটাও বাজে লাগবে আমার।"
"এটা কোন একটা কথা হোল?" এতক্ষণে নাঈম মুখ খোলে।
"কি কথা?"
"এলাম নাইটক্লাবে। এখানে এসে ড্রিংকও করবোনা, আবার নাচবোও না, তাহলে কি জন্যে এলাম?"
"তুমি কি নাচতে চাও নাকি নাঈম?" আমি জিজ্ঞেস করি।
"আমি তো এলামই সেই জন্যে। তুমিও কি যাবে নাচতে?"
আমার কেন যেন হাসি পেল। হাসতে হাসতেই বললাম,"নারে ভাই-তুমিই যাও। আমি আর সুজাত বরং কথা বলি।"

নাঈম মুহুর্তের মধ্যে উধাও হোল লোকজনদের ভিতর। মিনিট খানেক পর দু পাশে দুই ললনাকে নিয়ে তার আবির্ভাব ঘটলো নাচের আসরে। আমি অবাক হ'লাম। ছোকরার তো এলেম আছে দেখছি।

সুজাত আর আমি বসে অল্প অল্প চুমুকে পানীয় খাই। কথা বলি টুকটাক। চারপাশের প্রচন্ড আওয়াজে কথোপকথন চালানো খুব মুশকিল। আশপাশের মানুষ দেখি। খেয়াল করি যে কেমন ভাবে একদম অপরিচিত একজোড়া মানুষ হাত ধরাধরি করে নাচতে চলে যাচ্ছে। এ্যালকোহলই কি এর কারণ? শুনেছি এ্যালকোহল আমাদের ভিতরের অনুশাসনটিকে কমিয়ে দেয়। অনেক সময় তাই মানুষ একটু টিপসী হলে সত্যি কথা বলা শুরু করে।

সুজাত আমার চেয়ে দ্রুত গতিতে তার গ্লাস শেষ করছে। ব্যাটাচ্ছেলের নার্ভ আসলেই শক্ত। সে দিব্যি স্বাভাবিক রয়েছে। আশ্চর্য্য-কি ভয়ানক রক্ষণশীল পরিবারের মধ্যে বেড়ে ওঠা এই মানুষটি কি অবলীলায় বসে গ্লাসের পর গ্লাস হার্ড লিকার নামিয়ে দিচ্ছে। তার চোখের পাতাও কাঁপছে না, গলার স্বরটিও স্বাভাবিক, কথাও বলছে নির্বিকার ভাবে।

নাচের ফ্লোরে এখন একটি ঢিমেতালের গান বাজছে। তার মানে এখনকার নাচটি হবে একটু অন্তরংগ ভাবে। নাঈমের দুই সংগীনির একজন উধাও। অন্যজন নাঈমের গায়ের সাথে লেপটে রয়েছে যেন। তার মাথাটি নামিয়ে দিয়েছে নাঈমের ঘাড়ে। নাঈমের হাত মেয়েটির কোমর জড়িয়ে ধরেছে।

হঠাৎ আমার মনে হয় চারপাশের এইযে উদ্দামতা, এই যে জীবনকে শুষে নেবার প্রচেষ্টা, এটাই বোধকরি পশ্চিমাজীবনের সারমর্ম। আজকেই যা পারো, উপভোগ করে নাও। কালকের কথা কালকে ভাবা যাবে। কে এই মেয়েটি যে নাঈমের সাথে এতোখানি অন্তরংগভাবে নাচছে? সে কি জানে যে নাঈম কে? নাঈম কি জানে যে মেয়েটি কে? এই পরিবেশ বলে, জানার দরকারটাই বা কি? তুমি কে তা জেনে আমার কি লাভ? তোমারও নাচতে ইচ্ছে করছে , আমারও নাচতে ইচ্ছে করছে, এইটুকু জানাই যথেষ্ট। কালকে তুমিও থাকবেনা, আমিও থাকবোনা। লেটস্‌ হ্যাভ আ গুড টাইম টুনাইট!

সুজাতও নাঈমের দিকে তাকিয়ে ছিল। "হি রিয়েলী লাইকস্‌ গার্লস।"
"এ্যান্ড গার্লস লাইক হিম।" আমি গলা মেলাই।

সেই রাতে আমরা ওখানে ঘন্টাখানেকের মতো ছিলাম। আমার কাছে নাইটক্লাব জিনিসটি খুব বোরিং মনে হচ্ছিল। মদ্যপান করলে বা নাচানাচি করলে হয়তোবা ভাল লাগতো। সুজাতের কাছেও ওখানে বসে থাকতে আর ভাল লাগছিলনা, কেননা আমরা কথাবার্তা একদমই বলতে পারছিলাম না বিকট শব্দের জন্যে।
এখান থেকে চলে যাবো তো ঠিকই, কিন্তু যাবো কিভাবে? এসেছি তো নাঈমের গাড়ীতে করে।
সুজাত গিয়ে নাচের ফ্লোর থেকে তাকে ডেকে নিয়ে এলো।
"ইউ গাইজ আর লীভীং?"
"ইয়েস।"
"ওকে-বাই।"
"আরে শালা-বাই মানে কি? তোমাকেও যেতে হবে।"

নাঈম গাঁইগুই করে। "আমি এখন যাবোনা। তোমরা বাস-টাস কিছু একটা ধরে ঘরে ফেরার বন্দোবস্ত করো।"
"এখন বাস-টাস কিচ্ছু নেই। তোমাকেই আমাদেরকে নামিয়ে দিয়ে আসতে হবে।"
"ওহ-কাম অন! লিন্ডার সাথে কেবল একটু জমে উঠেছে, এখন আমি যেতে পারবো না।"
"জমা-জমি পরে হবে। আগে আমাদের নামিয়ে দিয়ে আসতে হবে।"

আরো মিনিট পাঁচেক তুমুল বাহাসের পরে বেচারা নাঈমকে অবশেষে লিন্ডার সংগ ছেড়ে আসতে হয়েছিল। গোটা পথ সে আমাদের সাথে কোন কথা বলেনি। আমার ধারণা যে আমাদের নামিয়ে দিয়ে সে আবার নাইট ক্লাবটিতে ফিরে গিয়েছিল।

ঘটনাটির পর সুজাতের মুখে শুনেছি যে মাঝে মাঝে নাঈম সাহেব একটু একাকিত্বে ভোগেন এবং সে কারণে নারীসংগ পাবার উদ্দেশ্যে তিনি নাইটক্লাবে গমন করেন। যাকগে- আমার কি? তবে এর পর থেকে সে আর আমাকে কোনদিন মসজিদ নিয়ে ঘাঁটায়নি।

আমার নাইটক্লাব অভিজ্ঞতার ইতি হয়েছিল সে রাতেই। যে মানুষ নাচানাচি বা মদ্যপান করেনা তার কাছে এমন জায়গা জেলখানার মতোই দুর্বিসহ।

বছর খানেক পর পড়াশুনা শেষ করে নাঈম হাওয়াই ছেড়ে চলে যায়। তার সাথে আর কোনদিন আমার আর দেখা হয়নি।

সুজাতও তার পিএইচডি শেষ করে ফেলে আমার প্রায় বছর দেড়েক আগে। সে চলে যায় মিশিগানে একটি পোস্ট-ডক্টোরাল ফেলোশিপ নিয়ে। যাবার আগে আমাদের দুজনেরই চোখ ছলোছলো।

"গুডবাই, হয়তো আর কোনদিন দেখা হবে না। ভাল থেকো।"

তখনো আমি জানতাম না যে সে দেখাই আমাদের শেষ দেখা ছিলনা।

(বাকী অংশ পরের পর্বে)
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই আগস্ট, ২০০৮ রাত ১০:০৬
৯টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্যাড গাই গুড গাই

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১১ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

নেগোশিয়েশনে একটা কৌশল আছে৷ ব্যাড গাই, গুড গাই৷ বিষয়টা কী বিস্তারিত বুঝিয়ে বলছি৷ ধরুন, কোন একজন আসামীকে পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়েছে৷ পারিপার্শ্বিক অবস্থায় বুঝা যায় তার কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

টান

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১১ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:২২


কোথাও স্ব‌স্তি নেই আর
বিচ্যুতি ঠেকা‌তে ছু‌টির পাহাড়
দিগন্ত অদূর, ছ‌বি আঁকা মেঘ
হঠাৎ মৃদু হাওয়া বা‌ড়ে গ‌তি‌বেগ
ভাবনা‌দের ঘুরপাক শূণ্যতা তোমার..
কোথাও স্ব‌স্তি নেই আর।
:(
হাঁটুজ‌লে ঢেউ এ‌সে ভাসাইল বুক
সদ্যযাত্রা দম্প‌তি... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বল্প আয়ের লক্ষ্যে যে স্কিলগুলো জরুরী

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ১১ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৯

স্বল্প আয়ের লক্ষ্যে যে স্কিলগুলো জরুরীঃ


১। নিজের সিভি নিজে লেখা শিখবেন। প্রয়োজন অনুযায়ী কাস্টোমাইজ করার অভ্যাস থাকতে হবে। কম্পিউটারের দোকান থেকে সিভি বানাবেন না। তবে চাইলে, প্রফেশনাল সিভি মেকারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহনা বলেছিল, তুমি হারাবে না

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ১১ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৫

অহনা বলেছিল, তুমি হারাবে না
অহনা বলেছিল, আমি জানি আমি তোমাকে পেয়েছি সবখানি
আমি তাই নিশ্চিন্তে হারিয়ে যাই যখন যেখানে খুশি

অহনা বলেছিল, যতটা উদাসীন আমাকে দেখো, তার চেয়ে
বহুগুণ উদাসীন আমি
তোমাকে পাওয়ার জন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিয়াল ফিলিস্তিনীরা লেজ গুটিয়ে রাফা থেকে পালাচ্ছে কেন?

লিখেছেন সোনাগাজী, ১১ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১০



যখন সারা বিশ্বের মানুষ ফিলিস্তিনীদের পক্ষে ফেটে পড়েছে, যখন জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে সাধারণ সদস্য করার জন্য ভোট নিয়েছে, যখন আমেরিকা বলছে যে, ইসরায়েল সাধারণ ফিলিস্তিনীদের হত্যা করার জন্য আমেরিকান-যুদ্ধাস্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

×