২০০৭ সালে ভার্সিটি লাইফ শুরু। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। কেউ জিজ্ঞেস করলে এই বিশাল নাম একটানে বলতে গেলে গলা শুকিয়ে যেত। এখনও যায়। বলা শেষ হলে বুঝতাম বেশীরভাগই নাম শো্নেনি এটার। কেউ বলত ‘হুম’, কেউ তাকিয়ে থাকত। এরপর মিনমিন করে বলত, ‘ইয়ে- এটা কি, কোথায় যেন?’। আবার নোয়াখালী নাম নিয়ে যাদের এলার্জি আছে তারা দ্রুত মাথা নেড়ে বলত- ‘ও আচ্ছা,আচ্ছা। বুঝছি।’ প্রথমদিকের স্টুডেন্টদের মধ্যে এই নাম নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েনি এমন কেউ নাই সম্ভবত। সঙ্গত কারণও ছিল অবশ্য। একেতো মফস্বল এলাকা। তার উপর একেবারে চরাঞ্চলে নতুন একটা বিশ্ববিদ্যালয়। যেখানে আশেপাশের গ্রামে তখনো কারেন্ট আসেনি। এই ছিল অবস্থা। কেবল দ্বিতীয় ব্যাচ ঢুকল। হল বলতে তখনও কেবল দুটো। ছেলেদের একটা । মেয়েদের একটা। তাও অসম্পূর্ণ। সবার জায়গা হয়না। নতুন ব্যাচের কিছু ছেলেকে তখন শিক্ষকদের জন্য বানানো ডরমিটরীতে অস্থায়ীভাবে রাখা হল। বাকিদের ব্যবস্থা করা হল পাঁচতলা একাডেমিক ভবনের পঞ্চম তলায়। নিচে বাকি চার ফ্লোরে চার ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্টদের ক্লাশ। তো জুলাই মাসের কোন এক বিকেলে মালপএ নিয়ে সেই হলরূপী একাডেমিক ভবনে উঠি। এক ফ্লোরে সব ছেলেপেলে। বাকিরা আরো কয়েকদিন আগেই এসেছে। আমার আসতে দেরী হয় কিছুদিন। হল জীবনের প্রথমদিন। একটু নার্ভাস। কলেজ লাইফের বন্ধু পরাগ হেল্প করল সাথে আনা জিনিসপএগুলো নিয়ে উঠতে। ওর সীট ডরমিটরীতে। বলা বাহুল্য প্রতি ডিপার্টমেন্টের মেধাতালিকার প্রথমদিকের ছেলেদের সীট ছিল ডর্মে আর আমার মত পিছের সারির গুলোর ঠাঁই ওই পাঁচতলায়। আমরা একটা হলরুমের মত জায়গায় ঢুকলাম। একগাদা ছেলেপেলে সেখানে। কেউ আড্ডা দিচ্ছে। কেউ সিগারেট টানছে। কেউ ফোনে কথা বলছে। নতুন কেউ আসছে কারো কোন মাথাব্যথা নাই। আমার জন্য বরাদ্দ সীটটায় কয়েকজন মিলে তাস খেলছিল। এক মূহুর্তে মনে হল- ঠিক জায়গায় আসছি তো! তাস খেলারত একজনকে জিজ্ঞেস করলাম সীটটা আসলেই আমার কিনা। সে প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘ধুর ভাই। একটু পরে আইতি।’ বাকিরা আমার দিকে একনজর দেখে বেড ছেড়ে পাশের বেডে গিয়ে আবার তাস নিয়ে মজে গেল। দু-একজন আড়চোখে দেখার চেষ্টা করছিল কি করছি আমি। ফ্রেশ হতে বাথরুমে গেলাম। গায়ে-মাথায় সাবান মেখে অর্ধনগ্ন একজন অকথ্য একটা গালি দিয়ে বলল, ‘শালার চুল আমার সব দুইদিনেই যাবে।’ কথার পিছের ব্যাপারটা বুঝলাম একটু পরে। পানি প্রচন্ড লবণাক্ত। ফিরে এসে কিছুক্ষন শুয়ে থাকলাম। ভাগ্যক্রমে তাস পার্টি খেলা শেষ করেছে এর মধ্যে। যাবার আগে মোবাইল ফোন চার্জে দিয়ে গেছিলাম। এসে দেখি সেটা খুলে আরেকজন তার মোবাইলে চার্জ দিচ্ছে। তাকিয়ে কিছু বলার আগে একজন বললো ‘এই,এই খুলিস না। আমার ফোনে চার্জ নাই। কিছুক্ষণ থাক।’ তাকিয়ে দেখি কালোমত মাঝারী গড়নের এক ছেলে। মুখ ভর্তি বসন্তের দাগ। ফ্রেঞ্চকাট দাঁড়ি রাখার চেষ্টা করেছে। এলাকার বড়ভাইদের ডানহাত বলে যে কিছু ছেলে থাকে সেরকম মনে হল অনেকটা। হাত মিলানোর পর বললো, ‘তা তুই কি কিছু আনছিস আমাদের জন্য? দেখি। খাবার-দাবার কি আছে বের কর।’ আমি তড়িঘড়ি করে বাসা থেকে নিয়ে আসা টোস্ট বিস্কুটের প্যাকেটটা হাতে দিলাম। বলল, ‘মামা আজকে প্রথম, না?’
হুম।
আমি এপ্লাইডে (এপ্লাইড কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট), তুই?
ফার্মেসী।
রাতে ফ্রি আছিস? আজকে বার্থডে পার্টি আছে একজনের। থাকিস। পরিচিত হতে পারবি সবার সাথে। আর ইয়ে, বিড়ি-টিড়ি খাস?
না।
ও। (শুনে আশাহত হল মনে হল) আচ্ছা থাক তাইলে-বলেই চলে গেল।
২-৩ সেকেন্ড পর কি মনে করে ফিরে এসে দাঁত বের করে বললো, ‘ওয়েলকাম টু এনএসটিইউ।’ কথার ধরণ এবং হাসি দুই-ই বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিল।
সন্ধায় ঘুমালাম কিছুক্ষণ। পরাগের ফোনে ঘুম ভাঙলো। এরপর ওকে নিয়ে হাঁটতে বের হলাম। ভার্সিটির সীমানা ঘেঁষে কিছু টং দোকানের মত গড়ে উঠেছে দেখলাম। ব্যাটারী দিয়ে আলো জ্বালিয়ে চলছে। টিভিতে বিটিভির অনুষ্ঠান। আমরা হলের দিকে ফিরতেই কারেন্ট চলে গেল। দেখলাম পুরো এলাকায় এক অবিশ্বাস্যরকম নিস্তব্ধতা। পরাগ এই কয়দিনে তার অভিজ্ঞতায় যা বললো তাতে মনে হল এখানে স্বাধীনতা যু্দ্ধের আগের সময়ের মত অবস্থা। পানি খারাপ। মাটি দিয়ে হাঁটতে গেলে পা ঢুকে যায় বালিতে। থাকার জায়গা কোনরকম। বড় দোকানপাট নাই আশেপাশে। খাবারের মান নড়বড়ে। সবচেয়ে বড় সমস্যা মোবাইলের নেটওয়ার্ক ওঠানামা করে। একটা বাদে বাকিগুলো নাই বললেই চলে। আর কারেন্ট গেলে পুরো এলাকা ভূতুড়ে। এরপর তার রুমমেট এবং হলের ছেলেপেলে কে কেমন সেটা বলল। সবই হতাশার গল্প। অবশ্য এরপর যা বললো তাকে এই মরুভুমির বুকে একবিন্দু জলের মত মনে হলো। ভার্সিটিতে সুন্দরীর সংখ্যা নেহায়েত কম না। সময় কেটে যাবে। নিজের রুমে ফিরে যাবার আগে চাঁদের আলোয় প্রশাসনিক ভবনের সামনে বলা তার সেই কথা মনে আছে আজো। ‘মামা চলেই আসলা তাহলে এনএসটিইউ-তে।ওয়েলকাম!
পাঁচতলায় হলে ফিরে দেখি ফ্লোরে ছেলেপেলে কম। রুমে গিয়ে একজনের সাথে পরিচয় হল। বললো ফিশারীজে পড়ে। একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিল ছেলেটা। বললো এই ফ্লোরে আমরা সবাই ব্যাচমেট। কোন সিনিয়র নাই। ঠান্ডা গলায় হাসি হাসি মুখে কথা বলা রাশেদকে দেখে জড়তা একটু কমলো। বললো কারেন্ট নাই, সবাই ছাদে। এরপর ছাদে গেলাম ওর সাথে । দেখি সাউন্ডবক্সের মত কিছু একটাতে বিকট শব্দে হিন্দি গান বাজছে “দিল দে দিয়া হে...।” গানের তালে তালে চাঁদের আলোয় খালি গায়ে শুকনোমতন কেউ একজন নাচার চেষ্টা করছে। বাকিরা মুগ্ধ দর্শক। কেউ লুটোপুটি খাচ্ছে মাটিতে। এক মুহূর্তে মনে হল দুনিয়ায় কোন দুঃখ নাই, কোন হতাশা নাই। ছাদে প্রত্যেকের মুখে হাসি। নাচ-গানের আসর থামলো কারেন্ট চলে আসাতে। কিছুক্ষনের মাঝেই শুরু হল সেই বার্থডে পার্টি। লম্বা নাদুস-নুদুস এক ছেলে যাকে বিকেলে আসার পর দেখেছিলাম তাস পার্টির সাথে। তার জন্মদিন। খালি গায়ে থ্রি-কোয়ার্টার পরে সবার মাঝে বসে আছে। চতুর্দিক থেকে আসা আনসেন্সরড্ কথার ফুলঝুড়ি চলছে তাকে ঘিরে। এর মাঝে বার্থডে বয় কি যেন বলার চেষ্টা করছে একটু পর পর। বুঝলাম না যদিও কিছু। আমার অবস্থা দেখে একজন মুচকি হেসে বলল, ‘ও এভাবেই কথা বলে।’ বারোটা বাজলো। উইশ করতে গিয়ে নাম জানলাম ‘বাবু’। এতক্ষণ যেটা আমি ভেবেছিলাম “বাইব্বা’’। সবাই এই নামেই ডাকছিল। বাইব্বা সবাইকে কেক খাওয়াল। পার্টি শেষে কেন যেন মনে হল কেকের অর্ধেক-ই তার গায়ে মাখানো। রাতে ঘুমানোর সময় আবিষ্কার করলাম বালিশ নাই। পাশের বেডে সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন বালিশ নিয়ে গভীরঘুমে তলিয়ে আছে। তার পায়ের কাছে পড়ে থাকা ছোট কোলবালিশের মত কিছু একটা নিয়ে শুয়ে পড়লাম। এবার নিজেই নিজেকে একবার বললাম ‘ওয়েলকাম টু এনএসটিইউ’ ।
(চলবে)
পাদটীকা:
২০০৭ থেকে ২০১৭…দশ বছর! সময় কিভাবে গেছে টের পাইনি। গতকাল রাতে ঘুমো্বার আগে হঠাৎ মনে হল এভাবে টের না পেতে পেতে আরো অনেক সময় চলে যাবে। কিন্ত অনেককিছু যে বলার ছিল! সময় শেষ হয়ে গেলে যদি না বলা থেকে যায়! আশঙ্কা থেকেই হুট করে লিখা শুরু। এলো্মেলো্ভাবেই। প্রথমে মনে হল আরো ভেবে লিখতে বসলে ভাল হত। পরে ভাবলাম জীবনের ধরণই তো হচ্ছে এলোমেলো চলা। এলোমেলো কোনকিছুকে গোছালোভাবে লিখব, মানে হয় না!
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০১৭ সকাল ১০:০২