somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হ্যালোইন গাঁথা (ব্ল্যাক ডায়মন্ড)

২৯ শে নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ৮:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


কিছুদিন আগে হ্যালোইন ডে পার হল। রাতে বের হয়েছি ঘুরতে। পরেরদিন ‘‘আলেরহাইলিগেন‘‘ (Allerheiligen) বা All Saints' Day-র ছুটি। কাজেই রাত জাগতে কিংবা ঘুরে বেড়াতে বাধা নেই। রঙ-বেরঙের মুখোশ পরা মানুষজন সব ভূত-প্রেত সেজে বের হযেছে। শিশু, ছেলে, বুড়ো সবাই। সপরিবারেও বের হয়েছে অনেক ভূত। আজ রাতটা ওরা রাস্তায় রাস্তায় ঘু্রে বেড়াবে। বাসে উঠতেই দেখলাম গাড়ি চালাচ্ছে এক মধ্যবয়সী ওয়্যার উলফ। যদিও প্রথমে খেয়াল করিনি। টিকেট না দেখিয়ে উঠে যাচ্ছিলাম। থামিয়ে দিলো। আমি দেখালাম টিকেট, সে দেখাল চেহারা। শেষের হাসিটুকুতে পিলে চমকে গেল!

মনে পড়ল প্রথম হ্যালোইন ডে’র কথা। সেদিন সন্ধ্যায় বাসায় ফিরছি। আমি গোবেচারা বাঙ্গlলী। জীবনের ঘানি টেনে কূল পাইনা আর এসব দিবস-টিবসের কথা কি মনে রাখব! বাসস্টপে দেখি মায়াকাড়া চেহারার এক পিচ্চি ভূত বসে আছে। সাথে শাকচুন্নির সাজে মা। পিচ্চি ভূত খুব গম্ভীর ভঙ্গিতে আমাকে কি যেন জিজ্ঞেস করলো। তখনও জার্মান বুঝিনা তেমন। সম্ববত আমার সাজ বা মুখোশ কই বা এমন কিছু। কিছু না বুঝে বাচ্চা ভূতের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসার চেষ্টা করলাম। দেখলাম শাকচুন্নির মুখেও ভদ্রতার হাসি। যেটা তখনও বুঝিনি সেটা হল শাকচুন্নির পাশেই বশে ছিল নেকড়ের বেশধারী আরেকজন। তার দিকেও তাকিয়ে ভদ্রতার হাসি দিলাম। ভদ্রতাকে অনেকে দূর্বলতা মনে করে এই বাণীকে অমোঘ প্রমাণ করে শাকচুন্নির পাশের নেকড়ে সাজের ‘ভদ্রলোক‘ গগনবিদারী আওয়াজ তুলে ঘেউ ঘেউ করে উঠল। হৃদপিন্ডটা বুকের খাঁচাছাড়া হবার যোগাড় তখন। বিদেশের মাটিতে এমনিতেই ক্রমাগত ‘শিক্ষা‘-র উপর ছিলাম। সেদিনও শিখলাম- মানুষেরই শুধু হ্যালোইন হবে, তা কেন, প্রানীরা কি দোষ করেছে? যাহোক, এরপর থেকে হ্যালোইনের পোশাকে কাউকে দেখলে আগে চেষ্টা করি ভালোমত দেখার- সেটা মানুষের ভূত নাকি অন্য কিছুর। তো দ্বিতীয় বছর এরকম আবারো হ্যালোইন ডে-তে আফ্রিকান বন্ধু নামডি-কে জিজ্ঞেশ করলাম তার প্লান কি। নামডি এক গাল হেসে বলল, ‘আমি রাতে বের হয়ে এভাবে হাসলে এমনিতেই কি তুমি ভয় পাবেনা?‘ দৃশ্যটা কল্পনা করে নিশ্চয়ই আমার মুখ শুকনো দেখাচ্ছিল। তা দেখে অট্টহাসিতে নামডি চমকে দিল। ওই রাতে সে বের হয়েছিল কিনা তা অবশ্য আর জানা হয়নি। তবে নামডির বলা কথাটা আমাকে নিয়ে গেছিল অনেকদিন আগের পুরোনো কিছু স্মৃতিতে। স্মৃতি মানেই তো মাতৃভূমি! সেই ছেলেবেলা থেকেই নামডির মত গায়ের রঙের অনেককেই আমরা হাসি তামাশাচ্ছলে ভূত, কালা, পাতিল সহ নানা বিশেষণে ডাকতাম। আশেপাশে যাদেরই গায়ের রঙ একটু ময়লা কিংবা অনুজ্জল ছিল তারাই সেসব বুলিংয়ের শিকার হত। এদের উপর নাকি জ্বীন-ভূতের আছর আছে এমনটাও শুনতে হত গ্রামে গেলে। এই ছেলে-মেয়েদের রীতিমত ক্ষ্যাপান হত নাম ধরে। বড়রা তাকিয়ে তামাশা দেখতেন। আমাদের ইভ টিজিংয়ের হাতেখড়ি মনে হয় সেখান থেকেই হয়। কালাম নামের এক বন্ধুকে আমাদের পুরো স্কুলের সবাই চিনতো শুধুমাত্র তার গায়ের রঙের কারণে। নামের শেষে ‘ম‘-টা বাদ দিয়ে সবাই আদর করে ডাকতো ‘কালা‘। কালামও সেটা মেনে নিয়েছিল অনেকটাই হাসি মুখে। না মেনে উপায় আছে! নিজের বন্ধু, সহপাঠীরা তো দূরের কথা যখন দেখতো ক্লাশে রোলকলের সময় শিক্ষকও ডাকছে কালা নামে তখন কি আর করবে সে। বরং কেউ জিজ্ঞেস করলে নিজের নামটা কালা-ই বলতো সে। অনেকেতো এটাও বলত যে কালার বাবা মা-ও নাকি নিজেদের পরিচয় দিত ‘কালা-র মা‘ কিংবা ‘কালার বাপ‘ বলে।



তো কালামদের গায়ের কালার কিংবা গাত্রবর্ণ নিয়ে গাত্রদাহ অবশ্য আমাদের সমাজ-সংস্কৃতিরই একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেই বহু আগে থেকেই কৃষ্ণবর্ণ নিয়ে বহু সাহিত্য, উপাখ্যান আছে। কৃষ্ণবর্ণী কাউকে নায়িকা কিংবা প্রধান চরিত্র করা হত না সচরাচর। বিয়ের বাজারে কালো মেয়েদের কদর কখনোই ছিলনা বলা যায়। সেই মেয়েদের বাবারা অনেক দুঃখী হত। সেখান থেকেই কি ‘‘কন্যাদায়গ্রস্থ পিতা‘‘ কথাটি এসেছে কি-না কে জানে! ভাষা কিংবা ইতিহাসবিদরা ভাল বলতে পারবেন। তবে এটা নিশ্চয়ই অনেকে মানবেন যে আমাদের সমাজে একটি কালো ছেলের চেয়ে একটি কালো মেয়ের দূর্ভোগ আর গঞ্জনা অনেক বেশি। এখনকার আধুনিক সমাজে সরাসরি না বললেও আকারে-ইঙ্গিতে তাদের বুঝিয়ে দেয়া হয় যে- তুমি অনেক পেশার জন্য যোগ্য নও তোমার গাত্রবর্ণের কারণে। এবং এই ‘সেন্টিমেন্ট‘-কেই কাজে লাগিয়ে যুগের পর যুগ ধরে ব্যবসা করে যাচ্ছে ত্বক ফর্সাকারী ক্রীম বা প্রসাধনী প্রস্তুতকারক সব কোম্পানীগুলো। এখনও করে যাচ্ছে। সাথে আছে তাদের সেই চটকদার বিজ্ঞাপণ গুলো। ক্রীম মেখে এক সপ্তাহের মধ্যে চাকরী পেয়ে যাওয়া কিংবা প্রমোশন বাগিয়ে নেয়া এসবইতো সেই প্রচারণার-ই অংশ। শুনতে অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি- জীবনের প্রথম চাকরীর ইন্টারভিউগুলোতে আমি আমার বন্ধুমহলেই অনেক ছেলেকে দেখেছি এসব রঙ ফর্সাকারী ক্রীম মেখে যেতে। বান্ধবীদের ক্ষেত্রে কি হত তা নিশ্চয়ই অনুমেয় এখান থেকে। এক সহপাঠীনিকে কৌতূহলবশত একদিন জিজ্ঞেশ করতেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো, ‘একটু সেজেগুজে না থাকলে, চেহারা একটু উজ্জ্বল করে না আসলে তো তোরাই ‘কালো‘, ‘ব্ল্যাক ডায়মন্ড‘ বলে টিটকারী করিস সামনে-পিছে। আবার সেজেগুজে আসলে বলিস চেহারার কারণে চাকরি পেয়েছে, স্যারদের থেকে বেশি মার্কস বাগিয়েছে। আমরা যাব কই তাহলে??‘ বেচারীর ওই প্রশ্নের কোন উত্তর সেদিন দিতে পারিনি; আজও পারছিনা।
নিজের মুখোশ এভাবে উম্মোচন করে দিলে আসলেই কি কিছু বলার থাকে!

তবে একথা নিশ্চয়ই কারও অজানা নয় যে সাদা-কালোর এই বৈষম্য শুধু যে আমাদের সমাজেই ছিল কিংবা আছে তা কিন্তু নয়। এই বৈষম্য ছিল যুগে যুগে, দেশে-দেশে। আমেরিকা থেকে আফ্রিকা সবখানেই। চলুন এটা শুনে আমরা এখন নতুন উদ্যমে ‘কালা‘-দের পিছে ঝাঁপিয়ে পড়ি, লম্বা করি তাদের দীর্ঘশ্বাসের সারি। সে দীর্ঘশ্বাস হয়তো নীরবে অভিসম্পাত হবে একদিন, ঝরবে সমাজ আর সমাজের তথাকথিত ‘সাদা‘-দের উপর। জিম্বাবুয়ের সাবেক স্বৈরশাসক রবার্ট মুগাবে সাদা-দের নামে বিষোদ্গার করতেন সুযোগ পেলেই। এমনও বলেছিলেন, ‘‘সাদা কাউকে তুমি তখনি কেবল বিশ্বাস করবে যখন সে মৃত।‘‘ যদিও তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় উক্তিটি সম্ভবত- "I don't care, so long as my toilet seat is white and I'm still using the white toilet paper... I'm still fine. "

হ্যালোইন দিয়ে শুরু করেছিলাম হ্যালোইন দিয়েই শেষ করি। সাবওয়ে স্টেশনে এরকম এক হ্যালোইনের রাতে এক পাড় মাতাল ভূত জিজ্ঞেস করছিল আমার কাছে কিছু খুচরো পয়সা আছে কিনা। এরকম কেউ চাইলে সচরাচর দেই না তবে সেদিন কি মনে করে যেন দিয়েছিলাম। পয়সা পেয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কি-হে তোমার হ্যালোইন মুখোশ কই? টিপ্পনী কেটে বললাম, ‘মুখোশ কেনার মত পয়সা নাই।‘ সে বলল, ‘শোন, এক হিসেবে ভালই করেছো। যওসব ভং! ভাবোতো- সবার মনের আসল চেহারাটাই যদি তার মুখে স্থায়ী হয়ে যেত কেউ কি তবে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারতো?‘

হ্যাপী হ্যালোইন!
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ৮:৪৩
৩টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মামুনুলের মুক্তির খবরে কাল বৃষ্টি নেমেছিল

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৯


হেফাজত নেতা মামুনুল হক কারামুক্ত হওয়ায় তার অনুসারীদের মধ্যে খুশির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ তো বলল, তার মুক্তির খবরে কাল রাতে বৃষ্টি নেমেছিল। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ায় আজ গাজীপুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×