তখন আমরা থাকতাম পল্লবী সাড়ে এগারোতে। সেইসময় অল্প কিছু বাড়ী ছিলো, বেশীরভাগ জায়গা ছিলো ফাঁকা। একতলা, দ্বিতলার বেশী উঁচু বাসা ছিলোনা। আমার বয়স তখন পাঁচ কি ছয় হবে। সবেমাত্র স্কুলে ভর্তি হয়েছি। তখনকার দিনে পড়াশুনার এত চাপ ছিলো না। সারাদিন প্রতিবেশী বন্ধু/বান্ধবীদের সাথে খেলে বেড়াই।
ডিসেম্বর মাস, পরীক্ষার পর স্কুল ছুটি। আমরা দুই ভাইবোন সকালের নাস্তা করে বের হয়েছি দুই বাসা পরে নাজমাদের বাসায় খেলতে। নাজমা আমাদের থেকে কিছুটা বড় ছিল।
আমার ছোট ভাই আর আমি পিঠাপিঠি। দুইজন সবসময় একসাথে খেলাধুলা করি আবার ঠোকাঠুকিও। ও ছিল বেশ চঞ্চল আর দুস্ট প্রকৃতির। অনেক শখ করে আমি একটা লাল রং এর ছোট্ট পার্স ব্যাগ কিনেছিলাম.. খুব পছন্দের ছিল সেটা... একদিন ঐ দুস্টুটা দোতলার বাসার জানালা দিয়ে ব্যাগটা নীচে ফেলে দেয়। কিছুক্ষন পরে নীচে যেয়ে দেখি ব্যাগটা নেই...সেটা না পেয়ে এসে কান্না জুড়ে দিলাম। কান্না শুনে আব্বা এসে ধমাধম পিটানো শুরু করলেন। এদিকে ওকে পিটানো দেখে আমার আবার কস্ট লাগছে। আব্বাকে টেনে ধরে বলছি, ওকে আর মারবেন না। বলতে বলতে আমারও আবার কান্না শুরু...সেটা দেখে আব্বাকে থামতেই হলো। এরকম দৃশ্যের অবতারনা প্রায় দিনই হতো। ও আমাকে মারছে, আব্বা আবার ওকে পিটাচ্ছে, আমি আবার ওকে মার থেকে বাচাচ্ছি। পিঠাপিঠি ভাইবোন হলে যা হয় আরকি!!
সেইসময়টায় স্যাটেলাইট চ্যানেল আসেনি। একটাই চ্যানেল বিটিভি। বিটিভিতে তখন এডগার রাইজ বারোজের টারজান সিরিজ দেখাতো। আমাদের দু ভাই বোনেরই দারুন প্রিয় ছিল অনুস্ঠানটা। টারজান আ..আ..করে চিৎকার দিতে দিতে একগাছ থেকে ঝুলে ঝুলে আরেক গাছে যেতো। আর তার আ.. আ.. চিৎকারে সব পশুপাখি এসে হাজির টারজানকে সাহায্য করতে। অবাক বিস্ময়ে দেখতাম আর অজান্তেই দৃশ্যগুলো মনে গেথে যেতো...
তো সেই শীতের সকালে দুইজন গিয়েছি নাজমাদের বাসায় খেলতে। সবাই মিলে খেলবো রান্নাবাটি। আমাদেরকে পাঠিয়েছে বাজার করতে মানে, পাতা, ফুল, ফল এগুলো নিয়ে আসতে। যে বাসায় থাকতাম সেই বাসার একদম সাথের একতলা বাসাটার সামনে কিছুটা ফাঁকা জায়গা ছিলো... সেখানে কিছু জংলি ফুল, লতাপাতা ছিলো... দুইজন ঐ বাসায় গেলাম ফুল তুলতে...
আগের রাতে বেশ ভালো জোরেশোরে ঝর হয়েছিলো। ঝরের তান্ডবে কারেন্টের তার ছিরে ঝুলে পড়ে ছিলো ঐ বাসাটায়, যেখানে আমরা ফুল তুলতে গিয়েছি....আমি নিজের মনে বাজার করে যাচ্ছি মানে ফুল তুলছি আর ওদিকে সেই ক্ষুদে বালকের ছেরা তার দেখে নিজেকে টারজানের ভুমিকায় কল্পনা করাও সারা...সেই সাথে কারেন্টের তার ধরে ঝুলে পরাও সারা। কিন্তু টারজানের মতো আ.. আ...চিৎকার করে আরেক গাছে যেতে পারেনি, মাটিতে শুয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। এদিকে আমি পিছন ফিরে দেখি ও মাটিতে শুয়ে আছে আর ওর হাতের মধ্যে তার। আমি কি করবো বুঝতে পারছি না...ওকে ধরে টান দিয়ে সরিয়ে নিয়ে আসবো, না কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না...কিছুই বুঝতে না পেরে আম্মা-আ-আ-আ------- বলে খুব জোরে একটা চিৎকার দিলাম। আম্মা বারান্দাতেই ছিলেন, আমার চিৎকার শুনতে পেয়ে এক দৌড়ে নীচে নেমে এক বাসা থেকে আরেক বাসার নীচু একটা সীমানা প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে ভাইকে মাটিতে শোয়া অবস্থায় দেখেই টেনে তুলতে গিয়েছিলেন...আম্মা নাকি প্রথমে ভাইয়ের মুখে ফেনা দেখে ভেবেছিলেন সাপে কামড় দিয়েছে,কিন্তু ধরার পরে শক খেয়ে বুঝতে পারলেন, কারেন্টের তার ধরে ঝুলে আছে....আসলে বিপদের সময় মাথা কাজ করে না। তারপরও আম্মা মাথা ঠিক রেখে ঐ বাসার ভিতরে যেয়ে কাঠের একটা চেয়ার নিয়ে আসেন... চেয়ার দিয়েই তারটা সরিয়ে ভাইকে কোলে নিতে যাবেন, সেইসময় তারটা আবার ঘুরে এসে দুইজনকেই প্যাচাতে যাচ্ছে। এদিকে অনেক মানুয জড়ো হয়ে গেছে, সবাই ঘটনা দেখাতেই ব্যাস্ত। এরইমধ্যে কে একজন একটা বাঁশ জোগার করেছে, সেটা দিয়েই তারটাকে আটকে ধরে রাখলো আর আম্মা, ভাইকে কোলে নিয়ে নিরাপদ স্থানে সরে আসলেন...
করুনাময়ের অশেষ রহমত যে, তখন কারেন্টের তারটাতে ভোল্টেজ ছিলো খুবই লো...ফুল ভোল্টেজ থাকলেতো সাথে সাথেই মারা যেত...
আব্বা ছিলেন অফিসে। পাড়ার ছেলেরা দ্রুত আম্মাকে সহ ভাইকে মেডিকেলে নিয়ে গেলো। হাতের আঙ্গুলগুলো কেটে হতের সাথে কোনোরকমে লেগে ছিলো। ডাক্তার আম্মাকে বাহবা দিলেন, আর বললেন আর একটু দেরী হলেই আর বাঁচানো যেতো না...অনেক দিন সময় লেগেছিলো কাটা আঙ্গুলগুলো ঠিক হতে...হাত দিয়ে কিছুই খেতে পারতো না, চামচ দিয়ে খেতে হতো সব খাবার।
আমার সেই বয়সটাতে তখনও বুঝতে শিখিনি, বিদ্যুৎপৃস্ঠ কাউকে ধরলে কি পরিনতি হতে পারে...কি মনে করে যেনো ওকে ধরিনি আমি...এখন ভাবি, সেইসময় যদি বাঁচাতে আমি ওকে ধরতে যেতাম....তাহলে হয়তো আরেকটি দুর্ঘটনার খবর যোগ হতো.... বিদ্যুৎপৃস্ঠ হয়ে ভাই এবং বোন বাচাতে গিয়ে দুইজনই মৃত।
সেই ভয়াবহ স্মৃতিটা এখনও মাঝে মাঝে মনসপটে ভেসে ওঠে....
কখনো কখনো জীবনের কোনো ঘটনা, নাটক সিনেমাকেও যেনো হার মানায়....
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সকাল ৮:৩৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




