পূর্বকথা
শঙ্খচূড় - প্রথম পর্ব "ক"
রাতে খাওয়া শেষে নিজেদের স্ত্রীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন মতিয়ার এবং এনায়েত সাহেব। পরিচয়টা চেহারা দেখা দেখির মত করে হল না। তাঁরা লম্বা ঘোমটা দিয়ে জানালার পাশে এসে দাঁড়ালেন, সেখান থেকেই হাজী সাহেবকে সালাম দেয়া ও কুশলাদী জিজ্ঞেসের মাধ্যমে পরিচয় পর্বের শেষ হল। কার পরিবারে কে কে আছে- জানা হল একে অন্যের। সাদা মাটা পরিচয় শেষে হাজী সাহেবদের শোবার ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত হয়ে পরলেন সবাই। হাজী সাহেবের থাকার ব্যবস্থা করা হল মূল মেহমান খানায়। সুলেমান থাকবে তাঁর পাশের ঘরের একটা বিছানায়। দু ঘরেই হারিকেনের ব্যবস্থা করা হল। মেহমান খানার বারান্দায় খাটিয়া পেতে ঘুমাবে কাজেম আলী। যদি রাতে মেহমানদের কোনো প্রয়োজন পরে, তাকে ডাকলেই হবে। মশারি টানিয়ে সব ঠিকঠাক করে দিয়ে মতিয়ার সাহেবের নিজের বিছানায় আসতে আসতে রাত হয়ে গেল অনেক।
আজ তাঁর বড় বৌ, ফাতেমা বেগম স্বামীর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। স্বামীর আগে স্ত্রী ঘুমিয়ে পড়লে স্বামীর অমঙ্গল হয়। তাই দীর্ঘ দিনের অভ্যাস মত আজ এত ক্লান্তির পরও জেগে রয়েছেন। পানের বাটা হাতে পান বানিয়ে দিলেন মতিয়ার রহমানকে। মতিয়ার সাহেব পানটা মুখে গুজে পাঞ্জাবী, পাজামা পালটে লুঙ্গি, গেঞ্জি পরলেন।
“রান্না বান্না সব ঠিক মত হইছে তো? হাজী সাহেব তো দেখলাম রান্নার খুব প্রশংসা করলেন।” মসারির ভেতরে বললেন স্বামীকে।
মতিয়ার সাহেব দুটো বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বললেন, “নাহ। রান্না মাশাআল্লাহ ভালই করছো। হাজী সাহেবের মনে থাকবে বহুদিন। যাগ্যা, সকাল বেলা ভাল করে পিঠা বানায়ো তো। খেজুরের রস দিয়া।”
“অভয় দিলে একয়াট কথা জিজ্ঞাস করবো?”
“বল, এত অনুমতির কি আছে?”
“হঠাৎ হাজী সাহেবকে এই ভাবে দাওয়াত দিয়া আনলা, এত খাতিরদারি.... ক্যান?”
“বুঝবানা। বুঝলে তো তুমিই মতিয়ার রহমান হয়া যাইতা।”
“বুঝায় বলেন। তাহলেই বুঝবো।”
“এখনো বলার সময় আসে নাই। সময় হলে সব জানবা।......... ভাল কথা, তহমিনা কোথায়?”
“ঘুমাইছে। রওশানের সাথে জয়নাবের ঘরে ঘুমাইছে আজ।”
“ও।”
“কেন? দরকার তারে?”
“নাহ।..... মাদ্রাসায় যায় ঠিক মত?”
“হু, যায়। পড়াশোনায় মাশাল্লাহ। পড়াইলে অনেক দূর যাবে সে।” গর্ব করে বললেন গর্ভধারিণী।
“এনায়েত কি তহমিনার বিবাহ নিয়া কিছু ভাবছে? রোকেয়ার সাথে এ বিষয়ে কোনো আলাপের আভাস পাইছো?” দুহাত মাথার পেছনে দিয়ে স্ত্রীর দিকে কাতালেন।
একটা নিঃশ্বাস ফেললেন ফাতেমা, “নাহ। এ বিষয়ে আমার সাথে রোকেয়ার কোনো কথা হয় না। সে নিজেও বলে নাই আমাকে।”
“ও।” গম্ভীর হয়ে গেলেন মতিয়ার সাহেব। ভেতরে সংশয় কাজ করে তাঁর। তহমিনার বিয়ের ব্যাপারে কি তাঁর আগ্রহ দেখানো উচিত হবে? পিতা তো এখন তিনি নন, তাঁর ছোট ভাই। যা দিয়েছেন, তাতে পিছুটান হটানো কঠিন। উজার করে দিয়েও আঁকড়ে পড়ে আছেন। কেমন যেন একটা কার্পণ্য ভেতরটায় এপিঠ ওপিঠ কুঁড়ে খাচ্ছে। অধিকারের পাট চুকিয়ে ফের অধিকারের রাশ ধরতে পারেন না তিনি, গত তেরটি বছরে নিজের ভেতরেই বেঁধে ফেলেছেন তহমিনা থেকে নিজেকে। মাঝে মাঝে বাঁধন খোলার বড় সাধ জাগে। পরক্ষণেই অজানা শংকায় হাত গুটিয়ে নেন।
শুয়ে পড়লেন পাশ ফিরে। ফাতেমা বেগমকে বললেন, “হারিকেনের আলোটা কমায় দেও। শুয়ে পড়ো। আর কত রাত জাগবা? সকালে অনেক কাজ তোমার। শরীরটাকে একটু বিশ্রাম দেও।”
পানের বাটা রেখে হারিকেনের সলতে কমিয়ে দিলেন ফাতেমা। শুয়ে পড়লেন স্বামীর পাশে। মানুষটা অন্যপাশ ফিরে ঘুমাচ্ছে। আহারে, এপাশ ফিরে ঘুমালে অন্ধকারে অল্প হলেও তো মুখটা দেখতে পেতাম। এতো কাছাকাছি মানুষটা হঠাৎ কেন এতো বড় দূরত্ব তৈরি করলেন? সবই তো ছিল। তাও কেন দূরের মানুষ হয়ে গেলেন?
এই সংসারে জয়নাবের আগমনটা আজও মেনে নিতে পারেননি ফাতেমা বেগম। মতিয়ার রহমান তাঁর বুকের ভেতর যে ক্ষত সৃষ্টি করেছেন, সে ঘাঁ এই জনমে তাঁর শুকাবে না।
আধো অন্ধকারে, হারিকেনের মিটমিটে আলোয় এক ফোঁটা হীরার মত অশ্রু গড়িয়ে বালিশে পড়ল ফাতেমা বেগমের চোখ থেকে। এত কাছে থেকেও মতিয়ার সাহেব টের পেলেন না। উনি ঘুমাচ্ছেন।
পরদিন ভোর বেলা ঘুম ভাঙল তহমিনা বেগমের। কেউ উঠেনি এখনো। পাশেই ঘুমাচ্ছে রওশান আরা আর মেজ মা, জয়নাব। জানালাগুলো বন্ধ, কিন্তু কিনার দিয়ে আলো আসছে ভোর বেলার। মশারী সরিয়ে বিছানা থেকে নামলো, ওড়নাটা নিয়ে মাথায় দিল। তাকে মাজনের শিশি আছে। গিয়ে হাতের তালুতে মাজন নিল। দরজার শিকল নামিয়ে দরজা খুলল। দো’তলার ঘরে ঘুমিয়েছিল আজ। ছোট্ট বারান্দা মত, ছাদ নেই বারান্দায়; পাশেই সিঁড়ি। দাঁত মাজতে মাজতে সিঁড়ি দিয়ে নামল। কুয়াশা চারিদিকে। ঠান্ডা পরেছে খুব। কলতলার দিকে এগিয়ে গেল দাঁত মাজতে মাজতে।
কিন্তু কলতলায় গিয়ে থমকে দাঁড়াল। আর যাই হোক, টিউবওয়েলের কাছে হাজী খামিরুদ্দিনকে আশা করেনি। চমকে গেল তাঁকে দেখে। ওযু সেরে সবে মাত্র ঘুরে সোজা হয়েছেন তিনি, তহমিনাকে দেখলেন একে বারে সামনে। ডান হাতের মধ্যমাটা এখনো মুখের ভেতরেই আটকে আছে তহমিনার। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রয়েছে হাজী সাহেবের দিকে। হাজী সাহেব মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, “ভাল আছো মা? কি নাম তোমার?”
তহমিনা মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত, “আ-আসসালামালাইকুম...... আমার নাম মোছাম্মদ তহমিনা বেগম।” বলেই ঘুরে এক দৌড় দিল। যাকে বলে ঝেড়ে দৌড় লাগানো। এক দৌড়ে জয়নাবের ঘরে। আজকে আর তার দাঁত মাজা হবে না।
হাজী খামিরুদ্দিন সাহেব ঘটনার আকস্মিকতায় খানিক্ষণ হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর বিড়বিড় করলেন, “ওয়ালাইকুম আসসালাম। বেঁচে থাকো মা, দীর্ঘজীবি হও!”
সকালে নাস্তা করার সময় হাজী সাহেব মতিয়ার রহমানকে বললেন, “আজকে ভোরবেলা ওযু করতে গেলাম যখন, তখন একটা মেয়েকে দেখলাম। নাম বলছে তহমিনা বেগম। বলেই একয়াট দৌড়। মেয়ে কি আপনার?”
এনায়েত রহমানও খেতে বসেছেন। মতিয়ার সাহেব আড়ষ্ট ভঙ্গিতে নড়ে চড়ে বসলেন, “নাহ। আমার ছোট ভাইয়ের মেয়ে। এক্মাত্র মেয়ে।” ছোট ভাইয়ের দিকে তাকালেন না। এনায়েত রহমান একবার মুখ তুলে বড় ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আবার খাওয়ায় মন দিলেন। কিছু বললেন না।
“মেয়ে কি পড়াশোনা করে?” এক টুকরো পিঠা ভেঙ্গে মুখে দিতে দিতে বললেন হাজী সাহেব।
“জী। মাদ্রাসায় পড়ে। খুব ভাল ছাত্রী।” এনায়েত রহমান বলে উঠলেন বড় ভাই জবাব দেয়ার আগেই।
“খুব ভাল। বেশি করে পড়াশোনা করাবেন। জ্ঞান আহোরণ করা প্রত্যেক মানুষের জন্য আবশ্য কর্তব্য।” আপন মনেই বললেন। “আমার মেয়ে গুলাকেও সাধ্য মত পড়ায়েছিলাম। এখন অবশ্য বিয়ে হয়ে গেছে।”
টুকটাক কথা বার্তার মধ্য দিয়ে সকালের নাস্তা শেষ হল। হাজী সাহেব ছড়ি হাতে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, “ভাই আজ তাহলে আসতে হয় আমাকে। বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়া প্রয়োজন। নয়তো দেরি হয়ে যায়।” পাঞ্জাবীর পকেট থেকে একয়াত চেন লাগানো ঘড়ি বের করে সময় দেখলেন। সকাল নয়টা বাজে। চাবি দিতে হয় নিয়মিত, নয়তো বন্ধ হয়ে যায়।
মতিয়ার সাহেব হেসে বললেন, “কেন ভাই? আমাদের মেহমানদারী ভাল লাগে নাই- এত তাড়াতাড়ি যাবার নাম নিলেন!”
“সেকি! সেটা বললে তো আমার অন্যায় হবে! এত কষ্ট করে ভাবী সাহেবারা রান্না করলেন, আমি তো খুবই অবাক হয়েছি। এমন আতিথিয়তা সত্যিই পাই নাই আগে। ধন্যবাদ দিলে ছোট করা হবে।” উদার ভাবে হাসলেন হাজী খামিরুদ্দিন।
“দুপুরটা পর্যন্ত থাকে যাইতেন, এক সাথে খেয়ে তারপর না হয় রওয়ানা দিতেন।” এনায়েত রহমান বললেন।
“নারে ভাই, পরের বার নিশ্চই থাকবো। আজকে তাহলে এযাজত দেন? আল্লাহর নামে রওয়ানা দেই।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। আমি গরু গাড়ি তৈরি রাখতে বলতেছি।” মতিয়ার রহমান সাহেব কাজেম আলীকে ডাকতে বেরিয়ে গেলেন।
এনায়েত রহমানের দিকে তাকিয়ে হাত বাড়ালেন করমর্দনের জন্য, “পঞ্চগড়ে গেলে অবশ্যই আমার বাড়িতে আসবেন। দাওয়াত রইল ভাই আপনাদের সবার। যদি শুনি ওখানে যায়ে আমার বাড়িতে আসেন নাই, অনেক কষ্ট পাবো। যাবেন কিন্তু।”
দু’হাতে হাজী সাহেবের বাড়ানো হাতটা ধরে ঝাঁকিয়ে দিতে দিতে হাসি মুখে বললেন, “অবশ্যই যাবো। আল্লাহ পাক চাইলে নিশ্চই যাবো। আপনেও আসবেন হাজী সাহেব।”
সুলেমান বাহিরেই দাঁড়িয়ে ছিল। বাকিদের সঙ্গে নিয়ে হাজী সাহেব বের হলে উঠানে। বাড়ির বৌ’দের দিকে তাকালেন। ওনারা বারান্দায় পিলার গুলোর কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন। মাথায় ঘোমটা, “তাহলে আজকে আসি। ভাবী সাহেবাদের অনেক কষ্ট দিলাম।” হাজী খামিরুদ্দিন সরল একটা হাসি দিলেন।
ফাতেমা বেগম নিচু গলায় বললেন, “না ভাই, সে কথা বলবেন না। আপনি তো আমাদের বড় ভাইয়ের মত। ভাই আসলে যা করতাম- আপনার জন্য তাই করছি। ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমা করে দিবেন।”
হাজী সাহেব তাঁদের সালাম দিয়ে বাড়ির বাহিরে চলে আসলেন। গরু গাড়ি তৈরি, কাজেম আলী চালাবে। দুটো গরু সামনে। ছই নাই গাড়িটায়, কেবল মাত্র বাড়ির মেয়েরা যাবার সময় ছই লাগিয়ে দেয়া হয়। সুলেমান সামনের দিকে বসল। হাজী সাহেব আর মতিয়ার রহমান বসলেন পেছন দিকে। এখান থেকে প্রথমে হাটে যাবেন তাঁরা। সাইকেল কেনা হলে পরে বজরায় যাবেন, রওয়ানা দেবেন বাড়ির উদ্দেশ্যে। মতিয়ার সাহেব শেষ পর্যন্ত এগিয়ে দিতে যাচ্ছেন।
পুকুরের পাশ দিয়ে রাস্তাটা চলে গেছে। আঁকা বাঁকা কাঁচা রাস্তা। গরু গাড়ির নিত্য যাওয়া আসায় লম্বা লম্বা একেকটা খাঁজ রাস্তার বুকে। শীতকাল এসে গেছে প্রায়, তাই মাটি খর খরে শুঁকনো। খরম পায়ে এখানে দিয়ে হাটতে গেলে খরম আটকে যায় এসব চাকার দাগগুলোতে।
পুকুরের মোড় ঘোরার সময় একয়াট খেজুর গাছ পড়ে। এখান থেকে মতিয়ার রহমানের বাড়ির দো’তলার বারান্দাটা স্পষ্ট দেখা যায়। হাজী হাসেব অন্যমনষ্ক ভাবে সেই বারান্দার দিকে তাকাতেই দেখলেন তহমিনা বেগমকে। সে মাজন দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে বারান্দায় বেরিয়ে এসেছে। এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে দাঁত মেজে যাচ্ছে। হঠাৎ হাজী সাহেবের ওপর চোখ পরতেই সুড়ুৎ করে আবার জয়নাবের ঘরে ঢুকে গেল। হাজী খামিরুদ্দিন সাহেব আচমকা সবাইকে অবাক করে দিয়ে হা-হা করে হেসে উঠলেন। মতিয়ার রহমান বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কি ব্যাপার ভাই? হঠাৎ হাসলেন যে?”
হাসি চাপতে চাপতে হাজী খামিরুদ্দিন বললেন, “নাহ। কিছু না। এমনি।”
মতিয়ার রহমান অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
মধ্য দুপুর। সূর্যটা ঠিক মাথার ওপর উঠে আগুণ ঝড়াতে চাইছে। শীতের দিন বলে পারছে না। ব্যররথ ভাবে সব কিছু জ্বালিয়ে দেয়ার আক্রশে জ্বলছে কেওবল। একরত্তি মেঘ নেই আকাশে। চকচকে নীল আকাশটা যেন ধূয়ে শুঁকাতে দেয়া হয়েছে। করতোয়া নদীর ওপর দিয়ে ধীর গতিতে ছুটে চলেছে হাজী সাহেবের বজরাটা। দাঁড় টানার এক ঘেয়ে ছল ছলাৎ শন্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। নিজের ছোট কামড়ায় বসে হাজী সাহেব এক মনে লিখে যাচ্ছেন। তাঁর হজ্জ্ব যাত্রার সমস্ত ঘটনা লিখছেন কবিতার মত করে বেশ কিছুদিন ধরে। বই আকারে ছাপাতে চান। নাম ঠিক করেননি এখনো। তবে মনে মনে ভাবছেন “হজ্জ্ব স্মৃতি” নাম দেবেন। হজ্জ্বের জন্য যাত্রা পথে কলকাতা হয়ে যেতে হয়েছিল তাঁকে। সেই ঘটনা লিখছেন নিবিষ্ট মনে-
“.....এইরূপে কত কথা ভাবিতে ভাবিতে
আলস্য ধরিল চেপে ফেলিয়া ঘুমেতে।
সারারাত্রি গাড়িখানি চলিতে লাগিল;
ভোর বেলা কলিকাতা আসিয়া পৌছিল।
পীরপুত্র নেকবক্ত পীরপত্র পেয়ে
ষ্টেশনে হাজির ছিল অধমেরি লিয়ে।
ছালাম মুছাফা বাদে ঘোড়া গাড়ী করে;
মার্কুইস লেনে চল্ল নিয়ে সঙ্গে করে;
নামিলাম ঐ লেনে এক নম্বর ঘরে,
এক টাকা দিতে হইল কোচম্যানেরে।
খাওয়া দাওয়া করে যাই হজ্জ্ব কার্য্যালয়,
বিখ্যাত নাখোদা নামে যেথা ধর্ম্মালয়.......”
বজরার দুলুনিতে তাঁর কামড়ায় হেলান দিয়ে রাখা নতুন কেনা হারকিউলিস সাইকেলটার বেলটা টিনটিন করে উঠছে আপনা আপনি। খেয়াল নেই সেদিকে হাজী সাহেবের। তিনি লিখেই যাচ্ছেন..... ঘোরের মধ্যে চলে গেছেন তিনি। তাঁর সামনে মার্কুইস লেনের ঘর বাড়িগুলো আবার জীবন্ত হয়ে উঠেছে........
(চলবে)
(ডি.এম. খায়রুল আনাম- আমার নানা, মারা যাবার বেশ কিছুদিন আগে হঠাৎ করেই আমাকে একটা খুব পুরনো বই পাঠিয়েছলেন আম্মুর হাতে দিয়ে। মেসের খুপড়ি টাইপের একটা ঘরে তখন আমি গন্ডি বাঁধা ফ্রাস্টেটেড লাইফের যাতাকলে নিজের লেখনি বিসর্জন দিয়ে দিয়েছি। লিখছি না দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে। সেই সময়েই হাতে পেলাম বইটা। বেশ অবাক হলাম। আমি মানুষ হিসেবে খুবই কুঁড়ে স্বভাবের। কোনো কিছুতে আগ্রহ একেবারেই নেই। ট্রাংকে ফেলে রাখলাম বইটা। এটা দিয়ে আমি কি করবো?
নানা ফোন দিয়ে আমাকে বারবার বলতেন বইটা পড়ার জন্য। লেখার জন্য নাকি অনেক কিছু পাওয়া যাবে। কিন্তু আমি বই টই বিমুখ মানুষ। পড়ায় মারাত্নক এলার্জি আছে আমার। পড়লাম না। ট্রাংকে নির্বাসিত জীবন কাটাতে লাগল বইটা। নানা প্রায়ই বলতেন বইটা যত্ন করে রাখতে। এটা নাকি তিনি কাউকে দেননি। তাঁর বদ্ধমূল ধারণা তাঁর বাবা, হাজী খামিরুদ্দিনের শেষ চিহ্ন “হজ্জ্ব স্মৃতি” নামের এই বইটা সামলে রাখতে পারবে তাঁর বত্রিশজন নাতি নাতনিদের মাঝে একমাত্র আমিই। তাঁর এই ভুল ধারণা আমি ভাঙ্গার চেষ্টা করিনি। তিনি ভেবেছিলেন আমি হয়তো তাঁকে নিয়ে একদিন লিখবো। চেয়েছিলেন আমি যেন সব সময় তাঁর সঙ্গে ঘুরি, ঘুরে ঘুরে তাঁর জগতটা আমাকে দেখাবেন বয়সের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধ এই শিক্ষক। পারেন নি। তিনি জানতেন না শিহাব নামের একজন অপদার্থ লেখক দুনিয়াতে আছে, যে কখনো কিছুতে আগ্রহ বোধ করে না।
তাঁর মৃত্যুর পর হঠাৎ করেই ভীষণ একটা নাড়া খাই আমি। আমি সবাইকে আসতে দেখেছি। কাউকে যেতে দেখিনি। এই প্রথম কাউকে চলে যেতে দেখলাম।
ডি.এম. খায়রুল আনামের মৃত্যুর ১৮ দিন পর ট্রাংকে হাত দিলাম। খুঁজে বের করলাম “হজ্জ্ব স্মৃতি” নামের জরা-জির্ণ বইটা। ঘাড়ের কাছটায় শিরশির করতে লাগল। একা ঘোরা শুরু হল আমার ডি.এম. পরিবারের অতীত খুঁজতে।
আমার অনেক পাঠক পাঠিকাই বিশ্বাস করতে চাননা যে আমি স্বপ্নে লেখার প্লট পাই। এই উপন্যাসের মোট ৯ টা চরিত্রের সঙ্গে আমার স্বপ্নে দেখা হয়েছে। যাদেরকে আমি বাস্তব জীবনে কখনো দেখিনি, এবং কখনো জানতাম না এরা ছিল এক সময়। আমার নানীকে স্বপ্নের ঘটনাটা খুলে বলার পর তিনি খুব আশ্চার্যান্বিত হয়ে বলেছিলেন, “তুমি কীভাবে এদেরকে চিনো? তোমার মাও তো চেনে না। আর আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম এদের কথা!”
আমি কেবল হেসেছি সেদিন। কিছু কিছু মানুষ স্বপ্নচারি হয়ে জন্মায়। হয়ত আমিও তাই।
- লেখক)