খোলা বইয়ের পৃষ্ঠাগুলো ঘরের ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে। বাইরে প্রচন্ড বেগে বয়ে যাওয়া ঝড় পৃষ্ঠাগুলোকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে সাই সাই করে। যে শব্দগুলো এতদিন পাঠকের চোখ আর পৃষ্ঠার মাঝে বন্দি ছিল, লেখকের ভালবাসার টানে জড়াজড়ি করে ছিল, বাতাসের ঝাপটায় সেগুলো আজ বর্ণ হয়ে উড়ে যাচ্ছে এক এক করে। তন্ময় শুয়ে শুয়ে উড়ে যাওয়া বর্ণ গুলো দেখছিল আর অবাক হচ্ছিল। তন্ময় তাড়াতাড়ি করে উঠে বইটা বন্ধ করতে গেল কিন্তু তার আগেই উড়তে থাকা পৃষ্ঠা গুলো একদিক ভারি করে বইটাকে ফেলে দিল।
হঠাৎ প্রচন্ড শব্দে ঘুম ভাঙল তন্ময়ের। পেজারটা তখনো বেজেই চলছে। ৯:৪০ বাজে, জিনিয়ার সাথে পড়া শুরু করার কথা ৯:০০ টায়। আজও ওর বকাঝকা শুনতে হবে এই ভেবে টেবিল থেকে মাথাটা তুলল, দেখল নিচে একটা বই পড়ে আছে আর লেখা গুলো হা করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
হোষ্টেল থেকে ক্যাম্পাসের দুরত্ব খুব বেশি না। কিন্তু তুমুল বৃষ্টিতে রিকশা নিতে হল তন্ময়কে। রিকশায় উঠেই তার মনে পড়ল, এই বৃষ্টিতে Yiruma এর "When the love falls raining" গানটা না শুনলে পুরা দিনটাই বৃথা। হেডফোনটা কানে দিয়েই চোখ বন্ধ করে ফেলল সে। গানের সাথে মিশে যাওয়ার জন্য এই কাজটা প্রায়ই করে তন্ময়।
ক্যাফেতে ঢুকেই জিনিয়াকে দেখতে পেল সে। চোখ দিয়ে যেন আগুন বেরোচ্ছে এমন ভাবে তাকিয়ে আছে তন্ময়ের দিকে। জিনিয়ার সামনাসামনি চেয়ারটায় বসতেই শুরু হয়ে গেল সেই চির পরিচিত ঝাড়ি। কিন্তু আশ্চর্য! - আজ মনে হচ্ছে কে যেন তার কান কে বন্ধ করে দিয়েছে, কিছুই সে শুনতে পাচ্ছে না, শুধু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জিনিয়ার লাল হয়ে যাওয়া মুখের দিকে। এক তীব্র ঝাকুনির চোটে সে হঠাৎ শুনতে পেল, "কি তোমার কানে কি কিছু ঢুকে না??"
দুরের এক টেবিলে কেয়া বসে বসে রুটিন করা এই দৃশ্য টা দেখছে আর অপলক দৃষ্টিতে তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে আছে। এই ছেলেটাকে কেয়ার মেডিকেলের প্রথম ক্লাস থেকেই ভাল লাগে। সময়ের সাথে সাথে সেই ভাল লাগা কখন যে ভালবাসা হয়েছে তা বুঝে না কেয়া, শুধু বুঝে সেই ভালবাসা শুধু এক তরফা। না হয় জিনিয়া অনেক মেধাবী কিন্তু তাই বলে কি তার সাথে প্রেম করতে হবে? কেন এমন হয়? কেন ভালবাসার মানুষের উপর আরেকজন ভাগ বসায়? কেন কেন??
কেয়া ক্যাফের বিল দিতে গেল। ফিরে আসার সময় মুখোমুখি দেখা তন্ময়ের সাথে।
তন্ময় : কি কেয়া কেমন আছ? প্রফ এর জন্য পড়া কতদূর? আমার অবস্থা খুব খারাপ।
ভিতরে ভিতরে কেমন যেন এক শিহরণ বয়ে যাচ্ছে কেয়ার। তন্ময়ের সাথে কথা বলতে গেলেই এই অনুভুতিটা হয় ওর।
কেয়া: আমার অবস্থাও তেমন ভাল না।
তন্ময়: ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছ না? আমি অনেক কষ্টে ব্ল্যাকে ট্রেনের একটা টিকিট পেয়েছি।
কেয়া: তোমার বাড়ী কোথায়?
তন্ময়: চট্টগ্রাম, কেন তোমার বাসা ও কি চিটগংগ নাকি?
কেয়া: হুম।
তন্ময়: আরে এতদিন কিছুই জানলাম না? কবে যাচ্ছ তুমি? আমি বৃহস্পতিবার যাচ্ছি।
পাজরে কাপন ধরে যাচ্ছিল কেয়ার। চট্টগ্রাম, প্রভাতী ট্রেন, বৃহস্পতিবার...এসব কি তাহলে সেরিনডেপিটি? সেরিনডেপিটিতে খুব বিশ্বাস কেয়ার।
কেয়া: আমিও বৃহস্পতিবার যাচ্ছি মহানগর প্রভাতীতে।
তন্ময়: ওয়াও, যাক ভালই হল, তোমার সাথে সারা পথ ফাইট দেয়া যাবে। জিনিয়াটা ইদানীং খুব বদ হইছে। কিচ্ছু বুঝাতে চায় না।
বুধবার সারারাত ঘুম হলনা কেয়ার, শুয়ে শুয়ে অজস্র সব তারার দিকে তাকিয়ে রইল, তারাগুলোও তার দিকে তকিয়ে থেকে বলল:
তোমার ভালবাসার প্রদীপ নিয়ে আমরা যে জেগে আছি কেয়া,
তোমার ভালবাসা মিথ্যা হবে না, দেখ...
খুব ভোরেই রওনা দিল কেয়া। কমলাপুর পৌছাতেই অস্থিরতা চরমে উঠল যে কখন ৭:৪০ বাজবে। ট্রেনের বাইরেই অপেক্ষা করতে থাকল। বার বার হাতঘড়িটার দিকে তাকাচ্ছে সে। সময় যেন আগাচ্ছেই না, যেন ঘড়ির মধ্যে কোন এক চুম্বক সেকেন্ডের কাটাটাকে পেছন থেকে ধরে রেখেছে। উশখুশ চুল ওয়ালা কাউকে দেখলেই হৃদপিন্ডটা দাপিয়ে ওঠে, আবার মিলিয়ে যায়।
আজ রাতে তন্ময়ের সমস্ত শরীরে কেমন একটা অবসাদ কাজ করছে। শুয়ে শুয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে সে। হঠাৎ দেখতে পেল জানালা দিয়ে অদ্ভুত এক সাদা রংয়ের বিড়াল, কেমন যানি দেখতে, চোখ দুটো জলজল করছে বিড়ালটির, আর মানুষের মত হাটার ভংগি দেখে তন্ময় খুব ভয় পেল। বিড়ালটা মিয়াও করতেই আরও ৫-৬ টা বিড়াল নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে পড়ল। বিড়াল গুলো সব তন্ময়ের কাছে এসে ওকে শুন্যে তুলে ধরল। তন্ময় প্রচন্ড ভয় পাচ্ছে কিন্তু কিছুই করতে পারছে না, হাত গুলোতেও কোন শক্তি অনুভব করছে না। অস্ফুট এক গোংগানি দিয়ে সে বলল, "তোমরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?" বিড়াল সর্দার বলল, "কেয়াবনে"। কেয়া নাম শুনে হুড়মুড় করে লাফিয়ে উঠল তন্ময়। পেজারটা আজকেও বেজে যাচ্ছে। সকাল ৭:৩০, হোষ্টেল থেকে কোনভাবেই ১০ মিনিটে কমলাপুর যাওয়া সম্ভব না...কেয়ার ফোন নাম্বার ও তার কাছে নেই, তা না হলে একটা ফোন দিত সে।
৭:৪০ বেজে গেল প্রায়, কেয়া ট্রেনে উঠে বসে। প্যাঁ প্যাঁ করতে করতে ট্রেন ছেড়ে দেয়। সেই শব্দের সাথে তার হৃদয় টাও হু হু করে ওঠে...আকাশটাও তখন ঝিরঝিরিয়ে কাদঁছিল কেয়ার সাথে সাথে। এই পৃথিবীর কেউ যদি তখন কেয়ার ভালবাসা মাপতে পারত তাহলে সে নিশ্চিত অঝরে কাদঁতে থাকত।
হঠাৎ তন্ময়ের খেয়াল হল, কমলাপুর না যাওয়া গেলেও এয়ারর্পোট গেলে নিশ্চত ট্রেন টা ধরা যাবে। ব্যাগটা নিয়েই সাথে সাথে দৌড়াতে থাকে তন্ময়।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে এপ্রিল, ২০১২ বিকাল ৩:০৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




