somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাচ্চা নিচ্ছো কবে? একটি অস্বাস্থ্যকর প্রশ্ন...

২১ শে মার্চ, ২০১৭ রাত ৯:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বিয়ে মানুষের জীবনে কতগুলো অত্যাবশ্যক প্রশ্ন নিয়ে আসে। কবে বিয়ে করলেন, কাকে বিয়ে করলেন, সংসার চলছে কেমন এবং পরিনত প্রশ্ন আসে বছর ঘুরে বাচ্চা নিচ্ছেন কবে। বাঙ্গালি কালচারে আমাদের অপার কৌতুহল। অনেকে আবার অন্যের হাঁড়ির খবর জানাকে নিজে অধিকারও ভেবে থাকেন। “ঘরের খাবার থেকে ব্যাংকের এ্যাকাউন্ট নম্বর ”- পরিবার, আত্মীয়, বন্ধু-প্রতিবেশি সবার সব কিছু জানতে হবে। কোনটা সামাজিক প্রশ্ন আর কোনটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন সেটা ভেবে সময় নষ্ট করতে বাঙ্গালি একেবারেই রাজি নয়। তাই সাত পাঁচ না ভেবেই প্রশ্ন আসে বিয়ে করছো কবে কিংবা বাচ্চা নিচ্ছো কবে। সন্তান নেয়াটা তো এখন আবার সামাজিক পরীক্ষায় উর্ত্তীন হওয়া মতো বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ।

সংসার জীবনে কোন সমস্যাই মূল সমস্যা নয়, সবই আমূল সমস্যা। সেই আমূল সমস্যার ভিতর দিয়েই নারী-পুরুষকে সবকিছু মানিয়ে গুছিয়ে চলতে হয়। যেমন, “বাচ্চা নিচ্ছো কবে?” এই প্রশ্নটির সম্মুখীন হতে হয় পরিবার-পরিজন, সহকর্মী, স্বল্প পরিচিত, সদ্য পরিচিত সবার কাছ থেকে। প্রথম প্রথম কেয়ারিং মনে হলেও একসময় প্রশ্নটা বিব্রতকর এবং বিরক্তিকর হয়ে ওঠে। প্রশ্নটি নারী–পুরুষ উভয়কেই অসম্মানিত করে। তবে নারী যেহেতু সন্তান ধারন করেন, তাই তাকেই এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় অপেক্ষাকৃত বেশি বার। প্রশ্নটার সাথে কোথাও শোবার ঘরের একটা ক্লোজ রিলেশন আছে। আমরা অবলীলায়, কড়া না নেড়েই অন্যের বেড রুমে ঢুকে পড়তে পছন্দ করি ।

যিনি বা যারা সন্তান নিচ্ছেন না তাদের দুটো কারন থাকতে পারে, হয় তারা এখন বাচ্চা চাচ্ছেন না অথবা তাদের বাচ্চা হচ্ছে না। সৌজন্যতার সীমালংঘন করে, অন্যকে হেয় প্রতিপন্ন করে অসুস্থ আনন্দ পাওয়ার একটা উপায় হতে পারে তবে, যে দীর্ঘদিন চেষ্টার পরেও মাতা - পিতা হতে পারেন নি তাদের জন্য প্রশ্নটা মনোঃকষ্টের কারণ হয় ওঠে।

আত্মীয়-স্বজনরা এই প্রশ্ন করাটাকে নিজেদের দায়িত্ব মনে করেন, ‘দেরি হয়ে যাচ্ছে বাচ্চা নিয়ে নাও’ ‘বিয়ের তো অনেক দিন হলো’ ‘ আরও দেরি করলে বাচ্চা মানুষ করবা কিভাবে’, বন্ধু মহলের অনেকের রুটিন করে খোঁজখবর - ' সুখবরটা পাচ্ছি কবে!’। স্বল্প পরিচিত এবং অনেক ক্ষেত্রে সদ্য পরিচিতরাও প্রশ্ন করেন, বাচ্চা কয়টা? উত্তরটা নেটিবাচক পেলেই পরবর্তী প্রশ্ন, বাচ্চা নাই কেন? অথবা ‘বাচ্চা তো নেয়া উচিত জাতীয় পরামর্শ।

বিবাহিত দম্পতিদের বাচ্চা না নেয়ার হাজারটা কারণ থাকতে পারে। নেয়ার কারণ কিন্তু একটাই। তারা বাচ্চা নিতে চান। নেয়ার কৈফিয়ত যখন দিতে হচ্ছে না, তখন না নেয়ার কৈফিয়ত চাওয়া হয়, কেন? এই কেন একটি অরুচিকর শব্দও বটে। বাচ্চা নিচ্ছো কবে প্রশ্নটা যারা করেন তাদের রয়েছে সুশিক্ষার অভাব। একজন মানুষকে কী প্রশ্ন করা উচিৎ কোনটা উচিৎ নয়। কোনটা ব্যক্তিগত জীবন, কোনটা সামাজিক জীবন এই পার্থক্য গুলো আমরা গুলিয়ে ফেলি। এদেশের মানুষ শুধু এটুকু জেনে সন্তুষ্ট নন যে আপনি চাকরীজীবী এবং কোথায় চাকরী করেন, প্রশ্নকর্তা এটা জানাও জরুরী মনে করেন যে, আপনার বেতন কত।

সামাজিক ভাবেও দম্পতিকে নোটিশ করা হয়। সমাজ মাতৃত্বকে নারীর জীবনের পূর্ণতা বলে স্বীকৃ্তি দিয়ে দেয়। ইনিয়ে বিনিয়ে বুঝিয়ে দেয় ‘তোমার জীবনের সব সাফল্য অর্থহীন তুমি যদি মা না হতে পারো’। বাচ্চা নেয়ার উৎসাহ দিতে দিয়ে ভয়টাও মার্কেটিং করে যায়। তাদের পরিচিত কে কে দেরি করে বাচ্চা নিতে গিয়ে কী কী সমস্যায় ভুগেছে। কারো কারো দেরি করার কারনে বাচ্চাই হয় নাই। ‘প্রথমে তো নেব-নিচ্ছি, তারপর কি হলো বাচ্চাই হলো না’। এমনি ভাবে সমাজিক পরিজনরা ঠিকও করে দিচ্ছেন কখন বাচ্চা নিতে হবে। রাষ্ট্র যেমন আমাদের বিবাহিতদেরকে পরামর্শ দিচ্ছেন কয়টা সন্তান নেয়া যাবে, একসময় বাজা মেয়ে বা আটকুড়ে লোক বলে এই সমাজে দম্পতিকে হেয় প্রতিপন্ন করা হতো। বিয়ের মতো শুভ কাজে তাদেরকে ডাকা হতো না। সকালে তাদের মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠলে দিন খারাপ যাবে বলে ভাবা হতো বহুল প্রচারিত পুরুষতান্ত্রিক একটা এ্যাপ্রোচ হলো “মা এবং কর্মজীবী মা”। সমাজ নিজেই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যায় যে ক্যারিয়ার সচেতন মেয়েরা বাচ্চা নিতে চান না। সময় কোথায় কর্মজীবী মেয়েদের! কিংবা মানুষ অনেক ক্ষেত্রে ধরেই নেন যে, যারা বাচ্চা নিচ্ছেন না নিশ্চয় তাদের কোনো শাররীক সমস্যা রয়েছে।

প্যারেন্টহুড একটা অনুভূতি, একটা বন্ধন, একটা দায়িত্বও বটে। নবজাতকের জন্য পৃ্থিবীকে বাসযোগ্য করার অঙ্গীকার সব যুগের, সব কালের, সব অভিভাবকের। এর জন্য দম্পত্বির মানসিক প্রিপারেশন দরকার। আবার প্যারেন্টহুড এর আকাংক্ষা সবার থাকে না। সবাই বাচ্চা পছন্দ করেন না। কিন্তু অন্যরা তা মানতে নারাজ। বাচ্চা পছন্দ করে না, এমন মানুষ আবার আছে নাকি!

বাচ্চা নেয়া না-নেয়া যার যার ব্যক্তিগত ইস্যু। মানুষের স্বাস্থ্যগত সমস্যা যেমন থাকতে পারে। তেমনি পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সমস্যা থাকতে পারে। কিছু মানুষ খুচিয়ে খুচিয়ে প্রশ্ন করে। এই মানবিক বোধও তাদের নেই যে যাকে প্রশ্ন করা হচ্ছে তার কতটা খারাপ লাগতে পারে। তিনি হয়ত প্রতি মাসে মিনস্ট্রেশনএর পরে আরো একবার হতাশ হন, কাঁদেন, কষ্ট পান এবং আরো একবার লজ্জিত হন যে অন্যদের কাছে আবারো প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হবে। কাউকে কোন ব্যক্তিগত প্রশ্ন করবার আগে তার অনুমতি নিতে হয়। প্রশ্নকর্তা এবং উত্তরদাতার মধ্যে বোঝাপড়া থাকাটা জরুরি। “বাচ্চা নিচ্ছো কবে?” এটা একটা সেনসেটিভ প্রশ্ন। এটা যাকে করা হচ্ছে তিনি বিব্রত হতে পারেন, কষ্ট পেতে পারেন আবার বিরক্তও হতে পারেন। এক্ষেত্রে প্রশ্নকর্তা ভেবে দেখেন না যে, তার সাথে উত্তরদাতার সম্পর্ক কী, কতটুকু প্রবেশাধিকার তার জীবনে আপনার আছে। ক্ষেত্র বিশেষে আবার ফ্রেন্ডলি ফায়ারও হতে পারে। কেউ কেউ হয়তো সত্যি সত্যিই শুভাকাংক্ষী। সে আপনার প্রতি আন্তরিক। কিন্তু সেই আন্তরিক মানুষও প্রশ্নটা যাকে করেছেন, সেই সমসাময়িক সময়ে বাচ্চা নেয়ার পরিকল্পনা তার নাই। কিংবা তিনি চাচ্ছেন কিন্তু হচ্ছেনা, অথবা উক্ত দম্পতি হয়তো বাচ্চা নিতেই চান না। যিনি নিতে চান না তার ক্ষেত্রে হয়তো প্রশ্নটা নেয়া সহজ কিন্তু অন্য দু’টো ক্ষেত্রে সহজ নাও হতে পারে।

এই প্রশ্নটা যারা করেন তারা যে অশিক্ষিত এমনটা ভাববার কোনো অবকাশ নাই। বরং অনেক তথাকথিত শিক্ষিতরাও এই ধরনের প্রশ্ন করে থাকেন। অপার কৌতুহল, পরনিন্দা-পরচর্চা, অন্যেকে ব্যক্তি পর্যায়ে হেয় প্রতিপন্ন করা, ঈর্ষাবোধ, পরামর্শ দেয়ার সুযোগ, আহা-উহু করে তাকে বোঝানো যে প্রশ্নকর্তা আপনার বিষয়ে কতখানি চিন্তিত এবং আন্তরিক। অন্যের দুর্বলতাকে, অপূর্নতাকে যদি আপনি জনসম্মুখে নিয়ে আসতে না পরেন তবে আপনি যথেষ্ট কুশলি হন।

আমরা অনেক প্রশ্নকে স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়েছি। ফ্রেন্ডলি ফায়ার- প্রশ্নকারীর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হতে পারে, জ্ঞানের স্বল্পতা থাকতে পারে। অনেকে উদ্দেশ্যমূলক ভাবেও করে। অপরকে হেয় করা, চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া তোমারও অপূর্ণতা আছে, যেটা একটা সমস্যা আছে। দিন শেষে আপনিও যে ভাল নেই সেটা আপনি না বুঝলেও আপনার আশে পাশের মানুষ সেটা ‘খুউব’ ভালো ভাবে বোঝে! উত্তরদাতাও নিজের অবস্থানটা পরিষ্কার করে দিতে পারেন। বাচ্চা না থাকা কোনো আনন্যাচারাল বিষয় নয়। এটা নিয়ে বিব্রত না হয়ে সহজ ভাবে শেয়ার করা যেতেই পারে ‘আসল কারণটা কী’। ‘আমি বাচ্চা নিবো কনে সেটা আপনাকে বলতে হবে?’ বলতে তো সবাই পারে আপনি না হয় একটু গুছিয়ে নিয়ে উত্তরটা দিলেন। প্রশ্নটা শুনতে ‘অস্বস্তি’ হয় বলে দিনে দিনে অন্যদের থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়া কোনো সমাধান নয়। অন্যকে প্রতিপক্ষ ভাবার কোন কারণ নাই। প্রশ্নকারী সত্যি হয়তো আপনাকে ভালোবেসেই তাই জানতে চাই। ভালোবাসাটুকুকে তো সম্মান করা যেতেই পারে।

পারস্পারিক উদারতা, শ্রদ্ধাশীলতা, মানবিক মর্যাদার বিষয়ে সচেতনতা থাকা চাই। এদেশের মানুষকে যথাযথ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। যেখানে শুভ বোধগুলো জাগ্রত হয়। মানবিক গুনগুলো বিকশিত হয়। এটার চর্চা শুরু হতে হবে পরিবার থেকে।

আর, সব বিষয় নিয়ে আমাদের এতো প্রশ্ন কেন করতে হবে? ………
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০২০ ভোর ৫:৫৫
৩৫টি মন্তব্য ৩৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।

লিখেছেন সাইয়িদ রফিকুল হক, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:১৫



ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক

বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×