আমেরিকার অঙ্গরাজ্য নিউজার্সির ছোট্ট এক শহরের ট্রাক ড্রাইভারের স্ত্রী মিসেস মেরি বেথ হোয়াইটহেড। দুই সন্তানের জননী। অত্যন্ত স্নেহশীল। আর্থিক অনটন রয়েছে সংসারে। একদিন হোয়াইটহেডরা খবর পেলেন এক নিঃসন্তান দম্পতির কথা, যারা একটি সন্তান উৎপাদনের বিনিময়ে একজন মহিলাকে দশ হাজার ডলার দিতে রাজি। হোয়াইটহেডদের মোটামুটি শান্তির সংসার। দুইটা সুস্থ সন্তান রয়েছে, তাঁদের আর সন্তান দরকার নেই। সংবাদপত্রে সন্তান ধারনক্ষম মহিলার জন্য যে দম্পতি বিজ্ঞাপন দিয়েছেন তারা পেশাজীবনে সফল। পড়াশুনা আর কাজের ব্যস্ততার কারণে বহুদিন সন্তান ধারণ স্থগিত রাখতে গিয়ে এখন সম্পূর্ণভাবে গর্ভধারণে অসমর্থ হয়ে পড়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনে ভদ্রমহিলা প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী। তার স্বামীও ডাকসাইটে ব্যক্তি, খুব সম্ভবত ডাক্তার। দুজনে মিলে তাই ঠিক করেছেন স্যারোগেশন করাবেন। দুজনের না হোক অন্তত একজনের জিন তো থাকুক সন্তানের শরীরে। মিসেস হোয়াইহেড ঠিক করলেন তিনি এই কাজে অংশ নিবেন। তাতে পরিবারটি একটি সন্তানের মুখ দেখতে পাবেন, আর তিনি পাবেন দশ হাজার ডলার। যা দিয়ে হোয়াইটহেড পরিবারে আসবে স্বাচ্ছন্দ্য। প্রতিমাসে নির্ধারিত কয়েকটি দিনে ক্লিনিকে যেতে হয় মিসেস হোয়াইটহেডকে। সেখানে ডাক্তার কৃত্রিম উপায়ে মিঃ এক্সের বীর্য স্থাপন করে তাঁর জরায়ুতে। যথা সময়ে মিসেস হোয়াইটহেড গর্ভবতী হলেন। নির্দিষ্ট সময়ে ও স্বাভাবিক ভাবে গর্ভাবস্থা কাটার পর তিনি একটি সুস্থ কন্যাসন্তান জন্ম দিলেন। কিন্তু গোল বাধলো সন্তান জন্মদানের পর। কন্যার মুখ দর্শন করে মিসেস হোয়াইটহেড বেঁকে বসলেন। দশ হাজার ডলার তিনি চান না- কোনো চুক্তি মানতে রাজি নন তিনি। এই কন্যা তার গর্ভজাত, তিনি এই সন্তানের মা; অতএব একে তিনি নিজের কাছেই রাখতে চান। ওদিকে ডক্টর এক্স এবং মিসেস এক্স কিছুতেই তা হতে দেবেন না। কেননা সন্তানটি মিস্টার এক্সের স্পাম থেকে হয়েছে এবং সবথেকে বড় কথা চুক্তিকৃত দলিল রয়েছে তাঁদের কাছে। হোয়াইটহেডদের বাড়ি থেকে শিশুটিকে জোর করে নিয়ে যাবার জন্য কোর্টের অর্ডারসহ যখন পুলিশ এসে হাজির দরজায়, তখন মিসেস হোয়াইটহেড তার স্বামীর সহায়তায় শিশুসহ জানালা দিয়ে পালিয়ে চলে গেলেন ফ্লোরিডায়। অনেক চাঞ্চল্যকর ঘটনার মধ্য দিয়ে বহুদিন ফেরারি থাকার পর মিস্টার এবং মিসেস হোয়াইটহেড ধরা পড়লেন এবং বিচারের রায় অনুযায়ী শিশুটিকে তুলে দিতে হল ডক্টর এক্স এবং মিসেস এক্সের হাতে। কেননা মিসেস হোয়াইটহেড এই সন্তানের মা নন, কেবল ভাড়া করা জন্মদাত্রী। অর্থের বিনিময়ে তাঁর মাতৃত্বকে কিনে নিয়েছেন এক ধনী দম্পতি। ফলে তার কিছুই করার নেই। ইতোমধ্যে তার নির্বিঘ্ন জীবনে ঝড় উঠে গেছে। একটা ঘটনায় জীবনটা ওলটপালট হয়ে গেল। অস্বাভাবিক ঘটনার চাপ এবং মিস্টার হোয়াইটহেডের চাকরি হারানোতে পরিবারে নেমে আসে দুর্গতি। বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে হোয়াইটহেড দম্পতির মধ্যে। অন্যদিকে ডাক্তার স্বামী আর আইনজ্ঞ স্ত্রী মিলে কন্যাকে নিয়ে সুখের সংসার করতে থাকেন।
মা তো মা-ই। মা কখনো ভাড়াটে হতে পারে! পারে বৈ কি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে যখন রোগ, জরা, দুর্যোগকে জয় করা গেছে তবে মা কেন ‘ভাড়াটে মা’ হতে পারবে না? গর্ভধারণের মতো কষ্টকর ও অস্বচ্ছন্দ্যকর অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে না গিয়েও, অর্থের বিনিময়ে গর্ভধারনের জন্য সাময়িকভাবে জন্য একজন নারীকে ভাড়া করে মা হওয়া সম্ভব। যাকে বলা হয় Surrogate mother বা ভাড়াটে মা। ‘Surrogate mother’ কৃত্রিম উপায়ে জরায়ুর অভ্যন্তরে শুক্রানু স্থাপন করে কিংবা টেস্টটিউবে সন্তান ধারণ সন্তান ধারণ করার কথা আমাদের কম-বেশি সবারই জানা। তবে সম্প্রতি surrogate motherhood নিয়ে গণমাধ্যম কয়েকদিন পরপর-ই হাজির হচ্ছে অডিয়েন্সের সামনে। বলিউডের তারকাদের মধ্যে এই বিষয়ে আগ্রহ বেশ চোখে পড়ার মতো। এবারের সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। চার বারের ব্যালন ডি’অর জয়ী এ তারকা এই বছরই জুন মাসে মাথেও এবং ইভ নামের যমজ পুত্র সন্তানের বাবা হয়েছেন। রোনালদোর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বরাত দিয়ে ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড পত্রিকা ‘দ্য সান’ রোনাদোর পুনরায় বাবা হওয়ার বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, দুই পুত্র সন্তানকে দেখতে অধীর আগ্রহে চেয়ে আছে ৪ বারের ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলার ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোসহ তার বাড়ির সদস্যরা।’ রোনালদোর সন্তানেরা বেড়ে উঠছে যুক্তরাষ্ট্রে এক নারীর গর্ভে। ২০১০ সালে প্রথম বাবা হয়েছিলেন রিয়াল মাদ্রিদ তারকা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। কিন্তু তার মা ‘কে’ এ প্রশ্নে বরাবরই নীরব থেকেছেন। তবে ধারণা করা হয়, ‘সারোগেট মা’য়ের (ভাড়াটে গর্ভধারিণী) মাধ্যমেই জন্ম হয়েছে প্রথম সন্তান জুনিয়র ক্রিশ্চিয়ানোর। জানা গেছে এবারও একই কায়দায় জমজ ছেলের বাবা হয়েছেন পর্তুগিজ এই সুপারস্টার। বিষয়টি গণমাধ্যমে এসেছিল এভাবে, ‘রোনালদোর পরিবারের ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন, গর্ভধারণের শেষ পর্যায়ে আছেন ওই নারী। শিগগিরই মা হবেন তিনি। সন্তান প্রসব করা মাত্রই স্পেনের রাজধানী রিয়াল মাদ্রিদে ৫ মিলিয়ন ব্রিটিশ পাউন্ড ব্যয়ে তৈরি ক্রিশ্চিয়ানোর বাড়িতে তাদের নিয়ে আসা হবে’। এবং হ্যাঁ বর্তমানে তিন পুত্র এবং সন্তানসম্ভবা বান্ধবী জর্জিনা রদ্রিগেজকে নিয়ে ছুটি কাটাচ্ছেন তিনি।
তারকাদের surrogating নিয়ে অডিয়েন্সের মাতামাতি করবে সেটা খুব স্বাভাবিক, তাই না? তো ‘Surrogate mother’ বিষয়টি কী? একজন নারী গর্ভধারণের মতো কষ্টকর ও অস্বাচ্ছন্দ্যকর অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে না গিয়েও মা হতে পারেন- কিছু অর্থের বিনিময়ে গর্ভধারণের জন্য সাময়িকভাবে অন্য একজন নারীকে ভাড়া করে। সেক্স লাইফ এবং গর্ভধারণকে আলাদা করা সম্ভব হওয়ায় অনেক বিত্তশালী ব্যক্তি স্রেফ টাকার লোভ দেখিয়ে গরিব মেয়েদের শরীর ভাড়া করে সন্তান উৎপাদনের মাধ্যমে নিজেদের সন্তান আকাংক্ষা মেটাতে অথবা নিজেদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির প্রমাণ দিতে সক্ষম হচ্ছেন। নারীদের সন্তান ধারনে biological clock বা প্রাকৃতিক ঘড়ি বসানো থাকে। পঞ্চাশ দশকে এসে সেটা বিদায় নেয়। সন্তান ধারণে অক্ষম বিবাহিত নারীরা artificial insemination- এই সুবিধা ভোগ করে না। surrogation পদ্ধতির মাধ্যমে যে কোন সচ্ছল দম্পতি-ই যারা আর্থিক ব্যয়ভার বহন করতে সক্ষম তারাই সন্তান লাভ করতে পারেন। এক্ষেত্রে সন্তান উৎপাদনের ব্যবসায় সব রকম মহিলাই পাওয়া যায়। দরিদ্র মানুষ যাদেরকে অভাব খুব কাছ থেকে বোধ করতে হয়, তাদের কাছে টাকার বিনিময়ে সন্তাম হস্তান্তরে আপত্তি থাকার কথা নয়। কেননা শুধু জরায়ু ভাড়া দিয়ে ভ্রুণটিকে বিকাশ ও বৃদ্ধিতে সাহায্য করতে হয়, তাকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। অনেকটা মানুষ বানানোর মেশিন আরকি!
সন্তান উৎপাদনের এই বানিজ্যে সবরকম মহিলাই এখন প্রতুল। কেননা যেখানে দারিদ্র আছে সেখানে টাকার বিনিময়ে অন্যের সন্তান গর্ভে ধারণ করে হস্তান্তর করতে তো সমস্যা থাকার কথা নয়। কিন্তু ২০১৪ সালে ‘জার্নাল অফ ল, মেডিসিন অ্যান্ড এথিকস'-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়, ‘‘সারোগেসি বিষয়টি এখন এতই বাণিজ্যিক হয়ে গেছে যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সারোগেট মায়েদের শুধু লাভের কথাই জানানো হয়৷ এর সঙ্গে যে অনেক ধরনের ঝুঁকিও জড়িয়ে আছে তা তাদের বলা হয় না৷'' সারোগেসি বিষয়টা এখন এতটাই বাণিজ্যিক হয়ে উঠেছে যে, যুক্তরাষ্ট্রে অনেক এজেন্সি তাদের ওয়েবসাইটে সন্তান নিতে আগ্রহীদের ‘ক্লায়েন্ট', গর্ভ ভাড়া দেওয়া মায়েদের ‘ক্যারিয়ার' আর সারোগেসির মাধ্যমে গর্ভধারণ ব্যবস্থাপনাকে ‘সেলস' হিসেবে উল্লেখ করে থাকে৷ বাণিজ্যিক হওয়ার কারণে সারোগেসিকে সন্তান বেচা-কেনা বিষয়টির থেকে আলাদা করা যায় না বলে মনে করে নিউইয়র্ক স্টেট ‘টাস্কফোর্স অন লাইফ অ্যান্ড দ্য ল'৷ এর ফলে শিশুদের ক্ষতির মুখে পড়ার সম্ভাবনা থাকে বলে আশঙ্কা করেছে তারা৷
দোষটি অবশ্য বিজ্ঞান বা প্রযুক্তির নয়। এর ব্যবহারে স্বার্থ বিবেচনায়ই সকল মানবিক ও সামাজিক সমস্যার জন্য দায়ী। প্রজনন প্রযুক্তি যতই সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিক না কেন, সেখান থেকে নানা ধরনের পারিবারিক ও সামাজিক জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। সন্তান জন্মাদানের শেষ পর্যায়ে অনেক মা-ই চুক্তি মানতে রাজি হন না। সন্তানের প্রকৃ্ত মা কে সে সিদ্ধান্ত তখন নিতে হয় কোর্টকে। এই ধরনের জটিলতার শিকার হচ্ছেন প্রধানত মেয়েরা, কেননা গর্ভধারনের ব্যাপারটা প্রকৃ্তি প্রদত্তভাবে নারীর। কে মা আর কে নয় সেটা ঠিক করার দায়িত্ব কার? যার গর্ভে, রক্ত মাংসে বেড়ে সন্তান বেড়ে ওঠে, তিনি প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে হয়ে যান ভাড়াটে মা। যার জিন থাকবে তিনি যদি প্রাকৃ্তিক মা হন তবে যার গর্ভে বেড়ে উঠছে তিনি কেন নন? তাহলে গর্ভধারন এবং সন্তান প্রসবকে কী ছোট করে দেখা হচ্ছে না? সন্তানহীনা কোনো নারীকে অন্য এক নারী যদি মানবিক কারণে সন্তানবতী করতে এগিয়ে আসেন, তার শরীর নিঃসৃত ডিম্বানু জরায়ুতে ধারন করে ও প্রসব করে, এর মতো মহৎ কর্ম নিয়ে বিতর্কের কোনো সুযোগ নেই। তবে সেটা যদি হয় টাকার বিনিময়ে কোনো অভাবী নারীকে ভাড়া করা এবং পরবর্তীতে যদি সন্তান ধারনকারী সেই নারীর সকল মানবীয় অনুভূতিকে অবজ্ঞা করা হয় তবে সেটা কোনো মতেই শুভ কাজ বলে মেনে নেয়া যায় না।
অর্থের বিনিময়ে আর্থিক অসচ্ছল নারীর শরীরকে সন্তান বানাবার মেশিন বানানোর যে সংস্কৃতি চালু হচ্ছে, সেই শোষনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার সময় এসেছে। প্রজনন বিজ্ঞানকে ব্যক্তিজীবনে যথোচিত ব্যবহারের ব্যাপারে একটি সুষ্ঠ নীতি নির্ধারণ ও তার সঠিক প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জানুয়ারি, ২০২১ রাত ২:১৭