রোজিনা আপার কথা ঠিক কিভাবে শুরু করবো ভাবতে ভাবতেই কেটে গেলো দুটো দিন। রোজিনা আপার সাথে আমার পরিচয় এপ্রিসিয়েশন থেকে। প্রথম আলোতে তাঁর 'বারো আনাই মিছে' বাইলাইন স্টোরিটা পড়ে আপাকে কল দিয়েছিলাম। ট্রাফকের শহরে পিঠ চাপড়ে দেয়াটা বেশ সময় সাপেক্ষ আর ব্যস্ত রিপোর্টারের দেখা পাওয়াটা আরো কঠিন বলে আমাদের যোগাযোগ মেসেঞ্জার কিংবা ফোন কলেই বেশি হতো। প্রায় আবদার করি, ইউনিভার্সিটিতে এসে আমার কোর্সে একটা ‘লেকচার’ দিয়ে যান। আপা হাসেন, কি তোমার কি খেয়ে দেয়ে কোনো কাজ নাই। আমি জানি-ই বা কি, আর বলবো-ই বা কি’। আপনি অনেক কিছু জানেন আপা, আগেও বলেছি; আবারও বলছি। জানেন বলেই তো রোজিনা আপা এখন কাশিমপুর কারাগারে…
রোজিনা আপার বিরুদ্ধ্বে তথ্য চুরির অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে। কিছু অপবাদ এতটাই ছেলে মানুষি যে তা আলোচনার অযোগ্য। আলোচনার যোগ্য বিষয়-ই বা কোথায়? রোজিনা ইসলাম একজন সাংবাদিক। প্রথম সারির একটি দৈনিক পত্রিকাতে তিনি কর্মরত। রোজিনা ইসলাম তথ্য সংগ্রহে সচিবালয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে একজন পি এস এর কক্ষে বসতে দিয়ে, তাকে সাড়ে পাঁচ ঘন্টা অবরুদ্ধ রেখে শাহবাগ থানায় সোপার্দ করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ফাইলের ছবি তুলেছেন এবং নিজের কাছে রেখেছেন। তো সেই রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ন ফাইল কী সম্পর্কিত? টিকা ক্রয় সংক্রান্ত ফাইল। এখন কথা হচ্ছে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সামরিক পণ্যাদি সংক্রান্ত ফাইল হলে বুঝতাম তাতে দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের টিকা ক্রয় সংক্রান্ত চুক্তিনামায় এমন কী লেখা থাকতে পারে যে, একজন সংবাদিককে পুলিশে সোপার্দ করে মামলা দায়ের করতে হলো?
মানুষ যখন সাংবাদিকতা পেশা নিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে আমি মনে মনে হাসি। প্রায় একটা কথা ঘুরেফিরে বলি, এদেশের একজন চা বিক্রেতাও জানেন দেশ কিভাবে চালাতে হবে, শুধু জানেন না এক কাপ ভালো চা কিভাবে বানাতে হয়। এত লম্বা চওড়া কথা এজন্য বলছি কারণ আমি সাংবাদিকতা বিভাগের একজন আজীবন শিক্ষার্থী। এই বিভাগে ভর্তি থেকে শুরু করে শিক্ষাকতা পেশায় আসার আগ পর্যন্ত নানা অপ্রীতিকর মন্তব্য শুনতে হয়েছে। অপ্রীতিকর মন্তব্য এড়ানোর জন্য শিক্ষকতায় এসেছি তা নয়। সাংবাদিকতার স্ট্রেস নিতে পারবো না এটা আমি অনার্স শেষ বর্ষে ইন্টার্নশীপের সময়-ই বুঝে গিয়েছিলাম। একটা টেলিভিশন চ্যানেলে আমার ইন্টার্নশীপ সম্পন্ন হয়। ভেবেছিলাম মাস্টার্স শেষ করে একটু বড় হয়ে পারবো বোধহয়। মাস্টার্স শেষে প্রথম আলো থেকে অফার আসে কাজের। দুইদিন নিউজ রুমে কাজের প্রেশার দেখে শুনে সাংবাদিক হওয়ার স্বপ্ন চিরতরে ইস্তোফা দিয়ে শিক্ষকতায় এপ্ল্যাই করি। যে প্রফেশনের প্রেসার নিতে পারিনি, সেই পেশায় রোজিনা আপা যখন ক্যারিয়ারে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর দিকে এগোচ্ছেন আমার কেন জানি খুব ভালো লাগে। রোজিনা আপার ছায়াতে আমি হয়তো নিজেকে খুঁজি!
সোর্স বলে একটা টার্ম আছে পুলিশ প্রশাসন এবং সাংবাদিকতায়। সোর্সের কাজ হচ্ছে নানা তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করা। এই সোর্স’রা হন মূলত যে কোনো ঘটনার খুব কাছের কোনো ব্যক্তি। তো রোজিনা আপা সচিবালয়ে গিয়েছিলেন একজন সোর্সের কাছ থেকে একটা খাম সংগ্রহে। করেছিলেনও। তারপর একজন উপসচিবের সাথে হ্যালো বলতে যান। সাংবাদিকদের এই হ্যালো কিন্তু মোটেও নির্দোষ হ্যালো নয়। কারণ সাংবাদিকদের গন্ধ শোকার একটা ক্ষমতা থাকে। অনেক ক্ষেত্রে ঘটনার লুপহোল গুলো তারা ধরে ফেলতে পারেন। বক্তব্যের সত্য-মিথ্যা যাচাই করতে শুধু বলা কথা নয়, না বলা কথাও বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বিশ্লেষণে বের করে আনতে পারেন। এটা সোর্সের দেয়া তথ্যগুলো ক্রসচেক করা। তো সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের সোর্সকে ট্রেস করার জন্যও এই হয়রানি করা হয়ে থাকতে পারে।
রোজিনা আপা যখন একের পর এক অসাধারণ অনুসন্ধানী রিপোর্ট করে যাচ্ছেন ঠিক তখন তাকে ট্রাপে ফেলা হলো। যখন খারাপ শক্তি সমান দক্ষতায় পেরে ওঠে না, তখনই তারা ট্রাপের মতো একটা নেতিবাচক পদক্ষেপ নেয়। তো সাড়ে পাঁচ ঘন্টা আটকে রেখে নানাবিধ মানসিক নির্যাতনেও রোজিনা আপাকে টলানো যায়নি। ঐ যে বলে না ‘আপোষ কা মামলা’ নিশ্চয় রিমান্ড চাওয়া হয়েছিল রোজিনা আপার কাছ থেকে সোর্সের নাম বের করার জন্য। সাংবাদিকতার এথিকসে সোর্সের নাম বলার কোনো সুযোগ নাই। তাতে যদি এই রাষ্ট্র রোজিনা আপাকে তিন বছরে জেলও দেয় তাও না।
ডয়চে ভেলে’তে কর্মরত সাংবাদিক খালেদ মহিউদ্দিন এর নাম গুগল করলে যে প্রোফাইল আসে সেখানে একটা কোটেশন লেখা আছে ‘কেউ প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নই’। ক্ষমতায় থাকলে-ই শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না। অন্তত যে দেশে রোজিনা আপার মতো সাহসী সাংবাদিকরা আছেন, সে দেশে তো নয়-ই। খালেদ ভাই প্রথম আলোতে কর্মরত সময়ে এক সচিবের দুর্নীতি নিয়ে একটা রিপোর্ট করেছিলেন। তো সেই ব্যক্তি হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা খালেদ তথ্যগুলো আপনি কিভাবে পেলেন? খালেদ ভাই সিরিয়াস মুডে জবাব দিয়েছিলেন, সচিবালয়ের নিচে দাঁড়িয়ে ঝালমুড়ি খাচ্ছিলাম। দেখলাম প্যাকেটের গায়ে কিছু লেখা আছে। পরে অফিসে গিয়ে রিপোর্টটা করলাম।
অন্তত ‘চেকবুক’ জার্নালিজমের সাথে রোজিনা আপার কখনো নাম শুনিনি। ডেইলি স্টার এবং প্রথম আলোর সাংবাদিকদের যে কোনো প্রীতি উপহার নেয়ার ব্যাপারে অফিস থেকে স্ট্রিকটলি নিষেধ করা থাকে। এদেশে দুর্নীতিবাজদের জন্য অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা রীতিমত আতংকের নাম। দশ হাজার টাকার পর্দা, সাত হাজার টাকার বালিশ, তিন হাজার টাকা দিয়ে চামচ কেনার তথ্য আমারদের কোনো দিন জানা-ই হতো না, যদি রোজিনা আপার মত সাহসী এবং পরিশ্রমি সাংবাদিক না থাকতো। না আমি প্রথম আলোর ব্র্যান্ড এম্বাসিডর নই। প্রথম আলো আজ প্রথম স্থানে আছে কারণ সম্পাদক মতি ভাই ঝুঁকি নিতে জানেন।
গত দুইদিন ভীষণ খারাপ লাগছে আলভিনা’র কথা ভেবে। আট বছরের একটা বাচ্চামেয়ে কিভাবে এই দুঃসময় পার করছে সেটা ভেবে। সব দুঃসংবাদের মধ্যে এটা ভেবে স্বস্তি পাচ্ছি রোজিনা আপা বেঁচে আছেন- থাকবেন ইনশা আল্লাহ। আলভিনাও সারাজীবন গর্ব ভরে বলতে পারবে, ‘সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম আমার মা’।
দেশে দুর্নীতিবাজদের রাজত্ব চলছে। বিরাট একটা শক্তি হয়ে মাথাচাড়া দিয়েছে এরা। দূর্নীতি কেউ একা করতে পারেন না। এটা এখন একটা চেইন সিস্টেম। সেই সিস্টেমে কার আঁতে ঘা লেগেছে? কার বেগম পাড়ায় বাড়ি কিনতে দেরি হচ্ছে সেটা ভালো ভাবে খুঁজে দেখা দরকার। দেশের এই পরিস্থিতিতে আমাদের শাসক দরকার নেই, প্রয়োজন একজন নেতার। স্বাধীনতার ৫০বছরে দাঁড়িয়ে একজন নেতার অপেক্ষার প্রহর গুনছে জাতি।
আপনাকে অনেক ভালোবাসি আপা...
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মে, ২০২১ দুপুর ২:১৭