কক্সবাজারঃ প্রিয় সমুদ্র দর্শন
ঢাকা থেকে কক্সবাজার এসি বাসের ভাড়া ৯৫০ টাকা; 'এস ক্লাস'-এর ভাড়া ১২৬০। একটু আরামের আশায় দ্বিতীয় অপশনটিই বেছে নিলাম। কিন্তু কিসের কী? কাউন্টারের ওয়াশরুম থেকে শুরু করে বাসের ভেতর সবখানে বেহাল অবস্থা । আসনগুলো অপরিচ্ছন্ন। এসির ঠান্ডা থেকে বাঁচার জন্য কম্বল চাইতেই পাওয়া গেলো দুর্গন্ধযুক্ত ব্যবহূত একটি কম্বল। করার কিচ্ছু নেই। বাধ্য হয়ে তা-ই ব্যবহার করতে হলো।
বিসমিলস্নায় গলদ দেখে প্রমাদ গুনলাম; ভ্রমণের বাকি সময় কেমন জানি কাটে! অতোটা অবশ্য খারাপ কাটলো না। সকালে কক্সবাজারে পৌঁছেই বীচ-লাগোয়া হোটেলের পাঁচতলায় একটি রুম পেয়ে গেলাম। রুমের জানালা ও বারান্দা থেকে সমুদ্র দেখা যায়। মনটা ভালো হয়ে গেলো। হোটেলের ডেস্ক থেকে জানানো হলো: ঈদ-পরবর্তী তিন-চারদিন এই রুমের ভাড়া ছিলো ২৪০০ টাকা। এখন এরই ভাড়া আমাকে দিতে হবে ১২০০ টাকা করে। নিজেকে ভাগ্যবান (!) মনে হলো।
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে কয়েক বছর আগে এসেছিলাম। পরিবর্তন বলতে সৈকতের বিশ্রামের আসনগুলোর (সৈকত-বেঞ্চি!) ভাড়া ঘন্টায় ২০ টাকা থেকে বেড়ে ৩০ টাকা হয়েছে, আর সৈকতের কাছাকাছি বেশ কয়েকটি বড় বিল্ডিং-এর কংকাল দাঁড়িয়ে আছে। ভাবতে অবাক লাগে, দেশটাতে কি পরিকল্পনামাফিক কিছুই হবে না! ইউরোপ ভ্রমণের সময় আমি বিদেশি সাংবাদিকদের কাছে বিশ্বের বৃহত্তম সমুদ্র সৈকতের গল্প করেছি গর্বভরে। আমাদের এই গর্বের জায়গাটি নিয়ে যেসব অনিয়ম হচ্ছে তা বন্ধ করার কেউ কি নেই? পরিবর্তন আরেকটি লক্ষ্য করলাম: কক্সবাজারের রাস্তাজুড়ে রিক্সার চেয়েও বেশি ব্যাটারি-চালিত 'টমটম'। আমরা সেই টমটমে চড়েই গিয়েছিলাম ইনানী সৈকত আর হিমছড়ির সৌন্দর্য-হারানো ঝর্ণা দেখতে। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।
আবহাওয়া খারাপ থাকার কারণে সেন্ট মার্টিনস-এ যাওয়া হয়নি। দুধের সাধ ঘোলে মেটানোর জন্য মহেশখালী যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে পৌছলাম ৬ নম্বর ঘাটে। ওখান থেকে স্পীডবোটে মহেশখালী যাওয়া যায়। ভাড়া জনপ্রতি ৬৫ টাকা+ঘাটের ৬ টাকা। কিন্তু আমাদের দু'জনকে নিয়ে স্পীডবোট ছাড়া হবে না; অপেক্ষা আরো ৮ জন যাত্রীর। আধঘন্টা অপেক্ষার পর যাত্রী মিললেও তারা ছিল ১১ জনের একটি গ্রুপ। আমাদের গতি হলো না। অবশেষে আরো মিনিট দশেক অপেক্ষার পর ৬০০ টাকায় একটি স্পীডবোট রিজার্ভ করে রওয়ানা হলাম। পরে জানলাম 'কস্তুরি ঘাট' থেকে উঠলে এই জরিমানা লাগতো না। কারণ, কস্তুরি ঘাট থেকে শত শত যাত্রী মহেশখালী যাতায়াত করে। তাহলে হোটেল থেকে আমাকে কেন ৬ নম্বর ঘাটে আসতে বলা হয়েছিল? প্রশ্নটা আর করা হয়নি।
সমুদ্রের বড় বড় ঢেউ-এর ওপর দিয়ে স্পীডবোট ভ্রমণটা আনন্দদায়ক ছিল। কিন্তু মহেশখালী (কক্সবাজারের একটি উপজেলা। এটি একটি দ্বীপ।) ও এর দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্য দেখে মনটা আনন্দে ভরে গেলো। কী সুন্দর এর পাহাড়, পানের বরজ, আদিনাথ মন্দির, বৌদ্ধ মন্দির! আদিনাথ মন্দিরটি একটি উঁচু টিলার ওপর। ওখান থেকে দূরের ল্যান্ডস্ক্যাপ দেখে মন আনন্দে নেচে না উঠে পারে না। মোহাম্মদ মুনির নামের এক রিকশাওয়ালা ছিল আমাদের 'অবৈতনিক' গাইড। না চাইতেই সারাক্ষণ আমাদের সাথে সাথে থাকলো। পরে বুঝেছি, ওটা ওর যাত্রী ধরার কৌশল। সে যাক, মনিরের কল্যাণেই জানতে পারলাম মহেশখালীতেও সমুদ্র সৈকত আছে। তবে সে সৈকতে জল থাকে কেবল জোয়ারের সময়। অনেক আশা নিয়ে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে কাঙ্ক্ষিত জায়গায় বালুময় সৈকত তো চোখে পড়লো, কিন্তু জল কোথায়? মনির বললো: এখন ভাটা। জলহীন সৈকতের বালুতে হাঁটাহাঁটি করার সময় সেন্ট মার্টিনস-এ যেতে না-পারার দুঃখটা আরো একবার নাড়া দিয়ে গেল। মহেশখালীর বিখ্যাত পান খেয়ে ফেরার পথে আর ভুল করলাম না। ওখানেও দেখলাম দুটো ঘাট। আদিনাথ মন্দিরে যাবার সুবিধার জন্য নেপাল সরকার দ্বিতীয় ঘাটটি বানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ওখানে স্পীডবোট আসে কালেভদ্রে। পুরনো ঘাট দিয়েই লোকজন বেশি চলাচল করে; স্পীডবোটের আনাগোনাও ওখানে বেশি। তেমনি একটি স্পীডবোটে ফিরে এলাম হোটেলে।
কক্সবাজার শহর থেকে ইনানী সৈকতের দূরত্ব প্রায় ২০ কিলোমিটার। গিনি্ন বললেন, ওখানে পাথর আছে; ছোটোবড় অসংখ্য পাথর। তবে সমস্যা হচ্ছে, সে-পাথর দেখা যায় কেবল ভাটার সময়। তাই অনেক পরিকল্পনা করে সেখানে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। প্রায় দু'দিন ধরে সুমন নামের এক 'টমটম' চালক পেছনে লেগে থেকে আমাদের সেখানে নিয়ে যাবার কাজ আদায় করলো। চুক্তি হলো, সে আমাদের ইনানী সৈকত আর হিমছড়ি ঝর্ণা দেখিয়ে নিয়ে আসবে, বিনিময়ে পাবে ৫০০ টাকা। সৈকতের পাশের মেরিন ড্রাইভ ধরে সড়ক পথে ইনানী যাত্রা ছিল আনন্দদায়ক। ইনানী সমুদ্র সৈকতে পাথরের হাল দেখে গিন্নী খানিকটা হতাশ হলেন। এতো পাথর গেলো কোথায়!? তার বিস্ময়-মাখানো প্রশ্ন। আমার কাছে এ প্রশ্নের জবাব না-থাকাই স্বাভাবিক। আমি এর আগে এখানে আসিনি। আমার কাছে বরং ইনানীর পাথরের সমাহার ভালোই লাগলো। খানিকটা পরিকল্পনার ছাপ থাকলে এই সৈকতটিকে আরো সুন্দর করা যেতো বলে আফসোসও হলো।
ফেরার পথে হিমছড়ি ঝর্ণা দেখে গিন্নীর সাথে আমি নিজেও হতাশ হলাম। কোথায় ঝর্ণা! এতো একটি ছোট্ট পাহাড়ী ছড়া মাত্র! গিনি্ন জানালেন, এক সময় এটি বড় ঝর্ণাই ছিল। আমার চোখে তখন ভেসে উঠলো যুক্তরাষ্ট্রের পোর্টল্যান্ডের সেই বিশাল ঝর্ণা। তুলনামূলকভাবে আমাদের এই ঝর্ণা (!) বেশ ছোটোই বটে। তবে ঝর্ণা দেখে হতাশ হলেও, একটি উঁচু টিলায় চড়ে সেখান থেকে সমুদ্র দেখার অনির্বচনীয় আনন্দ পেলাম। টিলায় ওঠার জন্য পাকা সিঁড়ি বানানো হয়েছে। সুমন জানালো, সিঁড়ির ধাপ আছে ৩০০-এরও বেশি। সেই সিঁড়ি বেয়ে ওঠা খানিকটা কষ্টসাধ্য। কিন্তু ওঠার পর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে যে আনন্দ পাওয়া যায় তার তুলনায় এই কষ্ট নস্যি। জানিয়ে রাখি, হিমছড়ি ঝর্ণা দেখতে ও সিঁড়ি বেয়ে টিলায় উঠতে দর্শনাথর্ীদের মাথাপিছু ২০ টাকা করে গুনতে হয়।
ইনানী ও হিমছড়ি ঘুরে কক্সবাজার ফেরার পথে ব্যাপারটা ভালো করে খেয়াল করলাম। রাস্তার দু'পাশে গড়ে উঠছে বিভিন্ন আবাসন প্রকল্প। প্রায় সবখানেই চটকদার সাইনবোর্ড। মনে প্রশ্ন জাগলো: এসব প্রকল্প কি আইন মেনে করা হচ্ছে? এ-ব্যাপারে কি সরকারের কোনো পরিকল্পনা আছে? পৃথিবীর বৃহত্তম সমুদ্র সৈকতকে নিয়ে এক শ্রেণীর ভূমিদসু্য ব্যবসার ধান্ধা করছে নাতো?
২০ সেপ্টেম্বর ২০১০। রাত পৌনে ১১টার বাসে ঢাকায় ফিরবো। টিকিট কেটেছি ভিন্ন একটি কোম্পানির এসি বাসের (যদিও ফলাফল একই রকম। বাসের আসনগুলো মোটেই আরামদায়ক নয়। ১৪ ঘন্টার জার্নির জন্য তো নয়ই)। শেষ মুহূর্তের জন্য কলাতলি সমুদ্র সৈকতে যাচ্ছি সমুদ্র দর্শনে। এমন সময় মুঠোফোনে খবর এলো, ঢাকা থেকে যানজটের কারণে বাস আসতে দেরি হবে এবং কক্সবাজার থেকে গাড়ি ছাড়বে রাত সাড়ে বারোটায় (বাস্তবে অবশ্য গাড়ি ছেড়েছে রাত ১টায় এবং যানজটের কারণে সেই গাড়ি ঢাকায় পেঁৗছেছে পরদিন বেলা আড়াইটায়)। ভাবলাম, যাক ঘন্টা দুয়েক সময় বোনাস পাওয়া গেলো সমুদ্রের কাছে কাটিয়ে দেয়ার জন্য।
খণ্ডিত চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে সমুদ্র সৈকত আর সমুদ্রের জল। এক মায়াবি পরিবেশ। আমরা শুয়ে আছি ঘন্টায় ২০ টাকা দরে ভাড়া নেয়া সৈকত-বেঞ্চিতে (রাতে ওরা ভাড়া খানিকটা কমই রাখে!)। সময় রাত সাড়ে আটটা। আমাদের মতো সমুদ্রপ্রেমীর সংখ্যা তখনও নেহায়াত কম নয়। কেউ সমুদ্রের জলে নাইছে, কেউ পা ভেজাচ্ছে, কেউ ঘুরে বেড়াচ্ছে, আবার অনেকে আমাদের মতো আয়েসে গা এলিয়ে দিয়ে রাতের সমুদ্র দেখছে। ঠিক সে সময় আমাদের সামনে দিয়ে হেলে-দুলে এগিয়ে গেলো দু'জন পুলিশ (একজন সাধারণ পুলিশ আর আরেকজন দাঙ্গা পুলিশ)। একটু কৌতূহলী হলাম। এতোবড় সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে আসা পর্যটকদের নিরাপত্তার বিষয়টি আমাকে আসার পর থেকেই খোঁচাচ্ছিল। প্রথমবারের মতো পুলিশ দেখলাম। আমার চোখ তাদের অনুসরণ করল। কিছুদূর যেয়ে তারা থামলেন। সেখানে পাশাপাশি রাখা তিনটি সৈকত-বেঞ্চিতে শুয়ে সমুদ্র দেখছিল তিন যুবক। দেখলাম পুলিশ তাদের সাথে কথা বলছে। একটু পর সব পরিষ্কার হলো। তিন যুবক (যারা নিজেদের ছাত্র বলে পরিচয় দিলো) শুয়ে-বসে মদ্যপান করছে। পুলিশের সাথে তাদের অনেকক্ষণ কথাবার্তা হলো। আমার চোখ যদি প্রতারণা না-করে থাকে তবে দেখলাম, কিছু আদান-প্রদান হলো এবং পুলিশ দু'জন চলে গেলেন।
আমি গিন্নীকে নিয়ে মদ্যপায়ী যুবকদের কাছ থেকে খানিকটা দূরে গিয়ে বসলাম (খানিকটা অস্বস্তিতে, খানিকটা ভয়ে)। কিছুক্ষণ পর পুলিশ দু'জনকে আবারো ফিরে আসতে দেখে তাদের হাত ইশারায় ডাকলাম। তারা এলেন। আমি বললাম, ছেলেগুলোর কি মদ খাওয়ার লাইসেন্স আছে? পুলিশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললেন, না নেই। আমি বললাম, থাকলেও ওরা খোলা সৈকতে বসে মদ খেতে পারে না; পারে কি? পুলিশ বললেন, না পারে না; এটা আইনবিরুদ্ধ। আমি বললাম, তাহলে ওদের চলে যেতে বলছেন না কেন? আমার কথা শুনে পুলিশ দু'জন ছেলেগুলোর কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ কথা বললেন। তারপর ফিরে এসে আমাকে বললেন, ওদের কাছে আর মদ নেই। সব খেয়ে ফেলেছে। ওরা কোনো ঝামেলা করবে না। আমি শুনে তাজ্জব হলাম এবং সৈকতে আসা সাধারণ নারী-পুরুষদের নিরাপত্তার কথা ভেবে আরেক দফা আতংকিত হলাম। ইচ্ছে ছিল আরো কিছুটা সময় সমুদ্রের গান শুনবো। কিন্তু ওই 'সোনার ছেলেদের' এবং 'জনগণের বন্ধু' পুলিশের কর্ম দেখে বিষণ্ন মনে উঠে গেলাম। মনে মনে বললাম, প্রিয় সমুদ্র আমার, বিদায়।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ডিসেম্বর, ২০১০ দুপুর ২:০৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




