somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অবরুদ্ধ আর্তনাদ (পাকিস্থান প্রেমী বঙ্গ সন্তানদের জন্যে)

০১ লা ডিসেম্বর, ২০১১ সকাল ১০:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



নাজনিন দ্রুত টাকাগুলো গুনে টিনের কৌটায় ভরে রাখে। পাশে তখনও পড়ে ছিল ভাঙ্গা মাটির ব্যাঙ্কটা। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ভাঙ্গা টুকরাগুলো। সব কেমন যেন এলোমেলো।
এমন সময় হঠাৎ রুম্পা এসে বলল, “কী রে দিদি? জমানো টাকা নিয়ে কই যাস?”
নাজনিন ভাঙ্গা অংশগুলো পরিষ্কার করতে করতে বলল, “কোথায় আবার যাবো? পরে সুযোগ মত ভাঙতে পারি কিনা ঠিক নাই। তাই আগেই ভাঙলাম। এখন এই টিনের কৌটায় থাকলো। দরকার মত বের করতে পারবো পরে।”
রুম্পা তবুও নাছোড়বান্দা। হাসতে হাসতে বলল, “কেন? রফিক ভাই কি তোকে নিতে আসবে না? এমন সময় তোকে দূরে রেখে থাকতে পারবে সে?”
নাজনিন এবার রুম্পার দিকে তাকায়। তারপর মনেমনে হাসে। রুম্পা চটাস চটাস কথা শিখছে। বয়স মাত্র চোদ্দ অথচ কথা বলে বড়দের মত।
“আমাকে ছাড়াতো সে ভালই আছে। এক মাস হতে চলল, কিন্তু কোন খবর নাই।”
নাজনিনের উত্তরে কিছুটা অনুযোগ এবং কিছুটা কষ্টও ছিল। চোদ্দ বছরের রুম্পাও সেটা বোঝে। তাই বলল, “না রে দিদি। রফিক ভাইতো ঢাকায় এখন। গতকাল আসাদ ভাই বলছিল ওখানে নাকি অবস্থা খুব খারাপ। তুই চিন্তা করিস না। দেখবি হয়তো দুই-এক দিনের মধ্যে চলে আসবে”
নাজনিন অবাক হয়ে দেখতে থাকে রুম্পা বড়দের মত করে কথা বলছে। ওর দুচোখ ভর্তি মায়া। এত মায়া বোনটার চোখে এলো কোথা থেকে? নাজনিনের কেমন যেন লাগে। তাই আর বোনের সামনে দাঁড়ায় না। রান্না ঘরে চলে যায়।
যদিও নাজনিন রুম্পাকে বলেছিল রফিক খবর নেয় নি। কিন্তু আসলে তা সত্য নয়। নিয়েছিল খবর। তবে মাত্র একবার। রফিকের বন্ধু আসাদ থাকে নাজনিনদের পাশের বাড়িতে। এক ছেলেকে দিয়ে হাতে হাতে আসাদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছিল রফিক। ডাকে পাঠালে সেই চিঠি পৌঁছে কিনা সে বিষয়ে রফিকের সন্দেহ ছিল। তাই এই ব্যবস্থা। পরে আসাদ নাজনিনকে সেই চিঠি দিয়েছিল। সেখানে রফিক লিখেছিল, “বৌ, চিন্তা করবা না। কয়েকদিন পরেই আসতেছি। শেখ সাহেবকে পশ্চিমারা ঘুরাচ্ছে। ওরা মনে হয় সৈন্য আনতেছে। শেখ সাহেবও হয়তো বুঝতে পারতেছেন। কিন্তু কিছু করার নাই। কেমন যেন সব কিছু আটকে গেছে। মনে হচ্ছে এইবার কিছু একটা হবে।” ১৭ তারিখে লেখা এই চিঠিটার পর এক সপ্তাহ কেটে গিয়েছে। রফিক আসে নি বা আর খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করে নি।



রাতে খেতে বসে নাজনিনের বাবা আজহার হোসেন বিগলিত গলায় বললেন, “বুঝলা কন্যারা, কৈ মাছের উপর কোন মাছ নাই। আল্লাহপাক কী অসীম কুদরত দিয়ে এই মাছ বানাইছেন। দেখ এর পেটের দিকে কাঁটা আর কাঁটা। অথচ পিঠের দিকে কোন কাঁটা নাই। বড় বড় মাছ ধরে আনো। দেখবা সব মাছের পিঠে কাঁটা, পেটে নাই। এই মাছে উল্টা।”
রুম্পা বলল, “কেন বাবা? রূপচান্দা মাছে তো পিঠে-পেটে কোথাও কাঁটা নাই।”
আজহার হোসেন মেয়ের কথায় বিরক্তবোধ করলেন। মাছটা খেতে সুস্বাদু হয়েছে তাই একটু প্রশংসা করছিলেন। কিন্তু এখন মেয়ে সেটা নিয়ে তর্ক বাধাচ্ছে। তবে এটা ভেবে তিনি খুশিও হলেন যে মেয়ে বুদ্ধিমতী হয়েছে। কথার পিঠে চট করে একটা যুক্তি দেয়া চাট্টিখানি কথা নয়।
“মা জননী, তোমার কথাও ঠিক। তবে একেবারে কাঁটা ছাড়া মাছ খাওয়া ঠিক না। মাছে কাটা থাকবে। সেটা বাইছা খাবা। এটা দুনিয়ার নিয়ম। খাওয়াও তোমারে শিক্ষা দিবে। বেহেস্তি খাওয়া অন্য জিনিস। আল্লাহপাক তোমারে এমন জিনিস খাওয়াবে যা চাবানোও লাগবে না। আপনাআপনি পেটে যাবে। তবে দুনিয়ার জন্য ঐ নিয়ম না। এইখানে কষ্ট করে বাঁচতে হয়। তাই আমাদের প্রতিদিনের কাজেও সেটার প্রকাশ থাকা দরকার।”
নাজনিন এতক্ষণ বাবা এবং বোনের কথা শুনছিল। কিন্তু এবার আর থাকতে না পেরে বলল, “বাবা, এটা তো তোমার স্কুল না। এখানে তুমি হেডমাস্টারও না। এটা তোমার ঘর। আমরা তোমার মেয়ে, ছাত্রী না।”
আজহার হোসেন আবারও বিগলিত গলায় বললেন, “মা-রে, বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র। এই দুনিয়ায় সব সময় আমরা কিছু না কিছু শিখছি। এখানে সবাই আমরা সবার ছাত্র। দেখলি না ঐ কৈ মাছটার কাছ থেকে একটু আগে কী শিখলাম আমি?”
নাজনিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বাবাকে কিছু বলে লাভ হবে না। সেটা সে বোঝে। ওর মা মারা গিয়েছেন যখন নাজনিন ছোট। সেই থেকে ওদের তিন জনের পরিবার। গত ডিসেম্বরে নাজনিনের বিয়ে হয়েছে রফিকের সাথে। এখনও নাজনিনকে তুলে নেয় নি। রফিক ঢাকায় এম.এ. পড়ছে। পড়া শেষে একটা চাকরি পেলেই নাজনিনকে ঢাকায় নিয়ে যাবে। আপাতত সে বাবার বাড়িতেই আছে।
নাজনিনকে চুপ করে থাকতে দেখে ওর বাবা বললেন, “আমার বড় কন্যা কি কোন কারণে চিন্তিত?”
নাজনিন কিছু বলার আগেই রুম্পা হাসতে হাসতে বলল, “দিদি দেশ নিয়ে চিন্তিত।”
“দেশ নিয়ে চিন্তার কিছু নাই। এই দেশ মুসলমানের দেশ। ভাইয়ে ভাইয়ে বিবাদ লাগছে। মিটে যাবে। এর আগেও এমন হইছে। আবারও হবে। এটারে বলে রাজনীতি।”
“তোমার জামাই বলছিল এবার নাকি পরিস্থিতি খুব খারাপ। পশ্চিম থেকে সৈন্য আসতেছে।” নাজনিন নিচু গলায় বলল।
তবে নাজনিনের কথায় আজহার হোসেন বিরক্ত হলেন। তাই বললেন, “সৈন্য আনতেছে তো কী হইছে? মনে রাখবা ওরা সাচ্চা দিল মুসলিম। পশ্চিমারা বাঙালীদের মত মুখে মুসলিম না। সাধারণ মানুষের ঐ সৈন্যদের ভয় পাবার কোন কারণ নাই।”
বাবার কথায় নাজনিন কোন জবাব দেয় না। কিন্তু ওর মন বলছিল বাবা যতই কারণ নাই বলুক। কারণ অবশ্যই আছে। না হলে পশ্চিমা সৈন্য এই দেশে কেন আসছে?



২৭ তারিখ সব কিছু কেমন যেন স্থবির হয়ে গেলো। সেদিন ছিল শনিবার। বিকেলের পর থেকে সবার মুখে মুখে শোনা যেতে লাগলো ঢাকায় আর্মি নেমেছে। গোলা-গুলি হয়েছে অনেক। পরিস্থিতি খুব খারাপ। নাজনিন খুব চিন্তিত হয়ে পড়লো। ওর চিন্তাকে আরো বাড়িয়ে দিল সন্ধ্যার পর রেডিওতে এক আর্মি আফিসারের দেয়া ঘোষণায়। মেজর জিয়া নামের সেই অফিসার কয়েকবার রেডিওতে বললেন যে শেখ সাহেব নাকি স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন। কিন্তু কেউ কেউ আবার বলাবলি করতে লাগলো শেখ সাহেবকে ধরে পশ্চিমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কার কথা যে বিশ্বাস করবে সেটাই বোঝা কষ্টকর হয়ে দাঁড়াল।
বিভিন্ন পক্ষের কথা শোনার পর আজহার হোসেন মেয়েদের বললেন, “এই সব গুজবে কান দিয়ে লাভ নাই। আমরা আমাদের মত থাকবো। রাজনীতির প্যাচ, বড় প্যাচ। সেটা তোমরা বুঝবা না।”
তবে নাজনিন লক্ষ্য করলো ওর বাবা মুখে স্বাভাবিক থাকার কথা বললেও তার চেহারায় চিন্তার ছাপ পড়েছে। তিনি চিন্তিত। কোন বিশেষ কারণে তিনি চিন্তিত।
সেদিন রাতেই দশ-বারো জন সৈন্যের একটা দল নিয়ে এক মেজর এলো নাজনিনদের গ্রামে। থাকার জন্যে তারা বাড়ি খুঁজছিল। শেষ পর্যন্ত হেডমাস্টার সাহেবের বাড়িটাই তাদের মনে ধরল। আজহার হোসেন বসার ঘরটায় মেজর সাহেবের থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। বারান্দা আর বসার ঘরের পাশেরটায় সৈন্যদের থাকারও ব্যবস্থা হলো।
রাত একটু গভীর হলে আসাদ এসে আজহার হোসেনকে বলল রফিক খবর পাঠিয়েছে যেন নাজনিন এবং রুম্পাকে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেন। পশ্চিমা আর্মির ব্যবহার ভালো ঠেকছে না। কিন্তু আজহার হোসেন কথাটা কানে তুলনে না। তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, “এরা সবাই মুসলিম। সকল মুসলিম ভাই-ভাই। আমার মেয়েরা ওদের কাছে বোনের মত।”
আসাদ তবুও আবার অনুরোধ করতে যাচ্ছিল। কিন্তু ওকে থামিয়ে দিয়ে আজহার হোসেন বললেন, “দেখো, সমস্যাটা পশ্চিমাদের নিয়ে না। সমস্যটা তোমাদের নিয়ে। তোমরা নাকি এক হয়ে ভারত যাচ্ছ ট্রেনিং নিতে? রফিকও যাচ্ছে তাই না? নাকি চলে গেছে?”
আসাদ আর কোন কথা বলে নি। দূরে নাজনিন চুপচাপ দাঁড়িয়ে সব শুনছিল।



পরদিন সকাল থেকে পশ্চিমা আর্মির সেবা করতে করতে নাজনিন এবং রুম্পা ক্লান্ত হয়ে পড়লো। তাদের জন্যে রুইমাছ, কৈ মাছ, গরুর গোশতো ভূনা সহ আরো বিভিন্ন খাওয়া রান্না করতে হচ্ছিল। আজহার সাহেব বারবার রান্নাঘরে গিয়ে বলছিলেন, “কন্যারা, এরা দেশের সেবক। আমাদের নিরাপত্তার জন্য এদের পাঠানো হয়েছে। দুনিয়ার কোন প্রান্ত থেকে এরা এসেছে! এদের সেবা করা আমাদের কর্তব্য।”
নাজনিন বাবার কথার কোন উত্তর দেয় নি। যেভাবে বাবা বলছিল, সেভাবেই কাজ করে যাচ্ছিল। রুম্পা খাওয়া-দাওয়া নিয়ে সৈন্যদের দিয়ে আসছিল। এর মাঝে মেজর সাহেব আজহার হোসেনের সাথে দাবা খেলতে বসল। প্রথম দুইবার খুব দ্রুত সে হেরে গেলো। তারপর তৃতীয় বার খেলতে বসল খুব মনোযোগ দিয়ে। খেলতে খেলতে আজহার হোসেনকে ইংরেজিতে বলছিল, “তোমরা বাঙালীরা দেখতে হাবাগোবা হলেও তোমরা অনেক চালাক। তোমাদের চেহারা দেখে বিচার করলে ভুল হবে।”
আজহার হোসেন মেজরের কথায় “হা হা” করে হাসছিল। কিন্তু বুঝতে পারে নি এই কথার আসল অর্থ কী।
বিকেলের দিকে খবর আসতে লাগলো সৈন্যরা নাকি বিভিন্ন বাড়িতে লুটপাট করেছে। আজহার হোসেন বিশ্বাস করলেন না। নাজনিন এবং রুম্পাকে বললেন, “এগুলা সব বানানো কথা। মেজর দেখছো কীভাবে ইংরেজি বলে? জন্মাইছে পাঠানের ঘরে। আসলে তো সাহেব। এরা গ্রামে-গঞ্জে লুটপাট করবে? আমাকে কি পাগলে পাইছে যে বিশ্বাস করবো?”
সন্ধ্যার পর পেছনের দরজা দিয়ে চুপিচুপি আবার আসাদ এলো। এবার আসাদ আর অনুরোধ নিয়ে আসে নি। সে এসেছে নাজনিন এবং রুম্পাকে নিয়ে যেতে। নৌকা অপেক্ষা করছে ঘাটে। ওদের নিয়ে চরের দিকে চলে যাবে আসাদ। পশ্চিমারা মরুভূমির মানুষ। পানিতে তারা খুব একটা পারবে না। এই জন্যে চরে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে আসাদ।
কিন্তু আজহার হোসেন কিছুতেই মেয়েদের ছাড়বেন না। তিনি চিৎকার করে বললেন, “আমার মেয়েদের ভালো আমি বুঝবো। তোমাদের এখানে আসতে হবে না।” তাঁর হাপানীর সমস্যা ছিল। উত্তেজনায় তাঁর হাপানীর টান উঠে গেলো।
আসাদ দেখলো পরিস্থিতি খারাপ। তাই সে আর কিছু না বলে বের হয়ে যায়। কিন্তু নাজনিনদের বাড়ির আসে পাশেই ঘুরতে থাকে। আসাদ বুঝতে পারছিল সময় ঘনিয়ে এসেছে। হয়তো আজ রাতেই কিছু একটা ঘটবে।



মধ্য রাতে মেজর সাহেব হুইস্কির বোতল খুললেন। আজহার হোসেনের ব্যাপারটা ভালো লাগছিল না। মুসলমান মদ খাবে, এটা কেমন কথা? কিন্তু মেয়েদের বললেন উল্টা কথা। “বুঝলা মায়েরা, সাহেব মানুষ। সাহেবদের এইসব ছাড়া মানায় না। তাছাড়া, জিনিসটা খারাপ না যদি সীমিত খাওয়া হয়। আরব জমানায়ও খাওয়া হতো।”
নাজনিন বাবার কথায় বিরক্ত হয়ে বলল, “বাবা, ওদের সাফাই গেয়ে তুমি আর একটা কথাও বলবা না। এদের আচরণ আমার একদম সুবিধার লাগছে না। পশ্চিম পাড়ার আশরাফ চাচাকে নাকি এরা মেরে ফেলছে। মালতীদের বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দিছে। তুমি তো কিছুই বিশ্বাস করছো না। এরা ঘরে বসে খাসির রেজালা খাচ্ছে আর বাইরে মানুষ মারছে।”
আজহার হোসেন কোন কথা বলতে পরলেন না। এই প্রথম তাকে অনেক ভীত দেখালো।
আরেকটু রাত গভীর হবার পর মেজর সাহেবের মাতলামি চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছল। এক সময় এসে মেয়েদের ঘরের দরজায় ঘা দিতে লাগলেন। রুম্পা ঘুমিয়ে গিয়েছিল। নাজনিন উঠে দেখলো রীতিমত দরজায় লাথি চালাচ্ছে সে। সমস্যা হচ্ছে এই ঘরে অন্য কোন দরজা নেই। তাই ওদের বের হতে হলে ঐ দরজা দিয়েই বের হতে হবে।
দরজায় লাথি দেয়ার শব্দ শুনে নাজনিনের বাবা তাঁর ঘর থেকে বের হয়ে আসেন। তিনি গিয়ে মেজরকে উর্দুতে বললেন, “কী হয়েছে স্যার? এটা আমার মেয়েদের ঘর।”
সেটা শুনে মেজর একটা কুৎসিত হাসি দিয়ে বলল, “সেই জন্যই তো যাচ্ছি। তোমার দুইটা জোয়ান মেয়ে আছে ঘরে আর আমরা বাইরে বসে আঙ্গুল চুষবো?”
আজহার হোসেন বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলেন মেজরের দিকে। এই লোকটার সাথেই সকালে কথা হয়েছে। নিতান্তই ভদ্র মানুষ। অথচ এখন কী সব বলছে?
এর মধ্যে মেজর হুঙ্কার দিয়ে তার কয়েকটা সেপাইকে ডেকে বলল, “দরজা ভাঙ্গ। তারপর দুইটারেই ধরে আমার রুমে দিয়ে যাও।”
পশ্চিমা পাঞ্জাবী সেপাইদের লোভাতুর চোখ চকচক করে উঠল। মাল টেনে টাল হয়ে থাকা মেজর যে খুব বেশী কিছু করতে পারবে না সেটা বুঝতে তাদের সমস্যা হয় না। এরপর পুরা রাততো ওদের জন্যে পড়েই আছে!
নাজনিন ভেতর থেকে শুনতে পাচ্ছিল রাইফেলের বাট দিয়ে দরজার উপর আঘাত করার শব্দ। দরজা ভাঙ্গা হচ্ছে। এরপর কী হবে? নাজনিন অনুভব করছিল সে যেন নিঃশ্বাস নিতে পরছে না। রাইফেলের বাটের শব্দে রুম্পাও ঘুম থেকে উঠে পড়েছিল। নাজনিন দ্রুত দৌড়ে গিয়ে টিন খুলে টাকাগুলো বের করে শাড়ির আঁচলে বেধে নেয়। তারপর দিশেহারার মত এদিক সেদিক তাকাতে থাকে। হঠাৎ ভেতর থেকে ওরা দুই বোন শুনতে পায় আজহার হোসেন সেপাইদের বাধা দিচ্ছে দরজা ভাংতে। অনুনয়-বিনয় করছে। তাতে যেন সেপাইদের অট্টহাসি আরে বেড়ে যাচ্ছিল। এক সময় আজহার হোসেন পাগলের মত চিৎকার করতে শুরু করলেন। কী বলছিলেন ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। হঠাৎ দরজায় রাইফেল-এর বাট চালানোর শব্দ কমে এসে ধস্তাধস্তির শব্দ শোনা গেলো।
“বাবা কি মারামারি করতেছে ওদের সাথে?” রুম্পা ভীত গলায় নাজনিনকে জিজ্ঞেস করে। কিন্তু নাজনিন কিছু বলতে পারে না। ওরা চুপ। বাইরে ধস্তাধস্তি হচ্ছে। তারপর এক সময় বিকট শব্দে গুলির আওয়াজ হলো। সাথে সাথে আজহার হোসেনের আর্তচিৎকারে প্রকম্পিত হলো পুরো বাড়ি। নাজনিন তাকিয়ে দেখলো রুম্পা ভয়ে কাঁপছে। কথা বলতে পারছে না। গো গো করে ওর মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে।
ঘটনার আকস্মিকতায় ওরা যখন অসাড় হয়ে বসে ছিল, তখন হঠাৎ করে প্রচণ্ড একটা রাইফেলের বাটের আঘাতে দরজা খুলে ভেঙ্গে পড়লো। সাথে সাথে নাজনিন রুম্পার হাত ধরে টান দিল। কিন্তু রুম্পা একটুও নড়ল না। নাজনিন আবারও রুম্পার হাত ধরে টান দিয়ে দরজা বরাবর দৌড় দেয়। কিন্তু এবারও রুম্পা একটুও নড়ে না। কেমন বোধহীন মানুষের মত রুম্পা দাঁড়িয়ে ছিল। দুইটা সেপাই নাজনিনকে ধরতে আসলে নাজনিন ওদের জোরে ধাক্কা দিয়ে সোজা দৌড় দেয় বাবার ঘরের দিকে। তারপর ভেতর থেকে দরজা আটকে দেয়। এই ঘর দিয়ে পেছন দিয়ে বেরিয়ে যাবার দরজা আছে। সেপাইরা সেটা জানতো না। তাই ওরা এই ঘরের দরজা ভাঙ্গা শুরু করে। সেই সুযোগে নাজনিন পেছনের দরজা খুলে বেরিয়ে যায়।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সাথে সাথে নাজনিন দেখতে পায় আসাদ আরো কয়েকজনকে নিয়ে আড়ালে অপেক্ষা করছে। নাজনিনকে দেখতে পেয়েই ওরা ছুটে আসে। নাজনিন কোনক্রমে আসাদের উপর শরীরের ভরটা ছেড়ে দিয়ে বলছিল, “রুম্পা, রুম্পা...”। তারপর আর কিছু মনে নেই নাজনিনের।



চল্লিশ বছর পর। ২০১১ সনের মার্চ মাস। ধানমন্ডির একটা বহুতল ভবনের পঞ্চম তলায় নাজনিন দাঁড়িয়ে ছিল বারান্দায়। নাজনিনের ছেলে এখন সরকারী আমলা। অবস্থা বেশ ভালো। বৌ-মেয়ে নিয়ে সুখের সংসার। নাজনিন এসেছে মাসখানেকের জন্যে বেড়াতে।
নাজনিনের নাতনী তাসফিয়া বন্ধুদের নিয়ে খেলা দেখতে যাবে মাঠে। বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল খেলা। ওয়েস্ট ইন্ডিজ বনাম পাকিস্থান। চোদ্দ বছরের তাসফিয়া একগালে বাংলাদেশ আর অন্য গালে পাকিস্থানের পতাকা এঁকেছে। ওর মা ওকে সাজিয়ে দিচ্ছিল।
সাজ শেষে তাসফিয়া নাজনিনের কাছে এসে বলল, “দাদু, আমাকে কেমন লাগছে?”
নাজনিন অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে তাসফিয়ার দুই চোখ ভর্তি মায়া। এত মায়া কোথা থেকে এলো?
তাসফিয়া আবার বলল, “আজকে আমরা সবাই পাকিস্থান। পাকিস্থানের পতাকা নিয়ে আমরা খেলা দেখতে যাবো। তুমি টিভিতে দেখো। আমাকে দেখাতেও পারে!”
নাজনিন নাতনীর হাত ধরে বলল, “দাদু ভাই, পাকিস্থানকে সমর্থন করবা? তাও ওদের পতাকা নিয়ে? মাসটা কিন্তু মার্চ মাস।”
নাজনিনের কথায় তাসফিয়া বিরক্ত হয়। তাই বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, “খেলার সাথে কেন তোমরা রাজনীতিকে মেশাও? প্লিজ, খেলাটাকে খেলার মত দেখতে শেখো।”

তাসফিয়া চলে গেলে নাজনিন আবার গিয়ে বারান্দায় দাঁড়ায়। রোদটা আজকে চরম কটকটে। সেই রোদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নাজনিন ফিরে যায় আবার চল্লিশ বছর আগের স্মৃতিতে। আসাদ নাজনিনকে নিয়ে গিয়েছিল চরে। পরে সেখান থেকে বিভিন্ন জায়গায় নয় মাস ঘুরে ঘুরে শেষ পর্যন্ত ফিরে এসছিল আবার ওদের গ্রামে। কিন্তু রফিক আর ফিরে আসে নি। কোথাও কোন এক অজানা যুদ্ধে রফিক শহীদ হয়েছিল। রুম্পাকেও নাজনিন আর কোন দিন দেখতে পায় নি। লোকমুখে শুনেছিল রুম্পার নগ্ন দেহ ভেসে উঠেছিল ওদের বাড়ির পাশের পুকুরে। পরে ওকে কবর দেয়া হয় অন্য লাশের সাথে। এরপর কিছুদিন নাজনিন একা ছিল ওদের বাড়িতে। কিন্তু একটা যুবতী মেয়ের পক্ষে এভাবে একা থাকা সম্ভব নয়। তাই আসাদ যখন বিয়ের কথা তোলে, তাতে নাজনিন আর অমত করে নি।

টেলিভিশন থেকে প্রচণ্ড চিৎকারের শব্দ আসছে। নাজনিন বসার ঘরের বড় টিভিটার দিকে তাকায়। গ্যালারীতে পাকিস্থানের পতাকা হাতে বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীদের উল্লাস দেখতে পায়। ওয়েস্ট ইন্ডিজের কেউ হয়তো আউট হয়েছে। তাতে বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা গগন বিদারী চিৎকারে মাতিয়ে তুলেছে মিরপুর স্টেডিয়াম। সেদিকে নাজনিন কিছু সময় তাকিয়ে থাকে। তারপর নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নাহ, ভুল বললাম। একটা অবরুদ্ধ আর্তনাদ।
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অনির্বাণ শিখা

লিখেছেন নীলসাধু, ০৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



রাত ন’টার মত বাজে। আমি কি যেন লিখছি হঠাৎ আমার মেজো মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, বাবা একজন খুব বিখ্যাত মানুষ তোমাকে টেলিফোন করেছেন।

আমি দেখলাম আমার মেয়ের মুখ উত্তেজনায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

=ইয়াম্মি খুব টেস্ট=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৪



©কাজী ফাতেমা ছবি
সবুজ আমের কুচি কুচি
কাঁচা লংকা সাথে
ঝালে ঝুলে, সাথে চিনি
কচলে নরম হাতে....

মিষ্টি ঝালের সংমিশ্রনে
ভর্তা কি কয় তারে!
খেলে পরে একবার, খেতে
ইচ্ছে বারে বারে।

ভর্তার আস্বাদ লাগলো জিভে
ইয়াম্মি খুব টেস্ট
গ্রীষ্মের... ...বাকিটুকু পড়ুন

অণু থ্রিলারঃ পরিচয়

লিখেছেন আমি তুমি আমরা, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৭


ছবিঃ Bing AI এর সাহায্যে প্রস্তুতকৃত

১৯৪৬ কিংবা ১৯৪৭ সাল।
দাবানলের মত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে।
যে যেভাবে পারছে, নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। একটাই লক্ষ্য সবার-যদি কোনভাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পেইন্টেড লেডিস অফ সান ফ্রান্সিসকো - ছবি ব্লগ

লিখেছেন শোভন শামস, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:১৯

"পেইন্টেড লেডিস অফ সান ফ্রান্সিসকো", কিংবা "পোস্টকার্ড রো" বা "সেভেন সিস্টারস" নামে পরিচিত, বাড়িগুলো। এটা সান ফ্রান্সিসকোর আলামো স্কোয়ার, স্টেইনার স্ট্রিটে অবস্থিত রঙিন ভিক্টোরিয়ান বাড়ির একটি সারি। বহু... ...বাকিটুকু পড়ুন

এশিয়ান র‍্যাংকিং এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান !!

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:২০

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী 'টাইমস হায়ার এডুকেশন' ২০২৪ সালে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। এশিয়ার সেরা ৩০০ তালিকায় নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়।তালিকায় ভারতের ৪০, পাকিস্তানের ১২টি, মালয়েশিয়ার ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×