যুদ্ধাপরাধের বিচার : ইসলাম অস্ত্র না নিশান? (১)
নোমান বিন আরমান
মানুষ নপুংশক হয়, রাষ্ট্রও কি? জানা নেই। তবুও নপুংশকদের জন্য আইন রয়েছে। নপুংশকদের আইন আছে। আর রাষ্ট্রের আইনের প্রয়োজন হয় তার কর্তব্য ও লক্ষ্য পূরণের জন্য। এই কর্তব্য ও লক্ষ্য পূরণে রাষ্ট্রের নির্দৃষ্ট কিছু এজেন্ডা ও দৃষ্টিভঙ্গি থাকে। এর আলোকেই রাষ্ট্র প্রতিপালিত ও পরিচালিত হয়। রাষ্ট্র চালনার এই নীতিতে কোথাও কোথাও ধর্ম প্রধান ‘আইন-প্রণেতার’ ভূমিকা পালন করে। ধর্মীয় বিধিবিধানের আলোকেই রাষ্ট্র-আইনের কাঠামো গড়ে উঠে। এভাবেই পৃথিবীব্যাপী রাষ্ট্রের বয়স বেড়েছে। রাষ্ট্রের প্রাণজুড়ে ধর্ম তার আলো বিস্তার করেছে। দীর্ঘ সময়।¬ কোথাও সেটি ইসলাম বা অন্য কোনো ধর্ম।
এখন সময় বদলেছে। বর্তমান পৃথিবীতে কোথাও আর রাষ্ট্র-আইনে ধর্মের নিরঙ্কুশ প্রভাব নেই। ধর্ম আর রাষ্ট্র এখন সহযোগী হিসেবে চলছে না। কোথাও কোথাও এটি এখন রাষ্ট্রের ‘আত্মীয়’ বলে গণ্য। কোথাওবা অন্য কিছু। তার মানে এই নয় যে, ধর্ম বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ধর্ম আছে এবং থাকবে। এখনো পৃথিবীব্যাপী অন্তত আশি ভাগ মানুষ ধর্মে বিশ্বাসী। কিন্তু ধর্মীয় রাষ্ট্রে এই বিশ্বাসীরা কেনো ফিরছেন না তা বড় প্রশ্ন হয়েই আছে। এর পেছনের কারণটি অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, নৈতিকভাবে স্খলিত কিছু নেতৃত্বের ¬ক্ষমতালিপ্সার কাছে মার খেয়েছে ধর্ম। বারবার। তারা দেখেছে, ধর্ম রাষ্ট্র আইনের প্রাণ হলে কখনো ক্ষমতার চেয়ারটি তাদের কব্জায় আসবে না। এ সিদ্ধান্ত থেকেই ধর্মভীতুরা ভিন্ন পথ অবলম্বন করে। আর স্পষ্টতই তা তাদের স্খলনের প্রমাণ হয়ে আছে। এই ‘ধর্মভীতু’ নেতৃত্বের কারণেই রাষ্ট্র-আইন থেকে ইসলাম, খ্রিস্টধর্মসহ অপরাপর ধর্ম দূরে। কারণ প্রধানতম কোনো ধর্মই ‘পাপের’ সুযোগ দেয় না। অন্যায়, অনৈতিকভাবে ক্ষমতা গ্রহণকে মনযূর করে না। কিন্তু পৃথিবীর দুঃখ, এই কিসীমের নেতৃত্ব থেকে কোন রাষ্ট্রই আপাত মুক্ত নয়।
০ দুই ০
বর্তমান লেখাটির মেজাজ বুঝতে রাষ্ট্র-আইন ও ধর্ম নিয়ে এই আলোচনাটুকু করতে হলো। বলার আরো অনেক ছিলো। কিন্তু লেখাটি যেহুতু এই বিষয়ে নয় তাই এগুনো গেলো না। তবু আশা করছি উদ্দেশ্যের কিছুটাও পূর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের বয়স এখন ৩৯ বছর। এই ৩৯ বছরে অনেক পালাবদল হয়েছে। স্বপ্ন আশার বীজ বুনেছে, প্রতিশ্র“তির কথা শুনেছে মানুষ। দেশের জন্মও হয়েছিলো এই রকম স্বপ্ন ও প্রতিশ্র“তির ক্ষণে। এর পেছনে ছিলো রাষ্ট্রীয় বঞ্চনা ও স্বেচ্চাচারিতা। ‘পশ্চিমে’ যখন বঞ্চনা ও স্বেচ্চাচারের জালকে মজবুত করার সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন হচ্ছিলো তখন ‘পূর্বে’ নতুন এক সূর্য উদয়ের সম্ভাবনাকে ক্রম অনিবার্য করে তুলেছিলো। অনিবার্য এই সূর্য উদয়ের বাস্তবতাকে উপলব্দি করতে ও মেনে নিতে পুরোপুরি রকমের ব্যর্থ হয়েছিলো ‘পশ্চিমিরা’। এবং তাদের এদেশেীয় কিছু অনুগত লোকেরা। বস্তুতঃ ‘অনুগতরা’ প্রায়শ অন্ধই থাকে। এরা নিজের চোখে দেখে না কিছুই। ফলে বাস্তবতা বুঝতে পারে না। প্রথমত এই ভুলই হয়েছিলো একাত্তরে। অনেকের। এদের কেউ কেউ পশ্চিমের প্রতি মোহান্ধ ছিলো। মোহান্ধ ছিলো ধর্মের নামে। ব্যবহার করছিলো ইসলামকে। রাষ্ট্রীয় বঞ্চনা ও স্বেচ্চাচারের বিরুদ্ধে গণরোষকে এরা ইসলামের বিরুদ্ধে ‘তাগুতের’ সংগ্রাম ভেবেছিলো। অথচ তারা যাকে ইসলাম বলছিলো সেটি যে ইসলামই না এটুকুন বিবেচনাবোধও তাদের ছিলো না। বোকার যুক্তিতে এরা চলেছিলো। মার খেয়েছিলো রাজধানীর রাজনীতিতে। রাষ্ট্রীয় তান্ডবের সাথে নিশ্চিন্তে শরিক হয়েছিলো। হত্যা করেছিলো প্রতিবাদী জনতাকে। কিন্তু হত্যায় যে স্বেচ্চাচারের শেষ রক্ষা হয় না এটি একাত্তরও বড়ভাবে প্রমাণ করলো। ৩৯ বছর পর এই হত্যাকারীরা, যুদ্ধাপরাধীরা এখন বিচারের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।
এখানে বড় রকমের একটি মিল অনেককে নিশ্চয় অন্য রকমের তৃপ্তি দেবে যে যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক দল আওয়ামীলীগ। বিচার করছে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল জামায়াতের। এ দুটি সংগঠনই পাকিস্তান সময়ের। এবং মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবস্থান ও ভূমিকা স্পষ্টতই বিপরীতমুখী। আওয়ামীলীগ একাত্তরে গণমানুষের সেন্টিমেন্টকে পুরোপুরি উপলব্ধি করেছিলো এবং জনতার পক্ষেই কাজ করেছিলো। বিপরীতে একই সময়ের হয়েও বাস্তবতা ও জনআকাঙক্ষার বিষয়টি বুঝতে পারেনি জামায়াত। ইয়াহইয়াদের তারা ইসলামের এবং নিজেদের ত্রাতা ভেবেই ‘জান কুরবানে’ প্রস্তুত থেকেছে। এর ফল যে আখেরে ভালো হয়নি, তাতো ব্যখ্যার দরকার নেই। মূলত কোনো অপরাধই যে শেষ পর্যন্ত নিজেকে বিচার থেকে নিস্কৃতি দিতে পারে না এটিও সম্ভবত তার একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকলো।
০ তিন ০
অস্বীকারের উপায় নেই, একাত্তরে যুদ্ধের নামে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে কেউ কেউ ইসলামের আলখেল্লা পরিয়ে একে হালাল ও নিরাপদ করার চেষ্টা করেছে। এটিযে স্পষ্টতই তাদের কালো চেহারা গোপন করার ঘৃণ্য প্রয়াস তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নিজেদের অপরাধকে হালাল করতে ইসলামকে এরা অস্ত্র (ঢাল) করেছে। কিন্তু ইসলাম তো কারো অপরাধের বোঝা বহন করে না। এই সত্যটি স্বাথোদ্ধারে ইসলামকে ব্যবহারকারীরা সহজে বুঝতে চায় না। কিন্তু এই কাজটি প্রায়ই হচ্ছে। অনেকে ব্যক্তি ও দল স্বার্থ হাসিল করতে, অপরাধ আড়ালে রাখতে ইসলামকে লেবাস করছে। এবং অনেকে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে অপরাধীদের ইসলামের পোশাক ব্যবহারের ‘অব্যর্থ’ কৌশলটি ধরিয়ে দিচ্ছে। এতে করে তারা যেমন নিজের শত্র“ খতম করতে পারছে নিজেদেরও দৃশ্যত পবিত্র রাখতে পারছে। মাঝপথে ইসলামের নামে রক্তারক্তি হচ্ছে। এই যে অপরাধীরা নিজেদের হালাল করতে ইসলামকে অস্ত্র করছে Ñ সেটি সম্ভব হচ্ছে রাষ্ট্র থেকে ইসলামকে দূরে রাখার কারণেই। রাষ্ট্র ধর্মকে সহযোগী মনে না করায় অপরাধীরা সহজেই ইসলামের নিশানবর্দার সাজতে পারছে। এই বিষয়টি যতদিন বুঝতে দেরি হবে, ততদিন ইসলামের নামের, ধর্মের নামের অপরাধীদের নির্মূল করা সম্ভব হবে না। হোয়াইট হাউসে ক্রুসেডের জন্য ইশ্বরের নির্দেশ আসাও বন্ধ হবে না।
নোমান বিন আরমান : সম্পাদক, কালকণ্ঠ
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুলাই, ২০১০ সকাল ১০:২৬