somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মৃত্যু ভয়ংকর নাকি এই নিখোঁজ সংবাদ।

১১ ই মে, ২০১৪ সকাল ১০:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একটি নিখোঁজ সংবাদ আর দরজায় পরিচিত পদধ্বনি শুনবার অপেক্ষায়। জীবন ছোট। আর মানুষের হাতে সময় আসলেই কম। তাড়াহুড়ো করে ওরা সব কাজ সেরে নিতে চায়। জানে, সময় ফুরিয়ে আসছে অতি দ্রুত। খেলা শেষ হবার আগেই শেষ দৃশ্য না দেখবার অতৃপ্তি নিয়ে খেলোয়াড়দের বিদায় নিতে হয় পৃথিবী নামক বর্তুলাকার মাঠ থেকে। যেখানে একদিন তাদের ছেড়ে দিয়ে বলা হয়েছিলো মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে।


সৃষ্টির আদিকাল থেকে এতবড় অপেক্ষা’কে ঘটা করে জড়িয়ে দেবার পরও মানুষদের যাপিত জীবনের সাথে যুগলবন্দী করা হয় ‘অপেক্ষা’ নামক মধুর কিংবা অতীব নিষ্ঠুর এক শব্দ। মানুষেরা অপেক্ষা করে। অপেক্ষা মানুষদের বেঁচে থাকবার টনিক। বেঁচে থাকতে গেলে অপেক্ষা নামক যন্ত্রণার প্রয়োজন রয়েছে। যাদের আর কোনও কিছুর প্রতি অপেক্ষা করবার থাকেনা তারা জীবনের প্রতি তৃষ্ণা হারিয়ে ফেলে। বেছে নিতে চায় স্বেচ্ছা মৃত্যু।


প্রযুক্তির উৎকর্ষে শীর্ষে উঠে যাওয়া দেশ জাপান। ওদের তরুণদের মধ্যে হতাশা জন্ম লাভ করে। বেশ কিছুদিন আগে ‘ মাস সুইসাইড’ নামের একটি ব্যাপার ঘটতে দেখা যাচ্ছিলো ওখানে। এখনো প্রবনতা রয়েছে। এটি দলবদ্ধ ভাবে আত্মহত্যা করাকে বোঝায়। ফোন করে করে বন্ধু বান্ধব মিলে একসাথে আত্মহত্যা করা। রিলিজিয়াস কারণে অনেক অত্যাচারিতেরা করেন। বৈপ্লবিক কারণেও করেন। মনিবের মৃত্যুতে প্রিয় কুকুরটিও আত্মহত্যা করে অনেক সময়। কারণ, মনিবের ফিরে আসবার জন্য আর অপেক্ষা নেই।


মানুষ ছাড়া অন্য প্রানীর মাঝেও এই ধরনের মাস সুইসাইড করবার উদাহারন রয়েছে। লেমিং নামের এক প্রকার ইঁদুর দলবদ্ধভাবে সমুদ্রে ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করে। তাদের নতুন প্রজন্মের জন্য সুন্দর জীবন রেখে যাবার প্রয়াসে। জাপানি তরুনেরা ওইরকম একটি অ্যাটেম্ট নিতে গিয়ে ব্যার্থ হবার পর কারণ হিসেবে জানা যায়, তাদের জীবনে আর কিছুই চাইবার নেই, সব পেয়েছে। কোনও কিছুর জন্যই আর অপেক্ষা করবার নেই। জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে ওরা।


আমার এত ইনিয়ে বিনিয়ে বলবার উদ্দেশ্য একটি আছে বৈকি। অপেক্ষার সবচেয়ে অমানবিক রুপ বাংলাদেশের মানুষেরা বহন করে চলছে প্রতিনিয়ত। আমি জানাতে চাই, হঠাত হারিয়ে যাওয়া মানুষের জন্য "অপেক্ষা" করা কি পরিমান অমানবিক আর ভয়াবহ একটি ব্যাপার! পৃথিবীর সকল নিষ্ঠুরতাকে ছাড়িয়ে গিয়ে নিষ্ঠুর একটি ব্যাপার। আমরা যেটিকে আজকাল নাম দিয়েছি গুম।


গুম নিয়ে খেলাচ্ছলে কথা বলছি। কবিতা করছি। কোলাজ করছি। গান গাইছি। হিউমারের ছড়াছড়ি। দেখে কষ্ট হয় প্রচন্ড। এত অমানবিক একটি ঘটনার মোড় ঘুরে যাচ্ছে আমাদের অজান্তে। যেন গুম হওয়া সবাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু এটি যে মৃত্যুর চাইতেও ভয়াবহ তা কে বুঝবে?


কিছু কিছু ব্যাপার আছে যেটির প্রচারনা করতে হয় হিউম্যানিটি দিয়ে, হিউমার দিয়ে নয়। আপনার পরিবারের কেউ একজন নিখোঁজ রয়েছে, ব্যাপারটি কেবল একবার ভেবে দেখুন। একবার। নিজেকে বসিয়ে নিন ওই গুম হয়ে যাওয়া ছেলের ভাই হিসেবে, কিংবা বোন। তবেই বুঝতে পারবেন এর মত অমানবিক ব্যাপার যে আর হয়না।


অনেক দিন আগে, আমার ছোট ভাই ১২ বছর বয়সে মাত্র ৮ ঘণ্টার জন্য নিখোঁজ হয়েছিলো। আমরা তিনজন বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আট ঘন্টা ছিলো আমাদের জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ সময়। আমরা কি করব না করব বুঝতে পারছিলাম না। যেই কাজ গুলো করা দরকার ছিলোনা তাও করেছি। একবার যদি দেখা পাই ওর। আম্মু পাগলের মত এদিক সেদিক খুঁজতে লাগলেন। আব্বুও পুরো মহল্লা খুঁজছেন। অসম্ভব সব জায়গায় আমরা খুঁজতে লাগলাম অপু’কে।


আমার বাবা ডিফেন্সে ছিলেন। উনার শারীরিক উচ্চতা নিয়ে আম্মু সবসময় কটাক্ষ করতেন। লম্বা যত আহাম্মক তত- এইটাইপ কটাক্ষ। কিন্তু সেদিনই প্রথম ভদ্রমহিলা তাঁর স্বামীকে বলেন, ‘আপনিতো লম্বা। একটু দেখেন না আলমিরার উপরের তাকে আছে কিনা’। ‘আর্মিদের বুদ্ধি হাঁটুতে থাকে’- এই সুত্রের সত্যতা প্রমান করে তিনিও উপরের তাকে খুঁজতে লাগলেন। যেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে দুটো লাগেজ তুলে রাখা। আব্বু একবারো বলেননি, তোমারকি মাথা খারাপ হয়েছে? এতটুকু জায়গায় ও থাকবে কিভাবে! আমিও গলা বাড়িয়ে দেখছিলাম। যেন ওখানে পেলেও পেতে পারি। ভয়ংকর একটি ব্যাপার।


আমার দুঃসম্পর্কের চাচী। সারাজীবন তার নিখোঁজ হয়ে যাওয়া স্বামীর জন্য অপেক্ষা করেছেন। অমানবিক এক ব্যাপার। ছেলেমেয়েরাও প্রথম প্রথম ভাবত বাবা ফিরে আসবে। কিন্তু পরে তারা তাদের সংসার নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে যায়। বুঝতে পারে, হয়ত আর আসবেনা। তবুও হঠাত অসময়ে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে তাদের মনেও উঁকি দিয়ে ওঠে, বাবা কি এলো? কিংবা দাঁড়ি গোঁফে জঙ্গল হয়ে থাকা কোনও অপরিচিত বয়স্ক লোককে আড়চোখে তাকিয়ে দেখা, বাবার ছবির সাথে মিল আছে কি? একটু মনে হয় আছে, ডাকি ডাকি করতে করতে বৃদ্ধও চলে যান। ডাকা হয়না। বলা হয়না, বাবা!


চাচী আর দাদীর ব্যাপারটি কেউ বুঝত না। দাদী কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে ফেলেছেন। আজও বুড়ি বেঁচে আছেন। কালবেলার কাল সাক্ষী হয়ে। স্বভাব মতে কাঁপা কাঁপা গলায় বলেন, “বৌমা, ও বৌমা, রাঙ্গা এহনও বাড়িতে আসেনাই? ছেমড়া আইজ এত দেরী করতাছে ক্যান?” চাচী এখনো মাফলার বোনেন চাচার জন্য। সামনের শীতে উনি আসবেন, পড়বেন। দরজার প্রতিটি শব্দে নড়ে উঠত সবাই, এই বুঝি চাচা এলেন। সত্যি সত্যি যদি আসতেন! ছাতা বন্ধ করতে করতে বলতেন, 'মরার বৃষ্টি, পুরাই ভিজায়া দিলোরে! মা কই কুসুম? মায় ভাত খাইছে?'


১৯ বছরেও চাচা ফেরেনি। চাচী বলতেন, ইলু, তোর চাচা ফিরলে আমাকে একটু সাজিয়ে দিবি? মানুষটা সাজগোজ খুব পছন্দ করত। চোখে কাজল দিতে পারিনা, এদিক সেদিক হয়ে যায়। উনি হাসতে থাকেন, লজ্জা লাগে খুব। তুই দিয়া দিস একটু। ‘আচ্ছা চাচী দিমুনে’ বলে কথা বাড়াতে চাইনা। আবার উনি গল্প শুরু করেন, বাসর রাতের গল্প। হাজার বছর ধরে চলে আসা পুরাতন গল্প। চমৎকার সব স্মৃতি। বহুবার শুনে নিয়েছি। তারপরও শুনতে হয় বিরক্তি নিয়ে। চাচীর বিরক্তি লাগেনা। স্বামী ফিরে এলে উনি বিয়ের শাড়ি পরবেন বলে ঠিক করেন।


এত বছরেও যে মানুষ ফেরেনা, সে আর ফিরবেনা। জানতাম। জীবন এতটা কাব্যিক নয় যে, শেষ বিকেলে কেউ একদিন বহুকাল আগে হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনের দেখা পাবে। আমি কামনা করতাম চাচার লাশ যেন ফিরে আসে। এই অসহনীয় যন্ত্রনা থেকে মানুষগুলোর মুক্তি মিলুক। বেঁচে থেকেও মরে যাওয়া। এর চাইতে মৃত্যু ভালো। আমি নিষ্ঠুর প্রকৃতির মানুষ। আবেগ কম। তবুও চাচীর বালিকা বধূ পনা দেখতে দেখতে ছাদের দিকে তাকিয়ে বলি, হা জীবন!


বাংলাদেশের অসংখ্য পরিবারে আজ এরকম চিত্র। আমরা কেবল সংবাদ গুলো পড়ি। নিখোঁজ, গুম এই শব্দ গুলোর সাথে পরিচিত হই কিন্তু শব্দের নির্মমতার ছোঁয়া আমাদের বিন্দুমাত্র স্পর্শ করেনা। আমরা বুঝতে পারিনা এর ভয়াবহতা। আমি সরকারের কাছে অনুরোধ করছিনা গুমের বদলে খুন করতে। প্রিয়জনদের ক্ষতবিক্ষত শরীর দেখেও তৃপ্তি লাগে। একদিন ফিরে আসবে- এই অপেক্ষার চাইতে।


আমি আল্লাহ্‌র কাছে অভিমান করে বলছিনা, ‘কেন আল্লাহ? কেন? উই আর জাস্ট হিউম্যান! জাস্ট হিউম্যান! আমাদের এতবার মারো কেন?’ আমি শুধু চাই, বাংলাদেশের প্রতিটি পরিবার থেকে একজন করে সদস্য নিখোঁজ হয়ে যাক, আর তার প্রিয়জনেরা অপেক্ষায় থাকুক। ঘোরের মাঝে কাটাক বাকিটা জীবন। দরজায় কারো পরিচিত পায়ের শব্দ শুনবার জন্য। সারাজীবন। বুঝুক, মৃত্যু ভয়ংকর নাকি এই নিখোঁজ সংবাদ।


এছাড়া আর এর বিরুদ্ধে আমাদের কলম থেকে রক্ত ঝরিয়ে জালিম এই শাসকদের সরানো যাবেনা। নিজেকে ভালোমানুষ ভাবেন নিশ্চই। পলিটিক্স থেকে গা বাঁচিয়ে নোংরামো এড়িয়ে চলা ভদ্দরনোক? শুনে রাখুন, সমাজ ধ্বংসে আপনার অবদান পরবর্তী প্রজন্ম ঘৃণা ভরে স্মরণ করবে। কারণ, একটি সমাজ খারাপ মানুষদের দ্বারা ধ্বংস হয়না। সমাজ ধ্বংস হয় ভালো মানুষদের নিষ্ক্রিয়তায়


ফেস বুক থেকে নিলাম লেখক Elora Zaman
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=আকাশে তাকিয়ে ডাকি আল্লাহকে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০১


জীবনে দুঃখ... আসলে নেমে
শান্তি গেলে থেমে;
আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে হই উর্ধ্বমুখী,
আল্লাহকে বলি সব খুলে, কমে যায় কষ্টের ঝুঁকি।

আমি আল্লাহকে বলি আকাশে চেয়ে,
জীবন নাজেহাল প্রভু দুনিয়ায় কিঞ্চিত কষ্ট পেয়ে;
দূর করে দাও সব... ...বাকিটুকু পড়ুন

"ছাত্র-জনতার বেপ্লবের" ১৮ মাস পরে, আপনার ভাবনাচিন্তা ঠিক আগের মতোই আছে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৭



২০২৪ সালের পহেলা জুলাই "ছাত্র-জনতার বেপ্লব শুরু হয়, "৩৬শে জুলাই" উহা বাংলাদেশে "নতুন বাংলাদেশ" আনে; তখন আপনি ইহাকে ব্যাখ্যা করেছেন, ইহার উপর পোষ্ট লিখেছেন, কমেন্ট করেছেন; আপনার... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

টাঙ্গাইল শাড়িঃ অবশেষে মিললো ইউনস্কর স্বীকৃতি

লিখেছেন কিরকুট, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৭



চারিদিকে যে পরিমান দুঃসংবাদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এর মধ্যে নতুন এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হলো বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের তাতের শাড়ি এর জন্য, ইউনেস্কো এই প্রাচীন হ্যান্ডলুম বুননের শিল্পকে Intangible Cultural... ...বাকিটুকু পড়ুন

×