
বছরের শেষ তাই স্মৃতি নিয়েই শেষ পোস্টটি করি। কোন একদিন হয়তো এই বছরেরই কোনো একটি স্মৃতি মনে পড়ে যাবে।
জাহিদ ডাকাত
জাহিদ নামের একটি ভ্যানওয়ালা আমার কারখানার মাল আনা নেওয়া করে। দীর্ঘদিনের পরিচিত ভ্যানওয়ালা। ওকে দিয়ে আমি কোথাও মাল পাঠিয়ে নিশ্চিন্তে থাকতে পারি, কোন এদিক সেদিক হয়না। পার্টিকে কিংবা ট্রান্সপোর্টে মাল বুঝিয়ে দিয়ে সুন্দরভাবে চালান কপি এনে জমা দিয়ে যাবে। ভাড়া নিয়ে কখনো তার সাথে কথা কাটাকাটি হয়নি। আসলে আমি তাকে মূল ভাড়া থেকে কিছুটা বাড়িয়েই দিই মাঝেমাঝে। একবার ভ্যানে করে আমার মাল নিয়ে যাচ্ছিল। পিছন থেকে হাইজাকার মাল কেটে নিয়ে যাওয়ার সময় হাইজ্যাকারের সাথে দস্তাদোস্তি করতে গিয়ে ওর হাতে ছুরির আঘাত পায়। চারটি সেলাই লেগেছিল।
অনেক সময় কারখানায় কাজকর্ম না থাকলে ওর সাথে বসে বসে কথা বলি। ও খুব মজা করে হাস্যরস করতে পারে। জাহিদের বয়স ৪০-৪২ এর মত হবে। ওর বাড়ির লোকেশন আমি এক্সজাট কোথায় জানিনা। তবে জানি যে ভৈরবের ঐদিকে বাড়ি। জাহিদের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল ও মাঝেমাঝে ১০-১৫ দিনের জন্য উধাও হয়ে যেতো। ওকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যেত না। তবে যাওয়ার আগে আমার এখানে ওর পরিচিত এক ভ্যানওয়ালাকে দিয়ে যেতো। বলতো ভাই মাল আনা নেওয়া লাগলে ওকে দিয়ে আনা নেওয়া করতে পারেন, সমস্যা নাই।
তবে করোনার আগে প্রায় ছয় মাসের মত জাহিদ ঢাকায় আসছে না। একদিন হঠাৎ করে ভাবলাম একটু খোঁজ নিয়ে দেখি কোথায় সে। ওর ঐ পরিচিত ভ্যানওয়ালার কাছে জিজ্ঞেস করার পর বললো, ভাই জাহিদ তো জেলে আছে। জিজ্ঞেস করলাম কি জন্য? বললো আমি ভাই ঠিক জানিনা, তবে শুনেছি জেলে আছে। এর কয়েকদিন পর জাহিদ আমার কারখানায় এসে হাজির। জিজ্ঞেস করলাম জেলে গেছিস কি জন্য? কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল ভাই ডাকাতির মামলায়। বললাম ডাকাতি করস কিনা? কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল করতাম এখন করি না, এটা আগের মামলা ছিল। ওর কথা শুনে আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম করতি মানে, কয়বার করেছিস জীবনে! বলল ভাই হিসাব নেই। জাহিদ আমাকে বললো ভাই আপনাকে বলতে তো সমস্যা নাই। এরপর সে তার ডাকাতের ইতিহাস বলতে লাগলো। ওর কথা শুনে আমার মাথা ঝিম ধরে গেলো। সর্বশেষ বললাম তো ডাকাতি ছেড়ে দিলি কি জন্য? বললো আমরা মূলত ট্রলার এবং বাসে মিশন চালাই। তো একবার ট্রলারে মিশন চালালাম। সেখানে অনেক টাকা পয়সা এবং স্বর্ণালংকার পেয়েছিলাম। এক মহিলা ছিল যার স্বর্ণালংকার ছিনিয়ে নিতে গেলে সে অনেক কাকুতি মিনতি করতে ছিলো। আমার পাশের থেকে একজন এসে ওর পেটে ছুরি দিয়ে খোঁচা দেয়। আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার চেহারা হুবহু আমার বউয়ের মত। মহিলাটির পেটে বাচ্চা ছিল। আমার বউয়েরও তখন পেটে বাচ্চা ছিল। আমি আর ওর থেকে ওর গয়না ছিনিয়ে নেই নাই। দেখলাম ওর পেট থেকে রক্ত বের হচ্ছে, তবে গুরুতর না। আমি মাঝিকে কিছু টাকা দিয়ে বললাম এই মহিলাকে হাসপাতালে নিয়ে যা। এ ঘটনার পর থেকে আমি আর কখনো মিশনে যাবো না বলে প্রতিজ্ঞা করেছি। আর কয়েকটি মামলা আছে এগুলি খালাস হলেই আমি ঝামেলা মুক্ত হয়ে যাবো। জাহিদের কথাগুলি আমি আসলে এখানে ঠিকভাবে বলে বুঝাতে পারব না কিন্তু আসলেই তার কথা সব শুনে আমার মাথা পুরোই হ্যাং হয়ে গিয়েছিল সে সময়। পরে তার দেওয়া ঘটনার বর্ণনাগুলি নেটে সার্চ দিয়ে খোঁজার চেষ্টা করি। চার-পাঁচটা ঘটনা সে বর্ণনা করেছিল, তার মধ্যে আমি দুইটি ঘটনা পত্রিকায় হুবহু পেয়ে ছিলাম। যাইহোক আবারো ৫ মাসের মত হবে জাহিদের কোন খোঁজ খবর নেই!
ব্যাঙের মনি।
তখন বর্ষাকাল একটানা বেশ কয়েক দিন বৃষ্টি হচ্ছিল। আমাদের স্কুল বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে হওয়ার কারণে বৃষ্টি দিয়ে স্কুলে যাওয়া বন্ধ। পরতাম প্রাইমারি স্কুলে, তাই স্কুলে যাওয়ার গুরুত্বটাও কম ছিল। আম্মা সন্ধ্যা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত বসিয়ে আমাদের পড়াতেন, শুক্রবার পড়া বন্ধ। শুধু গল্প গুজব চলত সন্ধ্যা থেকে আব্বা ঘরে আসার আগ পর্যন্ত। বাড়ির চাচি, জেঠি, ভাবীরা এসে আমাদের ঘরে গল্প করতো।
তেমনি এক শুক্রবার সন্ধ্যায় আমার আম্মা চাচি জেঠিদের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলেন ভাবি কালকে রাত্রে কি হয়েছে শুনুন। আপনার ভাই ঘরে ঢুকে আমাকে বললো একটি বড় পাতিল আর হূতা (আমাদের এলাকায় বাটাতে যে জিনিসটা দিয়ে ডলে ডলে পেঁয়াজ, রসুন, ভর্তা পিষানো হয় সেটাকে হুতা বলে। ওজনে প্রায় দুই তিন কেজির মত হয়) নেওয়ার জন্য। আমি জিজ্ঞেস করি এত রাত্রে এগুলি দিয়ে আপনি কি করবেন? বললো বেশি কথা বলবা না, তাড়াতাড়ি নাও। যাক, ধমক খেয়ে আমি সেগুলি নিয়ে আসলাম। বললো ছাতা নিয়ে আসো। এরপর ছাতা নিয়ে আসার পর আমরা বাইরে গেলাম। যাওয়ার পর আমাকে বললো, ছাতা ধরো আর পাতিল হুতা আমার হাতে দাও। আমি উনার হাতে দিলাম। একটু দূরে কি যেন জ্বলজ্বল করছে দেখলাম। উনি গিয়ে আস্তে আস্তে পাতিল দিয়ে সেটা ঢেকে উপরে ভারী হূতা দিয়ে রাখলেন। এরপর ঘরে আসলো, আমি বললাম এটা কি করলেন, কি ছিল ঐখানে? বললো তুমি দেখো নাই ব্যাঙের মুখটা জ্বলজ্বল করছে, আমি বললাম হ্যাঁ দেখলাম। বলল ওটা ব্যাঙের মনি হতে পারে।
আমাদের এদিকে একটি গল্প প্রচলিত ছিল কোলা ব্যাঙের মুখে মনি থাকে। একথা শুনে আমি জোরে জোরে হাসতে লাগলাম। উনি বললো এখানে হাসার কি হলো, ভাগ্য থাকলে পেতেও তো পারি। আমি বললাম আপনি তাড়াতাড়ি গিয়ে আমার পাতিল হুতা নিয়ে আসেন। ব্যাঙের মুখে ওটা মনি না, ওটা কেঁচো খেয়েছে। কেঁচোকে রাত্রের বেলায় আঘাত করলে তার শরীর থেকে এক ধরনের রস বের হয়, যেগুলি জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকে।
একটু পরে উনি বাহির থেকে আমার পাতিল ও হূতা এনে সুন্দর করে রেখে দিয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম কি হলো মনি পেয়েছেন? বললো না, ওটা কেঁচোই ছিল।
ঝালমুড়িওয়ালা।
আমাদের ইস্কুলের সামনে একদিন হঠাৎ করে একটি লোক ঝালমুড়ি বিক্রি করা শুরু করে। আমাদের এদিকে তখনও ঝালমুড়ি বিক্রির প্রচলন ছিলনা। লোকটির ঝালমুড়ি খুবই মজাদার ছিল। আস্তে আস্তে তার ঝালমুড়ির চাহিদা বাড়তে থাকে। স্কুলের সকল ছেলেমেয়েরা তার ঝালমুড়ির ভক্ত ছিল। লোকটির বয়স ছিল ৪০কি ৪৩ বছর। গায়ের রং কুচকুচে কালো, মুখের এক পাশটায় পোড়া দাগ ছিল। তারপরেও লোকটির চেহারায় কেনো জানি এক ধরনের মায়া ছিল। জানতে পারি লোকটি আগে ঢাকায় ঝালমুড়ি বিক্রি করতো, এখন দেশে চলে এসেছে। এখন থেকে আমাদের স্কুলের সামনেই ঝালমুড়ি বিক্রি করবে। যাইহোক তার ঝাল মুড়ির ব্যবসা ভালোই যাচ্ছিল। আমাদের তখন স্কুল জীবন শেষ হওয়ার পথে, আর কয়েকদিন পরেই এসএসসি পরীক্ষা। স্কুলে পরীক্ষার এডমিট কার্ড নেওয়ার জন্য গিয়েছিলাম, এডমিড কার্ড নিয়ে এরপর ঝাল মুড়িওয়ালাকে খুঁজছিলাম ঝালমুড়ি খাওয়ার জন্য। পরে শুনলাম আজকে দুইদিন থেকে সে নাকি ঝাল মুড়ি বিক্রি করতে আসে না। পাশের একজন দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম ঝালমুড়িওয়ালা কই? লোকটি বলল ঝালমুড়িওয়ালা লোকটিকে আজকে দুইদিন থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। গতকাল তার বউ এসে এখানে কান্নাকাটি করে গেলো। মনটা খারাপ হয়ে গেল ঘটনাটি শুনে।
যাইহোক পরীক্ষা শেষে মোটামুটি ফ্রি। সন্ধ্যার পর এখন বাজারে থাকলেও আব্বা আম্মা খুব বেশি বকাঝকা করেনা। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতেও বারণ নেই। আসলে স্কুল জীবন শেষ হওয়ার পর আস্তে আস্তে বাবা মায়ের শাসন থেকে সন্তান যেভাবে ছুটে যায় সেটা উপভোগ করছিলাম। তো হঠাৎ করে একদিন বাজারে শুনলাম সেই ঝালমুড়িওয়ালাকে নাকি কারা টুকরো টুকরো করে বস্তায় ভরে খালে ফেলে দিয়েছিল, পরে পুলিশ সেটা উদ্ধার করে। পুলিশের তদন্তে পরে উঠে এসেছিল কি জন্য তাকে হত্যা করা হয়েছিল। সে ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ঘটনাটা ছিল এমন, ঝালমুড়িওয়ালা আমাদের স্কুল ছুটি পর্যন্ত স্কুলের সামনে ঝাল মুড়ি বিক্রি করতো। এরপর আমাদের পাশের একটি বাজারে চলে যেতো, সেখানে রাত অব্দি ঝালমুড়ি বিক্রি করতো। তো সেদিন সে ঝালমুড়ি বিক্রি করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। পথে কয়েকজন লোক তাকে ধরে তার থেকে তার ঝালমুড়ি বিক্রি করার সকল টাকা ছিনিয়ে নিতে চায়। তাদের সাথে তার কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে সেই লোকগুলি তাকে মারধর করে তার থেকে টাকা গুলি নিয়ে যাচ্ছিল। এরপর লোকটি বলে তোরা আমার টাকা খেয়ে হজম করতে পারবি না। তোরা জানিস আমি কার ভাইগ্না? এরপর ঝালমুড়িওয়ালা তাদেরকে এমন এক লোকের কথা বলে যে ছিল আমাদের ঐ অত্র এলাকার গডফাদার। যার বিশাল একটি বাহিনী ছিলো, এখনো আছে। এ কথা শুনে ঐ লোকগুলি ঐ লোকটিকে ধরে বলল আমরা তো ওর লোককেই খুঁজছি। এই বলে তাকে তারা সেখানে মেরে ফেলে। আসলে সেই ঝালমুড়িওয়ালার সাথে আমাদের এলাকার সেই গডফাদারের কোনো রকমের সম্পর্কেই ছিলনা। লোকটি শুধুমাত্র তার পরিশ্রমের টাকাটি ফিরে পাওয়ার জন্য তাদেরকে ভয় দেখাতে চেয়েছিল। যার পরিণতি তাকে তার জীবন দিয়ে দিতে হয়েছিল!
স্মৃতি থেকে যা আজও আমায় ভাবায় (৬)
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জানুয়ারি, ২০২৪ রাত ১২:০৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




