somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলাদেশে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জনক, শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের ৪৮তম মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি

১০ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৪:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


এ দেশের সংবাদপত্র জগতের অন্যতম পুরোধা, মুক্তিযুদ্ধের নির্ভিক সৈনিক শহীদ বুদ্ধিজীবী সিরাজুদ্দীন হোসেন।পাকিস্তান আমলে যে কয়জন সাংবাদিকের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন এবং বাঙালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন, সিরাজুদ্দীন হোসেন ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ১৯৫২ সালে দৈনিক আজাদের বার্তা সম্পাদক থাকা অবস্থায় মহান ভাষা আন্দোলনের সপক্ষে তার সাংবাদিকতা বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতে তার অসাধারণ কীর্তি বলে পরিগণিত। সিরাজুদ্দীন হেসেন ছিলেন দৈনিক ইত্তেফাকের কার্যনির্বাহী ও বার্তা সম্পাদক। ব্রিটিশ আমলের শেষভাগ থেকে শুরু করে তার সাংবাদিকতা জীবন স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত ব্যপ্ত। এই পুরো সময়কালে দেশের সকল আন্দোলনের সঙ্গে তার ছিল সরাসরি যোগাযোগ। তিনি তার ক্ষুরধার লেখনির মাধ্যমে এ দেশের বঞ্চিত মানুষের কথা অসাধারণ দক্ষতায় সংবাদপত্রের পাতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেনের অসাধারণ শিরোনাম বাঙালি জাতির রক্তে আগুন ধরিয়ে দিত। চিনিল কেমনে, সুকুইজ্জা কডে, জয় বাংলার জয়, অবশেষে বাংলার ভাগ্যাকাশ হইতে বাস্তিলের কারাগার ধসিয়া পড়িয়াছে, জনতার জয় হইয়াছে, বিক্ষুব্ধ নগরীর ভয়াল গর্জন এবং দুই পাকিস্তানের ভারসাম্যহীনতাকে সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ করে যে শিরোনাম করেছেন, তা পাঠককে বিষয়ের গভীরে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জনক সিরাজুদ্দীন হোসেনের আজ ৪৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭১ সালের আজকের দিনে স্বাধীনতা যুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীল নকশার প্রথম শিকার হন সিরাজুদ্দীন হোসেন। শহীদ বুদ্ধিজীবী সিরাজুদ্দীনের মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।


সিরাজুদ্দীন হোসেন ১৯২৯ সালের ১লা মার্চ তৎকালীন মাগুরা মহকুমার (বর্তমানে মাগুরা জেলা) শালিখা থানার অন্তর্গত শরুশুনা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা পিতা মৌলভী মোজাহারুল হক। মাত্র সাড়ে ৩ বছর বয়সে তাঁর বাবা মারা যান। এ সময় তাঁর চাচা মৌলবী মোহাম্মদ ইসহাক পিতৃহারা ভাইপো-ভাইজিদের দেখাশুনার দায়িত্ব নেন। তাঁর পড়াশুনার হাতেখড়ি চাচার কাছে। সিরাজুদ্দীন হোসেন ঝিকরগাছা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এরপর যশোর মাইকেল মধুসূদন দত্ত কলেজ থেকে আই.এ. পাশ করেন। আই.এ. পাশ করার পর তিনি কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে বি.এ. পড়া শুরু করেন। এই কলেজে পড়ার সময়ই তাঁর শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুদ্দীন মোল্লা, আসফউদদৌলা রেজা, খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, কাজী গোলাম মাহবুব প্রমুখের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়। কলেজ জীবনে বই কেনার মতো আর্থিক স্বচ্ছলতা তাঁর ছিল না। অন্যের বই আর শিক্ষকদের লেকচারের উপর ভিত্তি করে নোট তৈরি করেই তিনি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতেন। পিতৃহীন সিরাজুদ্দীন হোসেন বেঁচে থাকার তাড়নায়ই এ সময় সংবাদপত্রে কাজ নিতে বাধ্য হন। ১৯৪৭ সালে ছাত্রাবস্থায় তিনি দৈনিক আজাদ-এ সাংবাদিকতা শুরু করেন। কালক্রমে তিনি আজাদ-এর বার্তা সম্পাদক হন। সমসাময়িককালে এত অল্প বয়সে বার্তা-সম্পাদকের পদে কাজ করার সৌভাগ্য আর কারো হয়নি। ১৯৫৪ সালে আজাদ-এর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পর তিনি ঢাকার ইউএসআইএস অফিসে জুনিয়র এডিটর হিসবে কিছুদিন কাজ করেন। এক বছর পর ১৯৫৫ সালে তিনি ইত্তেফাক-এর বার্তা সম্পাদক পদে নিযুক্ত হন। মানিক মিয়ার অসাধারণ দূরদৃষ্টি আর সিরাজুদ্দীন হোসেনের টিমওয়ার্ক ‘ইত্তেফাক’কে অল্পদিনের মধ্যেই একটি প্রথম শ্রেণীর সংবাদপত্রে পরিণত করে।


ব্রিটিশ আমলের শেষভাগ থেকে শুরু করে তার সাংবাদিকতা জীবন স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত ব্যপ্ত। এই পুরো সময়কালে দেশের সকল আন্দোলনের সঙ্গে তার ছিল সরাসরি যোগাযোগ। তিনি তার ক্ষুরধার লেখনির মাধ্যমে এ দেশের বঞ্চিত মানুষের কথা অসাধারণ দক্ষতায় সংবাদপত্রের পাতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। ষাট দশকের সব আন্দোলন, মি. জিন্নাহর নির্বাচন, পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্যাতিত-নিপীড়িত বাঙালিদের অব্যক্ত কথা ইত্তেফাকের পাতায় মূর্ত করে তুলেছিলেন তিনি এমনই দরদ-মমত্ব আর পারঙ্গমতার সঙ্গে, যা এ দেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসের এক অনন্য সাধারণ অধ্যায়রূপে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। ১৯৭১ সালে অবরুদ্ধ এই দেশে তিনি সাহসিকতার সঙ্গে সাংবাদিকতা করে গেছেন। সে সময় তার লেখা ঠগ বাছিতে গাঁ উজাড়, অধূনা রাজনীতির কয়েকটি অধ্যায় ধরনের উপ-সম্পাদকীয় এবং এতদিনে শিরোনামে সম্পাদকীয় মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে তার দৃঢ় অবস্থানের সাক্ষ্য দেয়। তিনি প্রবাসী সরকারের কাছে পূর্ব পাকিস্তানের আমেরিকান কনস্যুলেটের গোপন রিপোর্টটি পাঠিয়েছিলেন, যা পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বার বার প্রচারিত হওয়ার পর বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে উঠতে সাহায্য করে। মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত তিনি ইত্তেফাক-এই কর্মরত ছিলেন।


ব্যক্তিগত জীবনে আট পুত্র সন্তানের জনক ছিলেন শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন ছিলেন বিনয়ী, সদালাপী, পরোপকারী এবং সজ্জন ব্যক্তিত্ব। তাঁর স্ত্রীর নাম নূরজাহান সিরাজী। সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য মৌলিক গ্রন্থ হলঃ A Look into the mirror, ইতিহাস কথা কও, ছোট থেকে বড়, মহিয়সী নারী ইত্যাদি। তিনি বেশ কিছু বিদেশী গ্রন্থ অনুবাদ করেছেন। তার অনুদিত পুস্তকের সংখ্যা চল্লিশেরও অধিক। তাঁর অনুদিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্যগুলো হলঃ Man Against Nature, Sun, Democracy, Gone is gone, জার্মান রূপকথা, পারমানবিক শক্তির রহস্য, আমার জীবন দর্শন, মানব জীবন, অগ্নি পরীক্ষা ইত্যাদি। স্বাধীনতা যুদ্ধের এক বৎসর আগে তিনি Days Decisive নামে একটি মূল্যবান বই লিখেছিলেন। এই গ্রন্থের ভূমিকায় আবুল মনসুর আহমেদ লিখেছিলেনঃHis presentation of facts and documents and their analysis have been quite correct and objective but not without subjective outpouring of patriotic heart and tormented soul representative of suffering millions. একজন সাংবাদিক হিসেবে তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে ছিল দেশের গণমানুষ অপশাসন ও শোষণের হাত থেকে মুক্তির মাধ্যমে একটি সমৃদ্ধশালী জাতির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গঠন।


১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীল নকশার প্রথম শিকার হন সিরাজুদ্দীন হোসেন। স্বাধীনযুদ্ধে বিজয়ের প্রাক্কালে ১০ ডিসেম্বর ঘৃণ্য পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর আল বদর ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে তার চামেলীবাগের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়, এরপর তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। সাংবাদিতায় অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৭৬ সালে শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন একুশে পদক (মরণোত্তর) এবং ২০১০ সালে মানিক মিয়া স্বর্ণপদক (মরণোত্তর) দেয়া হয়। এছাড়াও সিরাজুদ্দীন হোসেন ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউট অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনয়ন লাভ করেছিলেন। বাংলাদেশের ইনভেস্টিগেটিং সাংবাদিকতার জনক শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন আজ আমাদের মাঝে নেই, তবে মরেও তিনি অমর হয়ে আছেন।


২০১৩ সালের ৩রা নভেম্বর, চৌধুরী মুঈনুদ্দীন এবং আশরাফুজ্জামান খান কে ১৯৭১ সালের ১০ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে সিরাজুদ্দিন হোসেন সহ ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে অপহরণের পর হত্যার দায়ে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। আজ সাংবাদিক জগতের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক অকুতভয় শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হেসেনের ৯০তম জন্মবার্ষিকী। আদর্শবাদী ও নীতিনিষ্ঠ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের জন্মবাষিীকীতে ফুলেল শুভেচ্ছা।

নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৪:৪৭
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডালাসবাসীর নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:৪৪

গত পাঁচ ছয় বছর ধরেই নানান কারণে প্রতিবছর আমার নিউইয়র্ক যাওয়া হয়। বিশ্ব অর্থনীতির রাজধানী, ব্রডওয়ে থিয়েটারের রাজধানী ইত্যাদি নানান পরিচয় থাকলেও আমার কাছে নিউইয়র্ককে আমার মত করেই ভাল ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×