somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইসলামের ইতিহাসে মহিয়সী নারীঃ যারা এসেছিঁলেন তিমির অন্ধকার ঘুচাতে

০৫ ই জুন, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


মুসলিম খেলাফত অবসানের সাথে সাথে মুসলিম জাহানে নারীদের পদচারণা যেন স্তব্দ হয়ে গেল। মুসলিম নারীদে ইতিহাস - ঐতিহ্য এত কম আলোচিত হয়েছে যে, আজকের নবীন বংশধরেরা মনে করতে পারছে না যে, তাদের পূর্ববর্তী মায়েরা ছিলন অতি উচ্চ স্তরের মহিলা-শুধু ধর্মীয় জীবনেই নয়, সাহিত্য-সমাজ-সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে তাদের ছিল উজ্জ্বল ঈর্ষণীয় ভূমিকা। রাজনীতির অঙ্গনে মুসলিম মহিলাদের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস।রাজনীতির অঙ্গনে মুসলিম মহিলাদের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। ৭ম শতাব্দী থেকে শুরু করে পরবর্তী প্রায় ১৩০০ বছরের খিলাফত তথা ইসলামী শাসনামলে হাজার হাজার মুসলিম নারী আইনবিদ, বিজ্ঞানী, রাজনীতিবিদ, বিচারক, ভাষাবিদ, জ্ঞানসাধক ও সর্বোপরি আদর্শ মা ও স্ত্রী হিসাবে অনবদ্য ভূমিকা রেখেছিলো ইসলামের ইতিহাসে। হজরত মুহম্মদ (সা.) বলেন, ‘দুনিয়ার সব নারীর মধ্যে চারজন নারীর বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। তারা হলেন হজরত মরিয়ম (আ.), হজরত আসিয়া (আ.), হজরত খাদিজা (রা.) ও হজরত ফাতেমা (রা.)। এ ছাড়া ইসলামের ইতিহাসে আরও অসংখ্য নারী ছিলেন যারা জ্ঞানে, গুণে, সততা আর প্রজ্ঞায় এখনো সব নারীর জন্যই অনুপ্রেরণার উৎস। চাঁদ সুলতানা ও সুলতানা রাজিয়ার নাম রাজনীতির ইতিহাসের পাতায় অক্ষয় হয়ে থাকবে। ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ মুসলিম নারীদের নিয়ে আমার আজকের আয়োজন ইসলামের ইতিহাসের মহিয়সী নারী যারা এসেছিঁলেন তিমির অন্ধকার ঘুচাতে।

১। হজরত খাদিজা (রা.)
আরবের কোরাইশ বংশের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন হজরত খাদিজা (রা.)। তারপরও অত্যন্ত সাধারণ জীবন-যাপন করতেন তিনি। ইসলাম আবির্ভাবের আগে তিনি ইব্রাহিম (আ.)-এর ধর্মে বিশ্বাস করতেন। তৎকালীন সমাজে সৎকর্ম ও দানশীলতার ক্ষেত্রে হজরত খাদিজার সমকক্ষ কেউ ছিলেন না। বিজ্ঞ ও সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গির খাদিজা ছিলেন হিজাজের অন্যতম বড় ব্যবসায়ী। আধ্যাত্মিকতার প্রতি ঝোঁক ছিল তার। জানা যায়, তিনি সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আবির্ভাবের অপেক্ষায় ছিলেন এবং তিনি আরবের সচেতন ও শিক্ষিত প্রবীণদের কাছে শেষ নবীর নিদর্শন সম্পর্কে মাঝেমধ্যেই জিজ্ঞাসাবাদ করতেন। কিন্তু নবুয়তপ্রাপ্তির আগেই রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে পরিচয় ঘটে খাদিজার। তিনি বুঝতে পারলেন, সমাজের অতুলনীয় ও পবিত্রতম পুরুষ হচ্ছেন মুহাম্মদ (সা.)। রাসুলের গুণাবলি তাকে আকৃষ্ট করে। এরপরই ৪০ বছর বয়সে তিনি ২৫ বছরের রাসুলকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। শুরু হয় তাদের দাম্পত্য জীবন। এই বিয়েকে তৎকালীন সমাজ স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। সম্পদহীন মুহম্মদ (সা.)-কে বিয়ে করায় অনেকেই তাকে তাচ্ছিল্য করতেন। কুরাইশ বংশের এক দল অহংকারী ও নিন্দুক মহিলা তাকে গরিব মুহাম্মদের প্রসঙ্গ টেনে কটাক্ষ করত। তিনি উত্তর দিতেন, ‘তার মতো আর কেউ কি আছে? তার মতো সচ্চরিত্রবান ও মর্যাদাবান দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তিকে কি তোমরা চেনো?’ ওইসব মহিলার বিদ্বেষমাত্রা এত বেশি ছিল যে, খাদিজার সন্তান প্রসবের সময় বিন্দু পরিমাণ সহযোগিতাও কেউ করেনি। ইসলাম গ্রহণের পর সমগ্র অস্তিত্ব দিয়ে তিনি ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত হন। ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তার সকল সম্পদ রাসুলকে উপহার দিয়েছিলেন। শোয়াবে আবু তালিব নামক উপত্যকায় মুসলমানরা যখন বিচ্ছিন্ন ও অবরোধের শিকার হয়েছিল, তখন তার আর্থিক সহযোগিতা মুসলমানদের টিকে থাকতে সহায়তা করেছিল। কোনো কারণে রাসুল (সাঃ)-এর মন খারাপ থাকলে তিনি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নিতেন এবং সকল কাজে পরামর্শ দিতেন। মুসলমানদের ওপর অবরোধ আরোপের পর খাদিজা (রা.) অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন। এত সম্পদের মালিক হয়েও তিনি দীর্ঘদিন শুষ্ক এক উপত্যকায় কষ্টের মধ্যে জীবনযাপন করেছেন। ইসলামের জন্য তার অঢেল সম্পদ বিলিয়ে দিয়েছিলেন। ওই উপত্যকায় কষ্টের মধ্যে জীবনযাপন করার কারণে খাদিজার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। তিনি মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন। এর ফলেই তার মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়। ইসলামের এই মহীয়সী নারী ৬১৭ খ্রিস্টাব্দের ১০ রমজান ৬৫ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।

২। হজরত আয়েশা (রা.)
আয়েশা বিনতে আবু বকর (রা.) ছিলেন নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর স্ত্রী। নবীজির খুব প্রিয় স্ত্রী ছিলেন আয়েশা। মুসলিম সম্প্রদায় তাকে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর স্ত্রী হিসেবে অত্যন্ত সম্মান ও শ্রদ্ধা করে থাকেন। ইসলামের ঐতিহ্য অনুসারে, তাকে ‘উম্মুল মুমিনিন’ বা ‘বিশ্বাসীদের মাতা’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এ ছাড়া ইসলামের ঐতিহ্যগত ইতিহাসেও তার অবদান অনস্বীকার্য এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামি জ্ঞানবিজ্ঞানে হজরত আয়েশা (রা.) ছিলেন নজিরবিহীন। কোরআন-হাদিসের জ্ঞান এবং ইসলামি শরিয়তের মাসলা-মাসায়েলের ব্যাপারে তিনি ছিলেন নারীদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয়। প্রাচীন আরবের অবস্থা এবং প্রাচীন আরবি কাব্য সম্পর্কে তার অসাধারণ বুৎপত্তি ছিল। নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর সঙ্গে ছয় বছর বয়সে মতান্তরে নয় বছর বয়সে তার বিয়ে হয়। নবীজির স্ত্রীদের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে ছোট বয়সের। মৃত্যুর সময় মুহাম্মদ (সা.) তার ঘরেই ছিলেন এবং তার এই প্রিয়তমা স্ত্রীর বাহুযুগলে মাথা রেখেই মহানবী (সা.) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। নবী (সা.)-এর মৃত্যুর পর জনগণ আবু বকর (রা.)-কে খলিফা নির্বাচন করেন। তখন আয়েশা (রা.) নবী (সা.)-এর স্ত্রী এবং খলিফার মেয়ে হিসেবে সমধিক সম্মান পেতেন। আবু বকর (রা.) তার মৃত্যুর আগে ওমর (রা.)-কে খলিফা নিযুক্ত করে যান। খলিফা ওমর (রা.)-এর শাসনামলেও তিনি দাপটের সঙ্গে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তসমূহে মতামত প্রদান করার স্বাধীনতা লাভ করেছিলেন। ইসলামের ইতিহাসে বসরার যুদ্ধ বা উটের যুদ্ধ নামে পরিচিত যুদ্ধে তিনি পেছন থেকে নেতৃত্ব দেন। ইতিহাসে এ যুদ্ধের প্রভাব ছিল ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী। তিনিই ছিলেন একমাত্র নারী যিনি সামনে থাকা অবস্থায় হজরত মুহাম্মদ (সা.) কাছে ওহি অবতীর্ণ হয়েছিল। ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর (রা.) ছিলেন তার বাবা। আয়েশা (রা.) ৬১৩ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে মতান্তরে ৬১৪ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকে জন্মগ্রহণ করেন। রোগে আক্রান্ত হয়ে ৫৮ হিজরি সনের ১৭ রমজান (১৬ জুলাই, ৬৭৮ খ্রিস্টাব্দ) মৃত্যুবরণ করেন। তাকে দাফন করা হয় জান্নাতুল বাকিতে। তার মাতার নাম উম্মে রুমান।

৩। বিবি আসিয়া (আ.)
হজরত আসিয়া (আ.) ছিলেন মিসরের অধিবাসী মুজাহিমের মেয়ে। তার বাবা তাকে মিসরের ফেরাউন (বাদশাহ) দ্বিতীয় রামসেসের সঙ্গে বিয়ে দেন। ফেরাউন ছিল অত্যন্ত প্রতাপশালী ও কুখ্যাত। নিজেকে তিনি খোদা বলে দাবি করতেন। কিন্তু আসিয়া (আ.) ফেরাউনের ভ্রান্ত দাবি, বিশ্বাস ও স্বৈরাচার নীতিকে প্রত্যাখ্যান করেন। এতে ফেরাউন তার ওপর ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়। আসিয়ার ওপর নেমে আসে জুলুম-নির্যাতন। ফেরাউনের নির্দেশে তাকে জিঞ্জিরে বেঁধে রাখা হয়, বিরাট পাথরের নিচে তাকে চাপা দিয়ে রাখা হয়। পাথরের আঘাতে তার পবিত্র দেহ ক্ষতবিক্ষত হয়। এমনকি তার চোখও উপড়ে ফেলা হয়। কিন্তু এসব অমানবিক নির্যাতনেও আসিয়ার বিশ্বাসকে চুল পরিমাণ টলানো সম্ভব হয়নি। অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট ও নির্যাতন সহ্য করেও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকার জ¦লন্ত প্রমাণ বিবি আসিয়া (আ.)। দুনিয়ার আরাম-আয়েশকে পদাঘাত করে আল্লাহর ভালোবাসাকে প্রধান্য দিয়েছেন তিনি। আসিয়া (আ.)-এর কোলে লালিতপালিত হন আল্লাহর প্রিয় নবী হজরত মুসা (আ.)। শিশু মুসাকে যখন তার মা ফেরাউনের ভয়ে সিন্দুকে ভরে নীল নদে নিক্ষেপ করেন, তা ভাসতে ভাসতে সেই ফেরাউনের ঘাটে গিয়েই ঘুরপাক খেতে থাকে। পাপিষ্ঠ ফেরাউন সিন্দুকটি উঠানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। তার অপবিত্র হাতে তা উঠছিল না। কিন্তু বিবি আসিয়া যখন আল্লাহর নামে তা ওঠানোর জন্য হাত দেন, সঙ্গে সঙ্গে তা উঠে আসে। সিন্দুক খুলে একটি পুত্রসন্তান দেখে ফেরাউনের মনে সন্দেহ সৃষ্টি হয় এবং তাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়। কারণ ফেরাউন গণকদের কাছ থেকে জানতে পেরেছিল, ইসরাইল বংশে এক শিশুপুত্র জন্ম নেবে, যার হাতে তার রাজত্ব ধ্বংস হবে। কিন্তু তার স্ত্রী আসিয়া (আ.) শিশুটিকে লালন পালনের আগ্রহ ব্যক্ত করে বলেন, ‘এ শিশু আমার ও তোমার নয়নমণি, তাকে হত্যা করো না।’ স্ত্রীর দাবির সামনে ফেরাউন নমনীয় হয়। আল্লাহ তায়ালা হজরত আসিয়া (আ.)-এর অন্তরে শিশু মুসা (আ.)-এর প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করে দেন। তিনি তাকে নিজ ছেলের মতো ভালোবাসতে থাকেন।

৪। উম্মে সালমা (রা)
নবী মুহাম্মাদের (সা.) স্ত্রী উম্মে সালমা। তার প্রকৃত নাম, উম্মে সালমা হিন্দ বিনতে আবি উমাইয়া। তার পিতার নাম আবু উমাইয়া বিন মুগিরা বিন আব্দুল্লাহ বিন আমের বিন মাখজুম এবং মাতার নাম আতিবাহ বিনতে রবিয়া বিন মালেক কানানী। তিনি ও তার প্রথম স্বামী আব্দুল্লাহ বিন আবদুল আসাদ প্রথম যুগে ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারীদের মধ্যে অন্যতম। মক্কার কাফিরদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে তারা আবেসিনিয়ায় হিযরত করেন। সেখানেই তাদের প্রথম পুত্র স্নতান সালামার জন্ম হয়। স্বাস্থানুকূল না-হওয়ায় তারা আবিসিনিয়া থেকে আরবে প্রত্যাবর্তন করেন এবং মদীনায় হিযরত করেন। হিযরত কালে তারা কাফিরদের হাতে বন্দী হন। তার স্বামী পালিয়ে মদীনা গমনে সক্ষম হলেও উম্মে সালামা সপুত্রক এক বছর বন্দী থাকেন। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের লক্ষ্যে মুহাম্মদ (সা.) তাকে বিবাহ করেন। এ সময় উম্মে সালামা বয়স ২৭ এবং রাসুলুল্লাহ`র বয়স ৫৭ বছর। তিনি বয়স্কা মহিলা ছিলেন। রাসূল (সা)-এর সাথে বিবাহের পর তাঁর গৃহ ইসলামী শিক্ষার কেন্দ্র হয়ে উঠে। ক্বিরাত-কন্ঠশিল্পে মদীনাবাসীদের ইমাম শোবাইয়া বিন নাছাহ তার ছাত্র ছিলেন। শোবাইয়অ উম্মে সালমার ক্রীতদাসম ছিলেন । তাঁর শিক্ষা প্রশিক্ষণের সকল দায়িত্ব উম্মে সালমাই গ্রহণ করেন। রাসুলুল্লাহ`র স্ত্রী হিসাবে তার গর্ভে কোনো সন্তান জন্মগ্রহণ করেনি। তিনি কত বছর বেঁচে ছিলেন তা সঠিকভাবে নিরূপিত হয়নি। ধারণা করা হয়, মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৮৪ বৎসর। রাসুলুল্লাহ`র স্ত্রীদের মধ্যে তারই সর্বশেষে ইন্তেকাল হয়। মদীনায় জান্নাতুল বাকীতে তার কবর অবস্থিত।

৫। হজরত ফাতেমা (রা.)
ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এবং তার প্রথম স্ত্রী খাদিজার মেয়ে ছিলেন ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ। সারা বিশ্বের মুসলমানরা তাকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। মক্কায় কোরাইশদের দ্বারা মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর নির্যাতন ও দুর্দশার সময়ে সব সময়ই ফাতেমা তার পাশে ছিলেন। ফাতেমা মহানবী (সা.)-এর মেয়ে হয়েও স্নেহময়ী মায়ের মতো মহানবীকে ভালোবাসতেন বলেই তার উপাধি হয়েছিল ‘উম্মে আবিহা’। এর অর্থ ‘তার পিতার মা’। মহান আল্লাহর নির্দেশে হিজরতের সময় হজরত ফাতেমাও নবী পরিবারের অন্যদের সঙ্গে হিজরত করেন। তিনি ছিলেন খোলাফায়ে রাশেদিনের চতুর্থ খলিফা ইসলামের বীর সৈনিক হজরত আলী (রা.)-এর প্রিয়তমা স্ত্রী এবং ইসলামের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম শহীদ হজরত ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইনের মা। ফাতেমা (রা.)-এর মা খাদিজা (রা.) মারা যাওয়ার সময় প্রচুর ধন-সম্পদ রেখে যান। মহীয়সী মায়ের মতো তিনিও সকল ধন-সম্পদ ইসলাম প্রচারের জন্য তার বাবার হাতে তুলে দেন। বদান্যতা, মহানুভবতা ও দরিদ্রদের প্রতি তার মমতা এতই বেশি ছিল যে, কোনো অসহায় বা ভিক্ষুক কখনোই কিছু না পেয়ে তার ঘরের দরজা থেকে খালি হাতে ফিরে যায়নি। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর চরিত্রের প্রতিটি গুণই তার জীবনে প্রতিফলিত হতে দেখা গেছে। তিনি ছিলেন সত্যের পূজারী, আমানতদারী, লাজুক, নম্র ও সরলমনা। শৈশব থেকেই হজরত ফাতেমা ছিলেন নির্ভীক, তেজস্বিনী ও বক্তা। তিনি সর্বদা তার বাবা হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর আদর্শ অনুসরণ করতেন এবং মা বিবি খাজিদা (রা.)-এর আদেশ ও উপদেশাবলি বাস্তব জীবনে পালন করতেন। তার জন্ম সম্পর্কে নানা মতভেদ রয়েছে। তিনি ৬০৫ খ্রিস্টাব্দে মতান্তরে ৬০৪ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। বলা হয়ে থাকে, প্রথম কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার পাঁচ বছর পর কাবাঘর সংস্কারের সময় জন্মগ্রহণ করেন। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মৃত্যুর কয়েক মাস পরেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন এবং মদিনার জান্নাতুল বাকিতে তাকে সমাধিস্থ করা হয়। হজরত ফাতেমার মর্যাদা সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেন, ‘দুনিয়ার সব নারীর ওপর চারজন নারীর মর্যাদা রয়েছে। তারা হলেন হজরত মরিয়ম (আ.), হজরত আসিয়া (আ.), হজরত খাদিজা (রা.) ও হজরত ফাতিমা (রা.)। পবিত্র কোরআনের অনেক আয়াতে হজরত ফাতেমার (রা.) মর্যাদার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

৬। যুবায়দা (রাঃ)
১৮৬ হিজরিতে খলিফা হারুনুর রশীদের স্ত্রী বিবি যুবায়দা হজ পালনকালে মক্কায় হাজিদের পানির কষ্ট দেখতে পান। তখন তিনি পাহাড়ের জলপ্রপ্রাত থেকে মক্কা শহর পর্যন্ত খাল কাটার নির্দেশ দেন। তার একক প্রচেষ্টায় ও ব্যক্তিগত খরচে প্রায় সাড়ে ষোল কিলোমিটার লম্বা খাল খনন করা হয় এবং সেখান থেকে বিভিন্ন পয়েন্টে হাজি ও মুসাফিরদের পানির যাবতীয় প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা করা হয়। বলা হয়ে থাকে, মক্কা থেকে তায়েফমুখী এই খাল খননকার্যে বিবি যুবায়দা আনুমানিক ৫৯৫০ কিলোগ্রাম স্বর্ণ খরচ করেছিলেন। ইতিহাসে এটি ‘উয়ুন যুবায়দা’ বা ‘বিরকাতে যুবায়দা’ হিসেবে প্রসিদ্ধ এবং ১২০০ বছর পরও এখান থেকে সেচপ্রকল্প অব্যাহত আছে।

৭। হযরত জয়নাব (সা.)
হযরত জয়নাব (সা.) ছিলেন এমন এক মহিয়সী রমণী যাঁর সম্মান-মর্যাদা আর সাহসী ভূমিকার ঐশ্বর্যে ইসলামের ইতিহাসের পাতা স্বর্ণোজ্জ্বল হয়ে আছে। হযরত জয়নাব (সা.) ষষ্ঠ হিজরীর ৫ই জমাদিউল আউয়াল জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন হযরত আলী (আ.) এবং হযরত ফাতেমা (সা.) এর তৃতীয় সন্তান। তাঁর জন্মের সময় নবীজী সফরে ছিলেন। তাই তাঁর মা ফাতেমা (সা.) আলী (আ.) কে মেয়ের জন্যে একটা ভালো নাম দিতে বললেন। কিন্তু হযরত আলী (আ.) এটা নবীজীর জন্যে রেখে দিলেন এবং নবীজীর সফর থেকে ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বললেন। নবীজী যখন সফর থেকে ফিরে এলেন তখন এই কন্যার জন্মের সংবাদে খুশি হয়ে বললেন: "আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন,এই কন্যার নাম রাখো জয়নাব অর্থাৎ বাবার অলংকার। রাসূলে খোদা (সা.) জয়নাবকে কোলে নিয়ে চুমু খেয়ে বললেন-সবার উদ্দেশ্যে বলছি,এই মেয়েটিকে সম্মান করবে,কেননা সে-ও খাদিজার মতো। " ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে যে,সত্যি-সত্যিই জয়নাব (সা.) খাদিজা (সা.) র মতোই ইসলামের দুর্গম পথে অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন এবং দ্বীনের সত্যতাকে তুলে ধরার জন্যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। জয়নাব (সা.) তাঁর জীবন শুরু করেন এক আধ্যাত্মিকতার পরিবেশপূর্ণ পরিবারে। কেননা এই পরিবার রাসূলে খোদা (সা.),আলী (আ.) এবং ফাতেমা (সা.) এর মতো মহান ব্যক্তিত্ববর্গের অস্তিত্বের সান্নিধ্য পেয়ে ধন্য হয়েছে,পবিত্র হয়েছে। এঁরা ছিলেন পূত-পবিত্র জীবনের অধিকারী এবং মানবীয় মর্যাদা ও ফযিলতের গোড়াপত্তনকারী। জয়নাব (সা.) সেই শিশুকাল থেকেই প্রত্যুৎপন্নমতি ছিলেন এবং আধ্যাত্মিকতাপূর্ণ মনের অধিকারী ছিলেন। সেই ছোট্ট বেলায় তিনি একবার তাঁর মা ফাতেমা (সা.) এর গুরুত্বপূর্ণ একটা ধর্মীয় ভাষণ শুনেছিলেন। সেই ভাষণ তাঁর মুখস্থ হয়ে যায় এবং পরবর্তী ঐ ভাষণের একজন বর্ণনাকারী হয়ে যান তিনি। তাঁর এই সচেতনতার জন্যে এবং তীক্ষ্ম স্মৃতিশক্তির জন্যে বয়সকালে তাঁকে সবার কাছেই 'আকিলা' উপাধিতে পরিচিত ছিলেন। আকিলা মানে হলো বুদ্ধিমতী ও চিন্তাশীল রমণী।

৮। মায়মুনা বিনতে আল-হারিস
তিনি ছিলেন ইসলামের শেষ নবী মুহাম্মাদ(সঃ) এর স্ত্রী। তিনি নবীর স্ত্রীদের মধ্যে সর্বশেষ স্ত্রী ছিলেনতার প্রকৃত নাম ছিল বাররাহ, কিন্তু মুহাম্মাদ তার নাম পরিবর্তন করে মায়মুনা রেখেছিলেন। ৬৩২ সালে নবী মুহাম্মাদ(সঃ) মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মায়মুনা তার সাথেই বসবাস করতেন। তার পিতা আল-হারিস ইবনে হাজন ছিলেন মক্কা নগরীর হিলাল উপজাতিদের একজন। তার মাতা হিন্দ বিনতে আউফ ছিলেন ইয়েমে্নের হিমার নামক উপজাতিদের একজন। উম্মে দারদা (রা): তিনি ছিলেনপ্রসিদ্ধ সাহাবী আবু দারদা (রা)-এর স্ত্রী। তিনি শিক্ষিতা আবেদা ও জ্ঞানী ফকীহ ছিলেন। বুখারীতে এ বিষয়ে তালীক্ব রয়েছে। তিনি তাঁর স্বামীর মাদরাসায় শিশু ও তরুণদের লেখার নিয়ম শিক্ষা দিতেন। কারণ তিনি ভালো লিখতে পারতেন।

৯। প্রথম মহিলা শহীদ সুমাইয়া রা.
ইসলামের জন্য পুরুষদের পাশাপশি মহিলাদের আত্মত্যাগের কাহিনী বড়ই করুণ। হযরত সুমাইয়া রা. ছিলেন আবু হুযাইফার বাঁদী। ইয়াসের তাঁর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের ঘর আলোকিত করে আম্মার নামক ছেলে সন্তান। আম্মার রাসূলুল্লাহর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর দাওয়াত পেয়ে তাঁর পিতা ইয়াসের এবং পরে মা সুমাইয়া ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় নেন। অত্যন্ত করুণ ও কঠিন অবস্থায় এই পরিবার নবীজির প্রতি ঈমান আনয়ন করে। মুশরিকরা এই দুর্বল পরিবারটির উপর তাদের নৃশংসতার মাত্রা পরীক্ষা করে। মুশরিকরা ইয়াসির পরিবারের উপর চরম নির্যাতন চালিয়ে অন্যদের কাছে এই বার্তা দিতে চেয়েছিল যে, মুহাম্মদের ধর্ম গ্রহণ করলে এ রকম মাসুল গুণতে হবে। সুমাইয়ার উপর তারা যে নির্যাতন চালায় তা ছিল লোমহর্ষক, অবর্ণনীয়। বলা হয়েছে, সুমাইয়ার দুই পা দুই উটের সাথে বেঁধে উট দুটিকে বিপরীত দিকে ধাবড়ানো হয়। আরো বর্ণিত আছে, মুশরিকরা হযরত সুমাইয়ার লজ্জাস্থানে বর্শা ঢুকিয়ে তাকে শহীদ করেছিল। ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় মহিলাদের এই ত্যাগ ও ভূমিকা আজকের বিশে^র মুসলিম মহিলাদের জন্য গৌরবের।

১০। বিবি মরিয়ম (আ.)
বিবি মরিয়ম বাইতুল মুকাদ্দাসের অদূরেই নাছেরা শহরের বাসিন্দা ছিলেন। পিতামাতার ইচ্ছানুযায়ী বাইতুল মুকাদ্দাসের খেদমতে নিযুক্ত হয়েছিলেন তিনি। বাল্যকাল থেকেই তিনি ছিলেন সুশীলা এবং ধর্মানুরাগী। তার পিতার নাম ছিল ইমরান এবং নবী জাকারিয়া (আ.)-এর শ্যালিকা বিবি হান্না ছিলেন তার জননী। একদিন মরিয়ম নামাজ পড়ছিলেন, হঠাৎ ফেরেশতা জিব্রাইল অবতীর্ণ হয়ে বললেন, ‘তুমি আল্লাহর অনুগ্রহপ্রাপ্তা। আল্লাহ তোমার সঙ্গে আছেন।’ বিবি মরিয়ম এই অপ্রত্যাশিত সম্বোধনে ভীত হলেন। জিব্রাইল বললেন, ‘আমি আল্লাহর ফেরেশতা জিব্রাইল। তুমি ভীত হয়ো না; পবিত্র সন্তান লাভ করবে তুমি, এই সুসংবাদ তোমাকে দিতে এসেছি।’
মরিয়ম বললেন, ‘তা কেমন করে, আমি যে কুমারী।’
ফেরেশতা বললেন, ‘আল্লাহর কুদরতেই হবে এটি। তার কাছে এটি কঠিন কাজ নয়।’ এই বলে জিব্রাইল উধাও হলেন। যথাসময়ে বিবি মরিয়ম গর্ভধারণ করলেন। কিন্তু কুমারী নারীর এভাবে গর্ভবতী হওয়ার ফলে সবাই তাকে বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে বের করে দিলেন। এমনকি তাকে স্বগ্রামও ছেড়ে যেতে হলো। বিপদাপন্ন মরিয়ম কোনো আশ্রয় খুঁজে না পেয়ে একটি শহরের দ্বারপ্রান্তে আস্তাবলের একটি পতিত জমিনে এক খেজুর গাছের নিচে আশ্রয় নিলেন এবং সঙ্গী-সহায়হীন অবস্থায় একটি পুত্রসন্তান প্রসব করলেন। এই পুত্র সন্তানই ছিলেন হযরত ঈসা (আ.)। আট দিন বয়সে সদ্যোজাত ঈসার ত্বক ছেদন করা হয়। মরিয়ম শুচি-স্নাতা হওয়ার পর সন্তান নিয়ে আবারও বাইতুল মুকাদ্দাসে ফিরে গেলেন। এদিকে, মরিয়ম স্বপ্ন দেখলেন, সম্রাট হিরুইস এই সন্তানের শত্রু, সে তাকে হত্যা করতে চায়। সে যেন শিশুকে নিয়ে মিসরে চলে যায়। মরিয়ম তার সন্তান নিয়ে মিসরে রওনা হয়ে যান। হিরুইস যত দিন জীবিত ছিল, ততদিন সন্তান নিয়ে তিনি মিসরেই অবস্থান করেন। হিরুইসের মৃত্যুর পর তিনি নিজ দেশ নাছেরায় ফিরে আসেন।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঈসার মধ্যে প্রখর জ্ঞান এবং তীক্ষ্ম মেধাশক্তির পরিচয় ফুটে উঠল। আল্লাহর বিশেষ একটি অনুগ্রহ যে তার ওপর রয়েছে, দিন দিন তা প্রকাশ পেতে শুরু করল। ক্রমান্বয়ে হযরত ঈসা আধ্যাত্মিক জ্ঞানের পূর্ণতা লাভ করতে লাগলেন। ত্রিশ বছর বয়সে তিনি আল্লাহর কাছ থেকে ‘ওহি’ লাভ করেন এবং নবীরূপে ধর্মপ্রচার করতে শুরু করেন।

১১। হাফসাহ (রা):
হযরত ওমরের (রা.) কন্যা হাফসার (রা.) যার কাছে চামড়া ও হাড়ের ওপর লিখিত কোরআনের প্রথম পান্ডুলিপি সংরক্ষিত ছিল। ইসলামি খেলাফতের অধীন বিভিন্ন প্রদেশে কোরআনের ছয়টি অপ্রামাণ্য সংকলন প্রচলিত ছিল। হজরত হাফসার (রা.) কাছে কোরআনের প্রামাণ্য পান্ডুলিপি সংরক্ষিত থাকায় খলিফা উসমানের (রা.) পক্ষে অপ্রামাণ্য সংস্করণগুলো ধ্বংস করে ফেলা সম্ভব হয়েছিল। এই ঘটনা থেকে হাফসার (রা.) যোগ্যতা ও নৈতিক অবস্থান কতটা নির্ভরযোগ্য ছিল তা অনুমান করা যায়। তিনি কিন্তু রাসুলের স্ত্রীও ছিলেন। তিনি অনেক হাদীস বর্ণনা করেছেন।

১২। রাবেয়া বসরী (রহ.)
ইরাকের বসরা নগরীতে এক দরিদ্র পল্লীতে জন্ম হয়েছিল হজরত রাবেয়া বসরীর (রহ.)। দরিদ্র হলেও তার পরিবার ছিল অত্যন্ত সম্মানিত। বাবার নাম ইসমাঈল ও মায়ের নাম মায়ফুল। প্রখর বুদ্ধিমত্তার অধিকারিণী ছিলেন তিনি। সব সময় গভীর চিন্তায় ধ্যানমগ্ন হয়ে যেতেন। তার জন্মতারিখ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তবে বলা হয় ৭১৯ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে এই মহীয়সী নারী জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কথিত আছে, তার বাবা এতই দরিদ্র হয়ে পড়েছিলেন, যে রাতে রাবেয়া বসরী (রহ.) জন্মগ্রহণ করেন, তখন ঘরে বাতি জ্বালাবার তেল এবং প্রসূতি ও সন্তানের পেটে মালিশ করার তেল পর্যন্ত ছিল না। রাবেয়ার আগে তার বাবার আরও তিনটি মেয়ে হয়েছিল। তিনি চতুর্থ নম্বর বলে তার নাম রাবেয়া রাখা হয়। আরবি ভাষায় রাবেয়া শব্দের অর্থ চতুর্থা। রাবেয়া বসরী (রহ.) মা-বাবার কাছ থেকে কোরআন, হাদিস ও অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থের শিক্ষা লাভ করেছিলেন। তিনি কখনো কারও মুখাপেক্ষী ছিলেন না। সব সময় তিনি আল্লাহর ওপর ভরসা করতেন। তিনি একটি ইবাদতখানা নির্মাণ করে সেখানে নীরবে দিন-রাত ইবাদতে রত থাকতেন। আল্লাহর একজন প্রকৃত ওলি হওয়ার জন্য যা যা গুণাবলি থাকা প্রয়োজন সকল গুণের অধিকারিণী ছিলেন হযরত রাবেয়া বসরী (রহ.)। সে সময় স্বনামধন্য অনেক সুফি রাবেয়া বসরীর (রহ.) কাছে ইসলাম নিয়ে আলোচনা করার জন্য আসতেন। রাবেয়া বসরী দাসত্বের জীবনও অতিবাহিত করেছেন। বিরামহীন ভাবে সারা দিন কাজ করে আল্লার ইবাদতে মশগুল হয়ে যেতেন। রাবেয়া বসরীর উদ্দেশ্যই ছিল আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি লাভ করা। রাবেয়া বসরীর ইবাদত-বন্দেগি দেখে তার মনিব তাকে দাসত্ব জীবন থেকে মুক্ত করেন।
একবার মুনাজাতের সময় তিনি বলছিলেন ‘হে আল্লাহ। যদি জান্নাতের লোভে ইবাদত করি তাহলে আমি যেন কখনোই জান্নাতে না যাই আর যদি জাহান্নামের ভয়ে ইবাদত করি তাহলে যেন আমি জাহান্নামে যাই। কিন্তু আল্লাহ আমি যদি শুধু তোমাকে ভালোবেসে তোমার ইবাদত করি তাহলে আমি যেন কখনোই তোমার দর্শন থেকে এক মুহূর্ত বঞ্চিত না হই।’ এই মহীয়সী নারী ৮০১ খ্রিস্টাব্দে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

১৩। চাঁদ সুলতানাঃ
চাঁদের কন্যা চাঁদ সুলতানা,
চাঁদের চেয়েও জ্যোতি
তুমি দেখাইলে মহিমান্বিতা নারী কি শক্তিমতী

শৌর্যে সাহসে চাঁদ সুলতানা বিশ্বের বিস্ময় চাঁদ সুলতানা। চাঁদ সুলতানা ছিলেন আহমদনগরের সাবেক বাদশাহ হুসাইন নিজাম শাহ (প্রথম)-এর কন্যা। ৫৯৬ সনের ১১ মার্চ দক্ষিণ ভারতের নিজাম-শাহী রাজবংশের পরিচালিত রাষ্ট্র আহমাদনগরে হামলা চালায় মুঘল সম্রাট আকবরের সেনারা। কিন্তু এই হামলা বীরত্বের সঙ্গে প্রতিহত করেন রাজকন্যা চাঁদ সুলতানা। বিজাপুর রাাষ্ট্রের সুলতান আলী আদেল শাহের বিধবা স্ত্রী চাঁদ সুলতানা (চাঁদ বিবি) এ সময় আহমদনগরের নাবালক সুলতান বাহাদুর নিজাম শাহের অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। এই সুলতান ছিলেন তারই ভাই বা বোনের নাতি। ১৫৯৬ সনের ১১ মার্চ দক্ষিণ ভারতের নিজাম-শাহী রাজবংশের পরিচালিত রাষ্ট্র আহমাদনগরে হামলা চালায় মুঘল সম্রাট আকবরের সেনারা। কিন্তু এই হামলা বীরত্বের সঙ্গে প্রতিহত করেন রাজকন্যা চাঁদ সুলতানা। বিজাপুর রাাষ্ট্রের সুলতান আলী আদেল শাহের বিধবা স্ত্রী চাঁদ সুলতানা (চাঁদ বিবি) এ সময় আহমদনগরের নাবালক সুলতান বাহাদুর নিজাম শাহের অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। এই সুলতান ছিলেন তারই ভাই বা বোনের নাতি। চাঁদ সুলতানা ছিলেন আহমদনগরের সাবেক বাদশাহ হুসাইন নিজাম শাহ (প্রথম)-এর কন্যা। দাক্ষিণাত্যের আহমদনগর রাজ্যে বীরাঙ্গনা স্বাধীনতা সংগ্রামী চাঁদ সুলতানা সম্পর্কে জানা যায়। সম্রাট আকবর ১৫৬১ খ্রি: হতে ১৫৯৫ খ্রি: পর্যন্ত প্রায় ৩৪ বছর যুদ্ধ-বিগ্রহ পরিচালনা করে কান্দাহার হতে বাঙ্গাল মুলুক পর্যন্ত উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করেন। এরপর সম্রাট দক্ষিণ ভারতে অভিযান পরিচালনা করে রাজ্য বিস্তারের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। কথিত আছে আততায়ীর হাতে নিহত চাঁদ সুলতানার লাশ তার ওসিয়ত অনুযায়ী দাফন করা হয় ইরানের মাশহাদে বিশ্বনবী (সঃ)’র পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য হযরত ইমাম রেজা (আ)’র মাজার প্রাঙ্গনের কাছে।

১৪। সুলতানা রাজিয়াঃ
ভারতবর্ষের প্রথম নারী শাসক সুলতানা রাজিয়া। যুদ্ধক্ষেত্রে একজন দক্ষ সৈনিক হিসেবে তার ছিল সুখ্যাতি। সুলতানা রাজিয়া জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১২০৫ সালে। দৃপ্ত কঠিন ক্ষণজন্মা এই নারীর জীবন প্রদীপ নিভে গিয়েছিল ১২৪০ সালে। রাজকার্য পরিচালনার জন্য নামের আগে সুলতানা না হয়ে সুলতান হওয়াই হয়তো যুক্তিযুক্ত ছিল। সুলতানা রাজিয়ার বাবা শামস-উদ-দীন ইলতুিমশ ছিলেন দিল্লির সুলতান। ১২১০ সাল থেকে ১২৩৬ সাল পর্যন্ত সুলতানি আমলে ইলতুিমশ নিজেও একজন দক্ষ শাসকের খ্যাতি অর্জন করেন। বিভিন্ন অঞ্চলের বিক্ষোভ, বিদ্রোহ দমন করা ছিল তার কাজ। মৃত্যুর আগে নিজের উত্তরাধিকারী মনোনয়নের বিষয়ে সুলতান ইলতুিমশ চিন্তায় পড়ে যান। কারণ ইতিমধ্যে তার বড় ছেলে নাসিরুদ্দিন মাহমুদ মারা গেছেন। সুলতান নিজ সন্তানদের মধ্যে নাসিরুদ্দিনের ওপর বেশি ভরসা করতেন। বাকি যে দুই ছেলে আছেন তাদের কেউই সিংহাসনে বসার যোগ্য ছিলেন না। এমন অবস্থায় চিন্তায় পড়ে গেলেন সুলতান। এরই মধ্যে তার জ্যেষ্ঠ মেয়ে রাজিয়া বেশ বুদ্ধিমতী, চৌকস, প্রজাপ্রীতি ও যুদ্ধকৌশল শিখে গেছেন। তখন রাজ্য চালানোর দায়িত্ব মেয়ে সুলতানার ওপর দিয়ে নির্ভার হন। তার মৃত্যু নিয়ে বেশ কয়েকটি কথা রয়েছে। একটি পক্ষ দাবি করেছেন, ১২৪০ পলায়নকালে তার একজন ভৃত্য যে কিনা এই চক্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল, তাকে খাদ্যে বিষ দিয়ে হত্যা করে। এই ভৃত্যই তাকে আশ্রয় দিয়েছিল। আরেকটি পক্ষ দাবি করেছেন, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে ক্লান্ত আর ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাজিয়া এক কৃষকের বাড়িতে আশ্রয় নেন। খাওয়া-দাওয়ার পর তিনি ঘুমালে কৃষক তার শরীরে রাজকীয় পোশাক দেখতে পায়। পোষাকে প্রচুর রত্ন লাগানো ছিলো। কৃষক সহজেই বুঝে যায় তাঁর সামনে ঘুমিয়ে থাকা নারী সাধারণ কেউ নন। কৃষকটি ধন-সম্পদের লোভে পড়ে ঘুমন্ত রাজিয়াকে হত্যা করে এবং রত্ন নিয়ে পালিয়ে যায়।


খুবই পরিতাপের বিষয় এই যে, এখন যারা সমাজে আইডল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, তারা পাশ্চাত্যেরই সৃষ্টি যা ইসলামী মূল্যবােধ ও বিশ্বাসকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত করেছে। মর্ডানিজমের যাতাকলে মুসলিম সমাজও এ ধ্বংসযজ্ঞের ইন্ধন যােগাচ্ছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে পশ্চিমা জগতে নারী অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে যে প্রতিক্রিয়া সঞ্জাত চেতনা জাগ্রত হয়েছে তার ঢেউয়ে আধুনিক মুসলিম নারী সমাজও যেন তলিয়ে যাচ্ছে। আজ তারা তাদের অতীত ইতিহাস-ঐতিহ্য ভুলে গিয়ে যেন অপরাধীর কাঠ গড়ায় দাঁড়িয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে স্বস্তি অনুসন্ধান করছে। ব্যাপারটি এ রকম হওয়ার কথা ছিল না। যখন গোটা বিশ্বের নারী সমাজ ছিল পিছিয়ে, তখন ইসলাম নারী সমাজকে সামনে এগিয়ে দিয়েছিল, যার পরিণতিতে তারা জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছিল একটি বিশ্ববিজয়ী জাতি। এ থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় ইসলামের প্রথম যুগের সাহাবায়ে কেরামকে আইডল হিসেবে গ্রহণ করা। তা হলেই কেবল বিশ্বের সমগ্র মুসলমানদের জন্য ইসলামের পথে আরও অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে এক অনবদ্য প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে, ইনশাআল্লাহ।

নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
নিউজ চ্যানেল :-& ফেসবুক
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুন, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৩৩
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×