somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মানবাধিকার আন্দোলনের পথিকৃৎ সালমা সোবহানের ৮৩তম জন্মবার্ষিকীতে ফুলেল শুভেচ্ছা

১১ ই আগস্ট, ২০২০ রাত ৮:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বাংলাদেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার অগ্রদূত এবং তৎকালীন পাকিস্তানের প্রথম মহিলা ব্যারিস্টার সালমা সোবহান। বহু গুণে গুণান্বিত ছিলেন তিনি। ব্যারিস্টার, শিক্ষক, মানবাধিকারকর্মী, সমাজ সংস্কারক এমন অসংখ্য পরিচয়ের ভিড়ে তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় ছিল, তিনি একজন মানবহিতৈষী ব্যক্তি। মানবাধিকার, গণতন্ত্র, নারীমুক্তি ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করতে হয় তাঁর অবদানকে। চিন্তা- চেতনায় তিনি ছিলেন অত্যান্ত অসামপ্রদায়িক এবং অনুসরণযোগ্য একজন মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদে দীর্ঘ ১৯ বছর শিক্ষকতা এবং মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সালমা সোবহান এদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য যেমন কাজ করে গেছেন, তেমনি মানবাধিকারের আন্দোলনেও রেখে গেছেন গুরম্নত্বপূর্ণ ভূমিকা। ১৯৮৬ সালে আইন ও সালিশ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০০১ সাল পর্যনত্ম বিনা পারিশ্রমিকে তিনি পালন করে যান নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব। তিনি শুধু আমাদেরই পথপ্রদর্শক ছিলেন না, তিনি ছিলেন এ দেশের মানবাধিকার আন্দোলনের পথিকৃৎ এবং বিরল মানবিক গুণসম্পন্ন, অনুসরণযোগ্য একজন মানুষ। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার অগ্রযাত্রার উজ্জ্বল নত্র সালমা সোবহান শুধু একজন সমাজকর্মীই ছিলেন না, তিনি সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রেও অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেছেন। সব ধরনের সামপ্রদায়িকতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে, একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিচারের দাবিতে, ফতোয়ার বিরুদ্ধে তিনি সর্বদাই সোচ্চার ছিলেন। ব্যারিস্টার সালমা সোবহান শিশুদের অত্যন্ত ভালবাসতেন। তিনি শিশুদের সান্নিধ্যে থাকতে পছন্দ করতেন। দীর্ঘদিন তিনি আইন ও সালিশ কেন্দ্রে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করেছেন এবং অনেক সময় তিনি যা উপার্জন করেছেন, তা শিশুদের জন্যে ব্যয় করেছেন। আজ এই মহিয়সী নারীর ৮৩তম জন্মবার্ষিকী। ১৯৩৭ সালের আজকের দিনে জন্মগ্রহণ করেন মানবহিতৈষী সালমা সোবহান। মানবাধিকার আন্দোলনের পথিকৃৎ সালমা সোবহানের জন্মদিনে ফুলেল শুভেচ্ছা।


অসামপ্রদায়িক এবং অনুসরণযোগ্য মহিয়সী নারী সালমা সোবহান ১৯৩৭ সালের ১১ আগস্ট লন্ডনের একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর তাঁর বাবা মো. ইকরামুল্লাহ ছিলেন পাকিস্তানের প্রথম পররাষ্ট্র সচিব এবং মা শায়েস্তা ইকরামুল্লাহ ছিলেন পাকিস্তানের প্রথম মহিলা সংসদ সদস্যদের অন্যতম। তাঁর মা-বাবা দু'জনই রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর শ্বশুরও পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। উল্লেখ্য সালমা সোবহানের স্বামী বাংলাদেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক রেহমান সোবহান। ইংল্যান্ডের ওয়েস্টনবার্ট স্কুলে সালমা সোবহানের শিক্ষা জীবন শুরু। পরবর্তীতে ১৯৫৮ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে কেমব্রিজের গির্টন কলেজ থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন এবং ১৯৫৯ সালে লিংকন'স ইন থেকে বার এট ল' ডিগ্রী লাভ করেন। এরপরে ১৯৬২ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন।
বাংলাদেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার অগ্রদূত সালমা সোবহানের কর্মজীবন ছিল বর্ণাঢ্য। ১৯৫৬ সালে মাত্র একুশ বছর বয়সে পাকিস্তানের প্রথম নারী ব্যারিস্টার সালমা সোবহান পাকিস্তানের মেসার্স সারিজ অ্যান্ড বিচেনো ল' ফার্মে লিগ্যাল এসিস্ট্যান্ট হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন এবং একজন প্রখ্যাত আইনজীবী হিসেবে নিজেকে মেলে ধরতে সমর্থ হন। সেখানে কর্মরত ছিলেন ১৯৬১ সাল পর্যন্ত। ১৯৬২ সালে বাংলাদেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক রেহমান সোবহানের সাথে বিয়ে হওয়ার পর তিনি ঢাকা চলে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে শিক্ষকতা শুরু করেন। আইন বিভাগের একেবারে শুরুতে যেসব আইনবিদ শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, সালমা সোবহান তাদের অন্যতম। ১৯৬২ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১৯ বছর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে শিক্ষকতা করেন। ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ল' অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স (বিলিয়া)-র গবেষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন৷ মাঝে ১৯৮১ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত সুপ্রীমকোর্ট ল' রিপোর্টসের সম্পাদক ছিলেন সালমা সোবহান। মানবাধিকার ও বঞ্চিত নারীদের আইনি সহায়তা কিংবা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আইনের বিস্তার লাভে তিনি মানবাধিকারকর্মীদের জন্য রেখে গিয়েছেন উজ্জ্বল পথ নির্দেশনা। আইন শিক্ষাকে শুধু একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মাঝে সীমিত না রেখে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আইন শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে তিনি ব্র্যাক থেকে একটি প্যারালিগ্যাল প্রকল্প গ্রহণ করেন।


১৯৮৬ সালে তিনি এবং আরও ৮ জন মানবাধিকারকর্মীর সম্বিলিত প্রয়াসে গঠিত হয় মানবাধিকার সংগঠন 'আইন ও সালিশ কেন্দ্র' (আসক)। বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টসহ অসংখ্য মানবাধিকার ও পেশাজীবী সংগঠনের প্রতিষ্ঠা ও বিকাশে তিনি জড়িত ছিলেন প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে। [দরিদ্র, ছিন্নমূল ও শ্রমজীবী শিশুদের জন্যে আইন ও সালিশ কেন্দ্রে তিনি গড়ে তুলেছেন আশ্রয়কেন্দ্র। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে শ্রমজীবী শিশুরা হেসে খেলে সঙ্গীদের সাথে সময় কাটানোর সুযোগ পায়। সেখানে তারা গান গায়, ছবি আঁকে এবং অভিনয় করে নিজেদের প্রতিভার বিকাশ ঘটায়। কাজের ফাঁকে তিনি কয়েকটি গ্রন্থও রচনা করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলীঃ
১। Legal Status of Women in Bangladesh, BILIA (১৯৭৫)
২। Peasants Perception of Law, BRAC (১৯৮১)
৩। No Better Option Women Industrial Workers, (Co- authored), UPL (১৯৯৮)। এছাড়াও তিনি একটি উপন্যাস এবং তিনটি ছোট গল্প রচনা করেছিলেন। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা দিয়ে মানবাধিকার ও আইন গবেষণায় সালমা সোবহানের অবদান পরিমাপ করা যাবে না। একজন শিক্ষক, লেখক এবং মানকাধিকারকর্মী হিসেবে, বিশেষ করে নারীসমাজের অধিকার রক্ষায় তাঁর ভূমিকা দেশে ও দেশের বাইরে স্বীকৃতিলাভ করেছে। গবেষণার ক্ষেত্রেও উত্তর প্রজন্মকে দীক্ষিত করা এবং আজীবন তাদের দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করে যাওয়ার মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যাবে তাঁর প্রকৃত অবদান। সালমা সোবহান তাঁর কর্মময় জীবনে বিভিন্ন কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ বিভিন্ন সময় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সম্মাননা ও পদকে ভূষিত হয়েছেন। ২০০০ সালে অনন্যা শীর্ষ দশ পুরস্কার এবং ২০০১ সালে নিইয়র্ক থেকে হিউম্যান রাইটস অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন


বিদায় সব সময়ই কষ্টের, তারপরেও অশ্রুজলে সিক্ত হয়ে বিদায় জানাতে হয় প্রিয়জনকে।সমাজসেবী, জনদরদি অথচ ভীষণভাবে নিভৃতচারী মানুষ সালমা সোবহান ২০০৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর মধ্যরাতে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মাত্র ৬৬ বছর বয়সে তার পার্থিব জগতের বন্ধন ছিন্ন করে পাড়ি জমায় অজানা এক জগতের উদ্দেশে। ওই দিন তার শারীরিক মৃত্যু হলেও দেশের নারী অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান মানবাধিকার সংগঠনগুলো তথা সচেতন নাগরিক সমাজ স্মরণ করে যাবে যুগের পর যুগ ধরে। আজ এই মহিয়সী নারীর ৮৩তম জন্মবার্ষিকী। মানবাধিকার আন্দোলনের পথিকৃৎ সালমা সোবহানের জন্মদিনে ফুলেল শুভেচ্ছা।

নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
নিউজ চ্যানেল :-& ফেসবুক
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই আগস্ট, ২০২০ রাত ৮:৩০
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×