সমাজবদ্ধভাবে জীবনযাপন করতে গিয়ে নানা শ্রেণির নানা পেশার নানা মত ও পথের মানুষের মুখোমুখি হতে হয়। মুখোমুখি হতে হয় অমুসলিমদেরও। লেনদেন ওঠাবসা চলাফেরা সাহায্য-সহযোগিতা ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে একজন মুসলমান ও একজন অমুসলমানের সাক্ষাৎ হতে পারে। কোনো মুসলিমপ্রধান দেশে অমুসলিমদের বসবাস কিংবা কোনো অমুসলিমপ্রধান দেশে মুসলমানদের বসবাস এখন বিচিত্র কিছু নয়। অমুসলিম ব্যক্তি হতে পারে কোনো মুসলমানের প্রতিবেশী। কোনো অমুসলিম যদি পুরনো ধর্ম ছেড়ে ইসলামের শীতল ছায়ায় আশ্রয় নেয়, তাহলে তো আরও অনেক অমুসলিমের সাথে তার আত্মীয়তার সম্পর্কও থাকবে। তাই ইসলাম উদার নির্দেশনা অমুসলিমদের সাথে আচরণে ভদ্রতা ও সৌজন্য রক্ষা করা। যদি কারও কোনো প্রতিবেশী কিংবা কোনো আত্মীয় অমুসলিম হয়, ইসলামের নির্দেশনা হল- তার সাথেও প্রতিবেশী বা আত্মীয়ের হক রক্ষা করে চলতে হবে। প্রতিবেশী ও আত্মীয়ের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলার এই যে নির্দেশনা, তাতে মুসলিম-অমুসলিমের মাঝে কোনো পার্থক্য করা হয়নি। এমনটি বলা হয়নি- তোমার প্রতিবেশী কিংবা আত্মীয় যদি মুসলমান হয়, ধার্মিক হয়, ভালো মানুষ হয়, তাহলে তার সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলবে। বরং প্রতিবেশী ও আত্মীয় যেমনই হোক, মুসলমান হোক কিংবা না হোক, তার অধিকার অকাট্য ও অনস্বীকার্য। একজন মুসলমানকে এ অধিকার রক্ষা করেই জীবনযাপন করতে হবে। ইসলামী রাষ্ট্রে যে সকল অমুসলিম রাষ্ট্রীয় নিয়মকানুন মেনে বসবাস করবে, তারা সেখানে পূর্ণ নিরাপত্তার সাথে নিরাপদ জীবন যাপন করবে। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তারা তাদের নির্ধারিত সকল হক পাবে। সন্দেহ নেই, রাষ্ট্রের শান্তিশৃংখলা বজায় রাখার জন্যে এ বিধানের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। অমুসলিমদের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে সূরা মুমতাহিনার এই নির্দেশনাটি বিশেষভাবে উল্লেখ্যঃ যারা দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের বিরম্নদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে তোমাদের ঘর-বাড়ি থেকে বহিষ্কার করেনি, তাদের সঙ্গে সদাচরণ করতে ও তাদের প্রতি ইনসাফ করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না। নিশ্চয়ই আল্লাহ ইনসাফকারীদেরকে ভালোবাসেন। আল্লাহ তো তোমাদের তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেছেন, যারা দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের সাথে যুদ্ধ করেছে, তোমাদেরকে তোমাদের ঘর-বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে এবং তোমাদেরকে বের করার কাজে একে অন্যের সহযোগিতা করেছে। যারা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে তারা জালিম। -সূরা মুমতাহিনা : ৮-৯
পবিত্র কোরআনুর কারীমে বলা হয়েছে মানুষ আল্লাহ সৃষ্টিকুলের অন্যতম। তারা সবাই একই পদ্ধতিতে এবং একই নিয়মে জন্মগ্রহণ করে। প্রত্যেকটি শিশুর মর্যাদা মহান রবের কাছে সমান। তারা নিস্পাপ। বয়সে পরিপূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত তারা মহান আল্লাহর কাজে নির্ভেজাল ও নিস্কলুষ ও মাসুম মানুষ। সমাজ তাদের বিভিন্ন আদর্শে অনুপ্রাণীত করে। পিতা-মাতা ও পরিবেশ তাদের মুসলিম, খৃষ্টান, ইহুদী বা মূর্তিপূঁজক হিসেবে পরিচিত করে। তাদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন আকীদা ও বিশ্বাসের জন্ম দেয়। মানুষ বিভক্ত হয়ে পড়ে বিভিন্ন দলে উপদলে। ধর্মে বিধর্মে। মুসলিম অমুসলিমে। এটা হবেই। রোধ করা যাবে না। সৃষ্টির রহস্যেও মধ্যে এটি একটি অন্যতম । রহস্য আছে বলেইতো মহান আল্লাহ জান্নাত ও জাহান্নাম সৃষ্টি করেছেন। রহস্য আছে বলেই পৃথিবীতে আদর্শিক সংঘাত ও সংগ্রাম লেগে আছে এবং থাকবে। সেউ যদি মনে করে আমরা সবাই একই মতের অনুসারী হবো, তা হবে আকাশ কুশুম কল্পনা। তা একেবারেই অসম্ভব। এই বিরোধ থাকার পরও মানুষ হিসেবে সকলের মধ্যে একটি সাধারণ সম্পর্ক থাকা অপরিহার্য। তাদেরস মধ্যে সম্প্রিতি ও ভালোবাসা থাকা আবাশ্যক। যদি না থাকে পৃথিবী হবে অনাবাসযোগ্য। হানাহানি, মারামারি, বিদ্বেষে ভরে যাবে এ ধরা। জীবনের প্রতিটি মূহুর্ত হবে দূর্বিসহ। ইসলাম সার্বজনীন এক ধর্ম। বিশ্বজনীন তার চিন্তাধারা। কারণ, ইসলামের প্রবর্তক আল্লাহ। গোটা বিশ্ব তারই সৃস্টি। তার মমতা ও ভালবাসায় এ পৃথিবী টিকে আছে। তিনি এ পৃথিবীতে শান্তি চান। অশান্তির অবসান চান। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেনঃ “ তোমরা মানুষের সাথে ভালো কথা বলবে; সালাত কায়েম করবে ও যাকাত আদায় করবে।” রাসূল (সাঃ) মুসলিমদের নির্দেশ করেছেন যে, তারা যেন সকল মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীর প্রতিও সদয় আচরণ করে। সে কাছের হোক কিংবা দুরের হোক, মুসলিম হোক কিংবা কাফের হোক। রাসূল (সাঃ) এর বর্ণিত হাদিসে বিশ্ব মুসলিমের জন্য সুস্পষ্ট নির্দেশ হলো জাতি,ধর্ম, বর্ণ, ভিন্নমতাবলম্বী নির্বিশেষে সকলের সাথে দয়া, অনুকম্পা, ভালোবাসা ও বিনয়ী ব্যবহার করতে হবে। যা এ কাজটি করবেন আল্লাহর রাসূল তাদের দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেনঃ “যারা দুনিয়ায় মানুষকে কষ্ট দেয় আল্লাহ তাদের (দুনিয়া ও আখিরাতের জীবনে) শাস্তি প্রদান করবেন।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষের প্রতি ছিলেন উদার। ধর্ম-বর্ণ-জাতি-গোষ্ঠী বিচারে তিনি করো প্রতি জুলুম করেননি। কারো প্রতি অবিচার করেননি। এমনকি তাঁর উম্মতের সবার উদ্দেশ্যে এ মর্মে নির্দেশ দিয়েছেন, যেন কেউ কারো প্রতি জুলুম না করে; যেন সবার সঙ্গে উত্তম সদাচরণ করে। এসব কারণেই মহান আল্লাহ তাআলা হজরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে উত্তম চরিত্র দিয়ে মানবতার মুক্তির দূত করে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। আর ঘোষণা করেছেন- ‘আর (হে নবি!) নিশ্চয়ই আপনি সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী।’রাসুল (সঃ) অমুসলিমদের অধিকার রক্ষায় ঘোষণা করেছেন, কোনো মুসলিম যদি অমুসলিমের প্রতি অবিচার করে তবে বিচারের দিন অমুসলিমের পক্ষে অবস্থান নেবেন। হজরত সুফিয়ান ইবনে সালিম রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘জেনে রেখ! কোনো মুসলমান যদি অমুসলিম নাগরিকের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন করে, কোনো অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ করে, তার কোনো জিনিস বা সহায়-সম্পদ জোরপূর্বক কেড়ে নেয়; তবে কেয়ামতের দিন আল্লাহর বিচারের কাঠগড়ায় আমি তাদের বিপক্ষে অমুসলিমদের পক্ষে অবস্থান করব।’ (হাদিসঃ আবু দাউদ) উল্লেখিত হাদিস থেকে বুঝা যায়, কোনো অমুসলিমের প্রতি অন্যায়ভাবে অত্যাচার-নির্যাতন এমনকি খারাপ আচরণও করা যাবে না। কেননা দুনিয়া বুকে সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম ইসলাম। আর ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব হলো সবার সঙ্গে সর্বোত্তম আচরণ করা। এ কারণেই প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ মর্মে সতর্ক করেছেনঃ ‘তোমরা মজলুমের বদদোয়া থেকে বেঁচে থেক, যদিও সে কাফির হয়। কেননা কোনো মাজলুমের মাঝে আর আল্লাহর মাঝে পর্দা থাকে না।’ (মুনাদে আহামদ)
মানুষের মুক্ত জ্ঞান এবং পৃথিবীতে তার ইচ্ছার স্বাধীনতাই তাকে সমগ্র সৃষ্টির ওপর প্রভুত্ব দান করেছে। জ্ঞানশক্তির কারণে মানুষকে বলা হয়েছে আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব। মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেনঃ ‘অবশ্যই আমি আদম সন্তানদের সম্মানিত করেছি এবং তাদের পানিতে ও স্থলে প্রতিষ্ঠিত করেছি, তাদের উত্তম জীবনোপকরণ প্রদান করেছি এবং তাদের অনেক সৃষ্টির ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।’ (সুরা ইসরা : ৭০) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে সম্মান করেছেন।হোক সে মুসলিম কিংবা অমুসলিম, কাফির, ইয়াহুদি কিংবা খ্রিস্টান। কারণ সুন্দর আচরণও অনেক সময় দাওয়াতের ভূমিকা পালন করে। হজরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর এমন মহানুভব আচরণে মুগ্ধ হয়েও তো অনেকে ইসলাম কবুল করেছেন এবং পরবর্তীতেও সাহাবাদের যুগ থেকে শুরু করে যারা ইসলামের সুন্দর আচারগুলো নিজেদের মাঝে লালন করে গেছেন, তাদের আচরণ নীরবে অমুসলিমদের ইসলামের দিকে আহ্বান জানাতো। অমুসলিমরা এতে যথেষ্ট প্রভাবিত হতো। আশ্রয় নিতো ইসলামের শীতল ছায়ায়। একবার বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে দিয়ে এক ইয়াহুদির লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল আর এতে তিনি ওই লাশের সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে গেলেন। তখন হজরত জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! এটি তো ইয়াহুদির লাশ! তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া বলেছিলেন, সে কি মানুষ নয়?’ (বুখারি) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন বিশ্বমানবতার মুক্তি দূত। ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় তিনি কারো প্রতি কোনো ধরণের পক্ষপাত মূলক আচরণ করেননি। কারো সঙ্গে আপোষ করেননি। অন্যায়ভাবে কোনো মুসলিমের পক্ষ অবলম্বন করেনি। প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্যায়ভাবে অমুসলিমের জান ও মালের ওপর হস্তক্ষেপ করতে নিষেধ করেছেন। কারণ এর পরিণতি হবে জাহান্নাম। হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেছেন, ‘যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কোনো অমুসলিমকে হত্যা করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন।’ (মুসনাদে আহমাদ) বিশ্ব নবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ) মানুষ হিসেবে সবার প্রতি ছিলেন উদার ও উত্তম আচরণকারী। প্রতিবেশি যে-ই হোক অর্থাৎ মুসলিম কিংবা অমুসলিম তার অধিকারের ব্যাপারে তিনি ছিলেন সজাগ দৃষ্টিসম্পন্ন। সুতরাং মুসলিম উম্মাহর উচিত, বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ উদার নীতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া। ইসলামের সুমহান আদর্শগুলো গ্রহণ করা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ মানুষের সামনে তুলে ধরা। আর তাতে মুসলিম-অমুসলিম সব মানুষের কাছে পৌছে যাবে বিশ্বনবির সুমহান আদর্শ। তবে অমুসলিমদের সাথে সুন্দর ও সৌজন্যপূর্ণ আচরণ রক্ষার শিক্ষাপ্রদানের পাশাপাশি ইসলাম তাকিদের সাথে বারবার এ নির্দেশও দিয়েছে- ‘কোনো মুসলমান যেন কাফেরদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্র হণ না করে।’ এবং এ তাকিদও করেছে, সৌজন্য ও উদারতার নামে যেন নিজেদের দ্বীনদারি আক্রান্ত না হয়। দ্বীনের বিষয়ে আপোস করা কোনোক্রমেই বৈধ নয়। এমনিভাবে সদাচরণের ক্ষেত্রে কোনো অমুসলিমকে মুসলিম ভাই থেকে প্রাধান্য দেওয়াও বৈধ নয়। আমরা যদি অন্যের প্রতি দয়াশীল হই; তবে পরকালে আল্লাহ আমাদের সঙ্গেও অনুরূপ দয়াশীল আচরণ করবেন এবং আমাদের অস্থিরতা এবং সমস্যাসমূহ দূর করে দেবেন। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে অমুসলিমদের সঙ্গে আচার-আচরণে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দিকনির্দেশনা মেনে জীবন পরিচালনা করার তাওফিক দান করুন। হাদিসের ওপর যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
নিউজ চ্যানেল ফেসবুক
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জানুয়ারি, ২০২১ রাত ১০:০০