somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আগ্নেয়গিরি অথবা শীতলতা

১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ১২:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সুব্রতর প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ। সন্ধ্যা থেকে সে যেন জ্বলে যাচ্ছে। ভেতরটা তার পুড়ে সিগারেটের ছাইয়ের মতো হয়ে যাচ্ছে। তার শরীরের প্রতিটি শিরা উপশিরা রক্ত মাংশ সব যেন আগুনে পুড়ছে। সে নিজেকে চিন্তা করছে যেন কোন অগ্নিকুণ্ডের উপর দাঁড়িয়ে আছে। যেখান থেকে সরে আসার তার তীব্র ইচ্ছা, কিন্তু আসে পাশে কোন শীতলতা খুঁজে পাচ্ছে না।
সন্ধ্যায় যখন সে ওই আওয়াজটি শুনে তখন থেকেই সে জ্বলছে। প্রথমেই তার মনে হয়েছে বিজ্ঞানীদের কথা। তাঁরা কতো কিছু আবিষ্কার করে চলছে, কতো কিছুই এতদিনে আবিষ্কৃত হয়ে গেছে। মানুষ যদি অনেকদিন ধরে খুব উচ্চ আওয়াজের মধ্যে থাকে তবে শ্রবণ শক্তির ক্ষতি হয়, তিক্ত তীব্র কড়করে কর্কশ আওয়াজ মানুষের মেজাজ খিটখিটে করে দেয়। সে সন্ধ্যায় যে শব্দটা শুনেছে তা যে খুব কর্কশ বা তীক্ষ্ণ বা উচ্চ ভলিউমের তাও না। আওয়াজটি শুনেছে সে তার মুঠোফোনে। কিন্তু তার মেজাজ চরম রকমের উচ্চে পৌঁছে গেছে। সে কোন ভাবেই নিজেকে শান্ত করতে পারছে না।
সে তার মুঠোফোনটি রাখার পর বাথরুমে যায়, কল ছেড়ে তার নিচে দাঁড়িয়ে ছিল অনেকক্ষণ। তার মনে হয়েছে তার উপর পানির ধারা নয় অগ্নিগিরির লাভা বর্ষিত হচ্ছে।
বাথরুম থেকে বের হয়ে সে এক কাপ চা বানিয়েছে। যেটা তার গলায় প্রবেশ করার সাথে সাথে মনে হয়েছে তার গলায় কিছু তীব্র ঝাঁজালো তরল প্রবেশ করছে। তার ইচ্ছে করলো কাপটা ছুঁড়ে ফেলে দিক। কিন্তু সে কোন জায়গা পেলো না ছুঁড়ে ফেলার। সে চোখ ঘুড়িয়ে দেখলো সবই আগুনে জ্বলছে । তার বিছানা, টেবিল, আলমারি, বইয়ের রেক, সব সব জ্বলছে। সে ছুটে এসে তার বইয়ের রেকের কাছে। সে একটি বই তুলে নেয়। নিতেই তা হাত থেকে পরে যায়। তার মনে হয় তার হাতটি পুড়ে গেছে। সে কম্পিত হাতে আবার বইটি তুলে। সে তীব্র জ্বলন অনুভব করে তার হাতে। তার হাতে শরতের শ্রীকান্ত দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে। তার চোখের মণিতে সেই আগুনের রূপটি লাল সূর্যের মতো ফুটে উঠে।
সে আর সহ্য করতে পারছে না। সে বের হয়ে যায়। পকেট ঘেঁটে সিগারেট খুঁজে। পায় না। শূন্যতা পায়। সে একটা সিগারেট কিনে। যেটা জ্বালাতেই তার ঠোঁট পুড়ে যায়। সে সিগারেট ফেলে দেয়। পথের মধ্যে পড়ে থাকা জ্বলন্ত সিগারেট তাকে পীড়া দিতে থাকে। সে চাচ্ছে আবার সিগারেটটি তুলে নিক, বা অন্যটা ধরাক, কিন্তু সে ভয় পাচ্ছে। এবার হয়তো তার পুরো মুখটি পুড়ে যাবে। সে হাঁটতে থাকে। হঠাৎ দেখা হলো সোয়েব ভাইয়ের সাথে। সাথে তার সদ্য বিবাহিত বউ।
“ আরে শুভ যে, কই যাও? এমন হতভম্ব মনে হচ্ছে কেন?
“ কোথাও না। একটু ঘুরছি”
“ কি চিনতে পারছ? তোমার ভাবি। ওকে নিয়ে নাকি আমি বের হই না। তাই আজ তার ইচ্ছে পূরণ করলাম”
নতুন বউকে নিয়ে ঘুরার চেয়ে বাসায় থাকাই তো উত্তম। সোয়েব ভাই উত্তম কাজটিই করে যাচ্ছিলেন এতদিন। তার বউটি হয়তো এই উত্তম কাজটি আর সহ্য করতে পারছিলেন না।
“ হুম, চিনবো না কেন। ভাবি খুব সুন্দর”
সোয়েব ভাইয়ের বউ লজ্জা পেলো। মেরুন রঙের শাড়িতে তাকে লাল রক্ত বিন্দুর মনে হচ্ছে। লাল বিন্দুটি ঠিক মতো দাঁড়াতে পারছে না। কিছুটা বেঁকে বেঁকে যাচ্ছে। হঠাৎ সুব্রতর চোখ গেলো লাল রক্ত বিন্দুর গলার দিকে। সে সেখানে একটা গভীর কালচে দাগ দেখতে পায়। এবং সে আবার তার জ্বালাটা অনুভব করতে থাকে। তার নিজের একটি রক্ত বিন্দুর কথা মনে পড়ে। সেই রক্ত বিন্দুর গলায়ও সে এমন অনেক গভীর কালচে দাগ উপহার দিয়েছে। তার পা জ্বলতে থাকে। মনে হয় সে যেন ফুটন্ত পিচের উপর দাঁড়িয়ে আছে। সে আর এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। সে উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করে।
সে একবার পিছন ফিরে। সোয়েব ভাইয়ের বউটি এখন আরও বেঁকে আছে। হাঁটতে তার এখন আরো কষ্ট হচ্ছে।
সুব্রতর পা পুড়ে যেতে থাকে। সে হাঁটতে হাঁটতে সিধান্ত নেয়। সে আর জ্বলবে না। সে তার মেজাজ আর খারাপ হতে দিবে না। পৃথিবীর আর কোন আওয়াজ কোন শব্দ তাকে বিচলিত করবে না। যেমন সে সন্ধ্যায় হয়েছে তেমন আর কখনও হবে না। সন্ধ্যায় সে তাসমিনার সাথে কথা বলছিল। তাসমিনা যে মোবাইলে কথা বলছিল সেটা সেই তাকে দিয়েছিলো। মোবাইলটি কিনতে গিয়ে ছোট খাটো সঞ্চয় শেষ হয়ে গিয়েছে। এমনকি তাকে কয়েকদিন ধার করেও চলতে হয়েছিলো। নিজে এখন একটা ভাঙা চুরা মোবাইল ব্যবহার করছে। কিন্তু মনে একটা সুতীব্র শান্তি ছিল। তাসমিনা চেয়েছে আর সে দিতে পেরেছে, এই ভালো লাগাই তাকে ২ মাস বিস্ময়কর আনন্দে ডুবিয়ে রেখেছিল। তাসমিনা আগে যে মোবাইলটি ব্যবহার করতো সেটা ওকে দিয়েছিলো ওর এক বন্ধু। ঠিক বন্ধুও না। ছেলেটি তাকে ভালোবাসে। যদিও তাসমিনা বলেছে সে নাকি ওই ছেলেকে পছন্দ করে না। সুব্রত তাকে মোবাইল দিলে সে ওই সেট ওই ছেলেকে ফিরিয়ে দিবে। মোবাইল পাওয়ার এক সপ্তাহ পর বলেছে সে নাকি ফিরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু গতকাল কথা বলার সময় সে ওই মোবাইলের মেসেজ আসার রিংটোন শুনতে পায়। ২ মাস আগে যখন তার সাথে দেখা হয়েছিলো তখন তাসমিনার কাছে ওই সেট দেখেছে। সে জানে মেসেজ আসলে কি রিংটোন বাজে।
এতদিন সুব্রত তাসমিনার কথা বিশ্বাস করেছে। বিশ্বাস করেছে যে সে সেটটি ফেরত দিয়েছে। কিন্তু সন্ধ্যায় সে হতভম্ব হয়েছে। তার মুখ দিয়ে অনেকক্ষণ কোন কথা বের হয় নি। সে তাসমিনাকে জিজ্ঞেসও করেছিলো। কিন্তু তাসমিনা সম্পূর্ণ অস্বীকার করলো। কোন মেসেজই নাকি আসেই নাই। এটা বলার সাথে সাথে অপর পাশ থেকে আবার ওই মোবাইলে রিংটোন বেজে উঠে। সেই থেকে সুব্রত আর স্থির থাকতে পারে নি। সেই থেকে জ্বলে যাচ্ছে।
আর সে জ্বলবে না। আর সে তাসমিনাকে কল করবে না। কথা বলবে না। সে শান্তি চায়। প্রিয়তমা যদি প্রিয়তমকে সত্য বলতে না পারে, শ্রদ্ধা করতে না পারে তবে সেখানে জ্বলতেই হবে। কিন্তু সে আর জ্বলবে না। তাসমিনা কল করলে সে তাকে সরাসরি বলে দিবে যে , সে তাকে মিথ্যা বলেছে। আর মিথ্যাবাদীরা ভালোবাসতে জানে না।
বাসায় এসে সুব্রত বিছানায় গেলো । যদিও বিছানাটি তার কাছে জ্বলন্ত চিতার মতো মনে হলো। কিন্তু তারপরও সে চোখ বন্ধ করে ওই কথা গুলোই বিড়বিড় করতে থাকলো। “ তুমি মিথ্যা বলেছ, আর মিথ্যাবাদীরা ভালোবাসতে জানে না”
কিন্তু ঘুমাতে সে পারলো না। তার মুঠোফোনটি তাকে জানান দিলো যে, কেউ তার সাথে কথা বলতে চাইছে।
‘হ্যালো”
“ কি করো, ঘুমাই পরলে নাকি? এতো তাড়াতাড়ি?”
“ তুমি তো কখনও রাতে কল করো না। আজ হঠাৎ ?
“ তুমি তো আমাকে ভুলেই গেলে, আমাকে মনে পড়ে না?”
“ তুমিই তো বলেছ মিসকল না দিলে কল করতে পারবো না”
সুব্রত অপর পাশ থেকে আবারও সেই মোবাইলের রিংটোন শুনে। সাথে সাথে তার জ্বালাটা আবার ১০০ কোটি গুন বেড়ে যায়। তার বিছানা জ্বলতে থাকে, তার রুম জ্বলতে থাকে, তার চারতলা বিল্ডিঙটি জ্বলতে থাকে, তার বাসার সামনে গলিটি জ্বলতে থাকে, যেখানে কয়েকটি কুকুরও থাকে, তারাও থরথর করে জ্বলতে থাকে, তার এলাকাটি জ্বলতে থাকে, তার শহরটি জ্বলতে থাকে, পুরো মহাজগত জ্বলতে থাকে...পুড়তে থাকে
“ তাসমিনা, তুমি কি আমাকে মিস করো?
‘ আজব , এটা কেমন কথা, অবশ্যই মিস করি। মিস না করলে কথা বলবো কেন?
হঠাৎ করে সুব্রতর সব জ্বালা নিমিষেই শেষ হয়ে যায়। সে নরম কোমল এক শীতলতা অনুভব করে। সে মনে করে তার আশপাশ বরফ দিয়ে বেষ্টিত। তার মনেই থাকে না সে কিছুক্ষণ আগে তীব্র জ্বালা অনুভব করেছিলো। সে ভুলে যায় কিছুক্ষণ আগে সে একটি আগ্নেয়গিরিতে ছিলো.........
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×