বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে আমারঅভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর না।বরাবরই দেখি ওরা কেন যেন আমাকে ভয় পাই।একারণে আমার বোন আমাদের পাশের বাসার দুইটা বিচ্ছুকে ভয় দেখাতো আমাকে দিয়ে।ওরা আমার একটা নাম ও দিয়েছিল।ইস্টাম্বোরি ইস্টুভিস্টু । এর মানে কি কে জানে।অবশ্য যেহেতু আমি জীন ছিলাম ওদের কে কিছু যাদু দেখাতাম।সেটা হল ওদের পিঠে জোরে জোরে কিল দিয়ে লজেন্স এনে দিতাম।ব্যাপার টা নিশ্চয় ব্যাখ্যা করতে হবে না।লজেন্স আমার বোন পেছনে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত ,মাঝখান দিয়ে বিচ্ছু দুইটা শয়তানির সামান্য শাস্তি স্বরূপ কিল খেত।
যাই হোক,কলেজে যখন পড়ি আমার বাবা একদিন এক পিচ্চি নিয়ে হাজির।তাকে পড়াতে হবে।আমরা খুব বিরক্ত।তো আপুনি পড়াতো ইংলিশ,আমি ম্যাথ।আমার মনে আসে রোজা রেখে আমি পুরা ২ ঘন্টা চিতকার করেছিলাম।
কিন্তু তাকে আমি বোঝাতে পারিনি “৩ টা মুরগির দাম ৪৪ টাকা হলে ৬ টার দাম কিভাবে ৮৮ টাকা হয়”।
আমার ই ব্যর্থতা হবে হয়ত।পিচ্চি পড়ত ক্লাশ টু এ।আমার সাথে ওর চুক্তি ছিল ও আমাকে নাচ শেখাবে।ও টিচার হিসাবে আমার চেয়ে ভাল ছিল।অনেক চেষ্টা করেছিল কিন্তু হায় !!আমাকে নাচ শেখাতে পারে নি।
একদিন আমি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়াচ্ছি –ত্রিভুজ ৩ প্রকার-সমবাহু ,সমদ্বিবাহু,বিষম বাহু,ও হঠাত করে বলে-আন্টি মাহেদির কোন ডিজাইন্টা সুন্দর...
এই সকল তিক্ত অভজ্ঞতা্র কারণে ভার্সিটিতে এসে ঠিক করলাম একটা পিচ্চিকে পড়িয়েই দেখব কি হয়।পেয়েও গেলাম যখন বেশ কম বেতনে ই রাজি হলাম।দেখা যাক কি হয়।
ও যে আমাকে পছন্দ করেনি সেটা প্রথম দিন ই বুঝেছিলাম ।ও আমাকে তুমি করে বলত।কিন্তু আস্তে আস্তে ওর সাথে আমার বেশ ভাব হয়ে যায় ।মজার ব্যাপার হচ্ছে ও ২য় দিন ই আমাকে বলেছিল তোমার ছ উচ্চারনে সমস্যা আছে।ওর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতায় মুগ্ধ হয়েছিলাম।আরো অবাক হয়েছিলাম ও যখন বলেছিল তুমি টিপ পরতে খুব ভালোবাস না?
আমরা একসাথে ছবি আকতাম।হাত নেড়ে ,মাথা নাচিয়ে ,দুলে দুলে,তালি দিয়ে ছড়া পড়তাম। ও খুব মজা পেত।ও কে নামতা যখন ধরতাম এত দ্রুত বলতো যে ভুল হলে বোঝা যেত না...আমি কপট রাগ দেখিয়ে বলতাম-পুস্পিতা ,ধীরে বলো।ও বলতো দেখিয়ে দাও।আমি আস্তে আস্তে বলতাম এবং মাঝে মাঝেই আটকে যেতাম।ওর কি হাসি...ও আমাকে বলত তুমি ছোটো বেলায় অনেক ফাকিবাজ ছিলে...ঠিক মত নামতা পড় নাই ।ওকে আমি ডাকতাম বুদ্ধিমতী কংকাবতী।
ও বাচ্চা হিসাবে বেশ স্মার্ট ও ছিল।পহেলা বৈশাখে ম্যাচিং করে শাড়ি ,জুতা কিনেছিল,আবার বলে কিনা ম্যাচিং করে রেশমি চুড়ি কিনতে হবে ...বৈশাখে রেশমি চুড়ি পরার ই নাকি নিয়ম।
কিন্তু আমার আর একটা জিনিস আবিষ্কার করা বাকি ছিল।ও একদিন আমাকে বিষণ্ন গলায় বলেছিল জানো আমি অনেক একা ।আব্বু আম্মু থাকে না।অবশ্য এখন অভ্যাস হয়ে গেছে।আমি খুব অবাক হয়েছিলাম।খারাপ লেগেছিল তার থেকে বেশি।এত ছোট একটা বাচ্চা ...আসলেই তো ,ওর তো এই বয়সে একা থাকার কথা না।
এর পর থেকে ওকে একটু বেশি সময় দিতাম।ও মাঝে মাঝে আমার হাত ধরে বসে থাকত।আসতে দেবে না।বলতো তোমার হল তো রাত ১০ টায় বন্ধ হয়,৯ টায় যেও।ওর বাবা ওকে অনেক দামী একটা কম্পিউটার কিনে দিয়েছিলেন।আমি ওকে পড়ানো শেষ করে ওর সাথে গেম খেলতাম আর ছবি আকতাম,ওকে কম্পিউটার শেখানোর কারণে আংকেল আমার উপর খুব খেপেছিলেন,ওর সময় নষ্ট করি,এত ছোট বেলায় কম্পিউটার শেখা ঠিক না,(তাহলে কিনলেন কেন কে জানে? ),ইত্যাদি।আমি ও রাগ করে চলে আসি।ওর জন্য মন খারাপ লেগেছিল খুব।
আমি মাঝে মাঝে ভাবি...এই যে বাচ্চাটা একা থেকে বড় হচ্ছে এটা কি ঠিক হচ্ছে?ওর এই বাচ্চাকালের বাবা মার অভাবে যে শূণ্যতা সেটা কখনো পূরণ হবে না,আবার ভাবি ওর বাবা মা দুজন চাকরী না করলে ওকে এত ভাল স্কুলে পড়ানো ,কম্পিউটার,ভাল পরিবেশ এ থাকা সম্ভব হত না। নিজে কি করব কে জানে?হয়ত সব দিক সামলাতে পারব,কিংবা আরও একটা বাচ্চা এভাবে একা একা বড় হবে।সেই শূণ্যতার কথা কেউ জানবে না কখনো...।