somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভয়ের গল্পঃ হাসি

২৯ শে এপ্রিল, ২০১৫ রাত ১০:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অনেকদিন পর সাইকেল চালাতে গিয়ে বেশ মজা পাচ্ছিলাম। গ্রামের রাস্তা। ঝিঁঝিঁর একটানা ডাক শুনতে বেশ লাগছিলো। কিছুক্ষণ আগে এক পশলা ভারী বৃষ্টি হয়ে গেছে। তাতে প্রকৃতির স্নিগ্ধতা বেড়ে গেছে বহুগুণ। ফুরফুরে বাতাসে ভাসতে ভাসতে আমার গ্রামের বাড়িতে ফিরছিলাম।

এখানে বেড়াতে এসেছি দিন কয়েক হলো। বেকার মানুষ, কোথাও যেতে সঙ্কোচ হয়। চাকরি-বাকরি নিয়ে মানুষের সহস্র প্রশ্নে জেরবার হয়ে মাথা নিচু করে থাকতে হয়। বিকালে গিয়েছিলাম হাটে। টু্কিটাকি কিছু কাজ ছিলো। ইচ্ছা ছিলো সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসবো। কিন্তু বেরসিক অতিথির মতো বৃষ্টি এসে সব কিছু চৌপাট করে দিলো। চায়ের দোকানে বসে দেব-কোয়েলের একটা মারদাঙ্গা সিনেমার পুরোটা হজম করার পর বৃষ্টিদেবী সদয় হলেন। ততক্ষণে দশটা বেজে গেছে। আমিও ভেজা সাইকেল ন্যাকড়ায় মুছে রওনা দিলাম বাড়ির দিকে। বলে রাখা ভালো, আমার গ্রামে এখনো বিদ্যুৎ পৌঁছেনি। লোকজন তাই আটটা নাগাদ শুয়ে পড়ার অচল অভ্যেস বদলাতে পারেনি। পাকা রাস্তা শেষ হওয়ার সাথে সাথে আমার সাইকেল ও বৃষ্টি সংক্রান্ত রোমান্টিসিজম ন্যাতানো মুড়ির মতো মিইয়ে গেল। অন্ধকারে কাঁচা রাস্তায় সাইকেল চালানোটা রীতিমত শাস্তির পর্যায়ে পড়ে। আমি সেই শাস্তি ভোগ করতে করতে মাইলখানেক এগিয়ে গেলাম। দক্ষ স্ট্রাইকারের মতো খানাখন্দ এড়িয়ে দ্বিচক্রযানটি চালিয়ে ফিরছিলাম লক্ষ্যের দিকে। ভালোই চলছিল সবকিছু কিন্তু হুট করে কিছু একটায় হোঁচট খেয়ে আমি ও সাইকেল দু'জনেই ধরণীর আশ্রয় নিলাম। কাদা-পানিতে ভিজে আমার তখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা! তাড়াতাড়ি উঠে সাইকেলটা তুলে নিলাম। বলে রাখা ভালো রাস্তার এই অংশটা সবচেয়ে নির্জন। সামনে একটা বুড়ো পাকুড় গাছের অস্পষ্ট অবয়ব ছাড়া কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। না কোন মানুষজন, না কোন আলো। মড়ার উপর খাড়ার ঘা'র মতো আকাশে জমে থাকা বদখত কালো মেঘ কেমন যেন অপার্থিব আবহের সৃষ্টি করেছে। অশুভ কতগুলো চিন্তা মনের মধ্যে কিলবিল করে নিজেদের অস্তিত্ব জাহির করতে শুরু করলো।

সাইকেলটা তুলে নিতেই মনে হলো কিছু একটা গড়বড় আছে। আমি সাইকেলে বসে তারপর প্যাডেল দাবাতে অভ্যস্ত। সেটা করতে গিয়ে দেখি প্যাডেল ঘুরছে না। মেজাজ ততক্ষণে সপ্তমে উঠে গেছে। অগত্যা সিট থেকে নেমে মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট চালু করলাম। স্মার্ট ফোনের এই এক সুবিধা। যন্ত্র এক, ফায়দা অনেক। আলোটা সাইকেলের প্যাডেলে ধরতেই আমার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হওয়ার জোগাড় হলো। প্রচন্ড একটা ভয় আমার মেরুদন্ড বেয়ে সাপের মতো একেবেঁকে নেমে গেল। অবর্ণনীয় দৃশ্যটা এক কথায় ভয়াবহ। একটা শিশুর মাথা আমার সাইকেলের চাকার সাথে আটকে আছে। বাচ্চাটার গলা থেকে শরীরের নিচের অংশটুকু নেই। শুধু কিছু নাড়িভুঁড়ি চেইনের সাথে পেঁচিয়ে থেকে প্যাডেলটাকে অচল বানিয়ে ফেলেছে। প্রচন্ড শকে আমি নির্বাক হয়ে গেলাম। বোবায় ধরা মানুষের মতো আমার হাত-পা থরথর করে কাঁপতে লাগলো। শরীরের প্রতিটা কেশ পেরেকের মতো দাঁড়িয়ে গেছে ততক্ষণে।একটা মানব শিশুকে আমি খুন করে ফেলেছি! এ আমি কী করেছি! বাচ্চাটার নিষ্পাপ চাউনি আর্তনাদ হয়ে আমাকে বিক্ষত করতে লাগলো। আধবোজা চোখে বিস্ময় নিয়ে সে যেন আমাকে দেখছে আর যেন প্রশ্ন করছে কেন! ভয়ে, বিতৃষ্ণায় আমি ডুকরে কাঁদতে লাগলাম। এতো খুন! এই বাচ্চার বাবা-মাকে কী জবাব দেব আমি? আর পুলিশ? তারা তো আমাকে ছাড়বে না। হায় খোদা! একী বিপদে ফেললে আমাকে।

আমার চিন্তাশক্তি লোপ পেতে লাগলো। কী করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। শুধু মনের ভেতর কে একজন গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো, "পালাও, পালাও"। আমি রাস্তা থেকে লাফিয়ে পাশের ধানক্ষেতে নেমে গেলাম। সেখানে হাঁটু পর্যন্ত পানি। অন্য সময় হয়তো সাপের ভয়ে তটস্থ থাকতাম। কিন্তু আজকের এই বিপদের কাছে অন্যসব কিছু নস্যি। পানি ভেঙ্গে ছুটতে শুরু করলাম সর্বশক্তি দিয়ে। মনের ভেতরকার কন্ঠটি দ্বিগুণ উৎসাহে আমার দৌড়ে তাল দিতে লাগলো। আমাকে পালাতে হবে! এই খুন আমি করিনি। একটা অবোধ শিশুর হত্যাকারী আমি নই। ছুটতে ছুটতে আমার স্যান্ডেল দুটো কোথাও হারিয়ে ফেললাম। হাতের মোবাইল ফোন ছিটকে গেল জলের অতলে। হৃৎপিণ্ড লাফাতে লাফতে উঠে এল গলার কাছে। শ্বাস বন্ধ হয়ে হাঁপানি রোগীর মতো হাঁসফাঁস করতে লাগলাম কিন্তু দৌড় থামালাম না। এভাবে অনেকক্ষণ দৌড়ানোর পর শরীর প্রতারণা করলো। আমি জলের মধ্যে হোঁচট খেয়ে পড়লাম। নাকেমুখে পানির ঝাঁঝালো অনুভূতি নিয়ে উঠে দাঁড়াতেই আমার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার দশা হলো। আমার সামনে কাদা মাখামাখি হয়ে পড়ে আছে সেই সাইকেলটা। ভয় থেকে পালিয়ে আমি আবার ভয়ের উৎসে ফিরে এসেছি। আশেপাশে তাকিয়ে দেখি আলকাতরার মতো অন্ধকার চারপাশে ছেয়ে আছে। হতাশায় হাঁটু ভেঙ্গে ধানক্ষতেই বসে পড়লাম। এ কোন গোলকধাঁধায় আটকা পড়েছি আমি? চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করলেও বিন্দুমাত্র শব্দ করতে পারছিলাম না। নির্বাক বাদুড়ের মতো উলটোপথে যেন আমায় চালিত করছিলো নিয়তি। একটা ঘোরের মধ্যে চোরাবালির মতো তলিয়ে যাচ্ছিলাম। সম্বিত ফিরলো অস্ফুট একটা হাসির শব্দে। শিশুর মতো খিলখিলে হাসি। মাথা তুলে চারপাশে কাউকে দেখতে পেলাম না। মনের ভুল ভেবে উড়িয়ে দেয়ার প্রস্তুতি নিতেই অনেকগুলো হাসির রিনরিনে শব্দ শুনতে পেলাম। সাত সকালে রংপুর জিলা স্কুলের মাঠে স্বাস্থ্য সচেতন বুড়োদের এইভাবে হাসতে শুনেছি। হাসির উৎসের সন্ধানে মাথা তুলতেই দেখি হাসছে সাইকেলের চাকায় আটকে থাকা সে শিশুর মাথাটা। সামনের পাটির দুইটা দাঁত অন্ধকার চিরে মুক্তোর মতো ঝিকিয়ে উঠছে। কলের পুতুলের মতো হাঁ হয়ে গেল আমার মুখ। আকস্মিক বাতাসে দূরের পাকুড় গাছটা দুই টুকরা হয়ে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। ধুপ ধুপ করে বৃষ্টির মতো আকাশ থেকে কিছু একটা চারপাশে পড়তে লাগলো। টলটলে পুকুরে শত শত পাথর একসাথে ছুঁড়লে যেমন শব্দ হবে ঠিক তেমন শব্দ হচ্ছিলো । আকাশের দিকে তাকিয়ে যা দেখলাম তা জীবনেও ভুলবো না। অসংখ্য শিশুর কাটা মাথা শিলাবৃষ্টির মতো চারপাশে এসে পড়ছে। অজ্ঞাত মেঘ যেন বয়ে এনেছে প্রাগৈতিহাসিক কোন অভিশাপ। প্রচন্ড গতিতে রাস্তায় ধাক্কা খেয়ে ছিটকে যাচ্ছে শিশুদের রক্ত ও মগজ। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে খিলখিলে হাসির শব্দ। হাজার হাজার শিশুর কন্ঠে ছন্দোবদ্ধ হাসির আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো পুরো জায়গাটায়। আমি সহ্য না করতে পেরে নিজের কান চেপে ধরলাম। সাদা দাঁতের হাসি জোনাকির মতো অপার্থিব আলো সৃষ্টি করলো।

আমি অবাক বিস্ময়ে দেখলাম শত শত শিশুর মাথা ভেসে আসছে আমার দিকে।
১৭টি মন্তব্য ১৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্যবহারে বংশের পরিচয় নয় ব্যক্তিক পরিচয়।

লিখেছেন এম ডি মুসা, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৫

১ম ধাপঃ

দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে কত মানুষের সাথে দেখা হয়। মানুষের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য আসলেই লুকিয়ে রাখে। এভাবেই চলাফেরা করে। মানুষের আভিজাত্য বৈশিষ্ট্য তার বৈশিষ্ট্য। সময়ের সাথে সাথে কেউ কেউ সম্পূর্ণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ধুর বউ কে শাড়ি উপহার দিলেন ব্যারিস্টার সুমন। বাটার প্লাই এফেক্ট এর সুন্দর উদাহারন।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



এক দেশে ছিলো এক ছেলে। তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার। তার নাম ব্যারিস্টার সুমন। তিনি একজন সম্মানিত আইনসভার সদস্য। তিনি সরকার কতৃক কিছু শাড়ি পায়, তার জনগণের মাঝে বিলি করার জন্য।... ...বাকিটুকু পড়ুন

অধুনা পাল্টে যাওয়া গ্রাম বা মফঃস্বল আর ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া শহুরে মানুষ!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০০


দেশের দ্রব্যমুল্যের বাজারে আগুন। মধ্যবিত্তরা তো বটেই উচ্চবিত্তরা পর্যন্ত বাজারে গিয়ে আয়ের সাথে ব্যায়ের তাল মেলাতে হিমসিম খাচ্ছে- - একদিকে বাইরে সুর্য আগুনে উত্তাপ ছড়াচ্ছে অন্যদিকে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমুল্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

×