বইয়ের নাম: আলফা এক্স
লেখক: তন্ময় আহমেদ, সাকিব তানভির
প্রকাশনী: চিরকুট
প্রথম প্রকাশ: অমর একুশে বইমেলা, ফেব্রুয়ারি, ২০২০
মলাট মূল্য: তিনশত টাকা মাত্র
প্রচ্ছদ: সজল চৌধুরী
আঁতেলীয় আলোচনা...
আমাদের দেশে এই মুহূর্তে থ্রিলার সাহিত্য একটি শক্তি ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে গিয়েছে। বাতিঘর, আদী, রোদেলা, ভূমি, চিরকুট সহ সব প্রকাশনী সেজন্য সাধুবাদের দাবীদার। হরর কিংবা সুপারন্যাচারাল জনরা নিয়েও অসাধারণ কিছু কাজ হয়েছে। কিন্তু, স্পেকুলেটিভ ফিকশনের অন্য দুই ধারা যেনো এদেশের পাঠক মহলে কিছুটা অবহেলিত। একদিকে, ফ্যান্টাসি জনরাটার সৃষ্টিই যেনো হয়েছে ইউরোপিয়ান ধ্যান-ধারনা মাথায় রেখে। দুর্গ, নাইট, ড্রাগন, ফিনিক্স, ম্যাজিক ও অন্যান্য বিষগুলোর সাথে আমাদের দেশের পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দেয়াটা দুর্গম গিরি, কান্তার মরু পার হওয়ার চাইতে কম কষ্টকর হবে না। তবে, বেশ কয়েকজন তরুণ লেখক উঠে আসছেন যারা ফ্যান্টাসিকে কোর আইডিয়া হিসেবে রেখে নিজেদের মতন করে জনরাটাকে বাংলা সাহিত্যে জায়গা করে দিতে চাচ্ছেন। অন্যদিকে, সায়েন্স ফিকশন জনরাটার সমস্যা অন্য জায়গায়। সায়েন্স ফিকশনের অসংখ্য সাব জনরা আছে, অনেক রকম-সকম রয়েছে। আমাদের দেশে বই বিক্রির দিকে তাকালে এক মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের জন্যই যেনো আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, সায়েন্স ফিকশন জনরা হিসেব দারুণ ভিতের উপর দাঁড়িয়ে আছে। অথচ, প্রকৃত চিত্র ঠিক তার বিপরীত। একটা প্রধান কারণ হচ্ছে, সায়েন্স ফিকশন পাঠকদের জ্ঞান-গম্মিটা একটু বেশিই হওয়া লাগে। বিজ্ঞানের নানান তত্ত্ব, যা নিয়ে কাহিনী লেখা হয়েছে, তার কোনো রকম বর্ণনাই হয়তো বইয়ে দেয়া থাকবে না। ঐ পাঠক বিজ্ঞানের সেই তত্ত্ব, কিংবা সায়েন্স ফিকশনের সেই জনরার ব্যাপারে সম্যক অবগত না হলে পুরো বইটা, তা সে যতই দারুণ কাহিনীর, তুখোড় লেখনীর হোক না কেনো, অনুধাবন করতেই ব্যর্থ হবে। কাজেই, এই জনরাটা জাফর ইকবাল স্যার, কিছুটা মোশতাক স্যার, আসিফ মেহেদী ভাই ব্যতীত অন্যদের দ্বারা সুলিখিত হয়েও আপামর পাঠকদের কাছে আবেদন জাগাতে পারেনি। অথচ, বিভং-এর কাল্ট রেফারেন্স, ধ্বংসতারা-র সময় ভ্রমণ, প্রজাপতির কাহিনী সবগুলোই দারুণ ছিলো বললে কম বলা হবে। পলাতকের মতন দারুণ সাইফাই থ্রিলারের নামও আপামর পাঠকদের কাছে অপরিচিত। কাজেই, সবার আগে তন্ময় ও সাকিবকে ধন্যবাদ "দ্য রোড নট টেকেন" বেছে নেয়ার জন্য।
হ্যাঁ, আমাদের স্পেকুলেটিভ ফিকশনের নতুন জাগরণের প্রাক্কালে সায়েন্স ফিকশন নিয়ে যে অল্পবিস্তর কাজ হচ্ছে, সেখানে ট্রিলজির প্রথম বই হিসেবে চিরকুট থেকে বের হওয়া "আলফা এক্স" নিঃসন্দেহে অনন্য সহযোজন।
কি আছে ফ্ল্যাপে লেখা...
“তুমি কি? মানুষ নাকি রোবট?” প্রশ্নটার উত্তর খুঁজতে যেয়ে আজিমো নিজেকে আবিষ্কার করে এক গোলক ধাঁধায়। একটি নির্দিষ্ট অতীত পর্যন্ত স্মরণ করতে পারে সে, তার আগের সব স্মৃতি অন্ধকার!
তাই দ্বারস্থ হয় সে প্রখ্যাত সাইকিয়াট্রিস্ট, ডা. স্টিভ হেলমনের। কাউন্সেলিং চলতে থাকে... আচমকা এক সকালে জানতে পারে- আগের রাতে ডাঃ স্টিভ হেলমন খুন হয়েছেন!
তদন্তের ভার চাপে ডিটেকটিভ সাইরাস জিমের কাঁধে। কিছুদূর এগুতেই সামনে আসে... প্রোজেক্ট আলফা এক্স!
ফিঙ্গারপ্রিন্ট থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে খুনের দায়ে গ্রেফতার হন বিখ্যাত স্কলার, প্রোফেসর লুক্সবার্গ ইথান। কিন্তু বিপর্যয় শুরু হয় তখন যখন সাইরাস জিম জানতে পারে- খুন হওয়ার সময় প্রোফেসর লুক্সবার্গ ইথান অন্য এক সেক্টরের একটি সেমিনারে লেকচার দিচ্ছিলেন!
দৃশ্যপটে গুপ্ত-সংঘ ‘কোম্পানি’-এর দুজন এজেন্ট পরিস্থিতিকে করে তোলে আরও গোলমেলে। খুনকে কেন্দ্র করে রহস্য হতে থাকে ঘনীভূত।
অনিশ্চয়তায় পড়ে যায় সাইরাস জিম।
কে এই খুনি?
কি এই প্রোজেক্ট... আলফা এক্স?
যা পড়লাম...
পুরো বইটাকে ভাগ করা হয়েছে চারটি পর্বতে। শুরুর পর্ব প্রারম্ভিক বেশ কিছু দিনব্যাপী ঘটলেও, পরের তিনটি পর্ব মাত্র দুইটি দিনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। আছে অনেক ফ্ল্যাশব্যাক, দারুণ কিছু টার্ন ও টুইস্ট। তবে দুইদিনের হওয়াতে ঘটনার টানটা ফুটে উঠেছে লেখাতেও, এ যেনো এক রোলার কোস্টার রাইড।
বইয়ের প্রধান প্রোটাগনিস্ট, আজিমো। টার্মিস বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র। নির্বিকার ভাবে দীর্ঘদিনের বান্ধবী ইয়ারার প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে সে, নিরাবেগভাবে সহপাঠী ভিনেলের সাথে থিসিসের কাজ করে। কিন্তু ভিনেলের সাথে তার সম্পর্কটাকে কি নাম দেবে সে? বন্ধুত্ব? আচ্ছা, বন্ধুত্ব কাকে বলে? ইয়ারা যে বললো সেই ভালোবাসাই বা কি? নিজের মানবিক অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে ওঠে আজিমো। খোঁজ নিতে থাকে নিকট অতীতের ব্যাপারে। আর সুদূর অতীত, সে যেনো ধোঁয়াশায় ঢাকা। স্মৃতি ধোঁকা খেয়ে যায় সেখানে। মনে পরে না শৈশবের কথা, পিতামাতার স্নেহের কথা। মনের জট খুলতে তাই সময়ের সেরা মনোবিজ্ঞানী ডঃ স্টিভ হেলমনের দরজায় কড়া নাড়ে সে। তার দেখানো পথে নিজের স্বপ্নের গলিঘুঁপচি ঘুরে, ধ্যানের মাধ্যমে অতীতের সূত্র খুঁজে পাওয়ার আশা দেখছিলো আজিমো, কিন্তু তার আগেই খুন হয়ে গেলেন ডাঃ স্টিভ হেলমন। অপহৃত হলো আজিমো। মঞ্চে প্রবেশ করলো গুপ্ত-সংঘ "কোম্পানি।"
হোমিসাইডের ডাকসাইটে তদন্ত কর্মকর্তা সাইরাস জিম তদন্তে নামতে বাধ্য হলেন উপর মহলের চাপে। ঐদিকে কোম্পানির দুই এজেন্টও বসে নেই। ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া ডাঃ হেলমনের ল্যাপটপ ঘেঁটে একটা সূত্র খুঁজে পেলো জিম। প্রজেক্ট আলফা এক্স। তার খোঁজ নিতে গিয়েই, খুন হয়ে গেলো এক হ্যাকার। সিসিটিভির ফুটেজ দেখে গ্রেফতার করা হলো প্রফেসর লুক্সবার্গ ইথানকে। কিন্তু, তার ফিঙ্গারপ্রিন্ট আর ডিএনএ আংশিকভাবে মিলছে কেনো খুনির সাথে? এরকম ঘটনা কি আদৌ ঘটতে পারে?
সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটছে সবাই। কিন্তু, একই সাথে দুজায়গায় দুইজন প্রফেসর লুক্সবার্গের উপস্থিতি ধাঁধায় ফেলে দিলো সবাইকে? ঐ লোকটা কে যে দাবী করছে সে এসেছে অন্য এক পৃথিবী থেকে? আজিমোই বা কে? সেই কি এই রহস্য সমাধানের শেষ সূত্র? নাকি এ ছিলো রহস্যর কেবল শুরু?
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণা...
সায়েন্স ফিকশনের সাথে থ্রিলারের যে মিশ্রণটা দেয়া হয়েছে তাকে 'পারফেক্টো' বলা ছাড়া উপায় নেই। আছে খুন, সেই খুনের পেছনে ছোটা গোয়েন্দা, আছে গুপ্ত-সংঘ আর তাদের পাঠানো খুনিরা। এমনকি আছে মাল্টি-ইউনিভার্সের মধ্যে আর্থ ১ থেকে আগত আগন্তুকেরা যাদের একমাত্র উদ্দেশ্য বিশ্বযুদ্ধের প্রকোপে প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত আর্থ ১ কে বাঁচিয়ে তোলা।
সায়েন্স ফিকশনের অনেকগুলো বিষয়কেই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বইটির মধ্যে। আছে প্যারালাল ইউনিভার্সের ধারনা যা কার্যত অসীম। আছে সময় পরিভ্রমণের বর্ণনা। প্রথাগত পথে সময় পরিভ্রমণের বর্ণনা না দিয়ে এখানে যে নতুন বিষয়টা এনেছেন লেখকদ্বয় তা সবাইকেই ভাবাবে। আছে এস্ট্রাল প্রজেকশন ও ড্রিম ওয়াকিং-এর মিশেল। দিনশেষে ভয়ংকর সব যুদ্ধাস্ত্র দিয়ে লড়াই করলে আখেরে লাভ হবে একদল যুদ্ধ-বেনিয়াদের, সেটাও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এক পৃথিবী ধ্বংস হলে অন্য সব পৃথিবী প্রভাবিত হওয়ার ব্যাপারটা বেশ ভালো লেগেছে। আছে কয়েকটা বিধ্বংসী অস্ত্রের বর্ণনা, মাত্রা-ভেদ করে ভ্রমণ করতে সক্ষম মহাকাশযানের কথাও আছে। সেখানে দেয়া ওয়ার্ম-হোল আর ওয়েভলেংথের কথা সবাইকে অন্য এক প্রখ্যাত মাল্টিভার্সের কথা মনে করিয়ে দিতে পারে। আর আছে, প্রজেক্ট আলফা এক্স - বিবর্তনের পরবর্তী ধাপে মানুষের থেকে জন্ম নেয়া কিংবা জন্ম নেওয়া মেটা-হিউম্যান।
ট্রাই হার্ডার... (আছে স্পয়লার..!)
ব্যক্তিগতভাবে আমি বিশ্বাস করি, সায়েন্স ফিকশন কিংবা ফ্যান্টাসি যদি আমরা পাঠকপ্রিয় করতে চাই তবে আমাদের এই দুই বিশেষ জনরার টার্মিনোলজির দিকে একটু নজর দিতে হবে। ইংরেজি থেকে বাংলায় এসব টার্ম অনুবাদ করা কষ্ট ও সময়সাপেক্ষ হলেও সেই কাজটা আমাদের লেখকদের করে দেখাতে হবে। কাজেই বইয়ের বিভিন্ন জায়গায় যথেচ্ছ পরিমাণে ইংরেজি শব্দের প্রয়োগ আমাকে ব্যথিত করেছে। এর মধ্যে কয়েক জায়গায় ইংরেজি শব্দ ব্যবহারে লেখকেরা বাধ্য ছিলেন ধরে নিলেও অনেক জায়গায় লেখকরা চাইলেই সহজবোধ্য বাংলায় বিষয়গুলো উপস্থাপন করতে পারতেন।
ভূমিকাতেই লেখকেরা বলে দিয়েছেন যে মারভেল, ডিসি, হ্যারি পটার থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গা থেকে তারা অনুপ্রেরণা নিয়েছেন। বেশ কিছু কারুকাজ তারা করেছেন নামের মধ্যে। হোমেজ দিয়েছেন অনেককে। ডিসি-মার্ভেলের মাল্টিভার্স থিম আবার এক্স-ম্যানের বেশ কিছু বিষয় এডাপ্ট করা হয়েছে। তবে রহস্যর কেন্দ্রে কিছু ফাঁক রয়ে গিয়েছে। ইঞ্জিনের কোর খুঁজতে গিয়ে এত সহজেই সমাধান খুঁজে পাওয়া, গুপ্ত-সংঘের দুই এজেন্টের মধ্যে যোগাযোগের অভাব আর দুর্বল নির্দেশ দেওয়া, প্রজেক্টের এক সাবজেক্টের অসীম ক্ষমতার নির্দিষ্ট কারণের অভাব যেখানে দ্বিতীয় সাবজেক্টের ক্ষমতার প্রয়োগ অনেক বেশী নিখুঁত - ধন্দে ফেলে দেয়। এছাড়াও, একজন ভালো গোয়েন্দা সন্দেহজনক এক ব্যক্তির রীতিমত পাগলের প্রলাপ এতটা সহজে মেনে নেবে কিনা - সে নিয়েও সন্দেহ আছে।
সবশেষে...
সবার আগে একজন পাঠক হিসেবে আপনাকে মাথায় রাখতে হবে, এটি কোনো স্ট্যান্ড এলোন বই নয়। একটি ট্রিলজির প্রথম বই। বইয়ের শুরুতে ছাড়া কিছু আলগা সুতো যেভাবে শেষে গিয়ে মিলিয়েছেন লেখকরা তা তারিফে কাবিল। আবার অনেক অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে পাতায় পাতায় যার উত্তর হয়তো সিরিজের পরবর্তী বইগুলোতে পাওয়া যাবে। ব্যক্তিগতভাবে, সায়েন্স ফিকশন জনরায় এই বই দারুণ একটি কাজ হয়ে থাকলো। তবে আমার মতন আরো অনেকেই হয়তো অপেক্ষা করে থাকবে দেখার জন্য দিনশেষে বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি কি করে হয় দেখতে?
কাজেই পাঠক, তৈরি হয়ে যান ম্যালভার্সে করে আর্থ ৬৫ থেকে আর্থ ১-এ যাওয়ার জন্য? ওয়ার্ম-হোলে প্রবেশের আগে এই আমার শেষ পাঠানো বার্তা। ওভার এন্ড আউট।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মার্চ, ২০২০ বিকাল ৪:৩৭