রাশেদ মাথাটা দুই হাত দিয়ে ধরে ডাইনিং টেবিলে বসে ছিল। দুই মাস হল অফিসে বেতন হয় না। অন্য চাকরিও খুঁজে পাচ্ছে না। এক বছর আগে ধার-কর্য করে শুরু করা ব্যবসাটাও মুখ থুবড়ে পরেছে।
সুদখোরেরা হাতে হারিকেন নিয়ে খুঁজছে ওকে। বাসা ভাড়া বাকী দুই মাসের। দোকানে বাকী। ছেলের স্কুলের বেতন, বউয়ের হাতখরচ, নিজের চলা - ব্যাংকে তো একটা টাকাও নেই। "শেষে কি আত্মহত্যাই করতে হবে আমাকে?" নিজের মনে বলে উঠলো সে।
"সেটার দরকার হবে বলে মনে হয় না।" অচেনা একটা কণ্ঠস্বর শুনে চমকে সামনে তাকাল রাশেদ।
শোবার ঘরের দরজার সামনে সাদা টি শার্ট, আর নীলরঙা জিনস পড়ে একটা বিশ-পঁচিশ বছরের ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু, সেটা কিভাবে সম্ভব?! বাসায় ঢোকার দরজাটাতো রাশেদের পেছন দিকে। আর বিকেল থেকেই রাশেদ বাসায় একা। লাবণী বাপের বাড়ি গিয়েছে ঝগড়া করে। সেও বিছানায় শুয়ে হাজারো চিন্তায় ডুবে ছিল। একটু আগে উঠে চা বানিয়ে নিয়ে এসেছে। দুধ-চিনি নেই দেখে, শুধু রং চা নিয়েই বসে আছে। এই ছেলে সেখানে ভেতরের রুম থেকে...! কিভাবে! কি করে সম্ভব!
ছেলেটা মুচকি হেসে বলল, "এত কিছু ভেবে লাভ নেই। আমি সর্বত্র যেতে পারি, যেখানে ইচ্ছে হয়। সর্বশক্তিমান বলাটা ঠিক হবে না। তবে ক্ষমতা আমার কম নয়।" ছেলেটার চেহারা আর দশজন সাধারণ লোকের মতই। রাস্তায় দেখলে হুট করে নজর যায় না, আবার বাসায় এসে মনেও থাকে না - এমন। কিন্তু, চোখ! চোখ দুটো কেমন যেন। কোথাও একটা সমস্যা আছে!
"কে তুমি? আমার বাসায় ঢুকলে কিভাবে?"
"আহা! বললামই তো। আমি সব জায়গায় অবাধে যেতে পারি। এখানেও সেভাবেই আসা। তোমাকে এই ঝামেলা থেকে বাঁচাতেই আসলাম।"
"কোন ঝামেলা?"
"যেই ঝামেলার কারণে তুমি মাথায় হাত দিয়ে বসে বসে আত্মহত্যার কথা ভাবছিলে, সেই ঝামেলা। টাকা-পয়সা। ফু:। এটা আবার একটা বিষয় হল নাকি?"
রাশেদ কাষ্ঠহাসি হাসলো, "হ্যাঁ, ব্যাপার যে না তা তো বুঝতেই পারছি। তা তুমি কি আলাদীনের চেরাগের দৈত্য নাকি? কিন্তু, সেরকম কোন প্রদীপ কিনেছি বলে তো মনে পড়ছে না।"
"ভালো। রসিকতা করার ক্ষমতা এখনো আছে মানে মানুষটা তুমি টিকে যাবে। তো, এত রহস্যের কিছু নেই। একটু বুদ্ধিমান হলে, নিজে থেকেই বুঝে যেতে। আমি ইবলিস। দ্য ওয়ান এন্ড অনলি।"
রাশেদ হতভম্ব হয়ে বলল, "এই উদ্ভট কথাটা বিশ্বাস করতে বলছ আমাকে?"
"বলছি। কারণ গাঁজা-চরস-ভাং কিছু তো খাও নি। আর এখানে আমাকে কিভাবে সশরীরে বর্তমান দেখছ তা যুক্তি দিয়ে নিশ্চয়ই বুঝাতে পারবে না নিজেকে। কাজেই আমার কথাটা মেনে নিলেই ভালো করবে।"
রাশেদ চুপ করে রইলো। এক মুহূর্ত পরে বলল, "আমার সমস্যা আমি কোন না কোনভাবে সামলে নিব। তোমার কোন সাহায্য আমার লাগবে না।"
"ধুর। ওসব কিছু লাগবে না আমার। ওসব সিনেমা-বইয়ে সব ফালতু কথা লেখা থাকে। তোমার আত্মা-টাত্মা কিছু চাই না আমি।"
চমকে উঠলো রাশেদ। ঠিক এটাই ভাবছিল সে। তবে কি...
"হ্যাঁ, তোমার মনের কথা একটু আধটু আমি ঠিক বুঝতে পারি। তা না হলে আর ইবলিস হলাম কিসে।"
"তাহলে? কি চাই তোমার?"
"আমার কি চাই তার আগে শুনো তুমি কি পাবে; তোমার এখনের টাকা-পয়সার ঝামেলা আর থাকবে না। জীবনে কখনো অর্থ-চিন্তা আর করা লাগবে না তোমার। সেটাই তো চাচ্ছ, নাকি?"
"হ্যাঁ, কিন্তু তার বদলে আমাকে কি করতে হবে?"
"তেমন কিছুই না। আগেই তো বললাম তোমার আত্মা নিয়ে আমার কোন লাভ নেই। অমন বিশেষ কোন ব্যক্তি নও তুমি। তবে কিছু একটা তো চাই। আর সেই জিনিসটা হল তোমার জীবনের অন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস।"
"এত না প্যাঁচিয়ে বলে ফেললেই পারো।"
"একটা সম্পর্ক। তোমার জীবনের একটা সম্পর্ক আমার নিজের সম্পদ বানাতে চাই আমি। সেটা তোমার আর তোমার স্ত্রীর মধ্যেকার সম্পর্কটা, কিংবা তোমার সাথে তোমার ছেলের সম্পর্ক হতে পারে। তোমার মার সাথে, বোনের সাথে। এমনকি তোমার কোন কাছের বন্ধুর সাথে তোমার সম্পর্ক হলেও চলবে। এমন কেউ যে সব সময় তোমার পাশে ছিল, যে তোমাকে খারাপ সময়ে চলার সাহস জুগিয়েছে। তার সাথে তোমার সম্পর্কটা তুমি আমার হাতে তুলে দেবে। আমার কথাটা বুঝতে পারছো?"
"বুঝেছি। কিন্তু সম্পর্ক... মানে এমন একটা জিনিস দিয়ে তোমার কি লাভ?"
"আমার লাভটা আমাকেই বুঝতে দাও। তোমাকে বললেও তুমি ঠিক বুঝবে বলে মনে হয় না। তাও বলি, শোনো। মানুষের কাছে সম্পর্কের মূল্য কিন্তু অনেক। তার উপর সেটা যদি আবার হয় এমন কোন বিশেষ সম্পর্ক যা একজনের জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত তাহলে তো কথাই নেই। এরকম সম্পর্কের মধ্যে অনেক শক্তি লুকিয়ে থাকে। এই পৃথিবীতে সেই শক্তির তেমন কোন মূল্য নেই, কিন্তু অন্যত্র, অন্য কোন পৃথিবীতে; অন্ধকার মাত্রায় সেই সম্পর্কে সুপ্ত হয়ে থাকা শক্তির মূল্য আর ক্ষমতা - দুইই অসীম। এসব তোমার বুঝে লাভ নেই। তবে জিনিসটা আমার কাছে দামী ও জরুরী।"
রাশেদ এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে কি যেন ভেবে নিলো, "ঠিক আছে। সেক্ষেত্রে আমি আমার এক বন্ধুর সাথের সম্পর্কটা তোমাকে দিয়ে দিলাম। তুমি আবার ওকে মেরে-টেরে ফেলবে নাকি?"
ইবলিশ বিরক্ত গলায় বলল, "এতো যে প্যান প্যান করলাম, কিছুই কানে যায় নি নাকি তোমার? ওকে মেরে আমার লাভটা কি? আমি চাই তোমাদের মধ্যেকার সম্পর্কটাকে। মানুষের প্রতি আমার কোন লোভ নেই। মানুষের জীবন খুব সস্তা জিনিস।"
"ঠিক আছে," মনস্থির করে নিলো রাশেদ। "আমি রাহাদের সাথে আমার যেই বন্ধুত্ব আছে সেই সম্পর্ক তোমাকে দিয়ে দিলাম। সেই স্কুল থেকেই ও আমার বন্ধু, একই এলাকাতে থাকতাম। একই কলেজ, ভার্সিটিতে পড়েছি; এখন একই জায়গাতে চাকরি করছি। ওর সাথে অনেক সুন্দর সব স্মৃতি আছে আমার। আমার খারাপ সময়ে সবসময় ওকে কাছে পেয়েছি। কাজেই বন্ধুত্বটা অনেক দামী আমার কাছে। তোমার কাজে দেবে মনে হয়।"
ইবলিশের চেহারাটা আস্তে আস্তে বদলে গিয়ে রাহাদের চেহারায় রূপ নিলো, "এই বন্ধুর কথাই বলছ নিশ্চয়ই।"
রাশেদ চুপ করে রইলো। রাহাদের চেহারার ইবলিশকে দেখে ওর অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছে।
"ঠিক আছে। তাহলে মালিকানার বদলটা হয়ে যাক। তুমি ওর পুরো নাম বল, আর তারপর তোমার সামনের ঐ বইটাতে তোমার বুড়ো আঙ্গুলের ছাপটা দাও।"
রাশেদের সামনে শূন্য থেকে একটা পুরনো দেখতে বই উদয় হয়েছে। সেখানে একটা পাতায় অদ্ভুত কোন ভাষায় অনেক কিছু লেখা। কিন্তু কোথায় বুড়ো আঙ্গুলের ছাপ দিতে হবে সেটা স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছিল। কারণ সেখানে একটা ক্রস চিহ্ন দেয়া। রাশেদ রাহাদের পুরো নাম বলতে বলতে নিজের বুড়ো আঙ্গুল সেখানে রাখলো।
"বাহ। দারুণ। তাহলে আমি চললাম। অনেক কাজ বাকী। টাকা-পয়সার সমস্যা নিয়ে তোমার আর ভাবা লাগবে না। সেটার চিন্তা এখন থেকে আমার। দেখা হবে, অন্য জীবনে," আর সেই সাথে ভোজবাজীর মতন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল ইবলিশ নামে পরিচয় দেয়া ছেলেটা।
হ্যাঁ, এই কথা ঠিক যে টাকার চিন্তা আর কখনো করতে হয় নি রাশেদের। তবে তার বদলে অনেক কিছুই ঘটলো। যেই রাহাদের সাথে তার বন্ধুত্বটা ছিল মানিক-রতনের মতন সেটাই আদায়-কাঁচকলায় পালটে গেল। একই অফিসে কাজ করার দরুন রাহাদ ক্রমাগত বসের কান ভড়কাতে লাগলো রাশেদের নামে, চাকরিটা চলে গেলো সেকারণে চার মাসের মধ্যেই। যদিও আরেকটা চাকরি, আরও ভালো বেতনে পেতে তেমন একটা বেগ পেতে হলো না রাশেদের। কিন্তু, ওর নামে নানান সত্য-মিথ্যা বানিয়ে বানিয়ে বলে রাহাদ এক পর্যায়ে ওকে একরকম অনাহূতই করে তুলল বন্ধু মহলে। লাবণীদের পরিবারের সাথেও রাহাদের সুসম্পর্ক ছিল আর সেটার ফায়দাও সে কড়ায়-গণ্ডায় তুলল। লাবণীর পরিবার আর লাবণীর কাছে তার নামে এমন সব কথা শোনানো হতে থাকলো যে এক পর্যায়ে ডিভোর্স ছাড়া গতি থাকলো না কোন। বন্ধুত্ব যে এমন কর্কশ, তিক্ত, ভয়ংকর শত্রুতায় রূপান্তরিত হতে পারে তা কল্পনাতেও ছিল না রাশেদের। শত চেষ্টাতেও এর কোনটাই ঘটতে থাকা থেকে থামাতে পারলো না সে। এক অদ্ভুত আক্রোশে রাহাদ যেন তার সাজানো জীবনটা তছনছ করে দিল।
অনেক অনেক বছর পর যখন কোটিপতি রাশেদুর রহমানের লাশ একা একা পচছিল তার আঠারো কোটি টাকা দামের ডুপ্লেক্স বাড়ির স্টাডিতে, পাশেই দাঁড়িয়ে রাশেদের অতৃপ্ত আত্মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবছিল, ইবলিসের সাথে লেনদেনে ভীষণ ক্ষতি হয়ে গিয়েছে তার।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে আগস্ট, ২০২০ বিকাল ৩:০৬