somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বড় গল্পঃ রাজা - ০১

০৬ ই মার্চ, ২০২১ সকাল ১১:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রাজার সাথে আমার প্রথম দেখা ক্লাস সিক্সে, সালের হিসাবে সেটা ২০০২। এর আগ পর্যন্ত আমাদের গ্রাম রসুলপুরে প্রাইমারি স্কুলেই পড়তাম আমি। ছাত্র হিসাবে গড়পড়তা ছিলাম, কিন্তু গ্রামের আর দশটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মত অনেক বড় স্বপ্ন দেখা হতো আমাকে নিয়ে। পরিবারের বড় ছেলে বলে কথা! কাজেই ক্লাস সিক্সে আমাকে ভর্তি করানো হলো, নবীগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে। একেবারে জেলা সদরের স্কুল, আমাদের গ্রামের স্কুলের তুলনায় বিশাল বড় আয়তনে। ছোট মামা নিয়ে এসেছেন আমাকে সাথে করে প্রথমদিন। সদরের দূরত্ব গ্রাম থেকে খুব একটা কম না, মুড়ির টিন বাসে করে আসতে আধা ঘণ্টার উপরে লাগে। কালকে থেকে অবশ্য গ্রামের আরও ছেলেদের সাথে, দলবেঁধেই আসা হবে। প্রথম দিন দেখে এই বিশেষ ব্যবস্থা। ভর্তি আগেই হয়ে গিয়েছিল, আব্বার সাথে হেডমাস্টার স্যারের খুব ভালো সম্পর্ক বিধায় ছোট মামা কুশল বিনিময় করতে ভেতরে গিয়েছেন আর আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাইরের মাঠটা দেখছি। মনে হচ্ছে শয়ে শয়ে ছেলেরা সব খেলতে নেমেছে। হঠাৎ কেউ একজন কাঁধে জোরে চাপড় দেয়ায় একটা লাফ মেরে উঠে পিছনে তাকালাম। লম্বায় আমার চাইতে বিঘত-খানেক খাটো একটা ছেলে, গায়ের রঙ ময়লা, মাথা-ভর্তি কোঁকড়ানো চুল নিয়ে কেমন অদ্ভুত ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। "এই, তোর নাম কি রে?"
আমি কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিলাম, বলতে লজ্জা নেই, ছিলাম তো গ্রামেরই ছেলে, কোনোমতে জবাব দিলাম, "আমার নাম আজাদ।"
"নতুন ভর্তি হইসোস নাকি সিক্সে? কোন স্কুল থাইকা?"
আমি দেখলাম পিছনের দরজা দিয়ে মামা বের হয়ে আসছেন, আমার চোখের দৃষ্টি দেখে ছেলেটাও পিছনে তাকিয়ে দেখলো, এরপর একটু সামনে এগিয়ে আমাকে কেমন ফিসফিস করে বলল, "ফুটবল খেলবি? তাইলে টিফিনের সময় মাঠের উত্তর কোনায় চইলা আসিস। ঠিক আছে। আমার নাম রাজা, কাউরে জিগাইলেই দেখাইয়া দিবো।" এই কথার কোনও উত্তরের অপেক্ষা না করেই কেমন হনহন করে হেঁটে চলে গেলো।
ক্লাসে বসে বসে আমি এই অদ্ভুত নিমন্ত্রণ নিয়েই ভাবছিলাম, ক্লাসে বসেছি শোভনের সাথে। আমাদের স্কুলের থার্ড বয় ছিল, সিরিয়াস ধরনের ছাত্র আর আমার জানি দোস্ত যারে বলে। তবে ওকে খেলার কথা বলে লাভ নেই, তাই টিফিনের ঘনটা পড়াতে আমি স্কুলের দেয়া পাউরুটি আর সিদ্ধ ডিম হাতে নিয়ে খেতে খেতে মাঠের ভেতর দিয়ে আড়াআড়ি হাঁটা দিলাম। ফুটবল আমি জীবনে খেলি নি, আসলে যে কোনও খেলাতেই আমার ভীষণ অনীহা। কখনো সখনো খেললে ক্রিকেট খেলা হয়েছে। সেখানে হঠাৎ করে আমাকে ফুটবল খেলতে এভাবে ডাক দেয়া হলো কেনও সেটাও মাথায় আসছিলো না। এটা তো নিশ্চিত ছেলেটা আমাদের ক্লাসে পড়ে না, তাহলে ক্লাসেই দেখা হতো। মাঠের একটা কোনায় বেশ একটা জটলা দেখেই আমার মনে হচ্ছিল ওখানেই ফুটবল খেলাটা হচ্ছে বা হবে। কাছে যেতেই নিশ্চিত হলাম, কারণ ছেলেদের জমায়েত ভেদ করে একজনের গলার আওয়াজ ভেসে আসছে, আর সেটা বেশ পরিচিত। "মানুষ বেশি হইলে সমস্যা কি, মাঠ তো আর ছোটো না, দুই দলে ভাগ হইয়া খেললেই হইলো তাতে একেক দলে বিশজন কইরা পড়লে সমস্যা কি?"
ঐদিক থেকে একটা মিনমিনে প্রতিবাদ শুরু হতেই সেটাকে আবার চাপিয়ে দেয়া হলো, "এইটা তো আর ক্রিকেট না যে একদল ব্যাটিং কইরা যাইবো, আরেকদল হুদা ফিল্ডিং। আধা ঘণ্টায় সবাই আরাম কইরা খেলোন যাইবো। ঠিক কি না?"
এবার প্রতিবাদটা আরও মিইয়ে যাওয়ায় তেমন একটা কিছু শোনা গেলো না। রাজা আরেকজনকে বিপক্ষ দলের ক্যাপ্টেন বানিয়ে দল ভাগ করে নিতে শুরু করলো, হঠাৎই ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা আমাকে দেখে হাত তুলে দেখিয়ে বলল, "ঐ যে ঐ লম্বুটা আমার।" আরেকটু হলে গলায় ডিম আটকে মারা যাওয়ার দশা হলো, এসেছিলাম খেলা দেখতে আর স্কুলের প্রথমদিন নতুন একটা ছেলের সাথে পরিচিত হতে সেখানে এভাবে দলে নেয়া হবে আমাকে সেটা ঘুণাক্ষরেও ভাবি নি।
একটু পরেই অবশ্য বুঝতে পারলাম এটা বেশ ভেবেচিন্তে নেয়া সিদ্ধান্ত, কারণ রাজা আমাকে ডেকে বলল, "তুই আগে কখনো ফুটবল খেলসোস?" আমি একটু রাগের সুরে বললাম, "না, খেলি নাই। সেইটা জানাইতেই তো আসছিলাম, কিন্তু তার আগেই..." "আইচ্ছা, কোনও সমস্যা নাই। তুই আমাদের গোলি, মানে গোলকিপার। একদম সহজ কাজ, ঐ যে ঐটা হইলো গোলপোস্ট। ঐটার ভিতরে যাতে বলটা না ঢুকতে পারে। ঢুকলে কইলাম পিছনের জংলা থাইকা বিছুটি পাতা আইন্না ঘইষ্যা দিমু গায়ে।" নিজের সিদ্ধান্ত যে কতটা ভুল ছিল সেটা ভেবে মনে মনে শঙ্কিত হয়ে উঠলাম। অবশ্য রাজাই তা দূর করলো, "মজা করলাম। ডরাইস না। খেলবি নিজের মনের খুশিতে, ঠিক আসে, কারণ জিতমু আমরাই। যা, গিয়া দাঁড়া পোস্টে।"
টিভির পর্দায় দেখা ফুটবল খেলা আর স্কুলের মাঠে চল্লিশ জন মিলে একটা বল দখলের কুস্তির মধ্যে অনেক ফারাক। কিন্তু খেলা শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝা গেলো, আমাদের দলটা বেশ গুছিয়ে খেলছে। বল যেখানে, সেখানে সবাই গিয়ে হুটোপুটি করলেও প্রতিবার সেই ছেলের দল থেকে একটা ছেলেই বলটা পায়ে নিয়ে তীরের বেগে ছিটকে বেরিয়ে আসছে- রাজা।
(হয়তো চলবে, না চললে মাফ কইরা দিয়েন...)
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মার্চ, ২০২১ সকাল ১১:৩৭
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×