somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

অজ্ঞ বালক
আমি আসলে একজন ভীষণ খারাপ মানুষ। তবে ভালো মানুষের মুখোশ পড়ে দুর্দান্ত অভিনয় করতে পারি বলে কেউ কিছু বুঝতে পারে না। সে হিসাবে আমি একজন তুখোড় অভিনেতাও বটে!!!

সে এক বিশাল ইতিহাসঃ শতরঞ্জ কা খিলাড়ি!

২৭ শে জুলাই, ২০২১ সকাল ১০:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বয়স কত হবে তখন? খুব সম্ভবত ৮ কিংবা ৯। নানাবাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম। ক্যারামবোর্ডের ঠকঠকানিতে বিরক্ত সকলের অভিযোগের প্রেক্ষিতে কাঠের সেই তক্তা তুলে রেখে এক অলস দুপুরে বড় মামা আমাকে সাদা-কালো চৌষট্টি ঘরের কারিকরি প্রথম শিখিয়েছিলেন।



নতুন শেখা খেলা কি আর আত্মস্থ করা যায় অত দ্রুত? তাই হেরে একশা হলাম। বাসায় ফিরে তাই বরাবরের মতন আপুর কাছে প্রথম জিজ্ঞাসা করলাম, যেমনটা একসময় করতাম, "তুমি দাবা খেলা পারো? পারলে আমাকে শেখাও।" আমার মতন আপুও মাস্টার অফ অল, জ্যাক অফ নান ধরনের মানুষ। সে আমাকে ঠিকই বেসিকটা আরও ভালো করে শিখিয়ে দিলো। বাকিটা নিজের মাথার জোরে আর কিছুটা আমার বড়ো নানার ছেলে, মানে আমার আরেক মামা যে কি না প্রায় আমার সমবয়সী, তার সাথে খেলে আত্মস্থ করলাম। ফলাফল পরের বছরান্তে যখন নানাবাড়ি গেলাম সেবার খেলায় হার-জিতের পাল্লা প্রায় সমান-সমান থাকলো।

এর পর এক বিশাল বিরতি। বুঝতে হবে তখন আমার বয়স মাত্র ১০। ক্লাস ফোরে পড়ি মে বি। আমার সমবয়সীরা তখনও এই খেলা শিখে উঠে নি বা শিখলেও এই বুড়োদের মতন ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে খেলার পেছনে দেয়ার মতন সময় বা সদিচ্ছা কোনোটাই তাদের নেই। তাই, বোর্ড আর রাজা-রানীরা গেলো অবসরে। তাদের অবসর ভাঙল যখন আমি কলেজের প্রথম বর্ষে উঠলাম।

এর মধ্যে যে খেলা হয় নি তা না। আমার পরিবারের মধ্যে তখন দাবাতে আমিই একচ্ছত্র অধিপতি। তবে স্কুলের কম্পিটিশনে থার্ড হয়ে বুঝলাম যে শেখার অনেক কিছুই আছে বাকি। তবে সেদিকে মনোযোগ দেয়ার অবসর কই? একটু হলে তো মেট্রিকেই পা ফসকানোর দশা হবে। সেই দুর্দশা ঘোচাতে যেই পরিমাণ শ্রম, মেধা এবং সময় ব্যয় করতে হলো তাতেই সময় চলে গেলো বছর দুয়েক। এরপর রেজাল্ট, বন্যার মধ্যে ভর্তি সব মিলিয়ে একটু সুস্থির হয়ে বসলাম কলেজে।

আহ! স্বাধীনতা!!! আমার মতন সর্বদাই ঘরে বন্দী হয়ে থাকা কারও কাছে এমন স্বাধীনতা পাওয়া মানেই তার অপব্যবহার। ব্যতিক্রম হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কাজেই বন্ধুদের সাথে কলেজ পালিয়ে ঘুরাঘুরি শুরু। লাইব্রেরিতে যাওয়ার পাশাপাশি নীলক্ষেত, পল্টন চষে বেড়ানো। এভাবেই একদিন হাতে চলে আসলো দ্য ওয়ান এন্ড অনলি, দ্য গ্রেট ববি ফিশারের লেখা দাবার বই, 'ববি ফিশার টিচেস চেজ।' অসংখ্য দাবার পাজল দিয়ে সাজানো এক বই। তখনও ইংরেজি বই পড়ায় আমি শিশু। মাথার ঘাম পায়ে নামলো পড়তে গিয়ে আর তাতেই আমার সুপ্ত হয়ে থাকা দাবার আগুন চড়চড় করে আবার জ্বলে উঠলো। লোহার ট্রাঙ্কের গাঢ় অন্ধকারে ডুবে থাকা দাবার বোর্ড আর গুটিরা বেরিয়ে আসলো আলোতে। তবে আমার জন্য বইটা তখনও দুর্বোধ্য। কয়েকদিন পল্টন, নীলক্ষেত ঘুরে যে বইগুলো পেলাম দাবার উপর তা আমার মতন নবিস খেলোয়াড়ের জন্যও একেবারেই অখাদ্য। এই অবস্থায় একদিন, নিউমার্কেটের এক দোকানে, দেখা পেলাম সকল বাংলা ভাষীদের জন্য দাবার বাইবেল বলে স্বীকৃত রানী হামিদের লেখা 'মজার খেলা দাবা' বইটির।

প্রতিদিন তখন হাত খরচ পেতাম ৪০ টাকার মতন। সেখান থেকে কিলো-কিলো হেঁটে আর টিফিন না খেয়ে তিন কি চারদিনের মাথায় হাতে নিয়ে আসলাম এই স্বর্ণখনিটাকে। আমার দাবা খেলা নিয়ে পাগলামির সেটা হলো মাত্র শুরু। গোগ্রাসে গিলে ফেললাম বইটা। ওপেনিং, মিডল গেম, এন্ড গেম, সেন্টার, কিং-কুইন পন এসব টার্মের সাথে ভালো করে পরিচিত হলাম তখনই। বাসায় বোর্ড পেতে শুরু হলো মকশো করা। সেই সাথে এলাকার ফ্রেন্ড সার্কেলে একটা জোয়ার এনে ফেললাম দাবার, কয়েকজন স্বঘোষিত দাবা খেলোয়াড়কে কুপোকাত করে। ছাড়লাম এলাকায় টুর্নামেন্ট। এবং আবারও তৃতীয় হয়ে নিজেকেই তাক লাগিয়ে দিলাম। আসলে আশ্চর্য হলাম দুটি পরাজয়ে। এলাকার কাঁচা বাজারের এক মাছ বিক্রেতার কাছে নিজের প্যান্ট-শার্ট সব খুলে দিয়ে আসা লাগলো আর এক পুলিশ কনস্টেবলের কাছে বাকি যেটুকু সম্মান অবশিষ্ট ছিল সেটাও খোয়ালাম। বুঝলাম দুটো জিনিস- এক, আমি আসলেই ভালো খেলি-খেলাটা বুঝি। দুই, আমার খেলার উন্নতি ঘটাতে হলে ভালো ভালো খেলোয়াড়দের সাথে খেলার বিকল্প নেই। এবার খোঁজ ভালো খেলোয়াড়দের, তাই পল্টনের বায়তুল মোকাররমের পাশে থাকা দাবা ফেডারেশনে প্রায়ই এই অধমকে দেখা যেতে থাকলো। অসংখ্য টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করলাম। প্রতিবার হেরে গিয়ে জেদ চেপে যেতো মাথায়, আবার দাঁতে দাঁত চেপে চেষ্টা-নিজে নিজে শেখা, আবার সাদা-কালোর যুদ্ধ। একবার এক টুর্নামেন্টে লুঙ্গি পড়ে পান খেয়ে পিচিক করে পিক ফেলা প্রতিপক্ষকে তাচ্ছিল্য করে খেলায় হেরে গেলাম ২০ চালের মধ্যে। আরেকবার ৯-১০ বছরের এক ছেলে, পরবর্তীতে আন্ডার ১৬ ওপেন টুর্নামেন্ট চ্যাম্পিয়ন, বাবুর কাছে হেরে গিয়ে সমুদ্রতীরে নুড়ি কুড়ানোর মর্মার্থ বুঝলাম।

এভাবে খেলার ফলও পেলাম। পরবর্তীতে এলাকায় আবার টুর্নামেন্ট দিয়ে বন্ধু-জেলে-পুলিশ সবাইকে হাতে হারিকেন ধরিয়ে 'বাপি বাড়ি যা' বলে বিদায় করে দিলাম। তারপর... এইচ এস সি নামক এক বিভীষিকার আগমন ঘটলো। টেস্টে একটি বিষয়েও পাশ করলাম না। স্বাভাবিক। চব্বিশ ঘণ্টা বই পড়ছি, নয় ছবি আঁকছি, না হয় মুভি দেখছি বা দাবা খেলছি। পাশ করলেই অবাক হতাম। মেট্রিকে জান বাঁচিয়ে দেয়া শিক্ষিকার কাছে ফিরে গেলাম। ছয় মাসের ক্রাশ কোর্স শেষে কোনোমতে যুদ্ধক্ষেত্রে বিজয়ী হয়ে ফিরে আসা। এরপর আবার ভার্সিটি ভর্তি। বহুকষ্টে চান্স পাওয়া।

ভার্সিটির প্রথম সেমিস্টার শেষে যখন ইনডোর গেমসের বন্দোবস্ত করে দেয়া হলো ইন্টার-ডিপার্টমেন্ট গেমের জন্য, আমাদের আনন্দ দেখে কে। ক্যারম-দাবা-টেবিল টেনিস; ঘুমানোর জন্য জীবনে পরে বহু সময় পাওয়া যাবে ভেবে ঘুমকে বিদায় করে দিলাম রুটিন থেকে। পরে অবশ্য ঘুম আর ক্লাসের মধ্যে গুরুত্ব বিবেচনা করে জনমতের ভিত্তিতে ঘুম বিজয়ী হওয়ায় ক্লাসকেই টা-টা গুড বাই করে দেওয়া।

সেই প্রথম আমার প্রতিভার সাথে পরিচয় হলো। কিছু জানোয়ারের সাথে। জীবনে কখনও বই না পড়ে, দাবার একটা চালের বিশেষত্ব না জেনে, শুধুমাত্র নিজে খেলে ও দেখে চোখ বন্ধ করে ভেটেরান প্লেয়ারদের হারিয়ে দিতে পারে এমন কিছু দানব। এদেরকে ঈশ্বরদত্ত প্রতিভা ছাড়া আর কিছুই বলা সম্ভব নয়। এরপর জীবনের নানাবিধ ঝামেলার ভিড়ে হারিয়ে গেলো আবারও গজ-কিস্তির চালগুলো।

গত বছরের কথা। আমার জীবনের সবচাইতে তিক্ত-রক্তাক্ত বছর। বাড়ি-ঘর-সংসার ছেড়ে তখন অজ্ঞাতবাসে। সারাদিন দিস্তা দিস্তা কাগজ শেষ করে, লেখার চেষ্টা করি - পারি না। রাতে বালিশ ভিজে যায় ভেবে যে কোন চালে ভুল হয়ে গেলো। অনলাইনে আবারও শুরু করলাম দাবা খেলা। একের পর এক মুভি দেখলাম। বই পড়লাম। আমাকে আবার সুস্থ করে তোলার পেছনে, স্বাভাবিক-সামাজিক জীবনে ফিরিয়ে আনার পেছনে যাদের অবদান কম না।

এত কথা মনে হলো কুইন'স গ্যামবিট দেখে। আমাদের পৃথিবীতে আমরা প্রতিভাবানদের নিয়েই মাতামাতি করি, পরিশ্রমীদের নিয়ে না। কেনও যেন এই কথাটা আমার খুব মনে হয়। হারমন গিফটেড, বেন-ও। কিন্তু বেলটিক না। তাই দিনশেষে দাবার প্রতি অন্ধ ভালোবাসা পিছনে ফেলে মার্কেটের এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হয়ে জীবন-যুদ্ধে লড়াইয়ে নামা হ্যারি বেলটিকই আমি। শতরঞ্জের খিলাড়ি হতে গিয়েও যে হতে পারে না। যার ওপেনিং মুভ সব মুখস্থ কিন্তু, ভ্যারিয়েশন জানা নেই। যার মিডল গেমে গিয়ে সেন্টার পিস এলোমেলো হয়ে যায়। যার এন্ড গেম খুব কাঁচা। তাও, দাবা, আমার অসমাপ্ত প্রেমের নায়িকাই হয়ে থাকবে আমৃত্যু।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুলাই, ২০২১ সকাল ১০:৩৮
৯টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×