somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রানুদের গল্প

৩০ শে মে, ২০১২ রাত ৯:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বৃষ্টির সময় ঢাকার রাস্তায় যে উচ্ছলতা দেখা যায় তা কোন আন্তর্জাতিক সংস্থাকে দেখানো হলে অতি নিশ্চিন্তে ঢাকাকে তারা "আনন্দের শহর" বলে নামকরণ করতো।আমার মনে হয় এসময় সবচেয়ে বেশি লম্ফঝম্ফ করে মা বাবাহারা টোকাই শিশুরা।তাদের আনন্দ দেখলে আমার এই ৩৮ বছর বয়সেও দৌড়ে রাস্তার পানিতে নেমে যেতে ইচ্ছা করে।আমি যখন ৭ -৮ বছরের বালক ছিলাম কখনো বৃষ্টিতে ভিজতে পারতাম না, বাসার বাহিরে যেয়ে খেলাধূলা করতাম না।আমি আশ্চর্য রকমের উদাসীন ছিলাম।আমার প্রিয় কাজ ছিলো হাতে একগাদা রঙ মেখে সেটা দেয়ালে, সাদা কাগজে মাখানো।পাঠক হয়তো ভাবছেন আমি একজন চিত্রশিল্পী।আপনার ধারণা অত্যন্ত ভুল।আমি বহু চেষ্টা করেও একটা সোজা দাগ আকতে পারিনা।আমার একটা হাত ছোট্টকাল হতে দুর্বল।খুব একটা সেটা নাড়াতে পারিনা।

আমার ছোট্টকালটা কেটেছে আলীপুর নামে একটি ছোট্ট গ্রামে।এই গ্রামের প্রিয় মাটিতে আমি শুয়ে শুয়ে মিষ্টি খেজুরের ঘ্রাণ নিতাম, পা ডুবিয়ে থাকতাম আড়িয়াল খা নদীর বুকে।কত বিকেলে মন খারাপ করে শশিকর হাইস্কুলের পাশে যে বিশাল সবুজ মাঠটা আছে সেখানে বসে বসে কাদতাম।মন ভালো হলে হলদেরাঙ্গা ডানামেলা প্রজাপতিগুলোর পিছে পিছে ছুটতাম।ছুটে ছুটে নদীর কিনারে পৌছে যেতাম।কেউ আমায় বাধা দেবার ছিলোনা, কেউ বলার মত ছিলোনা – “বাবা আসিও, দুপুরে ভাত খাইবিনা?”

কিভাবে বলবে বলুন, আমার যে মা ছিলোনা।বাবা ছিলেন অর্ধেক পাগল মানুষ, সারাদিন ঘরে নিজ বিছানায় বসে বসে পুথি পড়তেন চন্ডীদেবীর। কেউ সামনে গেলে লজ্জা পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকতেন।আমার বয়স যখন ১১ বছর তখন হঠাৎ করে একদিন মাঝরাতে বাবা আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বললেন, “অন্ধকার দেখবি।কালো নিকষ অন্ধকার”।

আমি ভয় পেয়ে মাথা নেড়ে বলি, “না ভয় করে”।

বাবা হেসে বলে, “অনেক বড় হবি জীবনে।পড়াশোনা করবি, না খেয়ে হলেও পড়াশোনা করবি”।

বাবা সেদিন রাতে নিজের গায়ে নিজেই আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন।আমি নিজ চোখে তা দেখেছি।বাবার যখন সারা গায়ে আগুন ধরে যায় আমি ভয়ে বিছানার নিচে লুকিয়ে ডুকরিয়ে কাদছিলাম।আমার স্পষ্ট মনে আছে বাবা চুপ করে মাটিতে বসে ছিলো, সারা গায়ে ছিলো লালা আগুন।একটা সময় পাশের বাড়ির রাবেয়া খালা আমাকে খাট থেকে জোর করে টেনে বাহিরে নিয়ে যায়।ওই বাড়িতে আমাকে আর কেউ কখনো থাকতে দেয়নি।আমিও আমাদের আধাপাকা বাড়িটার আশেপাশে যেতাম না।আমার অনেক ভয় লাগতো, মনে হতো এই বুঝি সারা গায়ে আগুন নিয়ে আমার বাবা দৌড়িয়ে আসবে।আমি এখনো প্রতি রাতে দুঃস্বপ্ন দেখি, প্রতিরাতে ঠিক ৩টা ২০ মিনিটে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়।আমি পোড়া মাংশের গন্ধ পাই।

বাবা মারা যাওয়ার পর আমার কিশোরবেলাটা কেটেছে একজন মানুষ যতটা পৈশাচিকতার কথা ভাবতে পারে তার থেকেও খারাপ ভাবে।আমি আমার ছোট চাচার বাসায় থাকতাম।উনি প্রতিরাতে আমাকে নির্যাতন করতেন।আমার সারা পিঠে এখনো তার সরিষার তেল মাখানো বেতের দাগ আছে।উনি অবশ্য শুধু আমাকে না তার স্ত্রী এবং মেয়েকেও মারতেন।চাচী এবং তার মেয়েও আমাকে দেখতে পারতেন না।তারা মনে করতেন আমার বাবার জন্য আজকে তাদের এই অবস্থা।আমার দাদাজান তার সব জমি সম্পত্তি বাবাকে দান করে গিয়েছিলেন।বাবা সেই সবকিছু বিক্রি করে চলেছেন, আমার বুবু যে ছোট্টকালে মারা গিয়েছিলো তার জন্য খরচ করেছেন।আমার ছোটচাচাকে দাদা কিছুই দেননি আর তাই ছোটচাচা আমাকে মারতো।আমি অনেকবার ভেগে গিয়েছিলাম, কিন্তু লাভ হয়নি।উনি ঠিকই আমাকে খুজে বের করতেন, তখন চলতো আরো অসহনীয় অত্যাচার।১২-১৩ বছর বয়সের কোন ছেলের সাধারণত আত্নহত্যা করার মনমানসিকতা হয়না।আমার হয়েছিল, আমি চেষ্টা করেছিলাম দুবার।কিন্তু ভয়ে পারিনি শেষ পর্যন্ত।

আমি সেই চাচার বাসায় থেকেই এস.এস.সি পাশ করেছিলাম।৭টা লেটার সহ মাদারীপুর জেলায় সর্বোচ্চ নম্বর নিয়ে।বোর্ড থেকে প্রথম স্ট্যান্ড করেছিলাম।আমার স্কুল- সাহেব রামপুর থেকে এর আগে কখনো কেউ স্ট্যান্ড করেনি।আমাদের হেডস্যার আমাকে সেদিন কোলে নিয়ে পুরো আলীপুর গ্রাম ঘুরে বেড়িয়েছিলেন।আমার জীবনের সেটা একটা ঐতিহাসিক দিন ছিলো।সেদিন দুর্ভাগ্যবশত আমার চাচা আমাকে একটু বেশি মেরেছিলেন।মার খেয়ে রাতে আমার জ্বর যখন অনেক বেশি তখন আধো জাগরণে দেখলাম আমার চাচী তার গলায় ফাস লাগাচ্ছেন।আমি দৌড়িয়ে যেয়ে তার পা জড়িয়ে ধরে বললাম, “আম্মা আপনার জন্য এখনো এই বাসায় পড়ে আছি।আপনি চলে গেলে আমার কি হবে?”

চাচী হতবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন।এরপর হঠাৎ করে অঝোরে কাদতে লাগলেন আমাকে জড়িয়ে ধরে।উনি সেদিন আর আত্নহত্যা করেননি, পরের দিন করেছিলেন।উনার ছোট্ট মেয়ে জলিকে নিজ হাতে পানিতে চুবিয়ে খুন করেছেন, এরপর নিজে গলায় দড়ি ঝুলিয়ে আত্নহত্যা করেছেন।সেদিন আমার চাচার চোখে আমি প্রথম পানি দেখেছিলাম।দাফন শেষে আমার চাচা যখন বাসায় ফিরে আসেন আমি তখন উঠোনে একটা রাম দা হাতে নিয়ে বসে ছিলাম।আমাকে দেখে চাচা একটু ভড়কায় যান।উনি তোতলায় বলেন, “রানু তোর হাতে দা কেন কুত্তার বাচ্চা?”

আমি মাথা নেড়ে বলি, “পশু জবাই দেবো।হাতটা নিশপিশ করতেছে বুঝলেন”।

আমি উঠে দাঁড়িয়ে যখন উনার দিকে হেটে যাই উনি দৌড়ে পালিয়ে যান।আমি পিছন থেকে চিৎকার করতে করতে তার পিছনে দৌড়াতে থাকলাম।গ্রামের রাস্তায় অনেকে এই নাটকটা উপভোগ করলো, কিন্তু কেউ আমাকে বাধা দেয়নি।আমি অবশ্য খুন করার মত সাহস রাখতাম না।তাই একটা সময় ক্লান্ত হয়ে দাটা ফেলে দিয়ে আমার প্রিয় আড়িয়াল খা নদীর পাশে শুয়ে পড়ি।আমি আর চাচার বাড়িতে ফিরে যায়নি।

সেই অসহায় আমাকে আশ্রয় দিলেন, দানা পানি দিলেন সাহেব রামপুর স্কুলের প্রধাণশিক্ষক গৌতম বসাক স্যার। উনি আমাকে ঢাকায় তার ছেলের বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন।স্যারের ছেলের নাম ছিলো উত্তম বসাক।তিনি অত্যন্ত খুতখুতে লোক ছিলেন।আমি যেদিন ঢাকায় উনার বাড়িতে পৌছালাম উনি আমার দিকে নাক কুচকিয়ে তাকিয়ে বললাম, “ঘরে কাজের মানুষ নাই।কাজ করবি, এর বিনিময়ে তোকে কলেজে পড়ার বেতন দেওয়া হবে।বইয়ের টাকা পাবিনা, টিউশনি করে যোগাড় করবি।দু বেলা আহার করবি।সকালে শুধু চিরতার পানি।যা ভাগ”।

উত্তম বসাক আমাকে এইচ.এস.সি পরীক্ষার প্রতিদিন নিজে হাতে ধরে পরীক্ষার হলে বসাতেন।তিনঘন্টা হাতে পানি নিয়ে অপেক্ষা করতেন।হল থেকে বের হলে আমার মুখে নিজ হাতে পানি দিয়ে ধুয়ে দিতেন।আমার যখন এইচ.এস.সি পরীক্ষার ফল বের হলো উনি আমাকে জড়িয়ে ধরে কি কান্না।যে বিল্ডিং এ আমরা থাকতাম সেখানে প্রতি ফ্ল্যাটে যেয়ে মিষ্টি দিয়ে বলেছিলেন, আমার ছোটদাদায় স্ট্যান্ড করছে।এক্কেবারে ফাস্ট স্ট্যান্ড। গৌতম বসাক স্যার আমার রেজাল্ট শুনে ঢাকা এসে পড়েছিলেন।আমাকে একটা খুব সুন্দর নীল কলম উপহার দিয়েছিলেন উনি। আমি সেই কলমটা এখনো যত্ন করে রেখে দিয়েছি।

তড়িৎ প্রকৌশল থেকে পাশ করে আমি যুক্তরাষ্ট্রের নির্জন শহর নর্থ ডাকোটায় চলে গিয়েছিলাম।পাঠকের অবগতির জন্য জানাই, নর্থ ডাকোটা পৃথিবীর সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন শহরগুলোর একটি।মাইলের পর মাইল এখানে মানুষের অস্তিত্ব পাওয়া যায়না।কেউ একে বলে শীতের শহর কেউ বলে গরমের।জ্ঞান দান বন্ধ করে আরেকটু নিজের কথা বলি।আমি গ্র্যান্ড ফর্কস এর ইউনিভার্সিটি অফ নর্থ ডাকোটাতে পড়াশোনা করেছিলাম।আমার খুব প্রিয় কিছু সময় কেটেছে সেখানে, খুব প্রিয় কিছু সময়।আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটার সাথে আমি সেখানে সময় কাটিয়েছিলাম।আচ্ছা আমি নাহয় একটু সারাহর গল্প এখন শোনাই।

সারাহর সাথে আমার দেখা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণকেন্দ্রে আর্ট মিউজিয়ামে।সেসময় নর্থ ডাকোটার উত্তর থেকে বরফ গলে পড়া শুরু করেছে।তখনো বন্যা শুরু হয়নি।আমি বাংলার ছেলে, বিদেশের সামার আমার কাছে হাড়কাপানো শীত। তাই আমি যখন ইয়া মোটা মোটা জ্যাকেট গায়ে দিয়ে থাকতাম আমার শর্ট জামাকাপড় পড়া বন্ধুরা হাসতো।আমি পাত্তা দিতাম না।যাই হোক কোন এক শুভ সামারে আমি মিউজিয়ামে দাঁড়িয়ে ১৮ শতকের কিছু চিত্রকর্ম দেখছিলাম যখন সারাহ আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো।হঠাৎ করে আমি খেয়াল করলাম আমার পাশে নীল চোখের একটা অপূর্ব পরীর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।আমি মাথা চুলকিয়ে তাকে বললাম, “তোমার আপত্তি না থাকলে আমি কি জানতে পারি এভাবে কান্না করছো কেন?”

সারাহ আমার দিকে পরিচিত মানুষের মত তাকিয়ে বললো, “এই ছবিটা দেখো।এখানে যে ছোট্ট এক মেয়েকে দেখছো তার মা কাছে নেয়ার জন্য হাত ধরে টানছে কিন্তু ঝড় তাদেরকে কাছে আসতে দিচ্ছেনা এই ছবিটা অনেকটা আমার জীবনের মত। আমি যখন সাত বছর বয়স তখন আমার মা মারা যান।মারা যাওয়ার আগে তিনি প্রচন্ড যন্ত্রণায় প্রতিরাতে চিৎকার করতেন।মার কিডনী নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে।শেষ দিকে তার শরীরের চামড়া সব পচে গিয়েছিলো।আমাকে তাই বাবা ভয় পাবো বলে কাছে যেতে দিতেন না।মা মারা যাওয়ার আগে অনেক কাদতেন আর চিৎকার করে আমাকে ডাকতেন।কিন্তু কেউ আমাকে মায়ের কাছে যেতে দিতোনা”।

আমি মেয়েটার কাধে হাত দিয়ে বললাম, “আমার মা আমাকে আর আমার বাবাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।উনি আরেকটা বিয়ে করে খুব সুখে আছে।গত ১৯ বছরে উনি একবারো আমার খোজ নেননি।মার চেহারাটা কেমন আমার তাও মনে পড়েনা।বলোতো মেয়ে কার ভাগ্য বেশি খারাপ?”

সারাহ একটা আর্ট কলেজে পড়তো। ও অত্যন্ত বোকাসোকা একটা মেয়ে ছিলো কিন্তু ওর মত এত সুন্দর করে কেউ কখনো আকতে পারেনা বলে আমি বিশ্বাস করি।ওর বাবা ছিলো জার্মান আর মা রাশিয়ান।বিংশ শতাব্দীর একদম প্রথমভাগে রাশিয়ায় বাস করা জার্মানদের মধ্যে বেশ বড়সড় একটা অংশ এই নর্থ ডাকোটায় আবাস গড়েছিলো।এর মধ্যে সারাহ একজন ছিলো।সারাহকে আমি প্রচন্ড ভালোবেসেছিলাম।আমি প্রায় সময় তাকে নিয়ে ইন্ডিয়ানাদের রাজ্যে চলে যেতাম।বনে ঢাকা গ্রাহামস আইল্যান্ড ছিলো আমার সবচেয়ে পছন্দের জায়গা।আমি তার হাত ধরে বনের মাঝে হাটতাম।তার নীল চোখে কতবার হাত দিয়ে ছুয়ে বলেছি, “তুমি পরী তো না?”

সারাহ হাসতো।আমাকে বলতো, “এমন করে কেউ বলেনা রনু।সবসময় এমন করে বলবা?”

আমি সারাহকে কথা দিয়েছিলো তার চোখগুলো এমন করেই ভালোবাসবো।সারাহর বাবা হেনরী এবং সৎ মা মার্থা আমাকে বেশ পছন্দ করেছিলেন।উনারা বলতেন আমার ভেতরে একজন বেশ বয়স্ক মানুষ বাস করে।সেই মানুষটা যেদিন আমার থেকে বিদায় নেবে সেদিন তারা সারাহর সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দেবেন।

সমস্যাটা হতো যখন সারাহর সাথে আমি অন্য কাউকে দেখতাম।একদিন সারাহ আমাকে ফোন করে বললো সে তার এক বন্ধুর সাথে একটা নাইট পার্টিতে যাবে।আমি ব্যাপারটা একদম পছন্দ করতাম না।কিন্তু তাকে হাসিমুখে শুভকামনা জানালাম।আমি আর ও তখন এক সাথে থাকতাম, যেটাকে আপনারা এখন লিভ টুগেদার বলেন।কিন্তু আমি কখনো তাকে ছুইনি, বাঙ্গাল বলে কথা।

সারাহ সেদিন ভোর সাড়ে চারটায় বেশ মদ্যপ অবস্থায় বাসায় পৌছায়, তার সাথে একটা ছেলে ছিলো।ছেলেটাকে আমি চিনতাম, ওর নাম ম্যাক।সে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্কেটবল প্লেয়ার ছিলো।সারাহ যখন ছেলেটার গাড়ি থেকে নেমে আসে তখন আমি খুব রেগে ছিলাম।কিন্তু আমি কিছু বলতে পারিনি।ও সোজা ওর বেডরুমে যেয়ে শুয়ে পড়ে।ম্যাক ঘরে ঢুকতে চাইলে আমি ওর বুকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে দরজার বাহিরে যেতে বলি।সে আমাকে এফ ওয়ার্ডের গালি দিয়ে এশিয়ান শব্দটা উচ্চারণ করলো।আমি দরজা লাগিয়ে দিয়ে কেন যেন আবার দরজা খুলে ম্যাকের পশ্চাতে জোরে একটা লাথি কষালাম।তাকে পরিষ্কার বাংলায় বললাম, “হারামজাদা এশিয়ানের দেখছোস কি?রাতে আমাকে মেইল করে জানাবি বাংলাদেশী লাথি খায়া কেমন লাগছে”।

আমি দুদিন সারাহর সাথে কথা বলিনি, সারাহও আমার সাথে কেন যেন কথা বলেনি।তৃতীয় দিন সারাহ আমার কাছে এসে বললো, “তুমি আমাকে সবসময় বোকাসোকা বলো।অথচ তুমি আমার থেকেও বোকা জানো।দুদিন আগে রাতে তোমার ওপর রাগ করে পার্টিতে চলে গিয়েছিলাম। আমি এই দুদিন তোমাকে আরো সময় দিয়ে অপেক্ষা করেছি কখন তোমার পাপবোধটা হয়”।
আমি সারাহর দিকে তাকিয়ে বললাম, “আমি কি পাপ করেছি জানতে পারি?”


সারাহর চোখে আবার অনেকদিন পর পানি দেখলাম।সে আমার মাথায় হাত দিয়ে বললো, “আমার সেদিন জন্মদিন ছিলো।আমি ভেবেছিলাম তোমার মনে থাকবে।আমি রাত একটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে যখন দেখলাম তুমি ব্যাপারটা মনেই রাখোনাই আমি রাগ করে পার্টির কথা বলে চলে গিয়েছিলাম।আমি একটা বারে সারারাত ড্রিংকস করেছি এবং ম্যাককে ফোন করে আমাকে নামিয়ে দিতে বলেছি।আমি তোমাকে অনেক হার্ট করতে চেয়েছিলাম, অথচ নিজেই হার্ট হলাম”।

আমি সারাহকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিলাম।অনেকদিন পর সেদিন আমিও কাদলাম।তাকে বললাম, “চলো বিয়ে করি।আমি বাংলাদেশ নামে একটা ছোট্ট দেশের রাজপুত্র যারা তাদের রাজকন্যাকে জীবন দিয়ে ভালোবাসতে জানে”।

সারাহ চোখ মুছে বলে, “ঠিক আছে বিয়ে করবো।কিন্তু একটা শর্ত, তুমি আর কখনো আমার জন্মদিন ভুলে যাবেনা। কথা দাও”।

সেই ঘটনার এগারো বছর পর আমি বৃষ্টির দেশে ফিরে এসে ডান হাতের ঠিক মাঝখানে তাকিয়ে আছি।সেখানে একটা ছোট্ট উল্কি আকা।তাতে লিখা, “একটা রাজকন্যার জন্ম হয়েছিলো ১লা সেপ্টেম্বর ১৯৭৯ তে।সেদিন সারা আকাশে থোকায় থোকায় মেঘ সাজানো ছিলো”।

সারাহ আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলো এর দুবছর পর।কোন এক ভয়ংকর সুন্দর রোদ ঝলমলে ভোরে আমার ঘুমটা ভেঙ্গে যায় ওর গায়ের গন্ধে। আমি চোখ বন্ধ করে ওর হাতটা ছুয়ে বললাম, “তুমি কি আমার প্রিয় সাদা জামাটা পড়ে আছো?”
সারাহ আমার মাথায় হাত দিয়ে বলে, “হ্যা আর তোমার সবচেয়ে প্রিয় পারফিউম সারা গায়ে ছড়িয়েছি”।
আমি বালিশের ভেতর মাথা ঢুকিয়ে বলি, “আমি পারফিউমের গন্ধ পাইনা জানোনা? আমি শুধু তোমার গায়ের গন্ধ পাই, শুধু তোমার”।

সারাহ আমার হাত ধরে বলে, “আমি এখন একটু বাহিরে যাবো।আসতে দেরী হবে।তুমি খেয়ে নিও, ঠিক আছে?”

সারাহ আর ফিরে আসেনি।তিনদিন পর ওর একটা চিঠি আসে যাতে লিখা ছিলো, “রনু আমি আসলে আর পারছিলাম না।আমার মনে হচ্ছিলো, আমার জীবনটা বদ্ধ হয়ে যাচ্ছে।আমি মুক্তি চাচ্ছিলাম, মনে প্রাণে মুক্তি চাচ্ছিলাম অনেক আগে থেকে।কিন্তু তোমাকে বলতে পারছিলাম না।কারণ তোমাকে কষ্ট দেবার সামর্থ্য আমার নেই।রনু, তোমাকে আমি স্যরি বলতে চাইনা।কারণ আমার মনে হয় আমার জীবনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার আমার আছে।ভালো থেকো প্রিয়”।

আমি অনেক চেষ্টা করেও সারাহকে ঘৃণা করতে পারিনি কখনো।আমি নিজেকে বরং ঘৃণা করতে থাকলাম, কারণ আমার মনে হচ্ছিলো আমি এমন এক বাস্টার্ড যার সাথে কখনো কেউ থাকতে পারেনা।মা চলে গেলো, বাবা হারিয়ে গেলো, যাকে এত্ত এত্ত ভালোবাসলাম সেই মানুষটাও কিছু না বলে চলে গেল।আমি প্রতিনিয়ত জগত থেকে জীবন থেকে হারিয়ে যেতে থাকি।আমি নিজেকে ভালোবাসতাম না, একদম না।একটা সময় আমি স্থবির একটা নিষ্ঠুর চিত্রকর্মের মত হয়ে গেলাম।

আজ থেকে সপ্তাহখানেক আগে আমি আমার ঠিকানায় একটা চিঠি পেলাম।চিঠিটা লিখেছিলো আয়েশা কবির নামে একজন ভদ্রমহিলা বাংলাদেশ থেকে।আমি একটু অবাক হয়েছিলাম প্রথম চিঠিটা হাতে পেয়ে।আমি জানতাম না চিঠির ভেতরের বিষয়বস্তু আমার জন্য এতোটা চমকপ্রদ হবে।আয়েশা নামে ওই মহিলার চিঠিটার সারসংক্ষেপ অনেকটা এমন যে তিনি আমার মায়ের মেয়ে, অর্থাৎ আমার সৎ বোন।আমার মা বেশ কয়েকবছর আগে মারা গেছেন।মারা যাওয়ার আগে তিনি তার মেয়েকে বারবার বলেছেন যেন আমি একবার তার কবরের পাশে যেয়ে দাড়াই।

আমি চিঠিটা হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ থম হয়ে বসে ছিলাম।আমার মনে হচ্ছিলো, আমার সারা শরীরে একটা গরম রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে।ভুল হলো কিনা জানিনা, কিন্তু অনেকদিন পর ভেতরে একটা কান্নার অনুভূতি হচ্ছিলো।কেন যেন সেইরাতেই আমি সিদ্ধান্ত নেই এই মরার দেশে আর থাকবোনা।চারদিনের মধ্যে আমি আমার সবকিছু গুছিয়ে নেই।আমি যে ডিপার্টমেন্টের এসোসিয়েট প্রফেসর ছিলাম তার হেড ড. বার্গ আমার অব্যাহতি পত্র দেখে মুচকি হেসে বললো, “টিপিক্যাল বাংলাদেশী।মহান আমেরিকা আর সহ্য হলোনা?”

আমি তার নকল করে মুচকি হাসি দিয়ে বললো, “টিপিক্যাল আমেরিকান বন্ধু, তোমার দেশের মাটি বড়ই লাল।আমার এখন সবুজ মাটি দেখতে ইচ্ছা করছে, স্বোতসিনী নদীর স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছা করছে, মায়ায় ঢাকা আমার দেশের মায়াবী মানুষগুলোকে দেখতে ইচ্ছা করছে।আমাকে ছেড়ে দাও, তোমার দেশ আমাকে আর টানছেনা”।

দেশের মাটিতে পা রেখে আমার একটা অদ্ভুত শান্তি হয়েছিলো।খুব অদ্ভুতভাবে আমি সারাহর সেই পরিচিত ঘ্রাণটাও পাচ্ছিলাম।আমি বোকার মত আশেপাশে তাকালাম।মনে হলো যেন সে আমার পাশেই কোথাও আছে নীল চোখের জাদু নিয়ে। আমার খুব ইচ্ছা করছিলো আমার প্রিয় কলেজের মাঠ দিয়ে হেটে যেতে।সেই সবুজ মাঠে আমি প্রায়ই বসে বসে ঘাসের ডগার স্বাদ নিতাম।মাঠের ঠিক মাঝখানে একটা বটবৃক্ষ ছিলো।সেই গাছের নিচে বসে বসে আমি কত্ত বই পড়েছি।আমার পড়া শেষ বইটা ছিলো পার্থিব।

ঠিকানা আগেই দেয়া ছিলো, কিন্তু আমার খুজে বের করতে বেশ কষ্ট হলো।অলি গলি পার করে যখন আমি আয়েশা কবিরের বাসায় পৌছালাম তখন প্রায় সন্ধ্যা। আমি আল্পনা আকা সিড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে উপরে উঠে এলাম।আমি ভদ্রমহিলাকে জানাইনি যে আমি আসছি।ভয় হচ্ছিলো যদি দেখি দরজায় একটা বিশাল তালা ঝুলছে।ঠিক তিনতলায় পৌছাবার পর আমার ভয় দূর হলো।আমি কলিংবেল টিপলাম দুবার। তৃতীয়বার কলিংবেল টেপার আগে একটা ছোট্ট মেয়ে দরজা খুলে দিলো।বয়স খুব বেশি হলে হবে ছয় বছর।আমাকে দেখে সে মনোযোগ দিয়ে দেখছিলো।একসময় বললো, “তুমি কে?”

আমি হতভম্ব হলাম।এভাবে এতটুকু একটা বাচ্চা মেয়ে আমাকে তুমি তুমি করে বলছে! একটু পর একজন ভদ্রমহিলা ভেতর থেকে এলো যাকে দেখেই আমি চিনে ফেললাম যে উনি আয়েশা কবির। আমি তাকে বললাম, “আমার নাম রানু।আপনি আমাকে চিঠি লিখেছিলেন।আমি পারভিন জাহানের ছেলে”।

ভদ্রমহিলা একটু থতমত খেয়ে বললো, “আসুন ভেতরে আসুন।আপনাকে দেখে খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে।এক গ্লাস পানি খাবেন?”
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “না।মার কবরটা কোথায় বলুন।আমি কাল রাতে আলীপুর চলে যাবো।একটু তাড়ার মধ্যে আছি”।
আয়েশা আমার মুখোমুখি বসলো।অনেকক্ষণ চুপ হয়ে থেকে বললো, “আপনি যেতে চাচ্ছেন, যাবেন।কিন্তু মার অনেক কিছু আপনাকে জানানো দরকার”।

আমি একটু ইতস্তত বোধ করলাম।কারণ আমার চোখ দিয়ে পানি এসে পড়তে চাচ্ছিলো।আমি এই অপরিচিত মানুষটার সামনে চোখের পানি ফেলতে চাচ্ছিনা।

আমাকে আয়েশা পাশের খাটটা দেখিয়ে বললো, “এটা মায়ের খাট।বাবা মারা যাওয়ার পর মা এই ঘরে থাকতো। আমার যখন দশ বছর বয়স তখন মা একদিন খুব কাদছিলো।আসলে মা প্রায় সময় অনেক কাদতো।মার মনে হতো আপনি তাকে অনেক ঘৃণা করেন।আপনি কি তাকে সত্যি ঘৃণা করতেন?”

আমি মাথা নেড়ে বললাম, “না।আমার মনে হয় মা বেশ বোকা ছিলেন।যে সময়টা উনি আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন উনি হয়তো বুঝতে পারেননি আমি কতটা অসহায় হয়ে পড়বো।তাছাড়া আমার মামারা মানুষ হিসেবে খুব একটা সুবিধার ছিলেন না।উনারা মাকে মিথ্যা করে বলেছিলেন যে আমাকে দেখাশোনা করবেন।উনারা কেউ মাকে নিয়ে চলে যাওয়ার পর আমার সাথে দেখাও করেননি”।
আয়েশা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বললেন, “রানু ভাই মা তোমাকে অনেক ভালোবাসতেন।মারা যাওয়ার আগে প্রতিরাতে কাদতেন তোমাকে একবার দেখার জন্য।তোমার বিদেশের ফোন নম্বর মার কাছে ছিলো।কিন্তু মা কখনো তোমাকে লজ্জায় ফোন দিতেন না।আমাকে মারা যাওয়ার আগের দিন বললেন, “আমার রানুকে বলিস তো যেন আমার কবরের সামনে যেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।তখন তো আমার শরীরে জান থাকবেনা।তাই আর লজ্জাও লাগবেনা।ওকে বলিস আমাকে ক্ষমা করতে”।
আমি ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম।আমার বুকের ভিতরে কি ভয়ংকর কষ্ট হচ্ছে তা এই জগতের কে তখন বুঝবে?আমার এই কষ্ট আমি কাউকে দেখাবোনা।আমার মা ছিলেন উনি, শুধু আমার মা।অথচ মাকে দেখতেই পারলাম না।

আয়েশাকে নিয়ে পরের দিন যখন মায়ের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আছি তখন ছোট্টকালে মা যেভাবে ডাকতো সেটা খুব মনে পড়ছিলো।মা দুপুরবেলা আমাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিয়ে তারপর আমার নাম ধরে ছড়া গাইতেন,
“ছোট্ট বাজান বুকে আয়
ঘুমালে রানু কোকিল গায়”

আমি হাটু গেড়ে বসে মায়ের কবরের মাটিতে হাত দিয়ে ভয়ংকর প্রশস্তি পেলাম।মাকে বললাম, “মা তোমার মত এত সুন্দর করে কেউ কবিতা শোনায়না।কেউ তোমার মত করে আমাকে বুকে নিয়ে ঘুম পাড়ায়না।তুমি কেন আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলা?আমি যখন ঢাকা শহরে আসি, তখন তোমার বয়সী কাউকে দেখলেই পাগলের মত দেখতাম।তোমার চেহারা খুজতাম।মাগো তোমার চেহারাটা এইখানে বেধে রাখছি, কেউ কোনদিন এটা ভুলাতে পারেনাই।পারবেনা।তুমি আমার সাথে কথা বলোনাই কেন মা, আমার কাছে লজ্জা কিসের?এই জগতের সবার চেয়ে তুমি আমার কাছে শ্রেষ্ঠ।তুমি কোন ভুল করো নাই মা, আমার ভাগ্য খারাপ ছিলো।আমি হয়তো পাপ করেছি”।

আমি কতক্ষণ কেদেছিলাম আমার মনে নাই।আমার পাশে আয়েশা দাঁড়িয়ে, তিনি একসময় আমার হাত ধরে উঠালেন।আমাকে বললেন, “ভাইয়া আমার অনেক হিংসা হতো যখন মা তোমার কথা শুধু বলতো।মা তোমাকে অনেক ভালোবাসতো, বিশ্বাস করো।অনেক অনেক বেশি ভালোবাসতো।মা তোমার কাছে অনেকবার চলে যেতে চেয়েছিলো, বাবার জন্য যেতে পারেনাই। আমি তোমাকে অনেক খুজছি ভাইয়া।যখন মা বেচে ছিলো তখনও অনেক খুজছি।মা দুনিয়াতে সবার থেকে বেশি তোমাকে ভালোবাসতো”।
আমি আমার চোখ মুছতে মুছতে বললাম, “আমি জানি। আমি জানি”।

আমি সেদিন রাতেই আলীপুর ফিরে গিয়েছিলাম।আমার মনটা তখন ভীষণ রকমের খারাপ ছিলো।মনে হচ্ছিলো বাকিটা জীবন আড়িয়াল খা-কে জড়ায় ধরে কাটিয়ে দেই।এইখানে আমার বাবা, আমার মার স্মৃতি আছে।আমার সবুজ ঘাসে দৌড়ে বেড়ানো অবাধ্য শৈশব আছে।আমার সেই ছোট্টকালের বন্ধু মুন্না, তনু আর মিলির সাথে কাটানো মাটির ঘর বানানোর দিনগুলো কে আমাকে ফিরিয়ে দিতে পারে আলীপুর ছাড়া।

অনেক রাতে আমি একটা অদ্ভুত কাজ করলাম যা শেষ দশটি বছরে আমি করিনি।সারাহ চলে যাওয়ার একবছর পর আমার কাছে ওর একটা চিঠি এসেছিলো।সেই চিঠিটা আমি কেন যেন কখনো পড়িনি।আমার ইচ্ছা করেনি।হয়তো সেখানে আমার প্রতি করুণা করে কিছু লিখা থাকবে।আমার মনে হতো আমি কারো করুণারও যোগ্য না।আশা ছিলো কোন একদিন প্রিয় মানুষের এই মূল্যবান চিঠিটা পড়বো।আজ কেন যেন পড়তে ইচ্ছা করছে।চিঠিটা খুলে পড়লামঃ

“রনু রনু রনু, আমার উপর অনেক রাগ হয়েছে? তুমি এতো বোকা কেন? যে মানুষটা তোমাকে পাগলের মত ভালোবাসে সে কি করে তোমাকে ছাড়া বেচে থাকে বলো তো?তোমার ওই লালচে সোনালী ঘাসফড়িংটার কথা মনে আছে?ওইযে আমাদের জানালায় প্রতিদিন সকালে উড়ে উড়ে আসতো, আমাদেরকে নীল আকাশে বাতাসের ঘ্রাণ নিয়ে বেচে থাকার লোভ দেখাতো?আমি প্রায় দিন ওই ঘাসফড়িংটার পাখায় উড়ে বেড়ানোর স্বপ্ন দেখতাম। জানো তুমি আমার কাছে ওই ঘাসফড়িংটার মত ছিলে।আমি তোমার সাথে যতটা সময় ছিলাম এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ ছিলাম।কারণ তুমি আমাকে ভালোবেসেছিলে, আমার মাঝে একটা নারীকে জাগিয়েছিলে আর আমাকে বুঝতে শিখিয়েছিলে - আমি সারাহ, পৃথিবীর জন্য সবচেয়ে মূল্যবান একটা সৃষ্টি।কে কবে কাউকে এমন হৃদয় দিয়ে দেখেছে যেমনটা তুমি আমাকে দেখেছো! বিশ্বাস করো, আমি আরো এক সহস্র বছর তোমার দিকে এমন করে তাকিয়ে থাকতে পারতাম।তোমার চোখের মমতা সবটুকু শুষে নিয়ে আমাকে আরেকটু রাঙ্গাতাম প্রতিক্ষণ সারাক্ষণ।
যখন তুমি এই চিঠিটা পাবে তখন হয়তো আমি তোমার পৃথিবীতে শ্বাস নিতে পারবোনা।তোমার উষ্ণতা আমাকে আর কখনো ছুয়ে দিবেনা।ব্লাস্ট নামে এক প্রকার প্রিকার্সর সেলের ভয়ংকর বংশবৃদ্ধি আমাকে তোমার থেকে অনেক দূরে নিয়ে যাচ্ছে।আমি তোমাকে জানাতে চাইনি, কখনো চাইনি। রনু তুমি মরে যেতে আমি জানি, তোমার চোখের সামনে আমি একটা কষ্ট হয়ে থাকতাম।প্রিয়, আমি তোমাকে এই যন্ত্রণাটা কেমন করে দেই আমাকে বলো?

তোমার জন্য আমি একটা উপহার রেখে যাচ্ছি মার কাছে।তুমি অবশ্যই মার সাথে যোগাযোগ করবে।মাকে বলবে তোমার জন্য দেয়া উপহারটা যেন বুঝিয়ে দেয়।তুমি আমার উপহারটা সারাজীবন যত্ন করে রাখবে কথা দাও?
রনুীই একটা জীবন যদি সত্যি হয় তবে কথা দিচ্ছি এর পরের জীবনটাও সত্যি হবে।আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো আমার সবটুকু সত্তা নিয়ে।ভালো থাকবে, অনেক ভালো”।

আমি চিঠিটা পড়ে অনেকক্ষণ চুপ হয়ে বসে থাকলাম।একটা সময় যখন আর পারছিলাম না তখন ঘরের দরজা খুলে ছুটতে থাকলাম।দূর থেকে দূরান্তরে, চিৎকার করতে থাকলাম।আমার অমানুষিক চিৎকার আলীপুর গ্রামের নিস্তব্ধতা ধ্বংস করে।একটা সময় আমি নদীর পাশে গিয়ে পড়ে গেলাম।আমার এই ৩৮ বছরের জীবনের সব কষ্টগুলোকে আজকে এই নদীর বুকে চাপা দিবো।প্রিয় নদী আমাকে আশ্রয় দাও, আমাকে রক্ষা করো।একটা সময় যখন অস্থিরতা থামলো তখন বিড় বিড় করে শুধু বলছিলাম, “আমায় কেউ আদর করে আর রনু ডাকেনা। কেউ না”।

এক সপ্তাহের মধ্যে আমি আবার লাল মাটির দেশে এসে পড়লাম।আমাকে এখন সারাহর মা আর বাবাকে খুজে বের করতে হবে।এই দেশে সবই সম্ভব তাই দুদিনের মধ্যেই সব বের করে ফেললাম।সারাহর বাবা বেচে নেই, ওর মা এক কম্যুনিটি ক্লিনিকে আছেন।আমাকে দেখে উনার চোখে ভয়ংকর হতাশা দেখলাম।তার প্রথম বাক্য ছিলো, “হলি কাউ।এত্তদিন পরে আসলে?”
সারাহর মা মার্থা যখন আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে গেলো তখন প্রায় সন্ধ্যা ছয়টা।উনি আমার খুটিনাটি খোজখবর নিলেন।একসময় আমার পাশে বসে বললেন, “তোমাকে আমি অনেক আগে একটা চিঠি পোস্ট করেছিলাম।সেই চিঠিটা আমি নিজে হাতে লিখে দিয়েছিলাম।সারাহর লিখার মত শক্তি ছিলোনা।ও তোমাকে অনেক ভালোবাসতো ছেলে”।

মার্থার চোখে অশ্রু চিকচিক করছে, আমার ভেতরটাও ছিলো আদ্র।আমি তাকে আস্তে আস্তে বললাম, “সারাহ আমার জন্য কিছু রেখে গিয়েছে?”
মার্থা হেসে দিলো।আমাকে বলতো, “আমি অপেক্ষা করছিলাম তুমি কখন আমাকে জিজ্ঞেস করো তোমার উপহারের কথা।আসো আমার সাথে উপরে চলো, তোমার উপহারটা দেখাই”।

মার্থা আমাকে উপরে সারাহ যেই রুমে থাকতো সেখানে নিয়ে গেলো।আস্তে করে দরজা খুলে বললো, “ভেতরে তাকাও।দেখো তো কে?”

আমি যখন ভিতরে তাকাই তখন দেখি বিছানার উপর কেবল ঘুম থেকে উঠা নীল চোখের একটা সাত আট বছরের কিশোরী।আমার মুখ দিয়ে আহ! বের হয়ে গেলো।আমি পিছিয়ে গেলাম একটু কিসের যেন ভয়ে।আমার সারা চোখে তখন অশ্রু।আমি মার্থার দিকে অশ্রুসিক্ত চোখ নিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করলাম, “আমার, এটা আমার?”

মার্থা চোখ মুছতে মুছতে মাথা নাড়ে।আমাকে বললো, “আমার মেয়েটা তোমার বাচ্চাকে বাচানোর জন্য তোমার থেকে দূরে চলে এসেছিলো।ও জানতো তুমি যদি জানো ওর অসুখ হয়েছে তুমি কখনো বাচ্চাটাকে দুনিয়াতে আনতে না।আমরা কেউ বিশ্বাস করিনি যে ও একটা সুস্থ বাচ্চা জন্ম দিতে পারবে।মাত্র সাত মাস ও সারাহর মাঝে ছিলো, একসময় সারাহর অবস্থা যখন খারাপ হয়ে যায় ওর প্রিম্যাচিউরড ডেলিভারী করানো হয়েছিলো।আমার মেয়েটা সেদিনই মারা যায়।আমরাও আসলে চাইনি ও এত কষ্ট করুক।কিন্তু ও তোমার জন্য সব সহ্য করেছে।রানু, তুমি ওকে কি জাদু করেছিলে বলো তো?”

আমি মার্থার কথা শুনতে পাচ্ছিলামনা ঠিকমত।আমি আমার মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছি।একটাসময় ওর দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে যাই।ও আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কে?”

আমি ওকে বলি, “আমি তোমার পাপা।ওয়ান এন্ড ওনলি।মামণি তোমার নাম কি সারাহ?”

ছোট্ট সারাহ মাথা নেড়ে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কেমন করে জানো?”

আমি আমার মেয়েটাকে বুকের মধ্যে নিয়ে বলি, “তুমি আমার আমার কলিজা যে তাই”।

এইতো আমার গল্প, আমার সারাহকে ফিরে পাওয়ার গল্প।জগতের সব অলৌকিকতাকে তুচ্ছ করে আলীপুরের সেই রানুর ভালোবাসাকে ফিরে পাবার গল্প।এই গল্প সেই রানুর যে সারাজীবন তৃষিত ছিলো তার মায়ের জন্য, সেই রানুরও যাকে তার মা হাজার চেষ্টাতেও ভালোবাসার কথাটা বলে যেতে পারেননি।কিন্তু রানু ঠিকই তার মায়ের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে তার মেয়েকে নিয়ে।ছোট্ট সারাহ তখন তাকে জিজ্ঞাসা করে, “বাবা তুমি তোমার মাকে অনেক মনে করো?”

বাবাটি বলে, “হ্যা মা।কিন্তু যখন তোমার দিকে তাকাই তখন মনে হয় আমার সব ভালোবাসার মানুষগুলো তোমার মাঝে বাস করে”।

আমি সেসময় আমার মেয়েটার হাতটা শক্ত করে ধরে থাকি।সব হারানো একজন যেমন করে তার শেষ সম্বলটাকে আকড়িয়ে রাখে ঠিক তেমন করে।

*****************************************************************

চরিত্রগুলো কাল্পনিক,ভালোবাসাগুলো সত্য। আমি বহুদিন ধরে এই গল্পটা লেখার জন্য অপেক্ষা করছিলাম, কেন যেন পারছিলাম না। অনেকদিন পর আজ দায়মুক্ত হলাম।আমি সবসময় বলি যে, আমি কারো জন্য গল্প লিখিনা।নিজের জন্য লিখি।এই গল্পটাও নিজের জন্য, তবে তার থেকে বেশি আমার প্রিয় মানুষটার জন্য।রানুরা সব জীবনে ভালোবাসা পাক এই প্রার্থনা করি।আর সারাহরা বেচে থাকুক হৃদয়ের সবথেকে প্রিয় স্থানে এই আশাবাদ রাখি।
২৬টি মন্তব্য ২৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×