somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নামহীন - ১

১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঠক ঠক করে দরজায় আওয়াজ হচ্ছে। বাতের ব্যথার জন্য আজকাল সকালে ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছা করেনা। কোন শালায় আসছে কে জানে। মাত্র সাড়ে আটটা বাজে, এখন না আসলে কি হইতোনা?প্রায় দুইমিনিট নানান কসরত করে বিছানা ছেড়ে উঠে আমি দরজার দিকে আগায় যাই। দরজা খুলে উঁকি দিয়ে দেখি আমার বন্ধু মুরশিদ। আমার দিকে তাকায় বলে, শুকায় গেছোস অনেক? ঘুমায় ছিলি।
আমি ঘরের ভিতরে ঢুকার জন্য চোখের ইশারা করি। কাল্লু নামে এক ছেলে আমার বাসায় এসে মাঝে মাঝে কাজ করে দিয়ে যায়। শূয়োরের বাচ্চা তিনদিন ধরে আসতেছেনা। ঘরে পড়ার একটা গেঞ্জী নাই ঠিকমত। দুইদিন আগে ধোয়ার জন্য ফেলে রাখা গেঞ্জীটা গায়ে দিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। মুরশিদের দিকে তাকায় বললাম, বিছানায় বয়। চেয়ার নাই ঘরে। কি অবস্থা?

মুরশিদ করুণ মুখে হাসে। আমার দিকে তাকায় বলে, হাপানীর রোগ হইছে। আজকাল কথা কইতে গেলেও দম লাগে। তোরে দেইখ্যা মনটা খারাপ হয়া গেলো। দাড়ি কাটোস না ক্যান?

আমি ভদ্রতার একটা হাসি দিয়ে বললাম, গাল কাইট্যা গেছে। ক্ষুর চালাইলে ব্যাথা লাগে। চা খাবি? নাস্তা করছোস?
মুরশিদ আমার দিকে তাকায় থাকে। ও কি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে কথা মনে করছে। ২১ বছর আগে একসাথে চারুকলায় জীবনগড়া শুরু করেছিলাম। আমি আঁকতে পারতাম বেশ ভালো।ও স্কাল্পচার বানাতো। একদিন আমরা ঠিক করলাম লেডি সোফিয়াকে বানাবো একদম নগ্ন। আমি আকবো, আর ও বানাবে। শোলা, নরম কাঠ, কালার গ্রেডার কত কিছু আনলাম। এরপর আর হলোনা কেন যেন। আমরা ঝরে গিয়েছিলাম আস্তে আস্তে। মুরশিদ পড়া শেষ না করেই গ্রামে ফিরে যায়। গরীবের ছেলের আর্ট শেখা একটা ঘোড়া রোগ। আর আমি রিকশার পেইন্টিং থেকে শুরু করে দেয়ালে আকাআকি সব করেছি। বড় কিছু হতে পারিনাই। মনে হয় ওই জিনিসটা ছিলোনাে। যেটা থাকলে মানুষ বড় হয়, অনেক বড়।

মুরশিদ বেশ অনেকক্ষণ পরে বলে, তোর মেয়ে একটা চিঠি দিছে। ও একটু অসুস্থ। ঢাকায় একটা কাজ ছিলো। ভাবলাম তোরে দেইখাও যাই।
মুরশিদের বোন সুমনাকে বিয়ে করেছিলাম আট বছর আগে। আমার বয়স তখন ৩৫। বোনের বয়স ১৭। বয়সের এতো ব্যবধান বলেই হয়তো আমি সুমনাকে কখনো ওভাবে প্রেমিকা ভাবতে পারিনি। মুরশিদ ছাগলের বাচ্চার জন্য আমার বিয়েটা করতে হয়েছিলো। আমি চাইনি, একরকম জোর করে করায় দিলো। আমার নিজের ভাতের জোগান নাই। আরেক মুখরে কেমনে খাওয়াবো। মেয়েটা একবারেই গ্রামের মেয়েদের মত ছিলো। সহজ সরল। দুই একবার মেজাজ খারাপ করে থাপ্পড় মেরেছিলাম। রাগ করে শহরের মেয়েদের মত গাল ফুলিয়ে রাখতোনা। শুধু ঘন্টাখানেক পর দেখতাম, গালে যে জায়গায় মেরেছিলাম ওখানে লাল রংটা চোখ পর্যন্ত ছেয়ে গেছে। মায়া লাগতো তখন। ছয় মাস শহরে সংসার করে ওকে আবার গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। এরপর আবার বাঁচার যুদ্ধ নিষ্ঠুর শহরে। তিন চার মাসে একবার ওকে দেখতে যেতাম। যখন বলেছিলো বাচ্চা হবে, মেজাজ খারাপ করেছিলাম। আমার সামর্থ্য নাই বাচ্চা পালার বুঝিয়েছিলাম। ও কথা রাখেনি। আমি বাচ্চা হওয়ার ছয় মাস পরও তাই দেখতে যাইনি। প্রথমবার মেয়েকে দেখে খুব মায়া লাগছিলো। বুবুর কথা মনে পড়েছিলো। বাচ্চাকে রেখে চলে যাওয়ার সময় বাচ্চাটা ঘুমের মধ্যে একটা আঙ্গুল ধরে রাখছিলো। বুবু ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্নহত্যা করার সময় আমার ঘরে এসে এমন করেই আমার ডান হাতের কড়ে আঙ্গুলটা ধরে রাখছিলো।

আমার চিন্তা ভাবনার বিস্তারে ব্যাঘাত ঘটিয়ে মুরশিদ বললো, গ্রামে যেয়ে পারলে মেয়েটারে একবার দেইখ্যা আসিস। বাবা মা ছাড়া মাইয়াটার মুখ দেখলে খুব কষ্ট লাগে। আমি যাই তাইলে?

আমি মুরশিদকে দরজা পর্যন্ত আগায় দেই। মুখ কাচুমাচু করে আধাপাকা দাঁড়িয়ে চুলকিয়ে ওকে অযুহাত শোনাই। বলি, যাইতে তো ইচ্ছা করে। পারতেছিনা। দেখি পরের মাসে একবার যামু। ভালো থাক।

মুরশিদ যাওয়ার পর আমার কাছে ফোন আসে শহীদ ভাইয়ের। ফোন ধরে সালাম দিয়ে বলি, আজকে অফিস আসতে পারতেছিনা।
শহীদ ভাই বলে, তোমার একটা খারাপ খবর আছে। বস মনে হয় তোমারে ফালায় দিবার চেষ্টা করতাছে। আমি খুব স্যরি। তুমি চাকরী খুজতে থাকো।

ফোনটা রেখে আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলি। আগের মাসে ৩১৮৯২ টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তুলেছিলাম বেতন হিসেবে। এখন পকেটে আছে ১৭০০ টাকার মত। চাকরীটা গেলে কোন সঞ্চয় নাই। ধুর শালার জীবন। হঠাৎ মনে পড়লো, সুমনার কিছু গহনা আছে আমার কাছে। একটা চুড়ি, দুইটা কানের দুল। একটা বাক্সে রেখে দিছিলাম। ওকে কবর দিয়ে আসার পর আর কোনদিন বাক্সটা খুলে দেখিনাই। গহনাগুলা নিয়ে বেচা দরকার। এগুলার কোন দরকার তো নাই এখন। হুদাই রেখে দিছি। হুদা হুদা।

বাক্সটা খুলে হলুদ রঙের খামে মোড়ানো চিঠিটা পেয়ে গেলাম। এই চিঠিটা পড়তে কখনো ইচ্ছা করেনি। সুমনা মারা যাওয়ার আগে লিখেছিলো। হয়তো একগাদা আবেগ অভিযোগ থাকবে। আমার এইসব দেখার সময় নাই একদম। ২০ বছরের মেয়ের প্রেম অভিযোগ নিয়ে লেখা চিঠি আমাকে টানেনাই। তবুও কি মনে করে আজকে চিঠিটা খুললাম। মাত্র কয়েকটা লাইন লেখা। পড়া শুরু করলামঃ
"আজ বৃষ্টি হচ্ছিলো খুব। আপনি বৃষ্টি হলে ভাত ভাজা ডিম দিয়ে খেতে চাইতেন। রান্না করেছিলাম তাই, যদি এসে পড়েন তা ভেবে। আপনি সবসময় বলেন আমি বাচ্চা মানুষ, বেশি আবেগ। কথাটা ঠিক না। আমি কখনো আপনাকে আবেগ দেখাইনি। দেখালে আপনি হয়তো জানতেন, রাতের পর রাত জেগে আমি আপনার পাশে বসে ভয়ে ভয়ে আপনাকে দেখতাম। আপনি জায়গা নিয়ে ঘুমান তাই আমি মেঝেতে বসে থাকতাম। আপনার ঘুম দেখতাম। আকাআকি করার পর আপনার হাতে যে রঙ লেগে থাকতো সেগুলো খুব সাবধানে মুছে দিতাম। যদি আবেগ দেখাতাম তাহলে জানতেন, আমার পৃথিবীটা খুব ছোট্ট ছিলো। সেখানে শুধু আপনাকেই দেখেছি। বিচার করতে চাইনি। আপনি রাগ করে মেয়েটাকে দেখতে আসেন না। আমার কষ্ট হয়। একটা সত্য কথা বলি। আমার বাবু হওয়ার আগে থেকেই আমি জানি আমি খুব তাড়াতাড়ি মারা যাবো। তাই খুব চাচ্ছিলাম একজন কেউ থাকুক যে আপনাকে শেখাবে মানুষকে কিভাবে ভালোবাসতে হয়। মেয়েটার চোখ দেখেই আমি বুঝি, ও আমার মত হয়েছে। অনেক ভালোবাসতে জানে, ভালোবাসার অবহেলাও সহ্য করতে পারে। আপনাকে প্রথম চিঠি লিখলাম। আর লিখা হবেনা। আপনি হয়তো এটাও পড়বেন না। আমার কথা কাউকে বলার ছিলোনা। নাহয় সাদা কাগজটাই জানলো।"

সুমনা বই পড়তে খুব পছন্দ করতো। ওকে তারাশংকরের কবি বইটা পড়তে দিয়েছিলাম। একদিন রাতে ঘুম থেকে উঠে আমি খেয়াল করি ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি পানি খেয়ে আবার শুয়ে যাই। কেন যেন প্রশ্ন করেছিলাম, কি দেখো?
সুমনা বলে, কবিকে।

আমি হেসে বলি, আমি কবি না। আমি হলাম নষ্ট মানুষ।
ও বলে, জানি। যে মানুষটা কবি হতে পারতো অথচ নিজেকে নষ্ট করে দিলো তাকে দেখছি।
এই কথাটা আমাকে খুব আঘাত করেছিলো। আমি ওর সাথে কয়েকদিন কথা বলিনি। এইভাবে এতো বড় সত্য কথা বলার অধিকার কে তাকে দিয়েছে?

ট্রেনের টিকেট কাটলাম। আমার মেয়েটার নাম দিয়েছিলাম সুবর্ণা। ওর মায়ের নামের সাথে মিল রেখে। আজ ওকে দেখতে যাবো।
ট্রেনের বসার যায়গাটা একবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা। গদিটা কেউ খামচিয়ে ছিড়ে ছিড়ে খেয়েছে যেন। আমার সবকিছুতেই বিরক্ত লাগছে। সবুজ রঙ্গের আধাছিড়া গদি, সামনের মোছওয়ালা পরিপাটি লোকটা। এমনকি বাহিরের সবুজ গাছগুলোকেও। পকেট থেকে মেয়ের চিঠিটা বের করলাম। দুইটা লাইন লেখাঃ

" বাবা আমি সুবর্ণা বলছি। আমার মন আর শরীর দুইটাই খারাপ। তুমি আসবা?"

আমি পকেটে চিঠি রেখে বাহিরে তাকায় থাকি। আজকে অনেক অনেকদিন পর একটা অদ্ভূত ব্যাপার হচ্ছে। প্রতিদিন জীবনের হাতে লাথি খেতে খেতে আমি ভুলে গিয়েছিলাম এখনো আমি একজন মানুষ। কাঁদতে পারি। মেয়ের চিঠি একটু পর পর খুলে পড়ি।তারপর আবার বাহিরে তাকাই। আশেপাশে কত মানুষ। এর মাঝে নিজেকে গাছ মনে হয়। অপরাধী গাছ।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:১৩
৪টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×