অফ এনি পারপাসের জহির রায়হান বিষয়ক মিথ্যাচার
নব্বইয়ের শেষ দিকে আবেদ খান 'ঘটনার আড়ালে' নামে একটা অনুষ্ঠান করতেন বিটিভিতে। '৯৮ সালের মার্চে একটি এপিসোড ছিল 'একাত্তরের দুঃসহ স্মৃতি' নামে। বিভিন্ন ভুক্তভোগীর বয়ানে উঠে এসেছিল রাজাকার-আলবদরদের যুদ্ধকালীন নৃশংসতা। গোলাম আযমসহ জামাত নেতারা আবেদ খান ও অনুষ্ঠান সহযোগীদের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করে বসেন। তাদের দাবি ছিল তারা একাত্তরে মোটেও এ ধরণের কুকর্মে জড়িত ছিলেন না। উল্টো মতিউর রহমান নিজামী সদম্ভে প্রশ্ন তোলেন জহির রায়হানকে নিয়ে। স্বাধীনতার পর কেন তিনি নিখোজ হলেন! এবং তখন থেকেই জামাতসহ মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি সুকৌশলে একটা প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছিল জহির রায়হানকে নিয়ে। তাদের বক্তব্যের সার হচ্ছে ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবিদের হত্যার যে দায় রাজাকার-আলবদরদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়, সেটা আসলে আওয়ামী লিগের কাজ। জহির রায়হান নাকি একটা ডকুমেন্টারি বানিয়েছিলেন এবং আওয়ামী নেতাদের হুমকি দিয়েছিলেন যুদ্ধকালীন তাদের সব কুকীর্তি ফাস করে দেবেন।
এর আরেকটা সংস্করণ অফ এনি পারপাস নামের এক ব্লগার আমাদের জানালেন। জহির রায়হান ভারতীয় সেনাবাহিনীর লুটপাটের উপর '৭২ সালে নাকি একটা ডকুমেন্টারি বানিয়েছিলেন, সে কারণে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা 'র' তাকে গুম করে দেয়। শেখ মুজিবের এতে সায় ছিল। এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন বলে মুজিবকে 'বঙ্গবন্ধু' বলা উচিত হবে না বলে মন্তব্য তার। মজার ব্যাপার, উনি ডকুমেন্টারির নাম বলেছেন 'স্টপ জেনোসাইড'। তার মানে উনি জানেইনি না যে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী বাহিনীর নির্মম গণহত্যার ওপর তৈরি এই প্রামান্যচিত্রটি বিশ্বব্যাপী মাস্টারপিসের মর্যাদা পেয়েছে। মিস্টার 'ও.এ.পি', আপনার এই পোস্ট সামহোয়ারে এ জাতীয় শততম পোস্ট। একটু স্থিতিশীল অবস্থা থাকলেই আপনারা শহীদের সংখ্যা, বাকশাল, শেখ কামালের ব্যাংক ডাকাতি থেকে শুরু করে জহির রায়হান, জলিলের কারাদন্ড নিয়ে বিতর্কিত পোস্ট শুরু করেন। উদ্দেশ্য একটাই আমাদের গালিবাজ বানানো। কোনো ডায়নামিক নিক নিয়ে এসব পোস্ট দেয়া হয়নি কখনোই। আমরা আগে গালি দিতাম, এবার তথ্যপ্রমাণসহ আপনাদের এসব উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচারের ওয়ান্স এন্ড ফর অল জবাব দেব ঠিক করেছি।
তার আগে কিছু কথা বলে নেয়া দরকার। জহির রায়হান একইসঙ্গে ছিলেন শহীদুল্লাহ কায়সারের ছোটভাই। সেই শহীদুল্লাহ কায়সার যার 'সংসপ্তক' দেখে এখানকার টেকমোল্লা একজন স্বঘোষিত জনপ্রিয় ব্লগার তার বিরুদ্ধে ইসলামকে হেয় করার অভিযোগ এনেছিল। এবং প্রতিবাদে মুক্তিযুদ্ধ আসায় অবাক হয়েছিল। যেন জানেই না এই শহীদুল্লাহ কায়সারকে আর সব বুদ্ধিজীবিদের সঙ্গে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। ওই ব্লগার অজান্তেই শহীদুল্লাহ কায়সারের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ এনেছেন যে অভিযোগে তাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল আল-বদররা। ১৬ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে করে জহির রায়হান ঢাকা আসেন। তার সব উদ্বেগ নিখোজ বড় ভাইকে নিয়ে। এরপর তিনি বুদ্ধিজীবি হত্যা ও গণহত্যার তথ্য অনুসন্ধান এবং ঘাতকদের ধরার জন্য একটি কমিশন গঠন করেছিলেন। জহির রায়হান ছিলেন এই কমিটির চেয়ারম্যান, সদস্য সচিব ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের বাশারত আলী। প্রতিদিন শত শত স্বজনহারা মানুষ আসতেন এই কমিটির অফিসে। ঘাতক-দালাল নির্মুল কমিটির এই প্রাথমিক কমিশনটির সাফল্য ছিল কুখ্যাত জামাত নেতা ও আলবদর কমান্ডার আবদুল খালেক মজুমদারকে খুঁজে বের করে গ্রেপ্তার করা। শহীদুল্লাহ কায়সারকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন খালেক। হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণের অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার পরও মাত্র সাত বছর জেল খেটে বেরিয়ে যায় এই ঘাতক শিরোমনি।
দেশ স্বাধীন হয়ে গেলেও তখনো আত্মসমর্পন না করা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর একাংশ, রাজাকার আলবদররা ঠাই নিয়েছিল তখন দুর্গম মিরপুরের বিহারী পল্লীতে। স্বাধীন বাংলাদেশে মিরপুর তখনো মুক্ত হয়নি। ভারতীয় সেনাবাহিনী ঘিরে রেখেছিল চারপাশ থেকে। ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হাতে দায়িত্ব সঁপে দিয়ে সরে যায় তারা। সেদিনের সেই অভিযানে জোর করে সামিল হয়েছিলেন জহির রায়হান। জানা যায় মাস্তানা নামের এক বিহারী নৃত্যপরিচালক জহির রায়হানকে খবর দিয়েছিলেন যে শহীদুল্লাহ কায়সারসহ বেশ কজন বুদ্ধিজীবি মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনে বন্দী আছে। সরকারকে রাজী করিয়ে সেই অভিযানে অংশ নেয়া সৈনিকদের সঙ্গে ভিড়ে যান জহির রায়হান। তাকে পৌছে দিয়ে আসেন তার্ই চাচাত ভাই জামাত এবং এই ব্লগের অনেক ব্লগারের চক্ষুশূল শাহরিয়ার কবির। আর জীবিত ফেরেননি।
এরপর রহস্য উন্মোচিত হতে অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘ ২৮ বছর। এই সময়কালে সামরিক সরকারগুলোর আশীর্বাদপুষ্ট জামাত সমানে চালিয়ে গেছে তাদের প্রচারনা। একটি মিথ্যা ১০০ বার বললে সেটা সত্য হয়ে যায়, লোকে বিশ্বাস করে- গোয়েবলসের সূত্র মেনে জহির রায়হান অন্তর্ধান রহস্যকে রাজনৈতিক পুনর্বাসনে কাজে লাগাতে থাকে তারা। মানুষ বিশ্বাস করতে থাকে তাদের কথা। কিন্তু সত্যি চাপা থাকে না। আচমকাই মোড় ঘুরে যায় এই কাহিনীর।
১৯৯৯ সালের জুলাইয়ে মিরপুর ১২ নম্বরের নুরী মসজিদের সম্প্রসারণ কাজের সময় একটি স্ল্যাব দিয়ে ঢাকা কুপের সন্ধান পায় নির্মাণকর্মীরা। স্ল্যাব ভেঙে তারা আবিষ্কার করে তিনটি মাথার খুলি ও কিছু হাড়গোড়। প্রথম আলো নিউজটি ব্রেক করার পর বুদ্ধিজীবিদের স্বজনরা ছুটে আসেন। এভাবে আবিষ্কার হয় মুসলিম বাজার বধ্যভূমি। ভোরের কাগজের অনুসন্ধানী রিপোর্টার জুলফিকার আলি মানিক সেটা কাভার করছিলেন। একই সময় জহির রায়হানের ছেলে অনল রায়হানও তার বাবার অন্তর্ধান রহস্য ভেদে মরিয়া হয়ে মাঠে নেমেছেন। সূত্র খুজে খুজে মানিক পেয়ে গেলেন ৩০ জানুয়ারি যুদ্ধের একজন সৈনিক আমির হোসেনকে। তার কাছেই জানলেন নিজের চোখে জহির রায়হানকে বিহারী ও রাজাকারদের হাতে গুলিতে শহীদ হতে দেখেছেন তিনি। '৯৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর মানিকের প্রতিবেদন নিখোজ নন, গুলিতে শহীদ হয়েছিলেন জহির রায়হান সাড়া ফেলে দেয় সারা দেশে। একইবছর ১৩ আগস্ট সাপ্তাহিক ২০০০ এ (বর্ষ ২ সংখ্যা ১৪) অনল রায়হান তার বাবার মৃত্যুরহস্য নিয়ে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন লেখেন বাবার অস্থি'র সন্ধানে নামে।
এ দুটো লিংকের প্রতিবেদন দুটো পড়ার পর আশা করি এ নিয়ে কোনো ধরনের অপপ্রচারে কান দেবেন না কেউ। আগেই বলেছি, এটা ব্লগ অস্থিতিশীল করার জন্য স্বাধীনতা বিরোধীদের উত্তরসূরীদের ষড়যন্ত্র যা আমরা এখন ঘেন্না নিয়েই উপেক্ষা করি। এ ব্যাপারে স্টপ জেনোসাইড এবং জহির রায়হানের একটি যুদ্ধকালীন সাক্ষাতকারের ফুটেজ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আপাতত বিদায় নিচ্ছি।
পাকিস্তানীদের প্রপোগান্ডার বিরুদ্ধে জহির রায়হানের সাক্ষাতকার :
জহির রায়হানের মৃত্যুরহস্য নিয়ে জুলফিকার আলী মানিকের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন
বাবার মৃত্যুরহস্য নিয়ে অনল রায়হানের প্রতিবেদন
কৃতজ্ঞতা : জুলফিকার আলি মানিক (ডেইলি স্টার), মাহবুব রনি (বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম), বিপ্লব রহমান (বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম), জাহিদ রেজা নুর (প্রথম আলো), জন্মযুদ্ধ।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই আগস্ট, ২০০৯ সকাল ৮:৫৭