স্থানীয় সরকার নির্বাচন। আমি ও মা একসাথে বের হয়েছি ভোট চাইতে। আমার এক হাতে একটা বালতি। সেখানে আঠা ভর্তি। আরেক হাতে এক বান্ডিল পোষ্টার। প্রার্থীরা সারা রাত ভরে ক্যানভাস করে। কারণ দিনের বেলায় সকলে কাজে ব্যাস্ত থাকে। নিতান্ত গৃহিনী ছাড়া আর কারও দেখা পাওয়া সম্ভব হয় না দিনের বেলায়। তাই সকলের কাছে ভোট চাইবার বার্তা পৌছে দেবার জন্য রাতই উপযুক্ত সময়। নির্বাচনের এই সময়টা সাধারণ মানুষের রাত্রের ঘুমের বারোটা বাজিয়ে প্রার্থীরা তাদের দরজায় নক করে বলে, "বাড়ী আছেন নাকি?" মানুষ কিছু বলতেও পারে না। কারন এটাই রীতি। "পদ্মা নদীর মাঝি"র মত সেই বিনামূল্যে যাত্রী পারাপারের রীতি। বিরক্তি লাগলেও কিছু করার নাই।
আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। মনে সমাজতান্ত্রিক ভাব। বুঝতে চাই, দেখতে চাই, উপলব্ধি করতে চাই আমার চারপাশ। তাই সারারাত জেগে ঘুরি এ পাড়া হতে ও পাড়া, এক বাড়ী থেকে অন্য বাড়ী। মানুষের রাতের জীবনধারা কাছ থেকে দেখার কিছুটা সুবিধা হয়। আমার প্রধান কাজ যেখানেই খালি পাওয়া একটা পোষ্টার সেটে দেওয়া। পোষ্টার লাগানতে আমি তখন একজন অভিজ্ঞ ব্যাক্তি।
আমার পরনের প্যান্টটা ছিল স্কুল ড্রেসের। টানা এক মাস ওই প্যান্ট পরে কাজ করেছি। ময়লা আর আঠা লেগে প্যান্টটা এক অন্য রুপ ধারণ করেছিল। প্যান্টটাকে কেমন যেন মিলিটারী পোশাকের মত লাগত।
এলাকায় বেশীরভাগই গার্মেন্টস কর্মীদের বাস। কোন দিন রাত নাই এদের জীবনে। এক একটা রোবটীয় জীবন। যদি দিনের বেলা কাজ থাকে তাহলে রাত্রে ঘুমায়, যদি রাত্রে কাজ থাকে দিনে ঘুমায়। এরপরে আছে দিনমজুররা। এছাড়াও বিভিন্ন কলকারখানায় সুপারভাইজার বা এজাতীয় পদে কাজ করা লোকও অনেক। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা।
একদিন রাত এগারটা কি বারোটা বাজে। এক বাড়ীতে গেলাম আমি আর মা। বাড়ীটায় কিছু আধা পাকা ঘর, কিছু টিনের ছাপড়া। হঠাৎ একটা বাশের চাটাইয়ের বেড়ার ছাপড়া চোখে পড়ল। মা ছাপড়ার কাছে যেয়ে বললেন কেউ আছে নাকি? দরজা খুলে দিলেন এক মহিলা। ভেতরে দেখলাম এক লোক ঘুমাচ্ছে, একটা বাচ্চা মহিলার সাথে বসে ভাত খাচ্ছে।
লোকটার গায়ে একটা চাদর, শুয়ে আছে একটা পাটির উপর, মাথাটা মাফলার ঢাকা। বাচ্চাটা তার মায়ের চাদরের নীচে ছিল, আমাদের দেখে বের হয়ে আসল। একটা শার্ট গায়ে। শার্টের একটা বোতাম ছেড়া। মহিলা ভাত খাচ্ছেন শুধু আলুর তরকারী দিয়ে। হ্যা শুধু আলু আর কোন কিছু নাই। হয়তো তার আলুর ঝোল খেতে ইচ্ছে করছিল তাই তরকারির মতন করে রান্না করছেন, মাছ বা মাংস কিছুই তার সাথে নাই।
ভোট চাওয়া ভুলে গেলাম আমরা।
মা জিজ্ঞাসা করলেন, "কি করো গো তুমি?"
উত্তরে বলল, "আমি আর আমার জামাই দুইজনেই কামলা দেই"
ঘর ভাড়া কত দেও?
মাসে ছয়শো টাকা।
প্রতিদিন কত পাও?
প্রতিদিন কাম থাকে না। থাকলে পঞ্চাশ ষাইট টাকার মত হয়।
ঘর ভাড়া ঠিকমত দিতে পার?
গত মাসের ভাড়া বাকী পড়ছে, এই মাসে দিয়া দেব।
মাস চলে যা পাও কাজ কইরা?
এই তো আল্লায় রাখছে।
মানুষের জীবন অনেক সংগ্রামের। প্রতি মূহুর্তে মূহুর্তে তাকে টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে হয়। আমি একটু দূরে চলে গেলাম উনাদের কাছ থেকে। চোখ দিয়ে পানি আসতে ছিল। বেটা মানুষের নাকি আবার কাদতে নাই।
এত কষ্ট কেন মানুষগুলার। ওরা তো চুরি ডাকাতি করতে চায় না। কাজ চায় সামান্য কাজ। ওরা তো বলে না আমাকে একটা সূরম্য প্রাসাদ দাও থাকার জন্য, বিলাসী পোশাক দাও পরিধানের জন্য। সেই সকাল বেলা স্থানীয় বাজারে যেয়ে এরা বসে থাকে, যদি কেউ কাজের জন্য ডেকে নেয়। বেলা বাড়তে থাকে আর একদিনের কাজ করার সম্ভাবনা কমতে থাকে তাদের। কেউ যদি ঐদিন ডেকে না নেয় তাহলে ঐদিন তার চুলোয় হাড়ি চড়বে না। এত কঠিন কেন এই দিনমজুরদের জীবন? একবেলা খাদ্যের জন্যও তাদের ভাগ্যের উপর বসে থাকতে হয়, অথচ তাদের শরীরে শক্তি আছে, কাজ করার ইচ্ছা আছে। আমরা সবাই আসলে খুব গরীব।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জানুয়ারি, ২০১২ রাত ৩:৫৬