কিছু কিছু বট গাছ আছে যারা প্রাচীন। কিছু কিছু কৃষ্ণচূড়াও আছে যারা প্রাচীন। এবং কিছু কিছু লোকও আছে যারা প্রাচীন। তাদের গায়ের জামাটাও প্রাচীন, পায়ের শখের বাটা স্যান্ডেলটাও প্রাচীন।
রফিক ভাই একজন প্রাচীন লোক, তবে তার স্যান্ডেল বা গায়ের জামা প্রাচীন নয়, প্রাচীন তার চায়ের দোকানটা। আর হ্যা তার হাতের কেসিও ঘড়িটাও প্রাচীন। ঘড়িটার বেল্টে একটা ছোট্ট দুর্বল কম্পাসও আছে। তার চায়ের দোকানের টিনের কলসিটা অথবা পানির ড্রামটাও প্রাচীন।
একটা বানিজ্যিক এলাকায় রফিক ভাইয়ের চায়ের দোকান। দোকানটা বড় রাস্তার পাশে। প্রতিদিন এই রাস্তা দিয়ে প্রচুর মালবাহী ট্রাক যাওয়া আসা করে। ট্রাকের বড় চাকা আর তার মালের ভারে প্রতি বছরই রাস্তায় খানা খন্দের সৃষ্টি হয়। গরমের দিনে ট্রাকগুলো ধুলো উড়িয়ে রাস্তার পাশের দোকানগুলোতে বিশাল ধূসর আস্তরন বসিয়ে দেয়। আর বর্ষার দিনে রাস্তার পাশ দিয়ে চলাচলকারী, এমনকি রিক্সার যাত্রীদেরকেও বিনামূল্যে কাদা বিতরণ করে থাকে।
দুইটা বেঞ্চি ইংরেজী এল আকৃতিতে বসানো, চারটা বাঁশের খুটি, একচালা টিন, একটা কাটের চৌকি যার এক কোনায় গর্ত তৈরী করা হয়েছে মাটিতে পা দিয়ে দাঁড়াবার সুবিধার্থে, আর কিছু সেলফ, যেখানে কিছু বিস্কুটের কার্টনের জায়গা হয়েছে, এই নিয়ে ৩৬ বর্গফুটের একটি ছোট চায়ের দোকান। দুইটি বেঞ্চির একটি ষ্টীলের পাটাতন আর লোহার রডের পায়া দিয়ে তৈরী। অপরটি কাঠের পাটাতন দিয়ে তৈরী, কিন্তু এর চারটি পায়ার দুটির অস্তিত্ত্ব আছে আর বাকী দুটি পায়ার জায়গা দখল করেছে কিছু ইট। লোহার বেঞ্চিটি স্থানান্তরযোগ্য হলেও কাঠের বেঞ্চিটি তা নয়। রফিক ভাই দোকান বন্ধ করে বাসায় যাওয়ার সময় লোহার বেঞ্চিটিতে দোকানের একটি পায়ায় লোহার শিকল দিয়ে তালাবদ্ধ করে যায়। কারণ বানিজ্যিক এলাকার পরিস্থিতি কখনই ভাল হয় না আর লোহার কেজি ২২ টাকা। দোকানের ঝাপি ঢেউটিন আর চেরাই কাঠ দিয়ে তৈরী। ঝাপির সংখ্যা দুই এবং দুটি ঝাপিই মাঝামাঝি ভাজযোগ্য। এছাড়া আছে ছয়টি বড়সড় কাঁচের ডিব্বা যাতে সর্বনিম্ন আট আনা হতে সর্বোচ্চ এক টাকা দামের বিস্কুট ও লজেন্স রাখা হয়। পরবর্তীতে বিস্কুটের সর্বোচ্চমূল্য দুই টাকা পর্যন্ত পৌছায়। প্রতিদিন সকালে বেকারীর ভ্যান এসে নতুন বিস্কুট, রুটি দিয়ে যায়। রুটিগুলো ঝোলান হয় ইংরেজী এস আকৃতির লোহার শিকে, পলিথিনে করে। আরও আসে সিগারেটের গাড়ী। সিগারেটের গাড়ীগুলো হয় অটোরিক্সা বা টেম্পু আকৃতির। দোকানটার পানির ড্রাম আর কলসগুলোর মতন দুটি কেরোসিনের ষ্টোভ এবং তার উপর কাপড় দিয়ে হাতল বাধানো দুটি পানির কেতলিও রফিক ভাইয়ের মতই প্রাচীন। একটি কেতলিতে সবসময় চা সিদ্ধ হয় আর একটি শুধুমাত্র গরম পানি। এবং সবচেয়ে প্রাচীন ও অবহেলিত, যাকে আমরা ভাঙ্গা কুলা বলতে পারি তা হল একটি লাল কানা ভাঙ্গা প্লাষ্টিকের গামলা, যেখানে সবসময় কিছু কাপ পানিতে ডুবে থাকে। বহুদিনের ব্যাবহারে পানিতে ধুয়ে ধুয়ে গামলাটার রঙ এখন হালকা গোলাপী বর্ণ ধারণ করেছে।
রফিক ভাই তার দোকানটাকে খুব ভালবাসেন। কারণ এটাই তার রুজি রোজগারের একমাত্র অবলম্বন। তিনি এই বানিজ্যিক এলাকার আর দশজনের মত কোন গার্মেন্টসেও কাজ করতে পারতেন অথবা বেছে নিতে পারতেন অন্য কোন পেশা। কিন্তু নিয়তির পাতা জাল তাকে এই চায়ের দোকানে জড়িয়ে ফেলেছে। দিন যায়, দোকানের কাপগুলো ভাঙ্গতে থাকে, কিন্তু কেতলি ভাংগে না। দিন যায় গামলার রঙ গোলাপী থেকে ঈষৎ গোলাপী হতে থাকে কিন্তু গামলাটা বাতিল হয় না। দিন যায় ষ্টোভের সলতেগুলো বদলায় কিন্তু ষ্টোভের মূল কাঠামোতে আরো কালো আস্তরন পড়ে। দিন যায়, দোকানের ষাট ওয়াটের বাতিটা নষ্ট হয়, নতুন বাতি কেনা হয় কিন্তু দোকানদার রফিক ভাই বদলান না। তিনি চায়ের কাপে ঠুক ঠুক করে ছোট চামচটা দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে ঘনদুধ, কড়া কালো লিকার আর চিনি ঘুটতে থাকেন।
রফিক ভাই বিয়ে করেননি।
চলবে...............
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জানুয়ারি, ২০১২ রাত ২:২১