-আপনি ?
-জি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে এসেছি !
-কোন টা ?
-ঐ রক্তমাখা ছুরির মালিক খুজছেন !
কিছুটা সময় মনোযোগ দিয়ে সামনে দাড়ানো লোকটাকে দেখতে লাগলাম !! বিশেষত্বহীন চেহারা ! মাঝ বয়সী, লাল রংয়ের একটা শার্ট পরে এসেছে । মুখে এক গাদা বসন্তের দাগের মত গোটা গোটা দাগ ! চেহারাটা যততা না ভয়ংকর করার কথা তার থেকেই হাস্যকর লাগছে !
বললাম
-আপনারই যে ছুরি প্রমান কি ?
লোকটা বিস্তৃত হাসি মুখে বলল
-জি জনাব প্রমান আছে ! একটু বসে বলি ! অনেকক্ষন হেটে এসেছি ! একটু ক্লান্ত !
-জি বসুন !
একটু ফ্যান টা ছেড়ে দিবেন ?
-এসি চলছে ! ফ্যান কেন ছাড়ব ? আজব ?
লোকটা দাঁত বের কয়ে হেসে দিল ! লোকটার চেহারা যেমনই হোক না কেন দাঁত দেখলাম একেবারে পরিস্কার । যাকে বলে একেবারে ঝকঝকে ফঁকফঁকে ! পেপ্সুডেন্ট কিংবা ক্লোজআপের বিজ্ঞাপন করতে পারবে নিশ্চিত ! তবে লোকটা এখানে দেখে খানিকটা বিরক্ত হলাম ।
অনেক গুলো কাজ পরে আছে আর এর মাঝে এই লোক এসে হাজির !
কোথা থেকে এই সব ঝামেলা এসে হাজির হয় কে জানে ?
বিশেষ করে ঐ দিন রক্তমাখা ছুরির বিজ্ঞাপন টা দেওয়ার পর থেকেই ঝামেলা শুরু হয়েছে ! একেক দিন একেক মানুষ এসে হাজির হয় ! সবারই পুরস্কার ধান্দা !
লোকটাকে কেমন জানি নিশ্চিত মনে হচ্ছে ! এদিক ওদিক দেখছে তবে খুব বেশি সিরিয়াস বলে মনে হচ্ছে না ! কদিন ধরে যারা আসতে তাদের সাথে এই লোকের চরিত্র টা ঠিক মত যাচ্ছে না !
গত পরশুদিন আসলেন এক কোট টাই পরা কেতা দুরস্ত এক ভদ্রলোক ! মুখ টা গম্ভীর ! দেখলেই মনে হবে এই লোকের কাছে সকাল বিকাল খুন করা কোন ব্যাপার না ! আমি মনে করলাম ছুরিটা এবার যথা যোগ্য মালিকের কাছে পৌছেই যাবে কিন্ত লোকটা কেমন সব উল্টা পাল্টা উত্তর দিতে লাগলো ! দিতে পারলাম না ছুরিটা তাকে ! কি আর করা ?
রক্ত মাখা ছুরিটা প্রথম পাই প্রায় সপ্তাহ দুয়েক আগে ! রাতের টহল শেষে থানায় আসছিলাম, কি মনে হল রমনা পার্কের ভিতর একটু ঘুরতে মন চাইলো ! গাড়ি থামিয়ে একা একা হাটতে লাগলাম পার্কের পাকা রাস্তা ধরে ! খানিক্ষন হাটার পরেই একটা কিছু পায়ের সাথে বাড়ি খেল ! পাকা মেঝের উপর স্টিলের চামচ গড়িয়ে গেলে যেমন আওয়াজ হয় ঠিক তেমন আওয়াজ শুনতে পেলাম ! অন্ধকার ছিল তাই কিছু খুজে পেলাম না ! মোবাইলের লাইট জ্বালিয়ে খুজতে লাগলাম । একটু দুরেই পেলাম ছুরি টা ! প্রায় এক হাত মত লম্বা ছুরিটা, পুরোটাই ফলা, ছুরির বাট টা একটু ছোট ! আলোতে ছুরিটা চকচকে করছিল সম্পূর্ন ফলার অর্ধেকটা জুরে রক্ত লেগে আছে ! একেবারে তাজা রক্ত ! ছুরির বাটেও একটু রক্ত লেগে আছে !
আসেপাশে খোজ করে কোন মানুষ পেলাম না ! বা কোন মৃতদেহও পেলাম না ! ছুটিটা নিয়ে পড়লাম ঝামেলায় ! এভাবে অন্যের ছুরি তো আমরা আমাদের কাছে রেখে দিতে পারি না ! এমনিতেও আমাদের উপরে মানুষের অভিযোগের শেষ নাই তাই ঠিক করলাম যার ছুরি তাকে ফেরৎ দিবো ! তাই পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে দিলাম ! উপুযুক্ত প্রমান সহকারে ছুরি নিয়ে যান !
এক সপ্তাহ পরেও যখন কেউ কোন প্রকার যোগাযোগ করলো না তখন পুরস্কার ঘোষনা করলাম ! তখন থেকেই মানুষ আসা শুরু ! মানুষ পারেও বটে !
লোকটা খানিকটা শান্ত হলে বললাম
-আপনার নাম কি ?
-ওবাইদুল করিম !
-আচ্ছা ! তো আপনি বলতে চান ছুরি টা আপনার ?
-জি !
-কোন প্রমান আছে ?
-জি আছে ?
-ছুরিটির বর্ণনা দিন !
লোকটা কিছুক্ষন ভাবলো ! তারপর বলল
-ছুরি টি প্রায় এক হাতের মত লম্বা । বাট টি একেবারেই ছোট ! ধরতে না ধরতে শেষ হয়ে যায় ! এবং
-এবং ?
-এবং ছুরিটি আমার খুব প্রিয় ! আমার প্রথম পছন্দ ! ঐ টা ছাড়া আমি কোন কাজই করতে পারি না !
তারপর ও. করিম আরও কিছু কথা বলতে লাগলেন ছুটির সম্পর্কে ! কথা শুনে আমার মনে হয় যে ছুরিটি আসলেই ওনারই ! তা না হলে এতো পরিস্কার ভাবে বর্ণনা দেওয়া সম্ভব না !
রক্ত মাখা ছুরিটার রক্ত শুকিয়ে অনেকটাই কালচে হয়ে গেছে ! ছুরিটা ও. করিম কে ফেরৎ দিতেই তিনি নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না ! আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়লেন ! যেন কত দিন পরে তার তার হারানো সন্তান কে ফিরে পেয়েছেন ! কেঁদে কেটে একেবারে একাকার অবস্থা !
যখন শান্ত হলেন তখন আমার দিকে তাকিয়ে বললেন
-পুলিশ আসলেই জনগনের বন্ধু ! আপনি জানেন না কি উপকার করলেন আমার !
আমি একটু অপ্রস্তুত হলাম ! আসলে মানুষের কাছ থেকে এরকম কথা শুনে অভ্যাস নেই তো ! ও. করিম আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-কদিন থেকে ঠিক মত খেতেও পারছিলাম না ! আজকে এই টা না পেলে কি যে হত !
আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না করিম সাহেব কি বলতে চাইছেন ! ছুরির না পাওয়ার সাথে, না খেয়ে থাকার কি সম্পর্ক ! আমি বললাম
-খেতে পারছিলেন না ! ঠিক বুঝলাম না ?
করিম সাহেব অবাক হয়ে বললেন
-আশ্চর্য যদি মাংস না কাটতে পারি তাহলে খাবো কি বলেন ! আমার আবার যে কোন ছুরি দিয়ে মাংস কারা হয় না ! বুঝেনই তো ! অভ্যাস আর কি ?
আমি ক্ষীন কন্ঠে বললাম
-কিসের মাংস ?
-আশ্চর্য ? মানুষের ! এতো সুন্দর ছুরি দিয়ে কেউ গরু ছাগলের মাংস কাটে নাকি ?
-মানুষের !!!
করিম সাহেব আমার দিকে বেশ কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বললেন
-আশ্চর্য ? আপনি এতো অবাক কেন হচ্ছেন ? ঐ দিন যে ছুরিতে রক্ত লেগে থাতে দেখলেন তা কি সের রক্ত মনে হয় আপনার ? নিশ্চই মানুষের মনে হয়েছে ! আসলের মানুষের রক্তের ভিতরে একটা আলাদা লাল ভাব আছে যা অন্য কোন প্রানীর রক্তের ভিতরে নেই ঠিক তেমনি মানুষের মাংসের ভিতরে একটা আলাদা স্বাদ আছে যা অন্য কোন প্রানীর ভিতরে নেই !
-ও ! বুঝলাম !
-আসলে এই ছুরিটা দিয়ে মাংস কাটতে খুব বেশি মজা ! তাছাড়া অন্য কোন ছুরি দিয়ে মাংস কাটার কথা আমি ভাবতেও পারি না ! জানেন ঐ দিন সবে মাত্র ঐ ছোকড়াটার মাথাটা আলাদা করে ছুরি টা পাশে রেখেছি, ডান হাতটা আগে কাটবো নাকি বা হাতটা আগে এটা ভাবছি, কোথা থেকে একা কুকুর এসে হাজির আমার উঠানের উপর ! আমার পাশ থেকে ছুরি টা মুখে নিয়েই দৌড় ! আমি কত দৌড়ালাম কিন্তু কিছুতেই পিছ পেলাম না ! বয়স হয়েছে তো !!
-কোন ছেলেটা ?
-আমার বাসায় যে কাজ করতো ? বোঝেনই তো আগের মত আর পেরে উঠি না ! ভাল লাগে না এতো খোজা খুজি করতে ! লোক ঠিক করা আছে ! সে আমাকে প্রতি সপ্তাহে ছেলে এনে দেয় ! এক সপ্তাহ কাজ চলে যায় !
-ও আচ্ছা ! তা কেউ খোজ করে না তাদের ?
আমার কথা শুনে ওবাইদুল করিম হো হো করে হেসে ফেলল ! বলল
-আরে ওদের কে দেখার কেউ নেই ! ঠিক মত খেতে পায় না ! বাব মা কেবল জন্ম দিয়ে ছেড়ে দিয়ে গেছে ! আছে না কত এতিম !
-তাই বলে খেয়ে ফেলবেন ?
অদ্ভুদ ভাবে হাসলো ! এমন ভাবেই হাসলো যে আমার বুকের ভেতর টা কেঁপে উঠলো ! হাসতে হাসতেই ওবাইদুল করিম বলল
-আমি তেমন কোন অপরাধ করছি না ! এরা সবাই জীবনে বেঁচে থাকার নূন্যতম সুবিধা টুকুও পায় না ! বেঁচে থাকা টা আর না থাকা এদের কাছে কোন পার্থক্য নেই ! বুঝছেন ! একদিন থেকে বললে আমি সমাজের উপরকারই করছি ! তার উপর বড় হয়ে এরাই যত সব অসামাজিক কাজে অন্যায় কাজে লিপ্ত হবে ! এর থেকে মরে যাওয়াই ভাল ! তাই না ?
-হুম ! ঠিক বলেছেন !
-আচ্ছা ! একদিন আসবেন আমার বাসায় ! আপনাকে রান্না করে খাওয়াবো ! অবশ্য কাচাও মজা খেয়ে! তবে আপনার পেটে সহ্য হবে না ! রান্না করেই খাওয়াবো !
-না না ঠিক আছে !
-আরে কি বলেন ঠিক আছে ! আপনি আমার এতো বড় উপরকার করলেন আর বিনিময়ে আমি কি এতটুকু করতে পারব না ? অবশ্যই পারবো ! আপনার আগামী শক্রবার আমার বাসায় দাওয়াত ! একেবারে ফ্রেস মাংস খাওয়াবো কথা দিলাম !
ওবাইদুল করিম আমার কাছ থেকে কথা নিয়েই তার পরে গেলেন ! যাওয়ার সময় আমার সাথে কোলাকুলিও করে গেলেন ! এমন কি পুরস্কারের টাকা টুকুও নিলেন না !
কি কবরো ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না ! যাবো নাকি সামনের শুক্রবারে ! হাজার হলেও ওবাইদুল করিম অনেক করে বলে গেলেন ! একবার কি টেস্ট করে আসবো নাকি ?
আবার না গেলে ওবাইদুল করিম মনে কষ্ট পেতে পারে ! হাজার হোক আমরা জনগনের বন্ধু ! বন্ধু হয়ে বন্ধুর মনে কষ্ট দেই কি করে !
প্রিয় ব্লগার প্রোফেসর শঙ্কুর ১১টা থিমের ভিতর এইটা থিম নম্বর আট । দেখি সামনে কোনটা লেখা যায় ।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মে, ২০১৪ রাত ১২:৩৩