কাল রাত তিনটায়... মাত্র শুয়েছি চোখটা ধরে এসেছে সাথে সাথে ফোন বেজে উঠল
ফোন রিসিভ করার পর ওপাশ থেকে কেউ বলে উঠলো
-আপনি মিথিলা বলছেন???
নাম্বার টা আরেকবার দেখলাম ! পরিচিত কোন নাম্বার না ! রাত তিনটার সময়ে যদি অপরিচিত কেউ ফোনে বলে আপনে মিথিলা বলছেন তাহলে কেমন লাগার কথা ? মেজাজ খানিকটা গরম হলেও আমি বললাম
-আপনি কে?
অপর প্রান্ত থেকে আওয়াজ এল
-আমি আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী ... আপনি কি কাল বাসা থেকে বের হবেন??? যদি বের হন তাহলে একটু সাবধানে থাকবেন !
আমার শুভাকাঙ্ক্ষী ? রাইত তিনটার সময় আমারে ফোন দিয়া কয় সাবধানে থাকবেন ? ফাইজলামীর একটা সীমা থাকা উচিৎ ! এমনিতেও ঘুমে চোখ লেগে আসতেছে আর এই রাত বিরাতে এই লোক আমার সাথে ফাইজলামি করে !
বেটাকে একটা ধমক দেওয়ার ইচ্ছা টা দমন করে বললাম
-কেন ?
শুভাকাঙ্ক্ষী বলল
-এই না মানে রাস্তা ঘাটে তো পদে পদেই বিপদ..
মেজাজ টা আসলেই খারাপ হল ! বেটাকে একটা জোড়ে ধমক দেওয়ার প্রস্তুতি নিলাম । বেটা রাত তিন টার সময় আমাকে ফোন দিয়ে কয় রাস্তা ঘাটে কত প্রকার বিপদই না থাকে ! বেটা তোর কাছ থেকে আমাকে শুনতে হবে ! আমি কিছু বলতে যাবো তখনই সে বলল
-আর কিছুদিন ধরে একটা ছেলে আপনাকে ফলো করছে...
-ফলো ?
-জি ?
-আপনি কিভাবে জানেন ?
-আমি জানি ! এই জন্য তো বললাম !
-তা আমার নাম্বার কোথা থেকে পেয়েছেন ?
-পেয়েছি !
-কোথা থেকে ?
-জানবেন ? এতো তাড়াহুড়া কেন ?
-আশ্চার্য আপনি আমাকে রাত তিনটার সময় ফোন দিয়ে বলছেন আমি সাবধানে থাকবেন তারপর বলছেন না আমার নাম্বার কোথা থেকে পেয়েছেন ! কে সেটাও বলছেন না ! মানে কি ?
ওপাশ থেকে কন্ঠ টা হেসে উঠলো ! হাসতে হাসতেই বলল
-মিথিলা আপনি ঘুমান ! কাল সকালে আপনার ক্লাস আছে না ! ঘুমান ! গুড নাইট !
আমাকে আর কিছু না বলার সুযোগ দিয়ে লাইন টা কেটে গেল !
সকাল বেলা বের হতে যবো মা ডেকে বলল
-কখন আসবি ?
-মা ! ক্লাস শেষেই আসবো !
-আচ্ছা !
আমি একটু অবাকই হলাম ! এমন তো হয় না ! প্রতিদিন মা তো আরও অনেক প্রশ্ন করে ! বলে ক্লাস শেষ করে আমি যেন সরাসরি বাসায় আসি । অন্য কোন দিকে যেন না যাই ! বেশি যেন ঘোরাঘুরি না করি ! কিন্তু আজকে তেমন কিছুই জানতে চাইলো না !
বরং আমার দিকে এসে বলল
-কপালে টিপ দিস না কেন ?
আমি একটু অবাক হয়ে বললাম
-কি !
তারপর আমাকে অবাক করে দিয়ে নিজের হাতে আমার কপালে টিপ পরিয়ে দিল ! তারপর বলল
-এই তো ! এখন কত সুন্দর লাগছে !
মায়ের মুখে হাসি দেখে কেমন যেন একটা সন্দেহ জাগলো ! কোন একটা সমস্যা নিশ্চই আছে ! আচ্ছা গতকালকের ফোন কলটার সাথে আজকে আম্মুর এই হাসিটার কি কোন সম্পর্ক আছে ?
কে জানে ? আমি অতো কিছু চিন্তা না করে বের হয়ে এলাম বাসা হয়ে এলাম !
####
-নাজিম ! দেখ ঐ লোকটা অনেকক্ষন ধরে আমার পিছু লেগে আছে !
একবার মনে হল নাজিম কে কথটা বলা ঠিক হবে না ! ওর মাথা এমনিতেই একটু গরম ! শুনলে কি করবে কে জানে ? কিন্তু লোকটা কয়েকদিন ধরেই আমার পিছু লেগেছে । আমি যেখানেই যাই সেখানেই আমার পিছু পিছে গিয়ে হাজির হয় ! আমি কিছু বলতে পারি না ! সে দিনের রাতেই ফোনকলের পর থেকেই এমন টা হয়েছে !
কিছু বলতে পারছিলাম না কারন ছেলেটা আমার কাছে কখন আসে না । কেবল দুর থেকেই আমাকে ফলো করে ! অসশ্য লোকটার চেহারা দেখেও মনে হয় না কোন খারাপ উদ্দেশ্য আছে তবে সারাক্ষন পেছনে লেগে থাকা টা কেমন অস্বস্তিকর লাগছে !
নাজিমের পাশে লিটা ছিল ! আমার মুখের কথাটা কেড়ে নিয়ে বলল
-কোন লোকটা রে ?
-ঐ যে কালো শার্ট পরে আছে !
নাজিম আর লিটা দুজনেই দেখলো তাকিয়ে !
নাজিম বলল
-চল একটা ধোলাই দিয়ে আসি !
লিটা তো এক পায়ে রাজি !
আমার কোন কথা না শুনে দুজনেই উঠে দাড়ালো ! আজকে লোকটা কপালে খারাবীই আছে !
নাজিম লোকটার সামনে গিয়ে বলল
-এই মিয়া সমস্যা কি আপনার ?
লোকটা খানিকতা ইতস্তত করে বলল
-জি মানে ?
-মানে পিছু নিয়েছেন কেন ?
-কার পিছু ?
-এখন ভাজা মাছ টা উল্টে খেতে পারেন না, না ? ফাইজলামো পাইছেন ! মেয়েদের পিছু করা ! তাই না ?
আমি দেখলাম লোকটা আমার দিকে কেমন একটা অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো ! কিছু হয় তো সাহায্যের আশায় ! লোকটার চোখের ভিতর কেমন একটা আকুলত ছিল ! লোকটা যেন আমাকে বলতে চাইছিল যে মিথিলা আমি কি তোমার কোন ক্ষতি করেছি কিংবা করতে চেয়েছি বল ? তাহলে এমন টা কেন করছো ?
ততক্ষনে চারিপাশে লোকজন জমে গেছে ! সবাই নাজিমের পক্ষে নিয়েই কথা বলছে ! আমার কেন জানি অস্বস্তি লাগছে । বিশেষ করে লোকটা চোখের দিকে তাকানোর পর থেকে ! কিছু একটা ছিল সেই চোখের দৃষ্টিতে তে ! কোন রকমে ওদের দুজনকে বের করে নিয়ে আসলাম ওখান থেকে ! নাজিমের তো তখনও রাগ যায় না ! বলল যে বেটা কে একটা ধোলাই না দিলে মনে শান্তি পাবে না !
বাসা এসে আসল ঘটনা জানতে পারলাম ! মা তো আমার উপর ক্ষেপা ! আম্মা যা বলল লোকটার নাম ফয়সাল আহমেদ ! মা কোন এক পরিচিতে ছোট ভাই ! গত মাসে কোথায় যেন আমাকে দেখেছে তার পছন্দ হয়েছে ! ঐ দিন রাতে সেই লোকই আমাকে ফোন দিয়েছিল ! নাম্বার টা মায়ের কাছ থেকেই নিয়েছিল ! এখন পারিবারিক বিয়ের কথা বলার আগে আমার সাথে কিছু কথা বলতে চায় । এবং এই জন্য নাকি আমার পিছু নিয়েছিল ! বলতে সাহস পায় নি ! আমার মনটা একটু বিষন্ন হল ! সাথে সাথে লোকটার উপর একটু মেজাজ গরম হল ! বেটা কথা বলবি সরাসরিই বল ! এরকম পিছু নেওয়ার দরকার কি ? বদ লোক !
তবুও মন টা বিষন্ন হয়েই রইলো ! বিশেষ করে লোকটা ঐ চোখের দৃষ্টি কিছুতেই ভুলতে পারছিলাম না ! সারাটা বিকেল কাটলো বিষন্নতায় ! বিষন্নতা টা আরও একটু বাড়লো সন্ধ্যার বৃষ্টি টা ! বারান্দায় দাড়িয়ে বৃষ্টিতে দেখছি তখন লোকটা ফোন এল !
কি কথা বলবো, কেমন করে বলবো এটা ভাবতে ভাবতেই প্রথম কল টা ধরতে পারলাম না ! একটু পরে আবার বেজে উঠলো !
এবার দেরি না করে ধরলাম ।
কোন কথা নেই প্রথমে ! দুজনেই চুপ ! ওপাশ থেকে পরিস্কার বৃষ্টির আওয়াজ পাচ্ছিলাম !
ফয়সাল সাহেবই প্রথমে কথা বলল
-বৃষ্টি দেখছেন ?
-হুম !
-বৃষ্টি পছন্দ আপনার ?
-হুম !
-আমারও ! বৃষ্টি হলেই আমি বৃষ্টিতে ভিজি !
আমি ক্ষীণ কন্ঠে বললাম
-আপনি কি এখন বৃষ্টিতে ভিজছেন ?
-হুম ! বৃষ্টিতে ভিজছি ! আপনি ভিজবেন ?
-হুম ? কি বললেন ?
কিছুক্ষন নিরবতা ! তারপর লোকটা বলল
-আপনি তো আপনাদের ডান দিক কার বারান্দার দাড়িয়ে বৃষ্টি দেখছেন, তাই না ?
-হুম ! কেন ?
-সোজা তাকান ! ল্যাম্প পোস্টের ডান দিকে ! কিছু দেখা যাচ্ছে !
আমার চোখ বেশ পরিস্কার ! আমি অবাক হয়ে দেখালম ল্যাম্প পোস্ট থেকে প্রায় আট দশ হাত দুরে একজন দাড়িয়া আছে ঝুম বৃষ্টির মধ্যে ! হাতটা কানের কাছে ধরা ! যদিও খানিকটা অন্ধকার তবুও তাকে চিনতে আমার বিন্দু মাত্র কষ্ট হল না !
আমি ঠিক বলতে পারবো না আমার ভিতরে হঠাৎ করেই কি হল ! আমি ফোন টা আপনা আপনি রেখে দিলাম ! তারপর সোজা আমাদের বাইরে বের হয়ে এলাম ! গেটের দারোয়ান আমার দিকে খনিকক্ষন অদ্ভুদ চোখে তাকিয়ে থেকে গেট খুলে দিল !
আমি বৃষ্টির ভিতরে নেমে এলাম ! ঠান্ডা বাতাস টুকু প্রথম শরীরে কাঁপন ধরালেও পরে সয়ে গেল মুহুর্তেই ! আমি ডান দিককার ল্যাম্প পোস্টের দিকে গিয়ে দেখি ফাজিল ছেলেটা এখনও সেখানেই দাড়িয়ে আছে ! আবছায়া আলোতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । চোখে সেই অদ্ভুদ দৃষ্টি আর মুখে এক আনন্দের এক টুকরো হাসি নিয়ে ! যেন ও জানতোই আমি বৃষ্টির ভিতর নেমে আসবো !
আসলেই কি জানতো ?
আমি জানি না ! আমি অবশ্য জানতে চাইও না !