আরেকবার হতাশ হয়ে এদিক ওদিক ওদিক তাকালাম ! এই নিয়ে মোট তিনবার আমি একই গলির ভিতরে যাওয়া আসা করতেছি ! পুরানো ঢাকার সব গলি গুলো দেখতে একই রকম কেন ?
এখন কি করি ?
গত দুই সপ্তাহ হয় আমরা এখানে এসেছি থাকার জন্য ! এখনও আমি ঠিক মত রাস্তা চিনতে পারলাম না ! সব কিছু ঠিক আছে কিন্তু এই রাস্তা আমি কিছুতেই চিনতে পারছি না ! এদিক দিয়ে যাওয়ার কথা আমি যাই অন্য দিক দিয়ে !
আমি হতাশ হয়ে চিপা গলির মাঝ খানে দাড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষন ! মাকে ফোন দিবো কি না বুঝতে পারছি না ! অবশ্য মাকে ফোন দিয়েও লাভ নেই ! মা এই সময় আমাকে নিতে আসতে পারবে না ! আব্বা এখন অফিসে !
এখন ?
আব্বা আসা পর্যন্ত আমি এখানে বসে দাড়িয়ে থাকবো ?
ভাবছি কি করবো তখনই বাড়িওয়ালার ভাতিজিকে দেখতে পেলাম ! নীল রংয়ের একটা সেলোয়ার কামিজ পরে এদিকেই হেটে আসছে !
ঠিক বুঝতে পারলাম না আমি তার সাথে কথা বলবো কি না নাকি কেবল তার পেছন পেছন যাবো ?
পেছন পেছন যাওয়াটা কেমন দেখায় ! ঠিক করলাম মেয়েটার সাথে কথা বলা যাক ! কিন্তু আমি কথা বলার আগেই মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-রাস্তা খুজে পাচ্ছেন না ?
আমি বোকার মত হেসে বললাম
-হুম !
-সব গলিই এক রকম মনে হয় তাই না ?
-হুম !
-গত দিনও আপনাকে এদিক ওদিক হাটতে দেখেছি !
এই বলে মেয়েটি হাসতে লাগলো ! বেশ চমৎকার হাসি !
-আসুন আামর সাথে !
পুরান ঢাকার মেয়েরা ঠিক যেমন হয় এই মেয়েটি ঠিক তেমন না ! এবং সব থেকে বড় কথা মেয়েটি পুরান ঢাকার মত কথা বলে না ! অবশ্য মেয়েদের মুখে পুরানো ঢাকার কথা শুনতে বেশ মজাই লাগে ! এখানে আসার পর থেকে বেশ আসে পাশে শুনছি !
হাটতে হাটতে মেয়েটি বলল
-আপনি ঢাবি তে পড়েন, তাই না ?
-হুম !
-তা হঠাৎ এই পুরান ঢাকায় থাকতে এলেন যে ?
-আসলে আমি ঠিক জানি না ! আমার আব্বার সাথে আপনার চাচার কোন একটা চুক্তি হয়েছে মনে হয় ! সেই জন্যই আমরা এখানে থাকতে এসেছি !
-হুম ! তাই হবে হয় তো !
মেয়েটি বলল
-এই দেখুন ! লাল বিল্ডিংটা ! এখান থেকে বায়ে মোড় নিবেন ! মনে থাকবে ?
-হুম !
হাটতে হাটতে চলে এলাম !
এমনিতে এলাকাটা বেশ ভাল ! তবে সব কিছুই পুরানো ! ঘর বাড়ি রাস্তা সব কিছু ! প্রথম যখন এলাম তখন মনে হচ্ছিল এখানে থাকতেই পারবো না কিন্তু এই দুই সপ্তাহে বেশ মানিয়ে নিয়েছি !
ক্লাসে যাই ! বিকেল বেলা হলে ছাদে উঠি ! চারিপাশের মানুষ দেখি ! এই ভাবেই সময় কেটে যায় !
পরদিন ঠিক একই ভাবেই আমি রাস্তা হারিয়ে ফেললাম ! এবং বাড়িয়ালার ভাতিজি এসে আবার আমাকে উদ্ধার করলো ! টুকটাক কথা বলতে বলতে বলতে জনাতে পারলাম মেয়েটির নাম আলিয়া ! আমাদের বাড়িয়ালার বড় ভাইয়ের একমাত্র মেয়ে ! তবে মেয়েটিকে দেখে ঠিক পুরান ঢাকার মেয়েদের মত মনে হয় না ! মানে কথা বার্তা চাল চলন কোন কিছুই না যেন !
পরের দিন রাস্তা মনে থাকলেও আমি ইচ্ছা করেই দাড়িয়ে থাকলাম বেশ কিছুক্ষন ! কিন্তু আলিয়ার দেখা নেই ! যখন মনে হল আলিয়া আর আজকে আসবে না তখন আমি নিজেই বাসায় চলে এলাম ! যদিও মনে মনে ইচ্ছা করছিল মেয়েটির সাথে একটু কথা বলি কিন্তু কিছু করার নেই !
সিড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে অবশ্য আলিয়ার সাথে দেখা হয়ে গেল ! দুতলার সিড়িটা ঠিক ওদের একটা রুমের ভিতর দিয়ে ! উঠতে গিয়ে ওদের ঘরের অনেক কিছুই দেখা হয়ে যায় !
আলিয়া মনে হয় তখন সবে মাত্র গোসল করে বের হয়েছে ! মাথায় তখনও তোয়ালে জড়ানো ! চেহারায় একটা অন্য রকম সিগ্ধতা জড়ানো রয়েছে ! আমি খানিকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম আলিয়ার দিকে !
আমাকে আলিয়া কেবল একটু হেসে ভেতরে চলে গেল !
আমার আলিয়ার সাথে কথা বলার আগ্রটা আরও একটু বেড়ে গেল ! বারবার উপরে নিচে করতে লাগলাম এই আশায় যে আলিয়ার সাথে দেখা হবে ! দু একটা কথা হবে ! কিন্তু আলিয়া সাথে একটা বারের জন্যও দেখা হল না ! মনের ভিতরে একটা হা হুতাস চলতেই লাগলো !
আলিয়ার সাথে দেখা হল পরদিন বিকেল বেলা ! ছাদের ! আমি হাওয়া খেতে উঠেছি, আসেপাশের ছাদের ওঠা মানুষ গুলোকে দেখছি কেউ কেউ এক ছাদ থেকে অন্য ছাদে টাংকি মারছে !
একটা আমার পাশের ছাদেই দেখলাম একটা মেয়ে লম্বা চুলের একটা ছেলের সাথে হাসাহাসি করছে ! আমি কিছুক্ষন হাসাহাসি দেখলাম ! ঠিক তখনই আলিয়ার কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম !
-আপনি এই সময় ছাদে আসেন ?
-আপনি ?
আলিয়া কে একটু শান্তি পেলাম ! যাক মেয়েটা নিজ থেকেই তাহলে কথা বলতে এসেছে !
-হ্যা ! আসি ! এখানে এখনও কোন বন্ধু হয়ে ওঠে নি তো তাই !
-আপনার এদের সাথে জমবে না !
-হুম ! আমারও তাই মনে হচ্ছে ! জমবে না ! তবে ...।
-তবে ?
আলিয়া আমার দিকে তাকালো ! আমি কথা টা বলতে গিয়েও বললাম না ! আমি আসলে বলতে চেয়েছিলাম যে ওদের সাথে না জমলেও আপনার সাথে জমতে পারবে !
কিন্তু এই কথা চাইলেই তো আর বলা যায় না ! আমি আলিয়া কে বললাম
-আচ্ছা আপনাকে দেখে ঠিক মনে হয় না যে আপনি এখানে বড় হয়েছেন !
-হুম ! ছোট বেলা থেকে আমি এখানে ছিলাম না !
-কোথায় ছিলেন ?
-আমি সিলেটে বড় হয়েছি ! আমার বাবাও ওখানে থাকে ! ইন্টার পাশের পরে এখানে এসেছি !
-তাই নাকি ?
-হুম !
-তা হঠাৎ এখানে ?
এই কথাটার উত্তর দিতে গিয়ে আলিয়া দিল না ! কিছু একটা ভাবলো যেন ! তারপর বলল
-লম্বা ইতিহাস !
দেখলাম আলিয়ার মুড অফ হয়েগেল ! ঠিক বুঝলাম ! আলিয়া আর কথা না বলে নিচে নেমে গেল !
সঠিক কারন টা কিছুতেই বুঝতে পারলাম না ! এমন কি জিজ্ঞাসা করলাম ?
এভাবেই দিন যেতে লাগলো ! মেয়েটির সাথে ঠিক মত কথা বলে শান্তি পাচ্ছিলাম না ! বারবার মনে হচ্ছিল আলিয়া কিছু যেন একটা লুকাচ্ছে কিংবা বলতে চাইছে না ! আর আমাদের মাঝে এমন কোন সম্পর্ক গড়ে ওঠে নি যে আমি ওকে জোর করবো !
কিন্তু এদিক দিয়ে মেয়েটার সাথে কথা বলার জন্য সারাটা দিন আমি অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে থাকি ! বুঝতে দেরি হল না যে আমি আলিয়া কে আমার ভাল লাগতে শুরু করেছে !
একদিন অনেক দ্বিধা নিয়ে আলিয়া কথা টা বলতেই আলিয়া আমার দিকে খানিকটা সময় অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো ! তারপর আমাকে কিছু না বলে চলে গেল ! বলতে গেলে আমাকে একেবারে এড়িয়ে চলা শুরু করলো ! আমি যেদিকে যাই মেয়েটা যায় অন্য দিকে ! আমাকে যেন চেনেই না এমন একটা ভাব !
একদিন বিকেলে আবার ওকে ধরলাম !
-আপনি আমাকে পছন্দ করেন না ?
-হঠাৎ এই কথা কেন ?
-তাহলে ?
আলিয়া আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল
-তাহলে কি........ মানে ?
-তাহলে কেন আমাকে এভোয়েড করছেন ?
-দেখুন ! আপনি আমার এমন কেউ না যে সব সময় আপনার সাথে আমার কথা বলতে হবে !
কথা সত্য ! এমন কোন সম্পর্ক আসলেই আলিয়ার সাথে আমার সম্পর্ক হয়য় নি ! এই কথা বলার অধিকার আমার নেই ! আমি নিজের ভুল বুঝতে পেরে বললাম
-ও ! তা অবশ্য ঠিক ! আই এম সরি !
আমি আর কথা বাড়ালাম না ! চলে আসতে চাইলাম ! খানিকটা অপমানিত মনে হইলো ! আলিয়া বলল
-দেখুন আমি ঐ টা মিন করি নি !
-তাহলে ? আপনার আমার পছন্দ না এটা বললেই হয় !
-সেইটা না ! আসলে ....... আসলে...।
-কি আসলে ?
আলিয়া বেশ কিছুটা সময় ইতস্তর করলো কথাটা বলল
-আসলে আমি বিবাহিত !
আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম ! মেয়ে বলে কি ?
বিবাহিত !
বিবাহিত ! সিরিয়াস লি ?
আলিয়া বলল
-আপনাকে বলেছিলাম না আমি এখানে বড় হইনি ! আমি সিলেতে বড় হয়েছি ! আসলে !
-আসলে ?
-আসলে এটা নিয়ে আমাদের পরিবারের অনেক ধামেলা হচ্ছে ! এই জন্যই আমাকে এখানে পাঠানো হয়েছে ! আমি এই জন্য এখানে আছি ! আমার এখানে থাকতে ভাল লাগে না ! বুঝেছেন !
আলিয়া এই কথা বলে নিচে নেমে গেল !
তখনও বাইরের সন্ধ্যা নামে নি ! আমি আর কিছু বলতে পারলাম না ! কেন জানি সুন্দর এই বিকাল টা বড় বিষন্ন মনে হল ! কিছু একটা ফাঁকা ফাঁকা মনে হল ! নিচে নামতে যাবো ঠিক তখনই পাশের ছাদের কেউ আমার দিকে লক্ষ্য করে কিছু একটা বলল !
অন্য মনস্ক ছিলাম বলে ঠিক মত শুনতে পেলাম না ! তাকিয়ে দেখি পাশের ছাদের সেই মেয়েটি ! সেদিন চুল লম্বা ছেলেটার সাথে হাসাহাসি করছিল !
আমি বললাম
-কি বললেন ?
মেয়েটি একটা হাসি দিয়ে বলল
-ও ! কিছু হুনেন নাই ! ভালা ! কম কম হুনবেন ! তাইলেই হইবো !
এই বলে মেয়েটি হাসতেই থাকলো !
আমিও অবাক হয়ে মেয়েটির হাসি দেখতে লাগলাম !
আশ্চর্য !