somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ আর্থ সেভেন্টিন

৩১ শে আগস্ট, ২০১৮ দুপুর ২:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :





টিউশনি থেকে প্রতিদিন ফেরার সময় একটা ক্লান্তি এসে জমা হয়। কিছুতেই সাইকেল চালাতে ইচ্ছে করে না। মনে হয় কেউ যদি আমাকে টেনে নিয়ে যেত তাহলে কতই না ভাল হত। তৃষাট অবশ্য আমাকে প্রায়ই বাইক কিনতে বলে। অনেকবার বলেছে যে সে নিজেই কিনে দিবে । আমার ইচ্ছে হয় নি । একে তো আমার বাইক চালাতে মোটেই ইচ্ছে না । তার উপরে ঢাকা শহরে বাইক মানেই হচ্ছে বাড়তি আরেকটা ঝামেলা। এমনিতেও আমার জীবনে ঝামেলার শেষ নেই। নতুন আরেকটা ঝামেলা নিতে মোটেই ইচ্ছে করছে না ।

আমি আস্তে আস্তে সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিতে থাকি। ৩২ নাম্বারে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির পেছন দিকে আসতেই একটা কালো রঙের জিপ গাড়ি আমার পাশ ঘেষে চলে গেল, আরেকটু হলেই আমার সাথে ধাক্কা লেগে যেত। ফাঁকা রাস্তা পেয়েছে তাই ইচ্ছে মত টান দেয় । আমরা যে আসে পাশে থাকি সেটা তাদের চোখেই পড়েই না ।

আমার মুখ দিয়ে একটা খারাপ গালি আপনা আপনিই বের হয়ে এল ৷ বেটা গাড়ি চালানোর সময় নিজেদেরকে ভাবে কি? যদি কিছু হয়ে যেত তখন?

একটু দুরে গিয়েই দেখলাম গাড়িটা থেমে গেল৷ তখনই আমার কেন জানি মনে হল আমার দেওয়া গালিটা বেটা শুনে ফেলেছে। নিশ্চয়ই বেটা হোমড়াচোমরা টাইপের কেউ হবে।

গাড়ি থামার সাথে সাথেই দেখলাম গেট খুলে একজন বের হয়ে এল৷ কালো স্যুট পরে আছে লোকটা৷ এই রাতের বেলাতেও লোকটার চোখে কালো চশমা। আমার পথ রোধ করে দাড়ালো। বুঝতে পারলাম আজকে আমার কপালে খারাবিই আছে। পাশ কাটিয়ে বের হয়ে যাবো নাকি, এখনই সাইকেল ঘুরিয়ে পেছন দিকে পালাবো এই নিয়ে দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগছি তখনই কালো চশমা পরা লোকটা আশ্চর্য মোলায়েম কন্ঠে বলে উঠলো
-মিস্টার অপু আপনার সাথে আমাদের স্যার কয়েকটা কথা বলতে চান।

আমি খানিকটা চমকে উঠলাম। এই লোক আমার নাম জানে। আমাকে চেনে। আমি যে এই রাস্তা দিয়ে যাই সেটাও বের করেছে। তার মানে বেশ কিছু দিন থেকেই আমার পিছু নিয়েছে এরা৷ এবং ওভাবে পাশ দিয়ে গাড়ি চালানোর অর্থ গাড়িটা ইচ্ছে করেই এভাবে চালিয়েছে, আমার মনযোগ আকর্ষণের জন্য কিন্তু আমি তো এতো গুরুত্বপূর্ণ কেউ নই৷ আমার সাথে এভাবে দেখা করার তো দরকার ছিল না।
আমি কি কিডন্যাপ হতে চলেছি?
সম্ভাবনা টা আগেই বাদ দিয়ে দিলাম। আমি আসলেই গুরুত্বপূর্ন কেউ নই। আমার বাবারও টাকা পয়সা নেই। আমাকে কারো কিডন্যাপ করার কথা না। অন্তত কিডন্যাপার এই ব্লাক পাজেরো গাড়িতে তো আসবেই না৷

আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। দাড়াবো নাকি চলে যাবো! ঠিক সেই সময়ই গাড়ির বাঁ দিকের দরজাটা খুলে গেল৷ একটু পরেই একজনের মাথা দেখতে পেলাম৷ লোকটা আমার দিকে তাকাতেই চেহারাটা আমার খুব বেশি পরিচিত মনে হল। গাঢ় নেভি ব্লু রঙের স্যুট পরা মানুষটা আমার দিকে হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। তারপর বলল
-বসে কথা বলি!

সাথে সাথেই একটা তীব্র বিস্ময়ের ধাক্কা আমাকে যেন নাড়িয়ে দিয়ে। আমি বুঝতে পারলাম লোকটাকে আমার কেন এতো পরিচিত মনে হচ্ছে। এই ভদ্রলোকের মুখ একেবারে ক্লিন শেভড৷ আর আমার বাবার মুখে সব সময় একটা মোঁচ থাকে। কেবল এই টুকুই পার্থক্য দুজনের চেহারার মাঝে। এমন কি দুজনেত হাসি, কথার বলার ধরনও এক রকম।

আমি কেবল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম লোকটার দিকে৷ আমার বাবার মত দেখতে লোকটা আমার কাছে কি চায়?


দুই

রাস্তার পাশের সিমেন্টের বেঞ্চের উপরেই আমি বসলাম। আমার বাবার মত দেখতে লোকটা আমার পাশেই বসলো। কিছুটা সময় সামনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল
-তোমাদের এখানে বায়ু খুব দুষিত। তাই না?

লোকটা এমন ভাবে কথাটা বলাল যেন লোকটা এখাকার নয়৷ এখানে এই পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছে না৷ লোকটা আবার বলল
-আর শব্দ দূষন টাও খুব বেশি।
আমি কি বলব কিছু বুঝতে পারলাম না। আমি আসলে কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার অবশ্য সব কিছুতে আগ্রহ কম কিন্তু নিজের বাবার মত হুবহু দেখতে এই লোকটাকে দেখে আমার ভেতরে কৌতুহল হচ্ছে। লোকটা আমার কাছে কি চায় সেটাও একটা প্রশ্ন। আমি আরও কিছুটা সময় চুপ করে থেকে বললাম
-আমি আসলে কিছুই বুঝতে পারছি না।
লোকটি বলল
-বুঝবে। আসলে আমি তোমার কাছে একটা সাহায্যের জন্য এতো দূর এসেছি।
-কি রকম সাহায্য?
-বলছি৷ তার আগে তুমি এটা দেখো৷
এই বলে লোকটা একটা ফটোগ্রাফ বের করে আমার হাতে দিল। ফটোগ্রাফটার দিকে তাকাতেই আমি আরেকবাত ধাক্কা খেলাম। ছবিতে তিনজন মানুষকে দেখা যাচ্ছে। একজন মধ্য বয়স্ক পুরুষ একজন মধ্য বয়স্ক সুন্দরী মহিলা আর তাদের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে একজন যুবক বয়সী ছেলে৷ পুরুষটি আমার জন সেটা বুঝতে কষ্ট হল না। তার পাশে যে মহিলা দাঁড়িয়ে আছে সেই মহিলাও দেখতে আমার নিজের মায়ের মত। তবে আমার মা এতো পরিপাটি থাকতে পারে না। স্পষ্টভাবে এই পরিবারটি অনেক বড় লোক৷ পোষাক আষাকে সেটাই পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে। আমাদের মত মধ্যবিত্ত পরিবার না। আর ছবির যুবক বয়সী ছেলেটা দেখতে আমারই মত। আমাকে নীল স্যুট পরিয়ে এই ছেলের স্থানে বসিয়ে দিলে কেউ বুঝতে পারবে না। আমি কেবল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম ছবিটির দিকে। ভদ্রলোক হঠাৎ বললেন
-আমাদের ছেলে অপু।
-এর নামও অপু?
লোকটা হাসলো একটু। তারপর বলল
-কেবল এর নাম অপু নয়, আমার নাম আর তোমার বাবার নাম একই এমন কি এই গ্রহের সকল মানুষের যে নাম আমাদের ওখানেও ঠিক একই নাম।

আমি কিছুটা সময় বোকার মত তাকিয়ে রইলাম লোকটার দিকে। এই লোকটা বলছে কি?
আমাদের গ্রহ!
এই লোকটি অন্য গ্রহের নাকি?
আমি খানিকটা অবিশ্বাসের সাথে বললাম
-আপনি কি বলতে চান? আমি অন্য গ্রহের?
-ঠিক অন্য গ্রহের বলবো না। আমাদের গ্রহের নামও পৃথিবী। আর্থ সেভেন্টিন।
-আমি আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না। আমার বিশ্বাসও হচ্ছে না।
-আমাকে দেখেও কি তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না? তারপর এই ছবিটা। চাইলে তোমাকে আমি আরো প্রমান দিতে পারি। তোমাদের এই পৃথিবীর মত এই পুরো বিশ্ব ব্রম্মান্ডে আরো ১৯টা পৃথিবী আছে৷ ১৯টা এই একই রকম সৌর জগত আছে। আরও ১৮ তুমি আছো।

আমার ব্যাপারটা হজম করতে আরও কিছুটা সময় লাগলো৷ আমার ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। আবার কেন জানি আমি ঠিক অবিশ্বাসও করতে পারছি না। আমার বাবাকে আমি খুব ভাল করেই চিনি। সে যখন মিথ্যা বলে তার ডান গালটা একটু কাঁপে। এই ভদ্রলোকের কথা বলার ধরনও ঠিক একই রকম। আমার লোকটাকে মিথ্যাবাদী মনে হল না। আমি বললাম
-আপনি বলতে চান আপনি সিমিলার আর্থের মানুষ।
-হ্যা। তুমি তো প্যারালাম আর্থের কথা জানো ? এখানে পার্থক্য হচ্ছে জোড়া গ্রহ নয় আছে মোট ১৯টা গ্রহ !
-একই রকম আরো ১৯টা পৃথিবী আছে। যার সব কিছু একই রকম।
-প্রায় সব একই রকম। মানুষ জন এবং তাদের ভেতরকার সম্পর্ক প্রত্যেক পৃথিবীতে প্রায় একই রকম। তবে টেকনোলজি ভিন্ন। যেমন তোমাদের এই পৃথিবী এখন জ্ঞান বিজ্ঞানে প্রায় প্রিমিটিভ পর্যায়ে আছো৷ সেখানো আর্থ সেভেনটিন অনেক অনেক এগিয়ে। বুঝতেই পারছো আমি এখানে চলে এসেছি।

আমি আরও কিছুটা সময় চুপ করে রইলাম৷ তারপর বললাম
-এখন আপনি আমার কাছে কি চান?
-সাহায্য চাই তোমার!
-কি রকম সাহায্য?
-তোমাকে আমার সাথে আর্থ সেভেন্টিনে যেতে হবে।



তিন

ব্যাপারটা গুরুতর তাই ভদ্রলোক আমার কাছে এসেছে। আমাকে আগেই জানিয়েছেন আর্থ সেভেন্টিন টেকনোলজিতে অনেক অনেক দূর এগিয়ে গেছেন। আর্থ সেভেন্টিনে রহমান গ্রুপ এই রকমই একটা টেকনো জায়েন্ট। সেটার মালিকই এই আজিজুর রহমান। কদিন আগেই তার ছেলে এই কোম্পানীর দায়িত্ব নিয়েছে। কদিনের ভেতরেই তার ছেলের বিয়ে হতে যাচ্ছিলো৷সব কিছু স্বাভাবিক ভাবেই চলছিলো আর তখনই একটা বড় দুর্ঘটনা ঘটে গেল।

শহর থেকে দূরে তাদের নতুন একটা সাইট বসছিল। সেটা হতে যাচ্ছিলো দেশের সব থেকে বড় টেকনো ফার্ম। কেবল কাজ শুরু হয়েছে। সেই ফার্মের কাজ দেখতেই তার ছেলে সেখানে গিয়েছিলো৷ কিন্তু একটা ব্রয়লারে আগুন ধরে যায় হঠাৎ। তারপরই বিস্ফোরণ। বেশ কয়েকজন মারা যায়। কিন্তু সব থেকে মারাত্বক খবর হচ্ছে তার ছেলেও সেই বিস্ফোরণে মারা যায়। যদি তারা দ্রুতই খবর টা চাপা দেওয়ার চেষ্টা করে৷ এবং অনেকাংশে সফলও হয়। এমন টা না করা হলে তাদের কোম্পানীর শেয়ারের দাম কমে যাবে একদম। হয়তো দেউলিয়া হয়ে উঠবে৷ কেবল এই একটা মৃত্যুর সংবাদ অনেক কিছু ঘটাতে পারে।
তাই এই ভদ্রলোক এসেছেন আমার কাছে। আমি কিছু দিন তার ছেলের স্থানে গিয়ে বসি। পরিস্থিতি সামলে উঠলে আবার আমাকে এখানে দিয়ে যাবে ওরা।
আমি বললাম
-আরও তো ১৮ টা পৃথিবী রয়েছে, আরও ১৮ টা অপু আছে। সব বাদ দিয়ে কেবল আমার কাছেই কেন এলেন?
ভদ্রলোক হাসলো৷ তারপর বলল
-প্রায় সব সম্ভাবনাই আমি যাচাই করে দেখেছি। সব অপুর মধ্যে আমি কেবল তোমাকেই দেখলাম যে তোমার অবস্থা বেশ খারাপ। এই দেখ চাকরি বাকরি নেই। এক প্রেমিকার ছেড়ে চলে গেছে। নতুন যে এসেছে সে তোমাকে ঠিক পাত্তা দেয় না। তোমার বাসায় তোমাকে ঠিক মত দেখতে পারে না। তুমি যদি গায়েব হয়ে যাও তাহলে কারও কিছু যাবে আসবে না। আর আমার মত হয় এই বর্তমান জগত থেকে তোমাকে আরও ভাল কিছু উপহার দিতে পারবো আমি।

আমি চুপ করে রইলাম কিছুটা সময়। ভদ্রলোক মোটেই মিথ্যা কথা বলে নি৷ আসলেই যদি আমি গায়েব হয়ে যাই তাহলে কারো কিছু যাবে আসবে না৷ মা হয়তো একটু কান্না কাটি করবে। তারপর ভুলে যাবে। তৃষা কি ভাববে আমার কথা?
হয়তো ভাববে আবার হয়তো না।

ভদ্রলোককে বললাম
-আমি কি মাঝে মাঝে আসতে পারবো?
ভদ্রলোক বলল
-সেটা কি ভাল হবে? মানুষ জন তখন কত প্রশ্ন করবে যার কোন উত্তর থাকবে না৷
-কিন্তু আমার বাবা মায়ের কি হবে? যতই তারা আমাকে পছন্দ না করুক আমি ছাড়া তাদের কে দেখবে?
-সেটা তুমি আমার উপর ছেড়ে দাও। তাদের যেন জীবনে আর কোন কষ্ট না হয় সেই ব্যবস্থা আমি করবো। তাহলে চল যাওয়া যাক!
-এখনই?
-হ্যা।
-আমার সাইকেলটার কি হবে?

ভদ্রলোক হেসে ফেলল৷ তোমার সাইকেলের কিছু হবে না৷ সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। চল ঐ গাড়ির ভেতরে যাওয়া যাক।

এই বলেই লোকটা গাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়লো। আমি আরও কিছুটা সময় এদিক ওদিক তাকিয়ে রইলাম। একবার মনে হল না যাই। তারপর আবার মনে হল এই জগতে আমি থেকেই বা কি করবো। কিসের জন্য থাকবো! তার উপর যদি আমার চলে যাওয়ার ফলে আমার ফ্যামিলির একটা গতি হয় তাহলে আমার চলে যাওয়াই ভাল। আর আর কিছু ভাবলাম না। সাইকেলটা এক পাশে দাড় করিয়ে আমি গাড়িতে উঠে বসলাম। প্রায় সাথে সাথেই গাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে গেল। গাড়ির ইঞ্জিন চালুই ছিল। মৃদু শব্দ করে সেটা চলতে শুরু করলো৷ আমি ছুটে চললাম আর্থ সেভেন্টিনের দিকে। না জানি ওখানে আমার জন্য কি অপেক্ষা করছে!



চার

আমি ভেবেছিলাম এই আর্থ সেভেন্টিন না জানি কেমন হবে। অথচ এখানে আসার পরে আমার তেমন কিছুই পার্থক্য চোখে পড়লো না। তবে এই আর্থ সেভেন্টিন বড় বেশি গোছালো। সব কিছুই এখানে হয় নিয়ম মাফিক। চারিদিক পরিস্কার পরিছন্ন। শহরের ভেতরে গাড়ি চলে সোলার এনার্জিতে৷ বড় বড় ফ্যাক্টরি সব শহরের বাইরে। এখানেও রাজধানীর নাম ঢাকাই । এই দেশটার নাম বাংলাদেশই । তবে আমি যে বাংলাদেশ থেকে এসেছি, সেই দেশের সাথে এই দেশের অনেক পার্থক্য । আক্ষরিক অর্থেই আমি আবিস্কার কারলাম আমরা ঐ বাংলাদেশটা যেমন আশা করতাম এই আর্থ সেভেন্টিনের বাংলাদেশটা ঠিক সেই রকম । আইনের শাসন, গনতন্ত্র সব আছে এখানে । আছে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা !

এখানে আসার পরে সত্যিই অনেক ক্ষমতাবান হয়ে গেছি। আমার এক হাতের ইশারাতে এখানে অনেক কিছু হয়। আমার ব্যাংকের একাউন্ট দেখলে আমি নিজেরই খাবি খাওয়ার মত অবস্থা হয়। এই সব কিছুই আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো।
মাস খানেকের মাঝেই আমি এখানে সব কিছু বুঝে উঠলাম। আমার কিভাবে চলতে হবে কি করতে হবে এই সবই আমাকে আস্তে আস্তে শিখিয়ে নিচ্ছিলেন অপু বাবা। সে অবশ্য এই পৃথিবীতে আমার নিজের বাবা৷ এবং একটা ব্যাপার আমি লক্ষ্য করলাম যে আমার প্রতি তার ভালবাসার কোন কমতি ছিল না। আমার এই আর্থ সেভেন্টিনের মায়ের বেলাতেও ব্যাপারটা একই রকম ছিল। তিনি তার এক মাত্র ছেলেকে হারিয়ে আমাকে পেয়েছেন আর আমাকে তিনি হারাতে চান না কিছুতেই, এমন একটা ভাব।

এবং সব থেকে মজার ব্যাপার হচ্ছে নিহিন৷ আমার নিজের পৃথিবীতে থাকতে নিহিন আমার প্রেমিকা ছিল এবং আমাকে ছেড়ে দিয়ে অন্য একটা ছেলেকে বিয়ে করেছিল৷ এখানে এই মেয়ে এখনও আমার প্রেমিকা আছে এবং খুব জলদিই এই মেয়ের সাথেই আমার বিয়ে হতে চলেছে।
এখানে নিহিনের বাবা হচ্ছে বর্তমান আইজিপির মেয়ে । তার ভাবই আলাদা । যদিও আমার নিজের পৃথিবীর নিহিনের বাবা একজন সরকারী অফিসারের মেয়ে ছিল । ঘুস খেয়ে পেট ফুলিয়ে ফেলেছিলো । এখানে আইজিপি সাহেবের বেশ সুনাম দেখতে পেলাম । যে পুলিশ আমরা আমাদের পৃথিবীতে কল্পনা করতে পারি সেই পুলিশই যেন এই পৃথিবীতে এসে হাজির হয়েছে । ব্যাপারটা আমার মজাই লাগছে।

আমাকে এখানে আনার পরেই কয়েকদিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছে। সবাইকে বলা হয়েছিল যে ঐ ব্লাস্টে আমি আহত হয়েছিলাম, আমার মাথায় কিছুটা আঘাত লাগার কারনে আমার স্মৃতিতে কিছুটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। অনেক কিছুই আমি ভুলে যেতে পারি। মানুষ জন যেন আমার আচরনের অসংগতি টা ধরতে না পারে সেই জন্য এই গল্প।

হাসপাতালেই আমাকে অনেক কিছু শেখানো হল। যেদিন সবাইকে জানানো হল যে আমি মোটামুটি সুস্থ আছি সেদিনই নিহিন এসে হাজির। আমাকে সবার সামনেই জড়িয়ে ধরলো। আমার সামনে আমার বাবা রয়েছেন, যতই তিনি নকল বাবা হোন তবুও বাবা তো, তার সামনে এভাবে একটা মেয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরবে ব্যাপারটা একটু অস্বস্তির বটে। তবে নিহিনের আচরন আমার কাছে যেন একটু বেশি অন্য রকম লাগলো। মেয়েটা আমার প্রতি যেন একটু বেশিই ভালবাসা দেখাচ্ছিলো।

দুদিন পরেই অবশ্য কারন টা জানতে পারলাম৷ নিহিন আমার অর্থ্যাৎ আর্থ সেভেন্টিনের অপুর ঠিক প্রেমিকা ছিল না। নিহিনকে অপুর বাবা পছন্দ করেছিল অপুর বউ হিসাবে৷ সেই হিসাবেই অপুর সাথে নিহিনের মেলামেশা৷ অপুর আম্মুর কাছ থেকেই জানতে পারলাম যে অপু নাকি নিহিনের ব্যাপারে খুব একটা সিরিয়াস ছিল না৷ কেবল ওর বাবার পছন্দ ছিল বলে অপু মিশতো নিহিনের সাথে। নিহিন অনেক আগে থেকেই অপুর পেছনে ছিল।

আমার বুঝতে কষ্ট হল না যে নিহিন কেন এতো বেশি বেশি ভালবাসা দেখাচ্ছে। যেহেতু সবাইকে বলা হয়েছে দুর্ঘটনায় আমার অনেক স্মৃতি চলে গেছে, তাই নিহিন আমাকে বোঝাতে চাচ্ছে যে তার সাথে আমি গভীর প্রেম ছিল৷ আমার স্মৃতি চলে যাওয়ার কারনে আমি সব ভুলে গেছি। কিন্তু আসল কথাটা আর এই মেয়ে জানে না৷

একদম আমার পৃথিবীর নিহিনের মতই আচরন। যেই পৃথিবীতেই যাই না কেন সব নিহিনরা একই রকম। আমার পৃথিবীতে নিহিন আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল আমার থেকে ভাল অপশন পেয়ে আর এই পৃথিবীতে আমার পেছনে লেগে আছে কারন আমার পেছনে রয়েছে বিশাল সম্পত্তি।
শ্লার লোভ!

পরের একটা মাসে আমি সত্যি সত্যি পুরোপুরি কাজের মানুষ হয়ে উঠলাম। পুরো কোম্পানি যেন আমি নিজে সামলাতে শুরু করলাম৷ তারপরেও কি যেন মনে হচ্ছিলো ঠিক নেই। কি নেই সেটা বুঝতে পারছিলাম না। হয়তো বুঝতে পারতামও না যদি না আমি শহরের বাইরে সেই ফ্যাক্টরি সাইটে না যেতাম।

সেদিন কি মনে করে নিজেই গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেলাম। ফ্যাক্টরির অফিসে নিজেই কাজ কর্ম দেখতে লাগলাম। হঠাৎ ফাইল ঘাটতে ঘাটতে একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম৷ ব্যাপারটা লক্ষ্য করতেই আমার পুরো শরীর যেন কেঁপে উঠলো৷
সপ্তাহের নির্দিষ্ট একটা দিনে ফ্যাক্টরির সাইট বন্ধ থাকে। যেদিন দুর্ঘটনা টা ঘটেছিল সেদিনও সাইট টা বন্ধ ছিল। প্রশ্ন হচ্ছে অপু কেন এমন দিনে সাইট দেখতে আসবে যেদিন কাজ বন্ধ রয়েছে?
এটা কি স্বাভাবিক?

আমি এবার সাইটের সিসিটিভি ফুটেজ লক্ষ্য করতে লাগলাম। যেদিন পুরো সাইট বন্ধ থাকে সেদিন কেবল মাত্র একটা সিসিটিভি চালু থাকে৷ সেটা থাকে গেটের কাছে। কে আসলো আর কে গেল সেটা দেখার জন্য।

আমি গভীর মনযোগ দিয়ে ফুটেজ টা দেখতে লাগলাম। বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে অপু গাড়ি নিয়ে হাজির হয় গেটের কাছে।
গেটম্যান এগিয়ে আসতেই বাঁ দিকের গাড়ির কাঁচ টা খুলে গেল। কিন্তু ভেতরে কে আছে সেটা দেখা গেল না। গেটম্যান মাথা গাড়ির জানলার পাশে বসা মানুষটার সাথে কথা বলল। তারপর সে মাথা নিচু করে ভেতরে তাকাতেই একটা স্যালুট দিল৷ যেন কাউকে দেখতে পেয়েছে।

ফুটেজ টুকু দেখেই আমি চমকে উঠলাম। স্পষ্ট এই টুকু যে গেটম্যান প্রথমে জানলার কাছে বসা মানুষকে দেখেছে তারপর একটু নিচু হয়ে ভেতরে আরেকজনকে দেখে স্যালুট দিয়েছে। স্যালুট দেওয়া মানুষটা যে অপু ছিল সেটা বুঝতে সমস্যা হল না। কিন্তু জানলার পাশে মানুষটি যার সাথে প্রথমে গেটম্যান কথা বলছিল সে কে?
আশ্চর্য এটা কেউ লক্ষ্য করে নি কেন?

এর একটু পরেই ফুটেজ বন্ধ হয়ে গেছে৷ আর নেই।

অপারেটর কে জিজ্ঞেস করতে সে বলল যে এরপরই সম্ভবত ইলেক্ট্রিসিটি চলে গিয়েছিল কিংবা সট সার্কিট হয়েছিল সেখান থেকে ব্রয়েলার ব্লাস্টের ঘটনা ঘটেছে। গেটম্যান নিজেও সম্ভবত দেখতে গিয়েছিল। সেও মারা পরে সেখানে।

কিন্তু আমার মনের ভেতরে কেমন কু ডেকে উঠলো। কিছু যেন ঠিক নেই এমন মনে হল৷ কিন্তু কি ঠিক নেই সেটা বুঝতে পারছিলাম না।



পাঁচ

পরদিন অফিসে এসেও আমার মাথার ভেতরে কেবল সেই একই চিন্তা কাজ করতে লাগলো। বারবার মনে হচ্ছিলো যে অপুর গাড়িতে আর কে ছিল? কে থাকতে পারে?
নিজের সেক্রেটারি জেসমিনকে ডাক দিলাম। তাকে ঐদিনের কথা জিজ্ঞেস করতেই সে বলল
-সরি স্যার, আমি তো সেই সময়ের কথা বলতে পারবো না৷
-কেন?
-স্যার আমি তো জয়েন করেছি মাস দুয়েক হল।
-তার মানে আমি হাসপাতাল থেকে ফিরে আসার পর?
-জি স্যার
আমি আবার খানিকটা চিন্তা করলাম । জেসমিন তখন আমার সেক্রেটারি না থাকে তাহলে কে ছিল !
জেসমিন বলল
-স্যার আপনার কি কিছুই মনে নেই?
-না আসলে কিছুই মনে পরছে না। তুমি কি খোজ নিতে পারবে এক্সিডেন্ট এর আগে আমার সেক্রেটারি কে ছিল?
জেসমিন বলল
-জি স্যার। নিশ্চয়ই কম্পিউটারে থাকবে। আমি খোজ নিয়ে জানাচ্ছি।

আধা ঘন্টা পরে যখন জেসমিন খোজ নিয়ে এল তখন আমি আরেকটা বড় ধাক্কা খেলাম৷ আমার মানে আসল অপুর আগের সেক্রেটারির নাম ছিল আরিফা রহমান। আমার পৃথিবীতে এই আরিফা রহমানকে আমি খুব ভাল করে চিনি। তৃষার ভাল নাম হচ্ছে আরিফা রহমান৷আরিফা রহমান তৃষা । এই মেয়ে আমার সেক্রেটারি ছিল ?
জেসমিন আরও জানালো যে আরিফা রহমান আমার এক্সিডেন্টের দিনই শেষ অফিসে এসছিল৷ আর আসে নি।

আমি আর বসে থাকতে পারলাম না। আমার কেন জানি মনে হল এই আরিফা নিশ্চয়ই কিছু জানে। নয়তো সে কেন এভাবে গায়েব হয়ে যাবে ? অফিসের ডাটা বেজে যে ঠিকানা ছিল সেই ঠিকানাতে গিয়ে দেখি সেখানে এখন আর কেউ থাকে না। আরও সম্ভব্য সব জায়গাতে আমি খুজতে লাগলাম কিন্তু আরিফাকে কিছুতেই খুজে পেলাম না৷ পুরো একটা সপ্তাহ আমি আমার সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে চেষ্টা করে গেলাম কিন্তু কিছুতেই আরিফার হদিশ পেলাম না। মেয়েটা যেন একেবারে গায়েব হয়ে গেছে। এভাবে একটা মানুষ কিভাবে গায়েব হয়ে যেতে পারে ? আমার আগের পৃথিবীতে হলে অবশ্য এটা খুউবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার ছিল । কিন্তু এখানে তো এমন হবার কথা না ।

যখন আমি আরিফার আশা ছেড়ে দিয়েছি তখন একটা অদ্ভুদ ফোন কল এসে হাজির হল। রাত তখন আট টা বাজে। আজকে আবার নিহিনদের বাসায় আমাদের সবার দাওয়াত আছে৷ওখানে সম্ভত আজকে আমাদের বিয়ের ব্যাপারে কোন কথা বার্তা বলা হবে । তবে আমি বাবাকে অর্থাৎ অপুর বাবাকে আগে থেকেই বলে দিয়েছি যে আমি ঐ নিহিনকে কিছুতেই বিয়ে করবো না । এই মেয়েকে আমার পছন্দ না । তাকে বিয়ে করতে পারবো না । তিনি বলেছেন যে তিনি ব্যাপারটা দেখবেন । তবুও দাওয়াতের ব্যাপারটা তো এড়ানো যায় না । আইজিপি সাহেবের বাসায় দাওয়াত বলে কথা ।

আমি অফিস থেকে বের হচ্ছি এমন সময় ফোনটা এল।
-হ্যালো
ওপাশ থেকে কিছু সময় কোন কথা হল না৷ আমি আবার হ্যালো বলতেই এবার আওয়াজ এল।
-আরিফা রহমান কে কেন খুজছেন?
একটা মেয়ের কন্ঠ মনে হল তবে সম্ভবত কিছুতে ধাক্কা খেয়ে আওয়াজটা আসছে। মেয়েটা কোন ভয়েজ ফিল্টার ব্যবহার করছে।
-দরকার আছে বলেই খুজছি।
-১০ লক্ষ টাকা।
-মানে?
-মানে ১০ লক্ষ টাকা পেলে তার খোজ দিতে পারি।
-শুধু খোজ দেওয়ার জন্য এতো টাকা?
-আচ্ছা ভুলে যান আমি আপনাকে ফোন দিয়েছিলাম। গুডবাই
-এই যে শুনুন শুনুন আমি দিবো আমি দিবো....
ওপাশ থেকে কোন আওয়াজ এল না। আমি আবার বললাম
-আপনি আছেন?
-এখনই আসুন৷ আমি ঠিকানা এসএমএস করি দিচ্ছি। কিন্তু অন্য কোন চালাকি করলে কিন্তু কোনটাই পাবেন না । মনে থাকে যেন ।

লাইনকেটে গেল। তারপরই একটা মেসেজ এসে হাজির হল৷ আমি আবার অফিসে দৌড় দিলাম। অফিসের সেলফে বেশ কিছু টাকা আছে।


জায়গাটা শহর থেকে বেশ দূরে। আমাদের পুরাতন ঢাকা হলে বসিলা ব্রিজ পার হয়ে জায়গাটা পাওয়া যেত । আমি নির্দিষ্ট জায়গায় এসে হাজির হলাম। বেশ কিছু সময় অপেক্ষা করলাম। এদিকে আমার অপুর বাবা দুবার ফোন দিয়েছে। নিহিন যে কতবার ফোন দিয়েছে সেটা বাদই দিলাম। তাদের কোন রকমে বলে বোঝালাম যে আমি আসছি৷ একটু কাজে আটকে গেছি।

নিহিনের ফোন রাখতেই পেছন থেকে আওয়াজ পেলাম৷ অন্ধকারের ভেতরে কালো অবয়ব টা চিনতে অসুবিধা হল না। একটা মেয়ে। আরও পরিস্কার বুঝতে পারলাম মেয়েটার পেটের দিকে তাকিয়ে। মেয়েটা প্রেগন্যান্ট।
-একা এসেছেন দেখে সামনে এলাম । টাকা এনেছেন?
সে জানতে চাইলো।

মেয়েটা সম্ভত অনেক আগেই আমার দিকে লক্ষ্য রাখছিলো । আমি যে একা এসেছি এটা জানার পরেই আমার সামনে এসেছে । আমি ব্যাগটা দেখালাম। তারপর সেটা ওর দিকে ছুড়ে ফেলে দিলাম। মেয়েটি ব্যাগটা এক হাতে তুলে নিল। ভেতরে দেখার চেষ্টা করলো। আমি বললাম
-ভয় নেই। টাকাই। অন্য কিছু না। কিন্তু এই ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না যে তোমার হঠাৎ এতো টাকার দরকার পড়লো কেন ঝুমঝুমি?

আরিফা রহমানকে আমি আদর করে ঝুমঝুমি ডাকি। ওর কন্ঠস্বর আমার কাছে সব সময় ঝুমঝুমির মত লাগে। আর্থ সেভেন্টিনের অপুও যে তাকে ঝুমঝুমিই ডাকবে সেটার কোন মানে নেই। তবুও আমার কেন জানি মনে হল হয়তো সেও ডাকতে পারে৷ এখন মনে হচ্ছে ডাকে।

মেয়েটা যেন জমে গেল। চাঁদের আলোতে আমি দেখতে পেলাম মেয়েটা আমার দিকে এক ভাবে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা তীব্র কন্ঠে বলল
-এই নাম তুমি কিভাবে জানলে?
আমি খানিকটা হেসে বললাম
-বাহ রে আমি আমার ভালবাসার মানুষের নাম জানবো না?
আরিফা রহমান বলল
-তুমি অপু নাও।
-তুমি কিভাবে জানো?
-তুমি হয়তো দেখতে ওর মত কিন্তু তুমি অপু নাও। তুমি আমার অপু নও।

হঠাৎ মেয়েটা ব্যাগটা ছেড়ে দিয়ে মাটিতে বসে পড়লো। তারপরই মেয়েটার কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম৷ আমি ধীরে ধীরে আরিফার দিকে এগিয়ে গেলাম। তারপর ওর হাতটা ধরে বললাম
-তুমি এভাবে পালিয়ে কেন বেড়াচ্ছো? ঐদিন গাড়িতে তুমি ছিলে, তাই না?

আরিফা বেশ কিছুটা সময় ধরে কেঁদেই চলল৷ কাঁদতে কাঁদতেই মাথা ঝাকালো তারপর বলল
-অপু নিহিনকে ভালবাসতো না। আমাকে ভালবাসতো। একটা সময় ও সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিলো যে নিহিনকে বিয়ে করবে না। ঐদিন সেই কথাটাই সে নিহিনকে জানিয়ে দেয়। তারপর আমাকে নিয়ে সাইটে ঘুরতে যায়। সাইটের উচু ক্রেনের উপরে ওঠা যেত৷ওটা ওর একটা পছন্দের জায়গা ছিল । আমাকে নিয়ে প্রায়ই উঠতো। সেদিনই তাই ইচ্ছে ছিল আমাদের। আর ঐদিন ও খুব খুশি ছিল।
আমি বললাম
-সু সংবাদ টা ওকে দিয়েছিলে?
-হ্যা।
আরিফা আবারও ফুফিয়ে উঠলো।
-কিন্তু নিহিন যে আমাদের পেছন পেছন আসছিল আমরা টের পাই নি।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিহিন পেছন থেকে অপুর মাথায় বাড়ি মারে একটা একটা রড দিয়ে । আমাকে একটা আঘাত করে। অপু ওকে কোন রকমে আটকে রেখে আমাকে পালিয়ে যেতে দেয়। কিন্তু দূর থেকে আমি দেখি নিহিন কিভাবে পাগলের মত আঘাত করছিল আর চিৎকার করে বলছিল যে ও যদি না পায় তাহলে আর কেউ পাবে না৷ আমি কিছুই করতে পারি নি। কিছুই করার ছিল না আমার। তারপর থেকে নিহিন আমাকে খুজে যাচ্ছে। আমি পালিয়ে বেড়াচ্ছি। আমি জানি না ও কিভাবে ব্যাপারটা দুর্ঘটনা বলে সাজিয়ে দিল । সম্ভত ওর বাবা পুলিশের আইজিপি এই জন্যই সব সম্ভব হয়েছে । কেউ আমার কথা বিশ্বাস করতো না। আসলে আমি এতো ভয় পেয়েছিলাম যে কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না৷ বিশেষ করে আমার গর্ভে যে আছে এর জন্য সব থেকে বড় ভয় ছিল। তাই আমি আসি নি বাইরে। তারপর জানতে পারলাম অপু নাকি ফিরে এসেছে। কিভাবে কি হয়েছে আমি জানি না তবে তুমি যে আসল অপু নও সেটা আমি জানি।
আমি কিছুটা সময় চুপ করে রইলাম । তারপর বললাম
-টাকার দরকার কেন পড়লো হঠাৎ ?
-আমি এই দেশে ছেড়ে চলে যেতে চাইছিলাম । কিন্তু এমন অবস্থা যেন আমার হাতে কিছুই নেই । আমি বাইরে আসতেও পারছিলাম না । ওরা অনেক ক্ষমতাবান । আমার কিচুতেই নেই । আমি কেবল যে কোন একটা উপায় খুজছিলাম । তখনই পরিচিত এক জনের কাছ থেকে জানতে পারলাম যে তুমি আমার খোজ করছো । তাই ....
আরিফা চুপ করে রইলো । আমি কিছু ওকে বলতে যাবো তখনই পেছন থেকে পায়ের আওয়াজ পেলাম। দুজনেজ ঘুরে তাকালাম । নিহিনেত গলার আওয়াজ পেলাম। নিহিন বলল
-অপু তোমার ফোনে ট্র‌েকিং ডিভাইস লাগিয়ে ভালই করেছি কি বল? তুমি কোথাও যাও, কার সাথে কথা বল সব আমার কাছে চলে আসে। যাই হোক এই ডাইনিকে খুজছিলাম অনেক দিন। একে আজকে আমার হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।

আমি তখনই আরিফাকে আড়াল করে দাড়ালাম। নিহিন বলল
-সরে দাড়াও বলছি। আসল অপুকে মারতে আমার হাত কাঁপে নি, তোমাকে গুলি করতেও কাঁপবে না।
আমি বললাম
-এসব করে কি লাভ? অপুকে পাবে না !
নিহিন হিসহিস করে বলে উঠলো
-না পাই। কিন্তু আমি না পেলে কেউ পাবে না৷
-কিন্তু অপুকে তো ঝুমঝুমি ঠিকই পেয়েছে। এই দেখ, ঝুমঝুমির কোল ঝুড়ে অপুর স্মৃতি।
-তাই? তাহলে তো আজকে সব কটাকে শেষ করবো!
আমার মাথায় তখন ঝড়ের গতিতে চিন্তা চলছে । কিভাবে নিহিন আটকানো যায় সেটা ভাবছি । নিহিন পিস্তলটা আমাদের দিকে তুলে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে । আমাদের থেকে কয়েক হাত দুরে এসে থামলো । তারপর বলল
-অপু, চয়েজটা তোমার ! তুমি এই মেয়েকে চেনোও না । এই মেয়ে মরলে তোমার কিছু যায় আসে না । আসো আমার দিকে । দুজন মিলে এই ডাইনিকে শেষ করি । তারপর চলে পার্টিতে । কেউ কিছু জানবে না ।
আমি বললাম
-ঐদিন অপুকে খুন করার পরে কিভাবে সামাল দিলে সব ?
নিহিন বলল
-আমি কিছু করি নি । সব আব্বু সামাল দিয়েছে । রাগের মাথায় যা করেছিলাম তাই সামলাতে আব্বুকে ফোন দেই । তিনি এসে সব কিছু সাজিয়েছেন ।

আমি এরই মাঝে আরেকটু এগিয়েছি নিহিনের দিকে । এমন একটা ভাব যেন আমি নিহিনের কথা মেনে নিচ্ছি । আরিফা রহমানের সাথে আমার আসলেই কিছু নেই । এই মেয়ের কিছু হলে আমার কিছু যাবে আসবে না । যখন মনে হল এখনই সুযোগ তখনই আমি বললাম
-আরে ড্যাড....

আমি এমন একটা ভাব করলাম যেন সত্যি সত্যিই নিহিনের পিছনে আমার নকল বাবা চলে এসেছে। অভিনয়টা এতোই নিখুঁত ছিল যে নিহিন পেছন ফিরে তাকালোই। ব্যাস এই সুযোগ টুকুই আমার দরকার ছিল। আমি এক লাফে চলে গেলাম ওর কাছে। পিস্তলটা ধরে ফেললাম সাথে সাথে।
যদিও মেয়েদের গায়ে আমার আঘাত করার কোন ইচ্ছে ছিল না কিন্তু নিহিনেত ব্যাপারটা আলাদা৷ আমার পৃথিবীতে ও আমার সাথে যা করেছে তার জন্য তো রাগ ছিলই, এই আর্থ সেভেন্টিন এ ও যা করেছে তার জন্য ওর শাস্তি প্রাপ্য। কষে এক চড় লাগালাম। এক চড়েই অবশ্য কাজ হল। উলটে পড়ে গেল। আর উঠলো না৷

আরিফাকে বললাম
-চল যাওয়া যাক। অনেক লুকিয়ে থেকেছো। আর না। সবাইকে সত্য বলার সময় এসেছে৷



পরিশিষ্ট

সব ঝামেলা শেষ করে আমার আবার নিজের পৃথিবীতে ফিরে আসতে আসতে আরো ছয় মাস লেগে গেল। অপু বাবা মায়ের কাছে আরিফা কে তুলে এসেছি। নিজের ছেলের সন্তানকে পেয়ে যেন আকাশেত চাঁদ হাতে পেয়েছে৷
নিহিনকে পুলিশ ধরেছে। তার বাবাকেও । আশ্চর্যের বিষয় তারা সব স্বীকার করে নিয়েছে৷নিহিনের শাস্তির পরিমানটা কম হয়েছে কারন উকিল এটা প্রমান করতে পেরেছে যে সে যা করেছে রাগের মাথায় করেছে । তার বাবাকে পুলিশ বাহিনীকে অব্যহতি দেওয়া হয়েছে এবং খুনের আলামত মেটানোর জন্য তারও শাস্তি হয়েছে ।

আমাকে আবারও যেতে হবে এই শর্তে অপুর বাবা আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে গেছে পৃথিবীতে। এবং অবাক করা বিষয় হচ্ছে আমি ঠিক যেখান থেকে গিয়েছিলাম আবারও যেন সেখানেই হাজির হলাম। সাইকেল টা যেখানে ছিল সেখানেই আছে। আমি গাড়ি থেকে বের হতেই সেটা চলে গেল। আমি বোকার মত চেয়ে রইলাম কিছুটা সময়।
কিছু ভাবতে যাবো তখনই ফোন বেজে উঠলো।
মহারানির ফোন । আর্থ সেফেন্টিনে এক আরিফা রহমান তৃষাকে রেখে এসেছি । এই নিজের পৃথিবীতে আমার আরিফা রহমান তৃষার ফোন এসে হাজির । রিসিভ করতেই আওয়াজ ভেসে এল।
-এই এই এই! কতবার ফোন দিছি ? অসভ্য কোথাকার! এখন আর আমাকে ভাল লাগে না, না!!...... তা লাগবে কেন ? আমি কে ? এখন তো আর আমাকে ভাল লাগে না, তাই না ? নতুন কাকে পেয়েছো শুনি ? এই এই ....
আমি মনে মনে হাসি কেবল !

যাক আবারও ফিরে এলাম নিজের পৃথিবীতে! সেই চিরো পরিচিত নিজের পৃথিবী !

সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে আগস্ট, ২০১৮ দুপুর ২:৪৭
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×