রিসিপশন থেকে ফোন করে জানালো আমার বউ এসেছে ।
নীতু এসেছে !
খানিকটা চমকালাম । অবাক হলাম । সেই সাথে খুশিও হলাম । মনের ভেতরে একটা আলাদা শংঙ্কা জাগলো । কেন জাগলো সেটা আমি জানি না । কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে নীতু কেন এসেছে?
নীতুর সাথে আমার ডিভোর্স হয়েছে মাত্র আট দিন । অফিসের লোকজনকে এখনও আমি কিছু বলি নি । পরিবারের লোকজন জানে। আর কাছের কয়েকজন বন্ধুবান্ধব ছাড়া কাউকেই বলি নি । আমরা বিয়ের কথা যতটা ঢাকঢোল পিটিয়ে বলি ডিভোর্সের কথা ততটা বলতে পারি না । ডিভোর্সকে আসলে কেউ ভাল চোখে দেখে না । বিশেষ করে মেয়েদের ব্যাপারে । ডিভোর্স হয়েছে মানে হচ্ছে মেয়ের মাঝে কোন না কোন সমস্যা আছে । সবার প্রথম চিন্তা এটাই আসে ।
তবে নীতু এখানে কেন এলো আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। যখন ও আমার বউ ছিল তখন প্রায়ই আসতো লাঞ্চ আওয়ারে । ওর অফিস আর আমার অফিসটা কাছাকাছি । রিক্সাতে ২০/২৫ মিনিট লাগে । বিয়ের প্রথম প্রথম প্রায় প্রতিদিনই আমরা এক সাথে লাঞ্চ করতাম । হয় সে আসতো নয়তো আমি যেতাম। তবে সময় যাওয়ার পরে সেটা কমে গিয়েছে । এক সময়ে একেবারেই বন্ধ হয়ে গেল । তারপর তো আলাদাই হয়ে গেলাম আমরা ।
আমি ধীর পায়ে হেটে এগিয়ে গেলাম গেস্ট রুমের দিকে । দরজা খুলতে গিয়েও কেমন যেন কেঁপে উঠলো হাতটা । এমন কেন হচ্ছে ঠিক বুঝতে পারছি না । মাস দুয়েক আগেও দুজন কেউ কারো মুখ দেখতে চাইতাম না । আজকে এমন কেন হচ্ছে !
আমার দরজা খোলার আগেই দেখলাম নীতুই দরজা খুলে ফেলল । আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো একটু । নীতুকে দেখে একটু অবাক না হয়ে পারলাম না । সাদা রংয়ের কামিজ পরেছে । সাদা লেগিংসের সাথে সাদা ওড়ণা । চোখে গাঢ় করে কাজল দিয়েছে । হাতের দিকে না তাকিয়েও আমি বলতে পারলাম যে ও আজকে হাতে মেহেদিও দিয়েছে ।
কেন !
আমার পছন্দের সাজ ! এটা ও খুব ভাল করেই জানে । শেষ কবে ওকে এই সাজে দেখেছি আমার মনেও নেই । তাহলে আজকে কেন এসব করছে ও ।
আমার দিকে তাকিয়ে আবারও হাসলো । তারপর বলল, চল লাঞ্চ করি এক সাথে !
বললাম, এখন?
-হ্যা । এখন তো লাঞ্চ আওয়ারই । তাই না । চল চল !
-না মানে?
-কেন এখন বউ নেই বলে আমার সাথে আর বসা যাবে না ?
-না আমি সে কথা বলি নি । মানে তুমি .....
-আচ্ছা চল চল । অন্য কিছু ভাবতে হবে না । এক সাথে দুপুরের খাবার খাই । তারপর তুমি তোমার দিকে আমি আমার দিকে ।
আমি কোন ভাবেই মানা করতে পারলাম না । আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না । আলাদা হওয়ার আগে আমরা মোটামুটি ছয়মাস আলাদা ছিলাম । কেউ কারো সাথে কোন কথা বার্তা বলি নি । ফ্যামিলির ভেতর থেকে চেষ্টা চলেছে ঝামেলা দুর করার কিন্তু সম্ভব হয় নি । শেষ পর্যন্ত বিয়েটা ডিভোর্সের দিকে গড়ায় । পারিবারিক ভাবেই আমরা আলাদা হয়েছি । আট দিন আগেই কাগজ পত্র সব হাতে এসেছে আমাদের ।
আমরা আমাদের পরিচিত রেস্টুরেন্টেই লাঞ্চ করতে এলাম । কোনার দিকের একটা টেবিল নিয়ে বসলাম । নীতুকে কেমন যেন একটু অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে । একটু যেন বেশি কথা বলছে । অফিসে কি হল না হল এই সব একের পর এক বলেই যাচ্ছে । তারপরই মনে হল নীতু এমন করেই কথা বলতো । লাঞ্চ করার সময় দুনিয়ার যত গসিপ হত সব আমাকে বলতো । এতোদিন ওর সাথে কথা বার্তা নেই বলেই হয়তো আমার কাছে এসব অস্বাভাবিক লাগছে । তবে আমার কেন জানি ভাল লাগছিলো । এতো দিন পরে ওর সাথে এভাবে কথা বলতে পেরে, ওখানে এভাবে দেখতে পেয়ে, ওর সাথে এভাবে সময় কাটাতে পেরে আমার সত্যিই ভাল লাগছিলো অনেক ।
আমার একদম বিয়ের প্রথম দিন গুলোর কথা মনে পরে গেল । আমাদের বিয়েটা ঠিক প্রেমের বিয়ে ছিল না । পারিবারিক ভাবে আমাদের পরিচয় হয়েছিলো । তবে বিয়ের আগে আমি মাস ছয়েক মিশেছিলাম একে অন্যের সাথে । দুজন দুজনকে পছন্দ করেছিলাম । বিয়ের পরেও চমৎকার সব সময় কেটেছিলো । ও গান শুনতে পছন্দ করে, বই পড়তে ভালবাসে । আমার এতো বইয়ের কালেকশন দেখে ও খুব ইম্প্রেড হয়েছিলো । নিজের বই গুলো এনে রেখেছিলো আমার সেলফে । আমাদের ফ্লাটে একটা ঘরই ছিল কেবল বইয়ের জন্য ।
কিন্তু তারপর হঠাৎ কেন জানি সব ফিকে হয়ে গেল । কোথায় যেন সুর কেটে গেল । প্রায় প্রতিদিন ঝগড়া হতে লাগলো । সিম্পল সব বিষয় নিয়ে ঝগতা । আমিও ধৈর্য্য ধরতে পারলাম না, নীতুও কেমন আচরন করতে শুরু করলো ।
কিন্তু আজকে নীতুর কথা বার্তা গুলো একদম অন্য রকম লাগছে । একেবারে অন্য রকম ।
খাওয়ার পরে আমরা আমরা বের রাস্তায় হাটতে লাগলাম এক সাথে । অফিস পাড়ায় এই সময়টা একটা ফাঁকায় থাকে । হাটতে হাটতে ওর অফিসের কাছে কখন চলে এসেছি টেরই পেলাম না । আসলে গল্প করছিলাম বলে টের পায় নি । ওর অফিসের ঠিক পেছনে ছোট একটা বসায় জায়গা আছে । কয়েকটা সিমেন্টের বেঞ্চ আর গাছ গাছালিতে ভর্তি । এখানেও আমরা এসে বসে গল্প করতাম কিছু সময় । তারপর ও অফিসে ঢুকে পড়তো আমি নিজের অফিসের দিকে রওয়ানা দিতাম ।
আজকেও তেমন করে বসলাম । তারপর বলল, তোমার শরীর ঠিক আছে ? আজকে অফিসে আসো নি সকালে ! নীতু এবার আমার দিকে তাকালো । তারপর বলল, আমি যে অফিসে আসি নি এটা তুমি কিভাবে জানো?
একটু থতমত খেলাম ! কি বলব খুজে পেলাম না । ওকে কেন জানি মিথ্যা বলতেও ইচ্ছে হল না । নীতু বলল, তুমি অফিসের সামনে দাড়িয়েছিলে ? অপেক্ষা করছিলে ?
-আসলে আমি ....
-গত আটদিন প্রতিদিন অপেক্ষা করছিলে আমার জন্য ? তাই না ?
আমি একটা কথা বলতে পারলাম না । সত্যিই আমি নীতুর জন্য অপেক্ষা করছিলাম । ওকে একটা বার দেখার জন্য ।
কেন এই কাজটা করছি আমি নিজেই জানি না । কেবলই মনে হচ্ছিলো যে আমি খুব মূল্যবার কিছু হারিয়ে ফেলেছি । ওকে একবার দেখার জন্য বুকের ভেতরটা কেমন করতে লাগলো ।
অথচ আমি কি চাইলে ডিভোর্সটা আটকাতে পারতাম না ?
একটু নমনীয় হলে তো এমনটা ঘটতো না !
আমি নীতুকে বললাম, তুমি কবে জানলে?
-আমি জেনেছি চার দিন আগে । আমার ম্যানেজার সাহেব হঠাৎ আমাকে বলল যে সে নাকি তোমাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখেছে অফিসের সামনে । খানিকটা লুকিয়ে ছিলে নাকি ! আমার ঠিক বিশ্বাস হল না । পরের দিন যখন আসি কালো সানগ্লাস পরেছিলাম । আড়চোখ তোমাকে দেখতেও পেয়েছিলাম । যদিও তুমি সার্জিক্যাল মাস্ক পরেছিলে, তোমাকে চিনতে অসুবিধা হয় নি ।
নীতু চুপ করলো । আমি কি বলবো খুজে পেলাম না । ও কি বিরক্ত হয়েছে? আমাকে ঝাড়ি দেওয়ার জন্য এখানে ডেকেছে নাকি বুঝিয়ে বলার জন্য যে আমাদের মাঝে এখন আর কিছু নেই । তাই এসব করা বন্ধ করতে হবে ।
নীতু বলল, বাসায় গিয়ে আমি এক ফোটা ঘুমাতে পারি নি । পরদিন আমি অফিসে ঢোকার সময় আবারও তোমাকে দেখলাম । অফিসে ঢুকে আবার বের হয়ে এলাম । এবার তোমার পিছু নিলাম । তুমি ঠিক এখানে এসেই বসলে ! তারপর ....
নীতু কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল । আমি অনুভব করলাম ওর গলা ধরে এসেছে । চোখ দিয়ে একটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো । তারপর গাঢ় কন্ঠে বলল, তুমি কাঁদছিলে ! আমার জন্য কাঁদছিলে ?
নীতু সব দেখেছে । আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম কেবল । তারপর আস্তে করে বললাম, আমাদের মাঝে যখন ঝামেলা চলছিলো তখন একটা অনুভূতি ছিল যে তুমি আমার ! আমারই আছো কিন্তু যখন আলাদা হয়ে গেলাম তখন কি যে মনে হয়েছিলো আমি বোঝাতে পারবো না । বারবার কেবল মনে হচ্ছিলো যে আমি আমার জীবনের সব থেকে মূল্যবান সম্পদটা হারিয়ে ফেলেছি ।
নীতুর দিকে তাকিয়ে দেখি সে ওর চোখ দিয়ে আবারও ভাল করে পানি গড়িয়ে পড়ছে । তবে কাজল গলে পড়ছে না । সম্ভবত ওয়াটারপ্রুফ কাজল দেওয়া । নীতু বলল, কাল তোমাকে ওভাবে দেখার পরে কি যে হল আমার মনে আমি জানি না । আমার কেবল মনে হল যে তোমাকে আমার আবারও চাই । যে মানুষটা আমার জন্য এভাবে কাঁদতে পারে তাকে ফেলে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না ।
এই কথা বলতে বলতেই নীতু আমার ঠোঁটে চুমু খেলো । এতো গাঢ় ভাবে আর এতো আবেগ মাখা চুম্বন ওকে আমাকে করেছে কিনা আমার মনে নেই । কিছু সময় যেন আমরা এই জগতেই ছিলাম না ।
আমি আর অফিসে গেলাম না । আরও ঘন্টা খানেক বসেই রইলাম সেই পার্কের । এই ছয় মাসে আমাদের মাঝে তেমন কোন কথা হয় নি । দুজনই দুজনের ঈগো নিয়ে বসে ছিলাম কেবল । একবার যদি কেউ ঈগো সরিয়ে রেখে এগিয়ে আসতাম তাহলে হয়তো আলাদা হওয়ার প্রশ্নই আসতো না ।
সামনে কি হবে আমি জানি না । আমরা আমাদের বাসায় কিভাবে আমার সব কিছু বলবো সেটাও বলতে পারি না । সব আস্তে ধীরে ভাবা যাবে । তবে একটা প্রতিজ্ঞা আমরা একে অন্যের কাছে করলাম যে দ্বিতীয়বার আর আমরা এই ভুল করবো না । ভালোবাসার সামনে আর ইগো আসবে না । যদি সমস্যা হয় তাহলে দুজন মন খুলে কথা বলবো আলোচনা করবো । যেন একে অন্যের কাছ থেকে দুরে চলে যেতে না হয় আর ! ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে দুরে থাকাটা কতটা কষ্টের সেটা আমি আর নীতু দুজনেই খুব ভাল করেই বুঝতে পেরেছি ।এই কষ্ট আর দ্বিতীয়বার পেতে চাই না ।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুন, ২০২১ রাত ১:০৫