এই পোস্টের ছবি কিংবা লেখা আপনাকে খানিকটা অস্বস্তিতে ফেলতে পারে । যদিও ছবি গুলো সরাসরি যুক্ত না করে কেবল লিংক যুক্ত করেছি তবুও পোস্ট পড়ার আগেই সাবধান করে দিলাম !
একটা দৃশ্য কল্পনা করুন । আপনি নিজের শোবার ঘরে শুয়ে শুয়ে মোবাইল ক্রল করছেন । আপনার ঠিক পাশের ঘরে আপনার মৃত কোন আত্মীয় শুয়ে আছে বিছানাতে । এবং সেটা একদিনের জন্য নয়, দিনের পর দিন মাসের পর মাস কিংবা বছরের পর বছরে ! ভাবতে পারছেন ব্যাপারটা ? ওয়েল, আমি কোন ভাবেই ভাবতে পারি না । আমি মৃতদেহকে ভয় পাই । শেষ কোন মৃত মানুষের মুখ দেখেছিলাম প্রায় ২১ বছর আগে !
উপরে যে দৃশ্যটার কথা বললাম, এটা আপনার আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হলেও টোরাজা উপজাতির কাছে এই ব্যাপারটা খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার । তাদের সবার বাড়ির খাটে এইভাবে একটা মমিকৃত মৃতদেহ শুয়ে থাকতে দেখা যায় প্রায় ! এই কালচারটার ব্যাপারে আমি প্রথমে জানতে পারি ডিকভারি চ্যানেল থেকে । বাড়িতে গেলে টিভি দেখা ছাড়া আমার তেমন কোন কাজ থাকে না । বেশির ভাগ সময়েই ডিসকভারি চ্যানেলটাই দেখা হয় । সেখানে এক্সিডিশন আননোন নামে একটা অনুষ্ঠান হয় । সেখানেই এই কালচার সম্পর্কে প্রথম জানতে পারি ।
টোরাজান উপজাতির বসবাস ইন্দোনেশিয়াতে । পাহাড় ঘেরা দক্ষিন সুলাওসি (South Sulawesi) রাজ্য তাদের বসবাস । ধর্মের দিক দিয়ে তারা বেশির ভাগই খৃষ্ট ধর্মের । তবে অন্যান্য ধর্মের ভেতরে মুসলিমও রয়েছে ।
কেউ মারা গেলে আমরা যত দ্রুত সম্ভব তাকে কবরস্ত করতে চাই। আমাদের কালচারটা এমন । আমরা জানি যে মৃতকে ঠিকমত সৎকার আর দ্রুত সৎকার না করলে তার আত্মা কষ্ট পায় । কিন্তু টোরাজা উপজাতির মানুষ এমনটা মোটেই ভাবে না । তারা মানুষ মরার ব্যাপারটা একেবারেই অন্য চোখে দেখে । তাদের কাছে মৃত্যু কোন দুঃখের ব্যাপার নয় বরং এটা নতুন একটা শুরু বলে তারা মনে করে ।
যখনই তাদের আত্মীয়দের কেউ মারা যায় সাথে সাথেই তখন তারা মৃত দেহের সৎকার করে না । তারা প্রথমে সেই মৃতদেহকে স্থানীয় কিছু মেডিসিন ব্যবহার করে মমিতে রূপান্তর করে যাতে মৃতদেহে পঁচন না ধরে । এরপর সেই মৃতদেহ কে তারা নিজেদের বাড়িতে রেখে দেওয়া হয় । ঠিক একজন পরিবারের জীবিত সদস্যদের মত করেই । প্রতিদিন মৃতদেহের সাথে তারা কথা বলে, খাদ্য পরিবেশ করে । বাড়ির সকল আনন্দ আলোচনাতেও তাকে সামিল করে । বাড়ির ছোটরা তাদের মৃত দাদী নানীর সাথে ঠিক সেই ভাবেই আচরন করে যেখানে জীবিত থাকা অবস্থায় করতো এবং এই ঘটনা একদিন দুইদিন নয় বরং মাস কিংবা বছর পর্যন্ত চলতে থাকে । টোরাজান উপজাতির মানুষেরা বিশ্বাস করে যে মৃত্যুর পরেও মৃতদের আত্মা তাদের মাঝেই বসবাস করে । তাদেরকে কবরস্ত করার আগ পর্যন্ত তাদেরকে ডাকা হয় টুমাকুলা (to’makula) যার অর্থ দাড়ায় অসুস্থ এখনও মৃত নয় ! তারা মৃত মানুষটাকে কোন ভাবেই মৃত ভাবে না ।
মৃতদেহের ছবি এখানে দিলাম না । তবে ছবির লিংক যুক্ত করলাম । নিজ দায়িত্ব নিয়ে দেখে আসতে পারেন । ছবি লিংক
এখানে একজন টোরাজান তার ছোট মেয়েকে নিয়ে তার মৃত পিতামাতা কে দেখাশুনা করছে ।
টোরাজান কালচারে অন্যতম বড় ব্যয়বহুল একটা উৎসব হচ্ছে এই মৃত সৎকারের উৎসব । কেউ মারা যাওয়ার পর পরিবারের লোকজন তার ফাইনাল ফিউনারালের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে শুরু করে । ব্যাপারটা এমন যে পর্যান্ত পরিমান টাকা যত সময় না জমা হচ্ছে তত সময় পর্যন্ত মৃতদেহটাকে তারা নিজেদের বাসায় রেখে দেয় । তবে তারা ব্যাপারটাকে অন্য ভাবে দেখে । তারা নিজেদের ভেতরেই নিজেদের মৃত মানুষটাকে রেখে দিতে পছন্দ করে । তাদের মতে মানুষ যখন মারা যখন তখনই যদি তাকে কবরস্ত করা হয় তখন প্রিয় জনের মনের ভেতরে একটা সাডেন শক কাজ করে । কিন্তু যখন দিনের পর দিন বছরের পর বছর মৃত মানুষটা তাদের সাথে বসবাস করে তখন সেই দুঃখটা আস্তে আস্তে কেটে যায় ।
ফিউনারেল সেরিমনির সেখানে উৎসবের মত । যারা ক্ষমতাবান তাদের ফিউনারেল অনুষ্ঠানে হাজার হাজার মানুষ এসে সামিল হয় । উৎসব চলে সাত দিন কিংবা মাসব্যাপি । বাড়ি থেকে মৃতদেহকে সাজিয়ে পরিয়ে কফিনে ভরে, বাঁশ কিংবা কাঠের মাচার উপরে কফিনকে রেখে নিয়ে যাওয়া হয় সমাধির দিকে । এই পথ টুকুতে তারা নেঁচে গেয়ে আনন্দ করতে যায় । জোরে হোরে মিউজিক বাজতে থাকে । এই সৎকার অনুষ্ঠানের আরেকটা দিক হচ্ছে ওয়াটার বাফেলো ! মৃত মানুষটা যত সম্মানীয় আর ধনবান হয় তার জন্য ততবেশি বেশি ওয়াটার বাফেলো জবাই দেওয়া হয় । সাথে থাকে শুকর । তারা বিশ্বাস করে যে যত বেশি মহিষ উৎসর্গ করা হবে মৃত মানুষটার জন্য ততই সহজ হবে দ্য ল্যান্ড অব সৌলে পৌছানো । অনেক টা মহিষের পিঠে চড়ে সেখানে সে যাবে ।
ছবি সুত্র
মৃতদেহকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ।
ছবিসুত্র
নীল চোখের ওয়াটার বাফেলো যা উৎসর্গ করা হবে
যেখানে মৃতদেহদের কবরস্ত করা হয় ছবি লিংক
একেবারে ছোট শিশু মারা গেলে যেখানে কবরস্ত করা হয় ছবি লিংক
ভাবছেন এখানেই বুঝি শেষ ? না, এখানেই এদের অনুষ্ঠান শেষ নয় । টোরাজানদের আরও একটা অনুষ্ঠান রয়েছে যার নাম মা'নেনে অনুষ্ঠান । এই অনুষ্ঠানে তারা মৃতদেহকে তাদের সমাধি থেকে উত্তলোন করে । তারপর তাদের সেই সমাধিটাকে পরিস্কার করা হয় । অন্য দিকে মৃতদেহেও পরিস্কার পরিছন্ন করা হয়। তাদের পোশাক বদলে দেওয়া হয় । নতুন ভাবে তাদের সাজানো হয় । তারপর তাদের সাথে পরিবারে আত্মীয় স্বজনেরা ছবি তোলে । এক সাথে খাওয়া দাওয়া করা হয় । এটা অনেকটা পারিবারিক পুনর্মিলনের মত একটা অনুষ্ঠান । সবাই এসে হাজির হয় । মৃতদেহকেও তুলে নিয়ে আসা হয় ! দুই তিন বছর পরপরই এই মা'নেনে পালন করে তারা ।
ছবি লিংক
মা'নেনের জন্য মৃতদেহ কে তুলে আনা হয়েছে ।
টোরাজান উপজাতির আসলে এই কালাচারটা কোথা থেকে পেল । নিউটাইমের একটা প্রতিবেদনে বলছে এই রিচু্য়্যালটা এসেছে পঙ রুমাসেক নামের একজন প্রসিদ্ধ শিকারীর কাছ থেকে । প্রায় একশ বছরের বেশি সময় আগে পঙ টোরাজান জঙ্গলে শিকার করতে গিয়ে একটা পরিত্যক্ত মৃতদেহ খুজে পায় । সে অপরিচিত এই মানুষটার দুর্ভাগ্য দেখে সে শোকাহত হয় এবং নিজে মৃতদেহটার দেখা শুনা করে । ভাল পোশাক পরিয়ে সৎকার করে । তারপর থেকেই নাকি তার পঙয়ের ভাগ্য বদলে যায় । এই গল্পের পর থেকেই এই ফিউনারেক কালচারটা শুরু হয়েছে বলে মানুষের ধারণা ।
আমি মৃতদেহের কাছ থেকে সব সময় দুরে থাকি । ভয় কিংবা অস্বস্তি যেটাই বলি আমি সব সময় দুরে থাকি । শেষ আমি আমার এক নানীর মৃত মুখ দেখেছিলাম । তাও সেটা প্রায় ২১ বছর আগে । এর পর আমি আর কোন মৃত মানুষের মুখ দেখি নি । ভাবতেই পারি না এই ব্যাপারটা । মাঝে কেবল মাত্র হুমায়ূন আহমেদের জানাযাতে অংশ নিয়েছিলাম । এছাড়া আর কোন মৃতের ধারে কাছেও যায় নি । অথচ এই মানুষ গুলো কত সহজেই না এই ভাবে কেবল মৃতের কাছে যাচ্ছে একই ছাদের নিচে থাকছে ।
এছাড়া ইউটিউব থেকে কয়েকটা ভিডিও দেখতে পারেন ।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফির ডকুমেন্টারি
বিবিসির ডকুমেন্টারি
তথ্যসুত্র
Wikipedia.org
Culturacolectiva.com
Smh.com-Life among the dead
Nationalgeographic.com
Thegypsyhearttravels.com
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২১ দুপুর ২:২০