উপরের ছবিতে বাসা বাড়িতে বানানো এক প্লেট ইফতারের ছবি দেখা যাচ্ছে । আজকে হঠাৎ ফেসবুক মেমরিতে আসলো । ভাবলাম কয়েকটা কথা লিখি । আমাদের সবার বাসাতেই মোটামুটি এমন ইফতারের ছবি দেখা যায় । কম বেশি ছোলা, পিয়াজু বেগুনি সবাই বানায় । অনেকে আবার ফল বেশি পরিমানে খায় । আমি অবশ্য ছোলা আর আলুর চপ বেশি খাই । উপরের এই ইফতারের প্লেটের ভেতরে আসলে বিশেষত্ব কী?
বিশেষত্ব হচ্ছে এই ইফতারটা বানিয়েছে একজন হিন্দু ধর্মালম্বীর মানুষ ।
আমি ঢাকা শহরে একটা হিন্দু পরিবারের সাথে সাবলেটে একটা রুম নিয়ে থাকি অনেক দিন । সময়ের হিসাবে সেটা প্রায় ১০ বছরের বেশি হতে চলল । এই সময়ে আমি আসলে তাদের পরিবারের একজন সদস্য হয়ে গেছি । তার ছোট ছেলেকে চোখের সামনে জন্মাতে দেখেছি । আমি তার রক্তের যোগানদাতা হিসাবে হিসাবে স্টানবাই ছিলাম অপারেশনের সময় ।
২০২০ সালের রোজার এই সময়টা কঠোর লক ডাউন দিয়েছিলো । আমাদের এলাকাতে তখন বেশ কড়াকড়ি । আমি এই লক ডাউনের সময় একদমই নিচে নামতাম না । নির্ধারিত সময়ে নেমে বাজার সদাই করতাম এই যা । রান্না বান্না সব বাসাতেই । কিন্তু ইফতার তো আর বাসায় বানানোর উপায় নেই । আমাদের এলাকাতে তখন ইফতারের দোকান বসে নি একটাও লকডাউনের কারনে। তাই ইফতারে জুস ফল চিড়া এসব খাওয়ার প্লান করেছিলাম । কিন্তু ইফতারের দিন থেকেই দিদি এই ইফতার নিয়ে হাজির । কেবল আমার জন্য আলাদা ভাবে এই ইফতার বানানো হয়েছে । এরপর পুরো রমজান জুরেই ইফতারে কোন না কোন কিছু ইফতারে সে বানিয়ে দিয়েছে ।
এই যে একজন অন্য ধর্মের বানিয়ে দেওয়া ইফতারে আমি রোজা ভাঙ্গছি, আমার মাথায় কোন দিন আসেও নি যে আমার রোজা হচ্ছে তো .. যদি কেবল উপরওয়ালা এই অন্য ধর্মের মানুষের হাতে বানানো ইফতার খাওয়ার জন্য আমার রোজা কবুল না করে, সত্যি বলতে কি তাতে আমার বিন্দু মাত্র আফসোস থাকবে না ।
এছাড়া দিদির পরিবার প্রতিবছর রোজার সময় ইফতারের আয়োজন করে । রোজার একটা দিনে তিনি তার অফিসের সব কলিগদের বাসায় দাওয়াত দেন । ইফতার থেকে ডিনার পর্যন্ত খাওয়ার আয়োজন চলে । এই যে আয়োজন এই আয়োজনের ভেতরে কি কোন খারাপ কিছু থাকতে পারে ? আমার চোখে কোন দিন পরে নি । আমার কোন দিন মনেও হয় নি যে এটা কোন বেঠিক কাজ !
যখন ঢাকাতে আমি প্রথম গিয়ে হাজির হয়ে তখন যেই মেস বাড়িতে ছিলাম, সেই মেস বাড়িতে আমাদের সাথে একটা হিন্দু ছেলে থাকতো । রমজান চলে একটা মজার ব্যাপার খেয়াল করলাম । মেস বাড়ি থেকেই ইফতারের আয়োজন করা হত । বড় একটা বোউলের ভেতরে ইফতার মাখানো হত । তারপর সবাই সেই বোউের চারিপাশে বসে ইফতার করতাম । খেতে খেতে গল্প । এবং সেই ইফতারে প্রতিদিন সেই হিন্দু ছেলেটাও যুক্ত থাকতো । আমার কাছে তখন এই ব্যাপার টা নতুন । কিন্তু তবুও আমার কেন জানি এই দৃশ্যটা একবারও অস্বাভাবিক মনে হয় নি । বরং মনে হয়েছে এর থেকে স্বাভাবিক কিছু যেন হয়ই না ।
এরপর বিশ্ব বিদ্যালয়ের বন্ধুদের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়লো । তখন প্রতি রমজানে আমরা বাসায় যাওয়ার আগে একটা ইফতার পার্টি করতাম । তখন টাকা পয়সা কারো কাছেই ছিল না । সবাই মিলে টাকা দিয়ে ইফতার কিনতাম । তারপর কারো মেসবাসা কিংবা খোলা মাঠে বসে ইফতার গুলো করা হত । আমাদের পছন্দের জায়গা ছিল টিএসসির পেছনের একটা স্থান । পাশেই আমাদের এক বন্ধুর বাসা ছিল । দরকারী সব জিনিস পত্র তার বাসা থেকে আনা হত । এই ইফতারেও আমাদের তিন চারজন হিন্দু বন্ধু যুক্ত হত আমাদের সাথে প্রতিবার । কেবল ইফতারই নয়, আমাদের এই ১২/১৩ জনের গ্রুপটা সব কাজ এক সাথে করতাম । ট্যুর থেকে শুরু করে এসাইনমেন্ট, গ্রুপ স্টাডি সব কিছু এক সাথে । ইফতার পার্টিও তাই এক সাথেই করেছি সব সময় ।
আরেকটা গল্প বলি আমাদের ছাত্র জীবনের এই গ্রুপটা নিয়ে । আমরা প্রায়ই এদিক সেদিক খেতে যেতাম বিভিন্ন উপলক্ষে । এর ভেতরে জন্মদিনের ট্রিট হত সব থেকে বেশি । নান্নার বিরিয়ানীতে কতবার গিয়েছি তার ঠিক নেই । আমাদের গ্রুপের ভেতরেই একজন এমন হিন্দু ধর্মের বন্ধু ছিল যে মাংস খেতো না । তার গোত্রের কোন একটা নিয়ম । কিন্তু তাহলে সে আমাদের সাথে যাবে কিভাবে? কিন্তু প্রতিবারই যে ঠিক ঠিক হাজির হত । আমরা যখন নান্নার বিরিয়ানী অর্ডার দিতাম সে পাশের কোন হোটেল থেকে ভাত আর মাছ কিনে নিয়ে আসতো । এরপর আমাদের সাথে একই টেবিলে বসে যেত । এই একসাথে বসে খাওয়া এটাই ছিল আমাদের মুল জিনিস ।
এই যে সাধারণ জীবনের গল্প গুলো তখন স্বাভাবিক ভাবে ঘটে গিয়েছে কিন্তু এখন যখন বসে বসে ভাবি তখন মনে হয় কত চমৎকার কত অসাধারণ সময়ই না আমরা পার করেছি ।
আমাদের বন্ধুত্বের মাঝে কোন দিন হিন্দু মুসলিম আসে নি । এখনও আসে না । ঠিক একই ভাবে মানুষের মেশা পরিচয়ের বেলাতেও কোন দিন তার ধর্ম পরিচয় আমার কাছে কোন দিন মূখ্য মনে হয় নি । মানুষের সাথে সব সময় মিশেছি তার স্বভাাব চরিত্র দেখে এবং সব বড় যে জিনিস টা হচ্ছে আমার প্রতি তার আচরন দেখে । যে আমার প্রতি মায়া মমতা ভালোবাসা যত্ন দেখিয়েছে, তার প্রতি ঠিক একই পরিমান ভালোবাসা আমি সব সময় দেখিয়েছি। নিজের ধর্মের হলেই তার সাথে ভালো সম্পর্ক তৈরি করবো অনন্য ধর্ম হলে মুখে মুখে ভাল কিন্তু অন্তরে ভাল সম্পর্কে তৈরি করবো না এমন তত্ত্বে আমি কোন কালে বিশ্বাসী ছিলাম না । এখনও নেই এবং সামনেও থাকবো না ।
সবাই সুস্থ থাকুক ।
হ্যাপি ব্লগিং এবং অগ্রিম ঈদ মোবারক ।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে এপ্রিল, ২০২২ রাত ১২:৩৩