
সালটা ২১২৬ । কোন প্যারালাল ইউনিভার্স । বিজ্ঞানের জয় জয়কার । ধার্মিকেরা এখানে সংখ্যা লঘু । বিজ্ঞানই এখানে ঈশ্বর । বিজ্ঞানের বাইরে কেউ যেতে পারে না । কোন কোন দেশে মানুষ বিজ্ঞানের বাইরে একটা কথা কেউ বলতে পারে না । তবে অনেক দেশেই অবশ্য নমনীয় ভাব বজায় রেখেছে । দেশ বিজ্ঞান ভিক্তিক হলেও সেখানে ধর্ম বিশ্বাসও প্রচলিত আছে !
প্রতি দেশের নিজেস্ব একটা বিজ্ঞান কাউন্সিল রয়েছে । দেশে যদিও সাধারণ ভাবেই ভোট হয়, সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বচিত হয় তবে আসল ক্ষমতা থাকে রয়েল একাডেমি অব সায়েন্স কাউন্সিলের হাতে । প্রায় সব দেশেই এই কাউন্সিলের প্রধানরাই প্রছন্ন ভাবে দেশ পরিচালনা করেন । প্রেসিডেন্ট তাদের পরামর্শ মোতাবেক কাজ করেন ।
দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধারীদের একজন হয়ে উঠতে মানুষকে হতে হয় সর্বোচ্চ জ্ঞানের অধিকারী, সব থেকে বড় মেধাবী । থাকতে হয় যুগান্তকারী কোন আবিস্কার নয়তো সর্বজনীন কোন বৈজ্ঞানিক থিউরি । দেশের নিরাপত্তায় নিয়োজিত গুরুতপূর্ণ ব্যক্তিকে বড় ডিগ্রীধারী হতে হবে । নয়তো তাকে চাকরি দেওয়া হয় না ! দেশের অন্যান্য পেশা মানুষদেরকেও যে অসম্মান করা হয় তেমনটা অবশ্য নয় । তবে সবচেয়ে বেশি সম্মানটা পান বৈজ্ঞানিক, বিজ্ঞান ভিত্তিক গবেষকগন !
এমনই কোন একটি দেশের গল্প । আজকে সেই দেশে বিজ্ঞান কাউন্সিলের একটা গোপন সভা বসেছে নিরাপত্তা ভবনে। সর্বোচ্চ সতর্কতা এবং গোপনীয়তা নিয়ে এই সভার আয়োজন করা হয়েছে । কেবল মাত্র কয়েকজন সর্বোচ্চ পর্যায়ের পরিচালক রয়েছেন সভাতে । এছাড়া নিরাপত্তা পরিষদের উচ্চতর কয়েকজন অফিসারও আছেন । আছেন গোয়েন্দা সংস্থার ডিরেক্টর । তবে কোন রাজনৈতিক দলের সদস্যকে সেখানে রাখা হয় নি । এমন কি দেশের প্রেসেডেন্ট পর্যন্ত এই সভার খবর জানেন না । হয়তো জানবেনও না !
রয়েল কাউন্সিল অব সায়েন্সের চেয়ারম্যান আদিমান আদিব আসন গ্রহনের সাথে সাথে সভা শুরু হল । আজকের সভার বিষয় বস্তু প্যারামজিদ ।
আদিমান বসতে বসতেই গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান রমানুজকে বললেন, কি খবর জনাব রমানুজ! আজকে এতো জরুরী তলব দিয়ে এখানে আমাদের সবাইকে জড় করেছেন ! তাও আবার রেডওয়ান ফ্লাগ দিয়ে ? খুলে বলুন তো সব !
রেড ওয়ান ফ্লাগ ইন্ডিকেশন টা হচ্ছে এমন একটা সংকেত যা কেউ এড়িয়ে যেতে পারে না । সর্বোচ্চ পর্যায়ের লোকজন থেকে শুরু করে দেশের সাধারণ মানুষ পর্যন্ত সবার ব্যক্তিগত যোগাযোগ মডিউলে এই নির্দেশণা পাঠানো যায় । এর অর্থ হল আপনাকে আসতেই হবে। কেউ যদি অসুস্থ হয়ে বিছানাতেও পড়ে থাকে তখন তার সেই বিছানা সহ তাকে উঠিয়ে নিয়ে আসা হয় । কারো এই নির্দেশনা উপেক্ষা করার ক্ষমতা নেই । দেশের প্রেসিডেন্ট, রয়েল সায়েন্স কাউন্সিল চেয়ারম্যানেরও না । তবে সবাই এই রেডওয়ান ফ্লাগ সংকেত পাঠাতে পারে না । অল্প কিছু মানুষের কাছে এই ক্ষমতা রয়েছে ।
রমানুজ একটু গলা খায়েরি দিয়ে বলল, স্যার আমরা প্যারামজিদ এর লেখকের পরিচয় বের করেছি ।
সভা কক্ষে যেন বোমা পরলো । সবাই যেন একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেছে । কারো মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না । কেউ যেন ঠিক মত কথাটা হজম করতে পারছে না । অবশেষ বদমাইশটাকে পরিচয় বের করা গেল । আদিমান বলল, কে সে?
রমানুজ সামনে থাকা মডিউলে একটা চাপ দিল । টেবিলের ঠিক মাঝে ত্রিমাত্রিক একটা ছবি ফুটে উঠলো । সবাই অবাক হয়ে দেখলো খুব সাধারণ চেহারার একজন মানুষ । নম্র ভদ্র একজন প্রাথমিক স্কুল শিক্ষকের মত চেহারা !
রমানুজ বলল, লোকটার নাম সাদেব মাহাতাব । বসিলাতে থাকে । নিজের একটা ছোট খাবারের ব্যবসা আছে । সেটা নিয়েই থাকে ।মানুষের উপরকার করে । কারো কোন ক্ষতি করেছে বলে এমন কোন রিপোর্ট আমাদের কাছে নেই । এমন কি কারো সাথে কোন ঝগরা বিবাদ পর্যন্ত কোন করে নি । এই হচ্ছে ''প্যারামজিদ'' এর আসল লেখক ।
এতো সময় সবাই সাদেব মাহাতাবের নাম চেহারা এবং কাজ কর্ম শুনছিলো । সবার মনে মাহাতাবের জন্য একটা সহানুভূতি কাজ করছিলো । আদতে সে ভাল মানুষই মনে হচ্ছে । কিন্তু যখনই প্যারামজিদের নাম শোনা গেল তখনই সবার মুখের ভাব বদলে গেল ।
বিজ্ঞানের জগতে প্যারামজিদ এক কলঙ্কের নাম ! যখন সব কিছুই বিজ্ঞান ভিক্তিক তখন প্যারামজিদ হচ্ছে চরম অবৈজ্ঞানিক এক গ্রন্থ । এই গ্রন্থে এমন সব কথা বার্তা লেখা আছে যা সরাসরি বিজ্ঞানের সাথে সাংঘর্ষিক । বিজ্ঞান অনেক সুত্র প্যারামজিদে অস্বীকার করা হয়েছে । বিজ্ঞান কাউন্সিল অবশ্যই মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে কিন্তু যখন সেটা বিজ্ঞানের সাথে সাংর্ঘষিক সেটা বিজ্ঞান কাউন্সিল কিভাবে মেনে নিবে? যখনই বইটা প্রকাশ হল তখনই চারিদিকে জনরোষ তৈরি হল । দেশের বিজ্ঞান মনস্ক মানুষ বইটাকে নিষিদ্ধের দাবী জানালো । তাদের বক্তব্য যে যদি এই বই তাদের বাচ্চারা পড়ে তাহলে বিজ্ঞানের উপর থেকে তাদের মন সরে যেতে পারে । এটা কোন ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না !
এছাড়া দেশে আছে কিছু উগ্রবাদী বিজ্ঞানমস্ক মানুষ । বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে তারা সামান্য বিরূপ কথা পর্যন্ত শুনতে পারে না । তাদের এখনও পর্যন্ত বিজ্ঞান কেবল মানুষের কল্যান করেছে । কোন ক্ষতি সাধন করেন নি । তাদের সমানে যদি কেউ বিজ্ঞান বিজ্ঞানের আবিস্কারের ব্যাপারে কোন খারাপ কিছু বলে তাহলে তারা তীব্র ভাবে রেগে যায় । একবার একজন ঈশ্বরে বিশ্বাসী মানুষ তার ফেসবুক স্টাটাসে লিখেছিলো যে বিজ্ঞানের আবিস্কারে এটম বোমা তৈরি হয়েছে যা মানব জাতির ক্ষতি সাধান করেছে । ব্যাস আর যায় কোথায় । তার সেই স্টাটাসে এই বিজ্ঞানমস্কেরা সমানে গালি গালাজ করতে শুরু করলো । কেবল সেখানেই থেমে থাকলো না, কিছু লোক তো তাকে সরাসরি হামলা করে বসলো ছুরি দিয়ে । এই ঘটনা কয়েক বছর আগের । সেই সময়ে সারা দেশে আলোচনার একটা ঝড় উঠেছিলো । তবে দেশের বেশির ভাগ মানুষেরই কেমন একটা প্রছন্ন সমর্থন ছিল এই হামলার ব্যাপারে । তাদের বক্তব্যটা ছিল যে কোন সাহসে একজন বিজ্ঞানের নামে কটু উক্তি করে । যেখানে বিজ্ঞান জীবন এতো সুন্দর এতো সহজ করেছে । সেই লোককে শেষে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে । জ্ঞান বিজ্ঞানে উন্ননত হলেও অনেক দেশে অবশ্য এই বিজ্ঞানের ব্যাপারটা বাধ্যতামূলক করা হয় নি । অনেকে দেশেই অবশ্য এখনও নয়মীয় ধর্ম বিশ্বাসের ব্যাপারে । তাদের কাছে ব্যক্তিগত ধর্ম বিশ্বাসের সাথে তাদের কোন বিরোধ নেই । বিরোধ তখনই হবে যখন সেটা অন্যের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবে । ততক্ষণ পর্যন্ত সবাই স্বাধীন !
তবে এই দেশে অনেকের বক্তব্য হচ্ছে মানুষের বিজ্ঞানুভূতি খুব সেন্সেটিভ একটা ব্যাপার । এমন কোন কথা বলা আসলে উচিৎ না যেখানে কেউ মনঃক্ষুন্ন হয় । তাই সবাইকে এই ধরনের বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত থাকা উচিৎ ।
এরপর প্যারামজিদ বইটা বের হল । সেই বইতে হাস্যকর সব যুক্তি উপস্থাপন করা হল । বিজ্ঞানের সাথে সাংঘর্ষিক এমন অনেক কিছুই লেখা ছিল । স্বভাবই দেশের মানুষ আবারও ফুসে উঠলো । বই নিষিদ্ধের দাবী উঠলো । লেখককে গ্রেফতার করার দাবী উঠলো । তবে এখানে লেখক একটা বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছিল । নিজের পরিচয় লুকিয়েই সেই বইটা প্রকাশ করেছিল অনলাইনে । অনেক চেষ্টা করেও তার পরিচয় বের করা গেল না ।
চেয়ারম্যান আদিমান বললেন, আপনি কি নিশ্চিত যে এই সেই লোক ? দেখে তো মনে হচ্ছে না ।
-আমার কাছে শতভাগ প্রমান আছে যে এই সেই লোক ।
-তাহলে কী করা যায় একে নিয়ে !
সভার কক্ষে থাকা একজন বলে উঠলো, স্বাভাবিক । আজই একে গ্রেফতার করা হোক । তারপর আমাদের বিজ্ঞানুভূতিতে আঘাত দেওয়ার জন্য শাস্তি দেওয়া হোক । ব্যাস ঝামেলা শেষ । একবার যদি একে শাস্তির আওয়ায় আনা হয় তাহলে অন্য কেউ আর বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে কিছু বলতে সাহস পাবে না ।
আদিমান বলল, নাহ, আমার মনে হয় এটা করা ঠিক হবে না । যদিও বিজ্ঞানুভূতিতে আঘাত দেওয়ার জন্য একটা আইন আমাদের কাছে আছে । এই আইনে এই লেখককে শাস্তি দেওয়া যায় । তবে আমি আপনি সবাই জানি যে এই আইনটা করা হয়েছে দেশের বিজ্ঞানমনস্কদের শান্ত করতে । এখন যদি আমরা এটা ব্যবহার করি বিশেষ করে এই ক্ষেত্রে এটা একটা বড় ইস্যু হয়ে যাবে । আপনারা সবাই জানেন সাধারণ মানুষের কিছু অংশ এখনও প্রচলিত বিশ্বাসে বিশ্বাসী । তাদের কথাও আমাদের ভাবতে হবে ।
-তাহলে আমরা কিছু করবো না?
আদিমান হাসল । তারপর বলল, আমরা সরাসরি কিছু করবো না তবে……
-তবে?
-এমন অনেকেই আছে যারা অনেক কিছু করতে পারে…
রমানুজ কিছু সময় তাকিয়ে রইলো চেয়ারম্যান আদিমান আদিবের দিকে । তারপর সেও হেসে ফেলল । তবে মুখ দিয়ে কিছুই বলল না সে । সে ঠিক ঠিক বুঝে গেছে তাকে কী করতে হবে ।
চেয়ারম্যান সভা শেষ করার আগে আরেকবার সবাইকে মনে করিয়ে দিল যে এই সভার ব্যাপারে যে বাইরে কোন কথা না হয় । কেবল মাত্র যারা যারা এই সভায় উপস্থিত আছেন তাদের ছাড়া আর কেউ এইসব ব্যাপারে না জানাই ভাল । এমন কি বর্তমান প্রেসিডেন্ট এবং তার রাজনৈতিক দলের কেউ যাতে না জানে !
সবাই সম্মত হয়ে বের হয়ে গেল সভা কক্ষ থেকে ।
পরিশিষ্টঃ
সাদেব মাহাতাবের কলাপে বিন্দু বিন্দু ঘাম । যদিও গাড়িতে এসি আছে তার পরেও সে ঘামছে । এই ঘাম গরমে নয়, এই ঘাম প্রাণ ভয়ের । তার গাড়িটা এগিয়ে চলছে উত্তর দিকে । সেখান থেকে দেশের বর্ডার ক্রস করার ইচ্ছে তার । তার পরিচয় বের হয়ে গেছে । পুরো ইন্টারনেটে কে বা কারা তার পরিচয় প্রকাশ করে দিয়েছে । সেই বিজ্ঞান মনস্কদের এক্সট্রিমিস্ট গ্রুপটা তার নামে হুলিয়া জারি করেছে । মাহাতাব এখন জানে যে তার পরিচিত মানুষেরাই তার শত্রু হয়ে উঠবে । তাকে পালাতে হবে । পাশের দেশে চলে যেতে হবে । সেখানে গেলে হয়তো কিছুটা নিরাপদ অনুভব করবে সে । অনেক কয় বছর ধরেই সেখানে এক জন রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছে । তার মতই মত প্রকাশ করতে গিয়ে সে হামলার শিকার হয়েছিল। এখন ওখানেই আছে । মাহাবের এখন লক্ষ্য সেখানেই যাওয়া !
মাহাতাব সব সময় বিশ্বাস করে এসেছে মানুষ যে কোন কিছু বিশ্বাস করতে পারে । যতসময় পর্যন্ত সেই বিশ্বাস অন্য একজনের ক্ষতির কারণ না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত কোন সমস্যা নেই । কিন্তু যখনই একজন নিজের বিশ্বাস অন্যের উপর জোর করে কিংবা ভয় ভীতি দেখিয়ে চাপিয়ে দিতে চায় তখন থেকেই যত সমস্যার শুরু !
মাহাতাবের নিজের নয় বছরের মেয়ে নিধির মুখটার কথা মনে পড়ছে খুব । মাহাবের স্ত্রী নিতু আর মেয়ে নিধিকে ও রেখে এসেছে ওর মায়ের বাসায় । এখন এক্সট্রিমিস্টিরা ওদের বাসায় হামলা না করলেই হল ! ওকে চলে যেতে হবে, পালিয়ে যেতে হবে । তবে ও নিজের বিশ্বাসকে থেমে যেতে দেবে না । মাহাতাব খুব ভাল করেই জানে ওর মত চাপিয়ে দেওয়া কিছু মেনে নিতে চায় না অনেকেই । ওর মত আরও অনেকেই আছে যারা কেবল নিজের বিশ্বাস নিয়ে বাঁচতে চায় । অন্যের চাপিয়ে দেওয়া কিছু নয় ।
হয়তো প্যারালাল ইউনিভার্সে সত্যি সত্যিই এমন একটা কিছু ঘটছে
ছবি সুত্র। ছবিটি ai দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই আগস্ট, ২০২২ দুপুর ১:৩২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




