শেষ কবে স্টারের কাচ্চি খেয়েছিলাম আমার মনে নেই। আগে একটা সময় ছিল যখন কাচ্চির নাম নিলে যে নামগুলো সবার প্রথমে সামনে আসতো তার ভেতরে এই স্টারের নাম থাকতো। এখনকার মতো এত ফ্যানসি কাচ্চির দোকান তখন আসেনি। তখন নান্না হাজি কিংবা স্টার। আর যাদের একটু টাকা-পয়সা বেশি তাদের ছিল ফকরুদ্দিন। আমাদের মতো ছাপোষা ছাত্রদের জন্য স্টার আর নান্নার থেকে ভালো কিছু ছিল না। তাই আমাদের বেশিরভাগ বন্ধুদের ট্রিট এই স্টারেই হতো।
প্রথম স্টারে খেয়েছিলাম যখন একেবারে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। ট্রিটটা আমিই দিয়েছিলাম। প্রথম মাসের টিউশনির বেতন পেয়ে। পুরান ঢাকায় যে স্টারের শাখাটা আছে সেখানে গিয়ে হাজির হলাম। সত্যি বলতে এই কাচ্চি আমার কাছে দারুণ ভালো লেগেছিল। তখন দামটা কত ছিল সেটা আমার স্পষ্ট মনে নেই। সম্ভবত প্লেট প্রতি কাচ্চির দাম ছিল ১২৫ টাকা। একটা বড় খাসির মাংস, একটা বড় কাবাব সাথে ডাল আর আলু।
মোটামুটি সেই থেকেই শুরু। তারপর থেকে আমাদের বন্ধুদের যেকোনো ট্রিট হলেই সেটা হয় এই স্টার কাবাবে হতো নয়তো নান্না বিরিয়ানিতে। এখানে একটা কথা বলে রাখি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে আমাদের ১০/১২ জনের একটা গ্রুপ ছিল। এই গ্রুপটার প্রায় সবাই ছিল একটু ফাঁকিবাজ টাইপের। আমাদের ক্লাসে যখন গ্রুপ অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হতো এদের কেউই বলতে গেলে সেটা করতো না। সব দায়িত্ব এসে পড়তো আমার আর আরেকজনের ঘাড়ে। তখন আমরা দুজন নিয়ম করলাম যে এসব আর হবে না। ফ্রি ফ্রি নম্বর হবে না। তখন তারা পরামর্শ দিল যে অ্যাসাইনমেন্টের কাজ আমরাই করব তবে এর বিনিময়ে তারা আমাদের কাচ্চি খাওয়াবে। আমরা রাজি হয়ে গেলাম। প্রত্যেক সেমিস্টারে যত অ্যাসাইনমেন্ট হয়েছে তার বেশিরভাগ আমরা দুই-তিনজন মিলে শেষ করতাম আর বাকিরা আমাদের কাচ্চি ট্রিট দিতো। এই ট্রিটের বেশিরভাগই হতো এই স্টার কাবাবে নয়তো নান্নার বিরিয়ানিতে। এছাড়া কারো জন্মদিন হলে সেও আমাদের এখানেই ট্রিট দিত।
বন্ধুদের ট্রিট দেওয়ার জন্য এই স্টার বা নান্না ছিল আদর্শ। তখন ছাত্র অবস্থায় কারো হাতেই অফুরন্ত টাকা-পয়সা থাকতো না। সবারই হিসাবের টাকা। সেখানে হাজার-পনেরশো টাকার ভেতরেই সব খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকে যেত। পুরো গ্রুপের খাবার হয়ে যেত।
তবে পড়াশোনা শেষ করার পরে এই স্টারের আবেদন আমাদের কাছে খানিকটা কমে এল। আমরা সবাই ঢাকার নানান প্রান্তে থাকতাম। ট্রিটের সময়টা মূলত হতো আমাদের ক্যাম্পাস থেকে ফেরার সময়ে। তাই সমস্যা হতো না খুব একটা। কিন্তু যখন আর ক্যাম্পাসে যাওয়া হতো না তখন আলাদাভাবে ঢাকার নানান প্রান্ত থেকে এই স্টারে আসার আগ্রহ অনেকেরই থাকতো না। পুরান ঢাকার নান্নাতেও তাই আর যাওয়া হয়নি।
এরপর আরও একটা কারণও ছিল। স্টার কাবাব রেস্টুরেন্টে সব সময়ই মানুষের ভিড় থাকতো। ছাত্র থাকা অবস্থায় আমাদের এই ভিড়ে খুব একটা সমস্যা না হলেও একটু বড় হওয়ার পর আমরা সবাই একটু নিরিবিলি স্থান খুঁজতাম, এমন একটা জায়গা যেখানে খাওয়ার আগে এবং পরে একটা লম্বা সময় শান্তিমতো গল্প করা যাবে। স্টারে সেই সুযোগ ছিল না। সেখানে খাওয়া শেষ করার আগেই দেখা যেতো একদল এসে দাঁড়িয়ে আছে। তাই ধীরে ধীরে স্টারে যাওয়া কমে এল। এক সময়ে একেবারে বন্ধই হয়ে গেল।
শেষ আমি কবে স্টারে বসে খেয়েছি সেটা আমার মনেও নেই। সম্ভবত চার-পাঁচ বছর আগে হবে, ব্লগের বন্ধু মাসুম আর আরেকজনের সাথে গিয়েছিলাম সেখানে। তারপরে আর সেখানে ঢোকা হয়নি।
গতকাল অনেক দিন পরে আবার স্টার রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। আমার বন্ধু এসেছিল ঢাকায় ল্যাপটপ নিয়ে। আমি সাধারণত ছুটির দিনে একদম বের-টের হই না। এই দিনে আমার সারাদিনের কাজ হচ্ছে ল্যাটকাইয়া শুয়ে শুয়ে বই পড়া। এমনকি পিসিও চালু করি না। তাই এই দিনে আমার সাথে কেউ দেখা করতে এলে আমি সাধারণত নানান অজুহাতে মানা করে দিই। কিন্তু এই বন্ধুটি কাছের একজন মানুষ। তাই তাকে মানা করলাম না। সকাল থেকে তার সাথে এদিক-ওদিক ঘুরাফিরা করলাম। মাল্টিপ্লান সেন্টারে ল্যাপটপটা ঠিক করে তারপর নামাজে গেলাম। নামাজের পরে দুজন মিলে দুপুরের লাঞ্চ এই স্টারে। অনেক দিন পরে। সব কিছু আমার কাছে আগের মতোই মনে হলো। আমাদের ঠিক পাশেই একদল কম বয়সী ছেলে-মেয়ে বসে ছিল। স্পষ্টই মনে হলো যে বন্ধুদের ট্রিটেই এসেছে সবাই। আমরা যেভাবে আসতাম।
কাচ্চির টেস্ট আমার কাছে আগের মতোই মনে হলো। তবে এখন মাংসের সাইজ একটু ছোট। এমনকি যে কাবাবটা সাথে, সেটা আগেরটার থেকে অনেক চিকন। খাওয়া-দাওয়া বেশ ভালোই হলো। দেখলাম ওয়েটারগুলো যেমন ছিল তেমনই আছে। খাবার দিয়েই গায়েব হয়ে যায়। আর তাদের দেখা পাওয়া যায় না। কিন্তু যখনই বিল দিতে গেলাম তখন ঠিক আগের মতোই টিপস নিতে হাজির।
স্টার কাবাব রেস্টুরেন্টের সাথে অনেক অনেক সুমধুর স্মৃতি জড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে যখন এগুলো মনে পড়ে তখন মনে হয় সে সময়টা কতই না চমৎকার ছিল। এখন সেটা বুঝতে পারছি বেশ ভালোভাবেই।
(কাল ছবি তুলতে ভুলে গেছি। উপরের ছবিটা নেট থেকে নেওয়া)
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মে, ২০২৫ সকাল ১১:৩৫