
গত কয়েকদিন ঢাকার বাইরে ছিলাম। ঢাকার বাইরে থাকলে ব্লগে ঢোকা হয় না একদম। রাতে ঢাকায় ফিরে একটু ফেসবুকের মেমরি চেক করতেই টের পেলাম যে গতকাল ১৯শে ডিসেম্বর ছিল বাংলা ব্লগ ডে। ব্লগে ঢুকে দেখি ব্লগ ডে নিয়ে কারও কোনো পোস্ট নেই। কারও মনে থাকার কথা না অথবা মনে থাকলেও দেশের পরিস্থিতি গত কয়েকদিন এমন ছিল যে হয়তো কারও এই ব্যাপারে মনে করার ইচ্ছে জাগেনি। আজকে ব্লগে ঢুকে একটু পেছন ফিরে খোঁজ নিয়ে দেখলাম যে গত বছরও ব্লগ ডে নিয়ে কোনো পোস্ট আসেনি। ব্লগ ডের প্রয়োজনীয়তা মানুষের কাছে ফুরিয়েছে। শুধু ব্লগ ডে নয়, বরং পুরো ব্লগের প্রয়োজনীয়তা এখন আর নেই হয়তো।
বাংলায় কমিউনিটি ব্লগ চালু হয়েছিল ২০০৫ সালে। তারপর ধীরে ধীরে বেশ কয়েকটা কমিউনিটি ব্লগ চালু হয়ে যায় পরপর। ২০০৯ সালে সামহোয়্যারইন ব্লগের উদ্যোগেই এই ব্লগ দিবস পালনের ব্যাপারটা শুরু হয়। তারপর বেশ কয়েকটা বছর এই ব্লগ দিবস পালিত হয়েছে। ২০১২ সালে আমি এমন একটা ব্লগ ডেতে গিয়ে হাজির হয়েছিলাম। ২০১৩ সালে সামু কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে বেশ বড়সড়ভাবে ব্লগ ডে পালনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তবে সেই সময়ে রাজনৈতিক ঝামেলার কারণে আর ব্লগ দিবস পালিত হয়নি। তারপর আরও কয়েকবার ব্লগ ডে পালিত হয়েছিল, তবে আমার আর যাওয়া হয়নি।
আগে এই ব্লগ ডে নিয়ে সংবাদপত্রেও খবর বের হতো। এছাড়া ব্লগ ডে নিয়ে কত শত পোস্ট যে আসতো তার কোনো ঠিক নেই। তবে আস্তে আস্তে যখন কমিউনিটি ব্লগের চল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তখন ব্লগ ডে পালন আসলে বিলাসিতা। গত বছর থেকে ব্লগ ডের কথা মানুষজন একেবারে ভুলে গেছে। সামনে আরও ভুলে যাবে।
এখন কমিউনিটি ব্লগের দিন আর নেই। যতগুলো নামকরা ব্লগ ছিল তার সবগুলো আস্তে ধীরে বন্ধ হয়ে গেছে কিংবা যাচ্ছে। যেগুলো টিকে আছে সেগুলোতে কালেভদ্রে কোনো পোস্ট আসে। তার ভেতরে আমাদের সামু ব্লগটা এখনও কোনোমতে ঠিক আছে। টিকে আছে বলতে জানা আপার কারণে ব্লগটা টিকে আছে। তবে সামনে আর কয়দিন টিকে থাকবে সেটা বলা যাচ্ছে না। আপনারা যদি আমার নেওয়া জাদিদ ভাইয়ের ইন্টারভিউটা পড়ে থাকেন, সেখানে দেখবেন তিনি খুব বেশি আশার বাণী শোনাতে পারেননি ব্লগ টিকে থাকার ব্যাপারে।
অবশ্য এই চলে যাওয়ার ব্যাপারটা স্বাভাবিক। প্রযুক্তি সব সময় পরিবর্তিত হয়। মানুষ এক জিনিস গ্রহণ করে, তারপর এক সময় সেটা ফেলে নতুন পণ্যের দিকে ধাবিত হয়। ব্লগটা যখন চালু হয়েছিল সেই সময়ে এই কমিউনিটি ব্লগের ব্যাপারটা আমাদের সবার কাছে একেবারে নতুন ছিল। তাই সবাই একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ব্লগের ওপর। সেই সময়ে সাধারণ মানুষের লেখালেখির মাধ্যম ছিল না বললেই চলে। যারা লিখতে পছন্দ করতো তারা হয় পত্রিকা প্রকাশের জন্য লিখতো, নয়তো সংবাদপত্র কিংবা ম্যাগাজিনে লেখা পাঠাতো। সেই লেখা ছাপা হওয়া যেন ছিল ভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু যখন কমিউনিটি ব্লগ চালু হলো, তখন খুব সহজেই মানুষ নিজেদের লেখাকে ছড়িয়ে দিতে পারছিল। তাই শিক্ষিত সমাজের ভেতরে মুহূর্তের ভেতরেই এর জনপ্রিয়তা হু হু করে বেড়ে যায়। তারপর এক সময় তা পিক অবস্থায় পৌঁছায়। আর তারপরেই পতন।
এখন যে কয়টা কমিউনিটি ব্লগ টিকে আছে যেগুলোতেও আজকে ঢু মারলাম। সেখানেও কোন ব্লগ ডের কথা খুজে পেলাম না। এমন কি ডায়েচে ভ্যালের সাইটেও কিছু পেলাম না। ব্লগ দিবসটা গায়েবই হয়ে গেল তাহলে!
২.
কমিউনিটি ব্লগ আর আগের মতো নেই, তার মানে কি মানুষ লেখালেখি, নিজের মত প্রকাশ আর তর্ক-বিতর্ক বন্ধ করে দিয়েছে? সেসব কিছুই বন্ধ হয়নি। কেবল মানুষ আর ব্লগে সেই কাজগুলো করে না। মানুষ মন প্রকাশের জন্য এখন নতুন নতুন মাধ্যম বেছে নিচ্ছে। সামনে গিয়ে আরও নিবে। এই দেশে ব্লগ আর ফেসবুকের যাত্রা বেশ কাছাকাছি সময়েই শুরু হয়েছিল। সেই সময়ে ফেসবুকে অল্প কয়েক শব্দের স্ট্যাটাস লেখা যেত আর ছবি আপলোড করা যেত। ব্লগে সেই সময়ে লম্বা লেখা যেত আর ছবি আপলোড করা যেত সম্ভবত। তারপর যখন দেশে অ্যান্ড্রয়েড ফোন হাতে পৌঁছে গেল, তখন সোশ্যাল নেটওয়ার্কের বিপ্লব হলো। মানুষ এখন আর এক পা-ও যেন নড়তে চায় না এই সোশ্যাল নেটওয়ার্ক ছাড়া। তারাও গ্রাহক ধরে রাখার জন্য কত কিছুই না নিয়ে আসছে। ছবি আপলোড থেকে এখন লাইভ পর্যন্ত করা যাচ্ছে। সামনে আসলে আরও কত কী যে করা যাবে কে জানে। অন্য দিকে আমাদের ব্লগের দিকে তাকিয়ে দেখুন, সেই একই পর্যায়ে রয়েছে। নতুন কিছু ব্লগে যোগ হয়নি। মানুষ কমিউনিটি ব্লগ থেকে আরও সহজে, আরও বেশি সুযোগ-সুবিধাসহ আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারছে; মানুষ কেন ব্লগে পড়ে থাকবে!
ব্লগের পরিচিত অনেকেই নিয়মিতভাবে তাদের লেখালেখি চালু রেখেছে। তাদের লেখার পাঠকের অভাব নেই। অনেকে ভিডিও ব্লগ করে। তাদের দর্শকের সংখ্যার অভাব নেই। এখন তারা আর ব্লগে আসে না। আসার দরকারও নেই। এভাবে সকলেই চলে গেছে ধীরে ধীরে। তবে বেশ কিছু ব্লগার আসলেই হারিয়ে গেছে। তারা আর লেখালেখি করে না। ব্লগের সেই শুরুর সময়ে অনেকে ছাত্র অবস্থায় ছিল। পড়াশোনার পর তারা নিজ নিজ চাকরি ও ফ্যামিলি জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছে। তাদের আর লেখালেখির সময় নেই। এমন দুজন মানুষের সাথে এখনও আমার পরিচয় আছে। আগে চমৎকার গল্প লিখতো তারা। পরে চাকরি আর বিয়ের পর এখন পুরো সাংসারিক জীবনে ব্যস্ত হয়ে গেছে।
ব্লগে এখন দুই ধরনের মানুষ রয়েছে। এক, যারা অন্য প্ল্যাটফর্মে নিয়মিত লেখালেখি করছে এবং সামুর প্রতি ভালোবাসা থেকে সেই লেখা থেকে কিছু লেখা সামুতে প্রকাশ করছে। সামু তাদের কাছে একটা অভ্যাসের মতো, ভালোবাসার মতো। সামুতে হয়তো আগের মতো আর সময় দেয় না তারা, তবে নিয়ম করে দিন বা সপ্তাহের একটা নির্দিষ্ট সময়ে ব্লগে আসে। শাহাদাত উদরাজী ভাইসহ অনেকেই ফেসবুকে খুবই অ্যাক্টিভ। তাঁর লেখা প্রচুর মানুষ পড়ে। প্রচুর মন্তব্য পড়ে। ব্লগের তুলনায় অনেক বেশি সেটা। তারপরেও তিনি মাঝে মাঝে ব্লগে আসেন। এই রকম অনেক ব্লগার পাবেন। ব্লগের বাইরে এদের অস্তিত্ব রয়েছে। মূলত এরা নিজেদের লেখার জোরেই টিকে আছে, থাকবে। আপনার লেখায় যদি জোর থাকে আপনি যেখানেই লেখেন না কেন মানুষ আপনাকে খুঁজে নেবে, আপনার লেখা পড়বে। আপনি আপনার লেখার মাধ্যমেই বেঁচে থাকবেন। আরেক শ্রেণির ব্লগার রয়েছে, যাদের ব্লগ ছাড়া কোনো উপায় নেই। ব্লগের বাইরে তাদের কেউ চেনেও না। ব্লগ বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে তাদের কথা আর কেউ মনেও রাখবে না। ব্লগ দিবসের মতো তারা হারিয়ে যাবে।
আপনাকে যদি প্রশ্ন করি, এই ব্লগের বাইরে আপনার বা আপনার লেখার অস্তিত্ব আছে?
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১০:২৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




